প্রথম অধ্যায়

১৩১. আমি এইরূপ শ্রবণ করিয়াছি, একসময়ে ভগবান রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করিতেছিলেন। ওই সময় মগধরাজ বৈদেহীপুত্র অজাতশত্রু বৃজিদিগকে আক্রমণ করিবার সংকল্প করিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “আমি বৃজিদিগকে উচ্ছিন্ন করিব, তাহারা যতই ঐশ্বর্যশালী হউক, যতই পরাক্রান্ত হউক; আমি বৃজিদিগকে ধ্বংস করিব; তাহাদের চূড়ান্ত সর্বনাশ করিব।

১৩২. অতঃপর তিনি মগধের প্রধানমন্ত্রী ব্রাহ্মণ-বর্ষকারকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ব্রাহ্মণ, ভগবানের নিকট গমন করিয়া আমার প্রতিনিধিরূপে তাঁহার পাদদেশে মস্তক স্থাপনপূর্বক বন্দনা করিয়া তাঁহার আরোগ্য, স্বাস্থ্য, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য জিজ্ঞাসা করিবে, “ভন্তে, মগধরাজ বৈদেহীপুত্র অজাতশত্রু ভগবানের পাদদেশে মস্তক স্থাপনপূর্বক বন্দনা করিতেছেন এবং তাঁহার আরোগ্য, স্বাস্থ্য, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য জিজ্ঞাসা করিতেছেন;” পরে তাঁহাকে ইহাও কহিবে, “ভন্তে, মগধরাজ বৃজিগণের বিরুদ্ধে অভিযান করিতে অভিলাষী। তিনি এইরূপ কহিয়াছেন, “আমি বৃজিদিগকে উচ্ছিন্ন করিব, তাহারা যতই ঐশ্বর্যশালী হউক, যতই পরাক্রান্ত হউক; আমি বৃজিদিগকে ধ্বংস করিব, তাহাদের চুড়ান্ত সর্বনাশ করিব।” ভগবান তোমার নিকট যাহা ব্যক্ত করিবেন তাহা উত্তমরূপে ধারণপূর্বক আমার নিকট জ্ঞাপন করিবে; তথাগতগণ অসত্য কহেন না।

১৩৩. ব্রাহ্মণ বর্ষকার “তথাস্তু” বলিয়া মগধরাজকে প্রতিশ্রুতি দানপূর্বক উত্তম উত্তম যান প্রস্তুত করাইয়া উত্তম যানে আরোহণ করিয়া ওই সকল যানসহ রাজগৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গৃধ্রকূট পর্বতে গমন করিলেন। তথায় যতদূর যানভূমি ততদূর যানে গমন করিয়া পরে যান হইতে অবতরণপূর্বক পদব্রজে ভগবানের সমীপে উপস্থিত হইলেন। ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক তাঁহার সহিত চিত্তরঞ্জক বাক্যালাপান্তে তিনি একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন এবং মগধরাজ কর্তৃক যেরূপ আদিষ্ট হইয়াছিলেন সেইরূপ সমস্ত বৃত্তান্ত ভগবানের নিকট নিবেদন করিলেন।

১৩৪. ওই সময়ে আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানের পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহাকে ব্যজনে রত ছিলেন। অতঃপর ভগবান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে বৃজিগণ প্রায়শই জনসাধারণের অবাধ সম্মিলনের আয়োজন করেন?

আনন্দ উত্তর করিলেন, “দেব, আমি শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিগণ এইরূপ জনসাধারণের অবাধ সম্মিলনের আয়োজন করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা। আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে বৃজিগণ সমগ্র হইয়া একত্রিত হয়, সমগ্রভাবে উত্থান করে, সমগ্র হইয়া বৃজিগণের করণীয় সম্পাদন করে?”

“দেব, আমি এইরূপ শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিগণ ওইরূপ করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা। আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে, বৃজিগণ অব্যবস্থিতের ঘোষণা করেন না, ব্যবস্থিতের উচ্ছেদ করেন না, যথাপ্রজ্ঞপ্ত পুরাতন বৃজিধর্ম গ্রহণপূর্বক উহাতে স্থিত হন?”

“দেব, আমি এইরূপ শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিগণ অব্যবস্থিতের ঘোষণা না করেন, ব্যবস্থিতের উচ্ছেদ সাধন না করেন; যথা : প্রজ্ঞপ্ত পুরাতন বৃজিধর্ম গ্রহণপূর্বক উহাতে স্থিত হন, ততদিন তাহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা। আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে, বৃজিগণ তাঁহাদের মধ্যে যাহারা বয়োজ্যেষ্ঠ তাহাদের সৎকার করেন, তাহাদের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাদিগের পূজা করেন, তাহাদের বাক্য শ্রোতব্যরূপে গ্রহণ করেন?”

“দেব, আমি এইরূপ শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিগণ তাঁহাদের বয়োজ্যেষ্ঠগণের সৎকার করিবেন, তাঁহাদের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করিবেন, তাঁহাদিগের পূজা করিবেন, তাঁহাদের বাক্য শ্রোতব্যরূপে গ্রহণ করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা। আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে, বৃজিগণ তাঁহাদের কুলস্ত্রী ও কুলকুমারীগণকে বলপূর্বক ধৃত করিয়া রক্ষিতায় পরিণত করেন না?”

“দেব, আমি এইরূপ শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিগণ তাঁহাদের কুলস্ত্রী ও কুলকুমারীগণকে বলপূর্বক ধৃত করিয়া রক্ষিতায় পরিণত না করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা। আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে, বৃজিগণ তাঁহাদের নগর এবং জনপদস্থ চৈত্যসমূহের সৎকার করেন, তাহাদের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাদের পূজা করেন, তাহাদের পূর্বদত্ত, পূর্বকৃত ধর্মানুমোদিত বলি দান করিতে পরাঙ্মুখ হন না?”

“দেব, আমি এইরূপ শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিগণ তাঁহাদের নগর এবং জনপদস্থ চৈত্যসমূহের সৎকার করিবেন, তাহাদের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করিবেন, তাহাদের পূজা করিবেন, তাহাদের পূর্বদত্ত, পূর্বকৃত, ধর্মানুমোদিত বলি দান করিতে পরাঙ্মুখ না হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা। আনন্দ, তুমি শুনিয়াছ কি যে, বৃজিগণের অর্হৎদিগের ধর্মানুমোদিত রক্ষা, নিরাপত্তা এবং পালন সুব্যবস্থিত, যাহাতে দূরস্থ অর্হৎগণ রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারেন এবং রাজ্যস্থ অর্হৎগণ স্বচ্ছন্দে বাস করিতে পারেন?”

“দেব, আমি এইরূপ শুনিয়াছি।”

“আনন্দ, যতদিন বৃজিদিগের অর্হৎগণের ধর্মানুমোদিত রক্ষা, নিরাপত্তা এবং পালন সুব্যবস্থিত থাকিবে, যাহাতে দূরস্থ অর্হৎগণ রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারেন এবং রাজ্যস্থ অর্হৎগণ স্বচ্ছন্দে বাস করিতে পারেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।

১৩৫. অতঃপর ভগবান ব্রাহ্মণ বর্ষকারকে সম্বোধন করিলেন :

“ব্রাহ্মণ, একসময় আমি বৈশালির সারন্দদ চৈত্যে অবস্থান করিতেছিলাম, ওই সময় আমি বৃজিদিগকে এই সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দিয়াছিলাম; ব্রাহ্মণ, যতদিন এই সাত মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম বৃজিগণের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবে, ততদিন তাহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।

ব্রাহ্মণ বর্ষকার প্রত্যুত্তরে ভগবানকে এইরূপ বলিলেন :

“হে গৌতম, মাত্র একটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মপালনরত বৃজিগণের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা, সমগ্র সাতটি ধর্মের পালনের তো কথাই নাই। কূটনীতি অথবা মিত্রভেদ অবলম্বন ব্যতীত যুদ্ধে মগধরাজ কর্তৃক বৃজিগণ অপরাজেয়। এক্ষণে, হে গৌতম, আমি যাই, আমার অনেক কর্তব্য আছে।”

“ব্রাহ্মণ, তোমার ইচ্ছা।”

অতঃপর ব্রাহ্মণ বর্ষকার ভগবদ্বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদনপূর্বক আসন হইতে উত্থান করিয়া প্রস্থান করিলেন।

১৩৬. অনন্তর ভগবান ব্রাহ্মণ বর্ষকারের প্রস্থানের অব্যবহিত পরে আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, তুমি যাও এবং রাজগৃহের নিকটে যে সকল ভিক্ষু অবস্থান করিতেছেন তাঁহাদিগকে উপস্থানশালায় একত্রিত করো।”

আনন্দ “তথাস্তু” বলিয়া রাজগৃহের নিকটস্থ সমস্ত ভিক্ষুগণকে উপস্থানশালায় একত্রিত করিয়া ভগবানের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইলেন; পরে তিনি ভগবানকে বলিলেন :

দেব, ভিক্ষুসংঘ একত্রিত, এক্ষণে ভগবানের যাহা ইচ্ছা।

তৎপরে ভগবান আসন হইতে উত্থান করিয়া উপস্থানশালায় গমনপূর্বক নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিয়া ভিক্ষুগণকে বলিলেন, “ভিক্ষুগণ, আমি তোমাদিগকে সপ্ত মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দিব, শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো।”

ভিক্ষুগণ “তথাস্তু” বলিলে ভগবান বলিলেন :

“ভিক্ষুগণ, যতদিন ভ্রাতৃবর্গ আপনাদের সম্মিলনের ব্যবস্থা করিয়া বারংবার একত্রিত হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা সমগ্র হইয়া একত্রিত হইবেন, সমগ্র হইয়া উত্থান করিবেন, সমগ্র হইয়া সংঘনির্দিষ্ট কর্মসমূহের সম্পাদন করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা অব্যবস্থিতের ঘোষণা না করিবেন, ব্যবস্থিতের উচ্ছেদ না করিবেন, যথাব্যবস্থিত শিক্ষাপদসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা অভিজ্ঞ, বহুপূর্বগ, সংঘপিতা, সংঘ-পরিনায়ক, তাঁহাদের সৎকার করিবেন, তাঁহাদিগকে ভক্তি করিবেন, তাঁহাদের সম্মান ও পূজা করিবেন, তাহাদের বাক্য শ্রোতব্যরূপে গ্রহণ করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা উৎপন্ন পুনর্ভবিকা তৃষ্ণার বশবর্তী না হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা নির্জনবাসে প্রীতিলাভ করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা স্বীয় স্বীয় চিত্তের স্থৈর্য সম্পাদন করিবেন, যাহাতে অনাগত প্রিয়শীল সব্রহ্মচারীগণ তাঁহাদের নিকট আগমন করিতে পারেন, এবং যাঁহারা আগত তাঁহারা স্বচ্ছন্দে অবস্থান করিতে পারেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন এই সাত মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাহাদের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাঁহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

১৩৭. “ভিক্ষুগণ, অপর সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দিব, শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো।”

ভিক্ষুগণ “তথাস্তু” বলিলে ভগবান বলিলেন :

“যতদিন ভিক্ষুগণ পার্থিব কর্মসমূহে প্রীতিলাভ না করিবেন, ওইরূপ কর্মে রত না হইবেন, উহাতে সম্পর্কবিহীন হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা বৃথা বাক্যালাপপ্রিয় না হইবেন, ওই রূপ বাক্যালাপে রত না হইবেন, উহাতে সম্পর্কবিহীন হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা আলস্যপরায়ণ না হইবেন, আলস্যে প্রীতিলাভ না করিবেন, আলস্যের প্রশ্রয় না দিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা সঙ্গশীলী না হইবেন, সঙ্গপ্রিয় না হইবেন, সঙ্গে প্রীতিলাভ না করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা পাপেচ্ছাসম্পন্ন না হইবেন, পাপেচ্ছার বশবর্তী না হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা পাপকারীর মিত্র না হইবেন, সহায়ক না হইবেন, পাপকারীর সহিত ঘনিষ্ঠতা না করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা অল্পমাত্র সাফল্য লাভ হেতু গন্তব্য পথে ক্ষান্ত না হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন এই সাত মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁহাদের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

১৩৮. “ভিক্ষুগণ, অপর সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মেরও উপদেশ দিব, শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো।”

ভিক্ষুগণ “তথাস্তু” বলিলে ভগবান বলিলেন :

“যতদিন ভিক্ষুগণ শ্রদ্ধাবান হইবেন, বিনয়ী হইবেন, বিবেকী হইবেন, বহুশ্রুত হইবেন, সংকল্পবদ্ধ হইবেন, স্থিরচিত্ত হইবেন, প্রজ্ঞাবান হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন এই সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁহাদের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাঁহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

১৩৯. “ভিক্ষুগণ, অপর সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দিব, শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো।”

ভিক্ষুগণ “তথাস্তু” বলিলে ভগবান বলিলেন :

“যতদিন ভিক্ষুগণ স্মৃতি-সম্বোধ্যঙ্গ, ধর্মবিচয়-সম্বোধ্যঙ্গ, বীর্য-সম্বোধ্যঙ্গ, প্রীতি-সম্বোধ্যঙ্গ, প্রশ্রদ্ধি-সম্বোধ্যঙ্গ সমাধি-সম্বোধ্যঙ্গ এবং উপেক্ষা-সম্বোধ্যঙ্গ ভাবনা করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন এই সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁহাদের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাঁহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

১৪০. “ভিক্ষুগণ, অপর সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দিব, শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো।”

ভিক্ষুগণ “তথাস্তু” বলিলে ভগবান বলিলেন, “যতদিন ভিক্ষুগণ অনিত্য-সংজ্ঞা, অনাত্ম-সংজ্ঞা, অশুভ-সংজ্ঞা, আদীনব-সংজ্ঞা, প্রহাণ-সংজ্ঞা, বিরাগ-সংজ্ঞা, এবং নিরোধ-সংজ্ঞার ভাবনা করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন এই সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁহাদের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাঁহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

১৪১. “ভিক্ষুগণ, ছয়টি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দিতেছি, শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো।”

ভিক্ষুগণ “তথাস্তু” বলিলে ভগবান বলিলেন, “যতদিন ভিক্ষুগণ সব্রহ্মচারীগণের প্রতি, প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে, কায়মনোবাক্যে মৈত্রীভাবাপন্ন হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা ধর্মানুসঙ্গত ধর্মানুসারে প্রাপ্ত লাভসমূহে, এমন কী ভিক্ষাপাত্রে নিক্ষিপ্ত দ্রব্য মাত্রে অপ্রতিবিভক্তভোগী হইয়া শীলবান সব্রহ্মচারীগণের সহিত সাধারণ ভোগী হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন তাঁহারা অখণ্ড, নির্দোষ, নির্মল, পবিত্র, শুদ্ধ, বিজ্ঞ-প্রশংসিত, নিষ্কলঙ্ক, সমাধি-সংবর্তনিক শীলসমূহে সব্রহ্মচারীগণের সহিত প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে স্থিত হইবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন ভিক্ষুগণ যে আর্যদৃষ্টি সংসার হইতে মুক্তির প্রদর্শক এবং যাহা উহার অনুসরণকারীকে সম্যক দুঃখক্ষয়ে উপনীত করে, সব্রহ্মচারীগণের সহিত প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে ওই দৃষ্টিযুক্ত হইয়া অবস্থান করেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

“যতদিন এই ছয়টি মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁহাদের মধ্যে বর্তমান থাকিবে, যতদিন তাঁহারা ওই ধর্মানুসারে আপনাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবেন, ততদিন তাঁহাদের পতন না হইয়া উত্থান হইবারই কথা।”

১৪২. রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থানকালে ভগবান ভিক্ষুদিগের নিকট বিস্তৃতভাবে ধর্মকথা বলিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা, শীলপরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী, সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী, প্রজ্ঞা-পরিভাবিতচিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যাসব হইতে বিমুক্ত হয়।

১৪৩. অতঃপর ভগবান রাজগৃহে ইচ্ছানুরূপ অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আনন্দ চল, আমরা অম্বলট্ঠিকায় গমন করি।”

আনন্দ বলিলেন, “দেব, “তথাস্তু”। তদনন্তর ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত অম্বলট্ঠিকায় গমন করিলেন।

তথায় ভগবান রাজভবনে অবস্থান করিতে লাগিলেন। সেইস্থানেও তিনি ভিক্ষুদিগের নিকট বিস্তৃতভাবে ধর্মকথা বলিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা, শীলপরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী, সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী, প্রজ্ঞা-পরিভাবিতচিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যাসব হইতে বিমুক্ত হয়।

১৪৪. অতঃপর ভগবান অম্বলট্ঠিকায় যতদিন ইচ্ছা অবস্থান করিয়া আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, চল, আমরা নালন্দায় গমন করি।”

আনন্দ বলিলেন, “তথাস্তু”। তৎপরে ভগবান সুবৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত নালন্দায় গমন করিলেন। তথায় ভগবান পাবারিক-আম্রবনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

১৪৫. অনন্তর আয়ুষ্মান সারিপুত্র ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলেন। পরে তিনি ভগবানকে বলিলেন :

“দেব, আমি ভগবানের প্রতি এতই শ্রদ্ধাবান যে, আমার মতে সম্বোধির সম্বন্ধে ভগবান অপেক্ষা অভিজ্ঞতর অন্য শ্রমণ অথবা ব্রাহ্মণ কখনো ছিল না, হইবে না এবং এখনও নাই।”

সারিপুত্র, তুমি যাহা বলিয়াছ তাহা সত্যই গৌরবমণ্ডিত ও সুস্পষ্ট, উহা সত্যই ভাবাবেশের গান। তাহা হইলে, সারিপুত্র, অতীতকালে যাঁহারা অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ হইয়াছিলেন, স্ব-চিত্তে তাঁহাদের চিত্ত পরিজ্ঞাত হইয়া তুমি জানিয়াছ তাঁহারা কীরূপ শীলসম্পন্ন ছিলেন, কীরূপ ধর্মসম্পন্ন ছিলেন, কীরূপ প্রজ্ঞাসম্পন্ন ছিলেন, কীরূপই বা তাঁহাদের জীবনযাত্রার প্রণালি ছিল এবং তাঁহারা কীরূপ বিমুক্তি লাভ করিয়াছিলেন?

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“তাহা হইলে, সারিপুত্র, যাঁহারা ভবিষ্যতে অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ হইবেন, স্ব-চিত্তে তাঁহাদের চিত্ত পরিজ্ঞাত হইয়া তুমি জানিয়াছ তাঁহারা কীরূপ শীলসম্পন্ন হইবেন, কীরূপ ধর্মসম্পন্ন হইবেন, কীরূপ প্রজ্ঞাসম্পন্ন হইবেন, কীরূপই বা তাঁহাদের জীবনযাত্রার প্রণালি হইবে এবং তাঁহারা কীরূপ বিমুক্তি লাভ করিবেন?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“তাহা হইলে, সারিপুত্র, বর্তমানে অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ আমার চিত্ত স্ব-চিত্তে পরিজ্ঞাত হইয়া তুমি জানিয়াছ ভগবান কীরূপ শীলসম্পন্ন, কীরূপ ধর্ম ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন, কীরূপই বা তাঁহার জীবনযাত্রা প্রণালি এবং তিনি কীরূপ বিমুক্তি লাভ করিয়াছেন?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“সারিপুত্র, অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধগণের চিত্ত তোমার পরিজ্ঞাত নহে, তবে কিরূপে তুমি এরূপ সুমহান ও সুস্পষ্ট উক্তি করিলে? কিরূপে তোমার এরূপ ভাবাবেশ গীত হইল?”

১৪৬. ভন্তে, অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধগণের চিত্ত আমার জ্ঞাত নহে। তবে আমি ন্যায়ানুযায়ী সিদ্ধান্তের উপর দণ্ডায়মান। দেব, মনে করুন কোনো রাজার সীমান্তে স্থিত নগরী সুদৃঢ় ভিত্তির উপর গঠিত, দুর্ভেদ্য প্রাচীর বেষ্টিত, উহার মাত্র একটি দ্বার; রাজা সেখানে বন্ধু ভিন্ন অপর সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করিবার জন্য চতুর, দক্ষ এবং বুদ্ধিমান প্রহরী রাখিয়াছেন। রাজা নগরাভিমুখী পথগুলি পরিদর্শনে যাইয়া দুর্গ প্রাকারের কোথায়ও এমন কোনো ছিদ্রাদি হয়ত দেখিতে পাইবেন না যেখান দিয়া বিড়ালের ন্যায় একটু ক্ষুদ্র প্রাণীও বাহির হইতে পারে। তথাপি তাঁহার মনে এইরূপ হইবে যে, বৃহত্তর প্রাণীগণ, যাহারা নগরে প্রবেশ করিবে কিংবা নগর ত্যাগ করিবে, তাহাদিগকে মাত্র ওই একটি দ্বার ব্যবহার করিতে হইবে। আমিও সেইরূপ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্থিত। আমি জানি অতীতের বুদ্ধগণ সকলেই চিত্তের উপক্লেশ প্রজ্ঞাদুর্বলকারী পঞ্চ নীবরণ পরিহার করিয়া, চতুর্বিধ স্মৃতি-প্রস্থানে চিত্তকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া, সপ্ত বোধ্যঙ্গ যথারূপে অনুশীলনপূর্বক অনুত্তর সম্যক সম্বোধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। যাঁহারা ভবিষ্যতে বুদ্ধ হইবেন তাঁহারা সকলেই ওই একই মার্গ অবলম্বন করিয়া সম্বোধি প্রাপ্ত হইবেন। বর্তমানে ভগবানও ওই মার্গই অবলম্বন করিয়া সম্যকসম্বুদ্ধ হইয়াছেন।

১৪৭. ওই স্থানেও ভগবান নালন্দায় পাবারিক আম্রবনে অবস্থানকালে ভিক্ষুদিগের নিকট বিস্তৃতভাবে ধর্মকথা বলিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা, শীলপরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী, সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী, প্রজ্ঞা-পরিভাবিতচিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যাসব হইতে বিমুক্তি হয়।

১৪৮. অতঃপর ভগবান নালন্দায় ইচ্ছানুরূপ অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “এসো, আনন্দ, আমরা পাটলিগ্রামে গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু,” আনন্দ এইরূপ কহিলে ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত পাটলিগ্রামে গমন করিলেন।

পাটলিগ্রামের উপাসকগণ শ্রবণ করিল যে, ভগবান পাটলিগ্রামে উপনীত হইয়াছেন। তখন ওই গ্রামের উপাসকগণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিল। পরে তাহারা ভগবানকে বলিল, “ভগবান, আমাদের অতিথিশালায় অবস্থান করুন।” ভগবান মৌনভাবের দ্বারা সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

তৎপরে উপাসকগণ ভগবানের সম্মতি জ্ঞাত হইয়া আসন হইতে উত্থান করিয়া ভগবানকে অভিবাদন এবং প্রদক্ষিণপূর্বক অতিথিশালায় গমন করিল। তথায় তাহারা চতুর্দিকে আস্তরণ বিস্তৃত করিয়া আসন স্থাপনপূর্বক জলাধার এবং তৈলপ্রদীপ প্রতিষ্ঠিত করিয়া ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইল। তৎপরে তাহারা ভগবানকে বলিল :

“দেব, অতিথিশালার সর্বত্র আস্তরণ বিস্তৃত হইয়াছে, আসন স্থাপিত হইয়াছে, জলপাত্র এবং প্রদীপ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এক্ষণে ভগবানের যাহা ইচ্ছা।”

তৎপরে ভগবান পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া পাত্র ও চীবরসহ ভিক্ষুসংঘের সহিত অতিথিশালায় গমন করিলেন এবং পাদ প্রক্ষালনপূর্বক অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া মধ্যেস্থিত স্তম্ভ পশ্চাতে রাখিয়া পূর্বাভিমুখী হইয়া উপবেশন করিলেন। ভিক্ষুগণও পাদ প্রক্ষালনপূর্বক অতিথিশালায় প্রবেশ করিয়া পশ্চিমদিকস্থ ভিত্তি পশ্চাতে রাখিয়া পূর্বমুখী হইয়া ভগবানকে বেষ্টন করিয়া উপবেশন করিলেন। উপাসকগণও পাদ প্রক্ষালনান্তে অতিথিশালায় প্রবেশপূর্বক পূর্বদিকস্থ ভিত্তি পশ্চাতে রাখিয়া পশ্চিমাভিমুখী হইয়া ভগবানের সম্মুখীন হইয়া উপবিষ্ট হইল।

১৪৯. তৎপরে ভগবান পাটলিগ্রামের উপাসকগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “গৃহপতিগণ, দুঃশীল শীলভ্রষ্টগণের পঞ্চবিধ ক্ষতি; কী কী?

দুঃশীল শীলভ্রষ্টগণ প্রমাদহেতু দারুণ দারিদ্র্যে উপনীত হয়, ইহা প্রথম ক্ষতি।

পুনশ্চ, তাহাদের নিন্দা ঘোষিত হয়, ইহা দ্বিতীয় ক্ষতি।

“পুনশ্চ, তাহারা যে সমাজেই প্রবেশ করুক, তাহা ক্ষত্রিয়দিগেরই হউক, অথবা ব্রাহ্মণদিগের, অথবা গৃহপতিদিগের, অথবা শ্রমণদিগেরই হউক। তথায় তাহারা সংকুচিত ও হতবুদ্ধি হইয়া থাকে, ইহা তৃতীয় ক্ষতি।”

“পুনরায়, মৃত্যুকালে তাহারা উদ্বেগপূর্ণ হয়, ইহা চতুর্থ ক্ষতি।”

“পুনশ্চ, মৃত্যুর পর দেহের ধ্বংসাবসানে তাহাদের পুনর্জন্ম, দুঃখ-দুর্দশা দুর্গতি পূর্ণ হয়। ইহা পঞ্চম ক্ষতি।”

১৫০. “শীলবানদিগের শীলরক্ষার পঞ্চবিধ ফল কী কী?”

“প্রথমত, তাঁহারা অধ্যবসায়সম্পন্ন হইয়া মহৎ ঐশ্বর্যের অধিকারী হন।”

“দ্বিতীয়ত, তাঁহাদের খ্যাতি চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হয়।”

“তৃতীয়ত, তাঁহারা যে সমাজেই প্রবেশ করেন, তাহা ক্ষত্রিয়দিগের হউক, ব্রাহ্মণদিগের হউক, গৃহপতিদিগের হউক, অথবা শ্রমণদিগেরই হউক, তথায় তাঁহারা আত্মপ্রত্যয় ও ধৃতিসহকারে প্রবেশ করেন।”

“চতুর্থত, তাঁহারা বিনা উদ্বেগে দেহত্যাগ করেন।”

“সর্বশেষে, মৃত্যুর পর দেহের ধ্বংসাবসানে তাঁহাদের পুনর্জন্ম সুখময় ও সুগতিসম্পন্ন হয়। শীলবানদিগের শীলরক্ষার এই পঞ্চবিধ লাভ।”

১৫১. তৎপরে ভগবান দীর্ঘরাত্রি পর্যন্ত পাটলিগ্রামের উপাসকগণকে ধর্মকথায় উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উত্তেজিত ও প্রহৃষ্ট করিয়া তাহাদিগকে বলিলেন, “গৃহপতিগণ, রাত্রি অনেক হইয়াছে, এক্ষণে তোমরা ইচ্ছানুরূপ করিতে পার।” এই কথা বলিয়া তিনি তাহাদিগকে বিদায় দিলেন। তাহারাও “দেব, তথাস্তু” বলিয়া আসন হইতে উত্থান করিয়া ভগবানকে অভিবাদন এবং প্রদক্ষিণপূর্বক প্রস্থান করিল। ইহার অব্যবহিত পরে ভগবান নির্জন কক্ষে প্রবেশ করিলেন।

১৫২. ওই সময়ে সুনীধ এবং বর্ষকার নামক মগধের প্রধান অমাত্যদ্বয় বৃজিগণের আক্রমণ প্রতিরোধার্থ পাটলিগ্রামে নগর নির্মাণ করিতেছিলেন। বহুসহস্র দেবতাও এ সময়ে তথায় বাস গ্রহণ করিতেছিল। যে-স্থানে মহাপ্রভাবশালী দেবতাগণ বাস গ্রহণ করেন, সেইস্থানে পরাক্রমশালী নৃপতিগণ এবং তাঁহাদের প্রধান অমাত্যগণ বাসস্থান নির্মাণ করিতে ইচ্ছা করেন। যে-স্থানে মধ্যম শ্রেণির দেবতাগণ বাসগ্রহণ করেন, সেইস্থানে মধ্যম শ্রেণির নৃপতি ও তাঁহাদের প্রধান অমাত্যগণ বাসস্থান নির্মাণ করিতে ইচ্ছা করেন; যে-স্থানে নিম্নশ্রেণির দেবতাগণ বাসগ্রহণ করেন, সেইস্থানে নিম্নশ্রেণির নৃপতি ও তাঁহাদের প্রধান অমাত্যগণ বাসস্থান নির্মাণ করিতে ইচ্ছা করেন।

ভগবান দিব্য, বিশুদ্ধ, অমানুষিক চক্ষু দ্বারা পাটলিগ্রামে বাসস্থান গ্রহণে নিরত ওই সকল সহস্রাধিক দেবতাগণকে নিরীক্ষণ করিলেন। অতঃপর তিনি প্রত্যুষে উঠিয়া আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, পাটলিগ্রামে কে নগর নির্মাণ করিতেছে?”

“ভন্তে, সুনীধ এবং বর্ষকার নামক মগধের প্রধান অমাত্যদ্বয় বৃজিগণের আক্রমণ প্রতিরোধার্থ পাটলিগ্রামে নগর নির্মাণ করিতেছেন?”

“আনন্দ, মগধের প্রধান অমাত্যদ্বয় যেন ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়াই বৃজিগণের আক্রমণ প্রতিরোধার্থ পাটলিগ্রামে নগর নির্মাণ করিতেছেন। আনন্দ, আমি দিব্য, বিশুদ্ধ, অমানুষিক চক্ষু দ্বারা এই পাটলিগ্রামে বাসস্থান গ্রহণে নিরত বহুসহস্র দেবতাকে দেখিয়াছি। যে-স্থানে মহাপ্রভাবশালী দেবতাগণ বাস গ্রহণ করেন, সেইস্থানে পরাক্রমশালী নৃপতিগণ এবং তাঁহাদের প্রধান অমাত্যগণ বাসস্থান নির্মাণ করিতে ইচ্ছা করেন। যে-স্থানে মধ্যম শ্রেণির দেবতাগণ বাস গ্রহণ করেন, সেইস্থানে মধ্যম শ্রেণির নৃপতি ও তাঁহাদের প্রধান অমাত্যগণ বাসস্থান নির্মাণ করিতে ইচ্ছা করেন; যে-স্থানে নিম্নশ্রেণির দেবতাগণ বাস গ্রহণ করেন, সেইস্থানে নিম্নশ্রেণির নৃপতি ও তাঁহাদের প্রধান অমাত্যগণ বাসস্থান নির্মাণ করিতে ইচ্ছা করেন। আনন্দ, যতদূর আর্যভূমি, যতদূর বণিকদিগের গমনাগমনের পথ, তাহার মধ্যে এই পাটলিপুত্র প্রধান নগর হইবে, ইহা সর্ববিধ বাণিজ্যের কেন্দ্র হইবে। কিন্তু পাটলিপুত্রের ত্রিবিধ অন্তরায় আছে-অগ্নি অথবা জল অথবা মিত্রভেদ।”

১৫৩. তদনন্তর সুনীধ এবং বর্ষকার, মগধের প্রধান অমাত্যদ্বয়, যেখানে ভগবান সেখানে গমন করিলেন এবং ভগবানের সহিত অভিবাদন এবং শিষ্টাচারের আদান প্রদানপূর্বক একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইলেন। পরে তাঁহারা ভগবানকে বলিলেন, “ভগবান অদ্য ভিক্ষুসংঘের সহিত আমাদের গৃহে আহার গ্রহণ করুন। ভগবান মৌনভাবের দ্বারা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন।”

সুনীধ এবং বর্ষকার, মগধের দুই প্রধান অমাত্য, ভগবানের স্বীকৃতি জ্ঞাত হইয়া স্বকীয় আবাসে প্রত্যাবর্তনপূর্বক উৎকৃষ্ট খাদ্য ও ভোজ্য প্রস্তুত করিয়া ভগবানের নিকট সংবাদ প্রেরণ করিলেন, হে গৌতম, আহার প্রস্তুত”।

তখন ভগবান পূর্বাহ্নে পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর হস্তে ভিক্ষুসংঘের সহিত অমাত্যদ্বয়ের গৃহে গমনপূর্বক নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন। মগধের প্রধান অমাত্যদ্বয় বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে উত্তম খাদ্য ও ভোজ্য স্বহস্তে পরিবেশনপূর্বক তৃপ্ত করিলেন। তদনন্তর অমাত্যদ্বয় ভগবান আহারান্তে পাত্র হইতে হস্ত অপসারিত করিলে নিম্ন আসন গ্রহণপূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন।

অমাত্যদ্বয় উপবেশন করিলে ভগবান নিম্নোক্তরূপে দানানুমোদন করিলেন :

পণ্ডিত ব্রহ্মচারী যে-স্থানে বাস করিয়া শীলবান সংযত পুরুষদিগকে আহার দান করেন, এবং ওই স্থানে যে সকল দেবতা আছেন তাঁহাদিগকে দক্ষিণা দান করেন, সেইস্থানে দেবতাগণ পূজিত ও সম্মানিত হইয়া তাঁহার পূজা ও সম্মান করেন।

মাতা ঔরসপুত্রকে যেরূপ অনুকম্পা করেন, ওই সকল দেবতাগণ তাঁহাকে সেইরূপ অনুকম্পা করেন; দেবানুকম্পিত পুরুষ সর্বদা মঙ্গল দর্শন করেন।”

অনন্তর ভগবান অমাত্যদ্বয়কে উপর্যুক্তরূপে সাধুবাদ দিয়া আসন হইতে উত্থানপূর্বক প্রস্থান করিলেন।

১৫৪. অমাত্যদ্বয় ভগবানের পশ্চাদনুসরণ করিল এবং বলিতে লাগিল, “অদ্য ভগবান যে দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইবেন তাহার নাম হইবে গৌতম দ্বার। যে তীর্থ দিয়া তিনি গঙ্গা নদী পার হইবেন, সেই তীর্থের নাম হইবে গৌতম-তীর্থ।” তৎপরে ভগবান যে দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইলেন ওই দ্বারের নাম হইল গৌতম-দ্বার।

অতঃপর ভগবান গঙ্গা নদীতে গমন করিলেন। ওই সময় গঙ্গা নদী কূলে কূলে পরিপূর্ণ। ইতস্তত গমনাগমনের নিমিত্ত কেহ কেহ নৌকার, কেহ বা ভেলার অন্বেষণ করিতেছিল, কেহ বা কুল্ল নির্মাণ করিতেছিল। তৎপরে ভগবান যেরূপ বলবান পুরুষ সংকুচিত বাহু প্রসারিত করে, অথবা প্রসারিত বাহু সংকুচিত করে, সেইরূপ গঙ্গা নদীর এই পারে অন্তর্হিত হইয়া ভিক্ষু সংঘের সহিত অপর তীরে প্রত্যুত্থান করিলেন।

মনুষ্যগণের উপর্যুক্ত ক্রিয়া ভগবান দেখিলেন, তখন তাঁহার মুখ হইতে এই উদান বাক্য নির্গত হইল :

যাঁহারা ক্ষুদ্র জলাশয় পরিহারপূর্বক সেতুর সাহায্যে সমুদ্র ও নদী উত্তীর্ণ হন, তাঁহারা পণ্ডিত; যখন জনসাধারণ কুল্ল নির্মাণ রত, তখন পণ্ডিতগণ উত্তীর্ণ।

প্রথম ভাণবার সমাপ্ত

দ্বিতীয় অধ্যায়

১৫৫. অতঃপর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, চলো, আমরা কোটিগ্রামে গমন করি।” “দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মত হইলেন। তৎপরে ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত কোটিগ্রামে গমন করিলেন এবং তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন।

তথায় ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :

“ভিক্ষুগণ চারি আর্যসত্যের জ্ঞান এবং অনুভূতির অভাবের কারণেই পুনঃপুন জন্ম হইতে জন্মান্তরে ভ্রমণ হইয়াছে, আমারও এবং তোমাদিগেরও। ওই চারিটি কী কী? ভিক্ষুগণ, দুঃখ আর্যসত্য, দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য, দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য এবং দুঃখ নিরোধের মার্গ আর্যসত্য-এই চারি আর্যসত্যের জ্ঞান এবং অনুভূতির অভাবের কারণেই পুনঃপুন জন্ম হইতে জন্মান্তরে ভ্রমণ হইয়াছে, আমারও এবং তোমাদিগেরও। কিন্তু ভিক্ষুগণ, এই চারি আর্যসত্যের জ্ঞান এবং অনুভূতি হইলে ভব-তৃষ্ণা উচ্ছিন্ন হয়, পুনঃপুন জন্ম প্রবর্তনকারী তৃষ্ণার ধ্বংস সাধন হয়, তাহার পর আর পুনর্জন্ম নাই।”

ভগবান এইরূপ বলিলেন। সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“চারি আর্যসত্যের যথারূপ দর্শনের
অভাবে বহুজন্ম অতিক্রান্ত হইয়াছে।
তাহাদের সম্যক অনুধাবনে পুনর্জন্মের
হেতু বিনষ্ট হয়, দুঃখের মূল উচ্ছিন্ন হয়,
তখন আর পুনর্জন্ম নাই।”

কোটিগ্রামে অবস্থানকালে ওইস্থানেও ভগবান ভিক্ষুগণকে বিস্তৃতরূপে ধর্মকথা বলিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা; শীল-পরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; প্রজ্ঞা পরিভাবিত চিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যা-আসব হইতে বিমুক্ত হয়।

১৫৬. ভগবান কোটিগ্রামে যথেচ্ছা অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :

“আনন্দ, চল, আমরা নাদিকে গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

অনন্তর ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত নাদিকে গমন করিলেন এবং ওইস্থানে ইষ্টক নির্মিত ভবনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

তদনন্তর আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। পরে তিনি ভগবানকে বলিলেন :

“দেব, সাল্‌হ নামক ভিক্ষু নাদিকে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন; তিনি কী গতি লাভ করিয়াছেন? পরলোকে তাঁহার নিয়তি কি? নাদিকে নন্দা নাম্নী ভিক্ষুণীর মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহার কী গতি এবং পরলোকে তাঁহার নিয়তি কী? ওইস্থানে সুদত্ত নামক উপাসকের মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহার কী গতি এবং পরলোকে তাঁহার নিয়তি কী? ওইস্থানে সুজাতা নাম্নী উপাসিকার মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহার কী গতি এবং পরলোকে তাহার নিয়তি কী? ককুধ, কালিঙ্গ, নিকট, কটিস্সভ তুট্ঠ, সন্তুট্ঠ, ভদ্দ, সুভদ্দ নামক উপাসকগণ নাদিকে দেহ ত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহাদের কী গতি এবং পরলোকে তাঁহাদের নিয়তি কী?”

১৫৭. আনন্দ, ভিক্ষু সাল্‌হ আসবসমূহের ক্ষয়হেতু এই জগতেই অনাসব চিত্ত-বিমুক্তি এবং প্রজ্ঞা-বিমুক্তি স্বয়ং জ্ঞাত হইয়া এবং উপলব্ধি করিয়া উহা লাভ করিয়াছিলেন। ভিক্ষুণী নন্দা পঞ্চ অবরভাগীয় সংযোজনের ক্ষয়হেতু ঔপপাতিকা হইয়াছেন, ওই অবস্থাতেই তিনি পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইবেন, ওই অবস্থা হইতে তাঁহার চ্যুতি নাই। উপাসক সুদত্ত ত্রিবিধ সংযোজনের ক্ষয়হেতু রাগ-দ্বেষ-মোহের অবসানে সকৃদাগামী হইয়াছেন, তিনি আর একবার মাত্র এই জগতে আসিয়া দুঃখের অন্ত করিবেন। উপাসিকা সুজাতা ত্রিবিধ সংযোজনের ক্ষয়হেতু স্রোতাপন্ন হইয়াছেন, ওই অবস্থা হইতে তাঁহার চ্যুতি নাই, এবং সম্বোধি তাঁহার নিশ্চিত নিয়তি। উপাসক ককুধ পঞ্চ অবরভাগীয় সংযোজনের ক্ষয়হেতু ঔপপাতিক হইয়াছেন, ওই অবস্থাতেই তিনি পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইবেন, ওই অবস্থা হইতে তাঁহার চ্যুতি নাই। কালিঙ্গ, নিকট, কটিস্সভ, তুট্ঠ, সন্তুট্ঠ, ভদ্দ এবং সুভদ্দ নামক উপাসকগণ পঞ্চ অবরভাগীয় সংযোজনের ক্ষয়হেতু ঔপপাতিক হইয়াছেন, ওই অবস্থাতেই তাঁহারা পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইবেন, ওই অবস্থা হইতে তাঁহাদের চ্যুতি নাই। নাদিকের পঞ্চাশাধিক উপাসক মরণান্তে পঞ্চ অবরভাগীয় সংযোজনের ক্ষয়হেতু ঔপপাতিক হইয়াছেন, ওই অবস্থাতেই তাঁহাদের পরিনির্বাণ হইবে, ওই অবস্থা হইতে তাঁহাদের চ্যুতি নাই। নাদিকের নবতির অধিক উপাসক মরণান্তে ত্রিবিধ সংযোজনের ক্ষয়হেতু রাগ-দ্বেষ-মোহের অবসানে সকৃদাগামী হইয়াছেন, তাঁহারা আর একবার মাত্র এই জগতে আসিয়া দুঃখের অন্ত করিবেন। পঞ্চশতের অধিক নাদিকের উপাসক মরণান্তে ত্রিবিধ সংযোজনের ক্ষয়হেতু স্রোতাপন্ন হইয়াছেন, ওই অবস্থা হইতে তাঁহাদের চ্যুতি নাই এবং সম্বোধি তাঁহাদের নিশ্চিত নিয়তি।

১৫৮. আনন্দ, মনুষ্যের যে মৃত্যু হইবে ইহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই; কিন্তু প্রত্যেক মনুষ্যের মৃত্যুর পর তুমি যদি তথাগতের নিকট আসিয়া এইরূপ প্রশ্ন করো, তাহা হইলে উহা তথাগতের বিরক্তির কারণ হইবে। অতএব আমি ধর্মাদর্শ নামক ধর্ম পর্যায়ের উপদেশ দিব। ওই আদর্শ সমন্বিত আর্যশ্রাবক ইচ্ছা হইলে আপনার সম্বন্ধে আপনিই ভবিষ্যদ্বাণী করিতে পারিবেন, “আমার আর নরক নাই, পশুযোনিতে জন্ম নাই, প্রেতযোনিতে জন্ম নাই, আমি স্রোতাপন্ন হইয়াছি, উহা হইতে আমার চ্যুতি নাই, সম্বোধি আমার নিশ্চিত নিয়তি।”

১৫৯. আনন্দ, এই ধর্মাদর্শ কী? আনন্দ, আর্যশ্রাবক বুদ্ধে অচল শ্রদ্ধাসম্পন্ন হন, “ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকজ্ঞ, অনুত্তর দম্য-পুরুষ-সারথি, দেব মনুষ্যের শাস্তা, বুদ্ধ ভগবান।” তিনি আর্যশ্রাবক ধর্মে অচল শ্রদ্ধাসম্পন্ন হন, “ধর্ম জগতের হিতার্থ ভগবান কর্তৃক ঘোষিত; উহা সাংদৃষ্টিক, অকালিক, সর্ব জগৎকে সাদরে আহ্বানকারী, মুক্তি প্রদায়ী, এবং বিজ্ঞগণ কর্তৃক স্ব-স্ব চেষ্টায় জ্ঞাতব্য।” তিনি আর্যশ্রাবক সংঘে অচল শ্রদ্ধাসম্পন্ন হন, “ভগবানের শ্রাবকসংঘ সু-প্রতিপন্ন, ঋজু-প্রতিপন্ন, ন্যায়-প্রতিপন্ন, সম্যক-প্রতিপন্ন। চারি পুরুষ-যুগল এবং অষ্ট পুরুষ পুদ্গলবিশিষ্ট ভগবানের এই শ্রাবকসংঘ; তাঁহারা সম্মানের যোগ্য, সৎকারের যোগ্য, দক্ষিণার যোগ্য, পূজার যোগ্য; তাঁহারা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যক্ষেত্র।” এই সংঘ অখণ্ডিত, নির্দোষ, নির্মল, নিষ্কলঙ্ক, শৃঙ্খল মোচনকারী, বিজ্ঞ-প্রশংসিত, বিশুদ্ধ, সমাধি-সংবর্তনিক, আর্য কান্তশীল সমন্বিত।

আনন্দ, ইহাই ধর্মাদর্শ ধর্মণ্ডপর্যায়। এই আদর্শ সমন্বিত আর্যশ্রাবক ইচ্ছা হইলে আপনার সম্বন্ধে আপনিই ভবিষ্যদ্বাণী করিতে পারিবেন, “আমার আর নরক নাই, পশুযোনিতে জন্ম নাই, প্রেতযোনিতে জন্ম নাই, আমি স্রোতাপন্ন হইয়াছি, উহা হইতে আমার চ্যুতি নাই, সম্বোধি আমার নিশ্চিত নিয়তি।”

ভগবান নাদিকে ইষ্টক গৃহে অবস্থানকালে এইরূপে বিস্তৃতভাবে ভিক্ষুগণকে ধর্মের উপদেশ দিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা; শীল-পরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; প্রজ্ঞা পরিভাবিত চিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যা-আসব হইতে বিমুক্ত হয়।

১৬০. অতঃপর ভগবান নাদিকে ইচ্ছানুরূপ অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ চল, আমরা বৈশালি গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

তৎপরে ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত বৈশালি গমনপূর্বক তথায় অম্বপালি-বনে বাসস্থান গ্রহণ করিলেন।

ওইস্থানে ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :

ভিক্ষুগণ, ভিক্ষু স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইবেন, তোমাদের প্রতি আমার এই উপদেশ।

“কিরূপে ভিক্ষু স্মৃতিসমন্বিত হন? ভিক্ষু কায়ে কায়ানুদর্শী হইয়া বিহার করেন, তিনি উদ্যমশীল, সম্প্রজ্ঞানযুক্ত এবং স্মৃতিমান হইয়া লোকে অভিধ্যা এবং দৌর্মনস্যের দমন করেন; তিনি বেদনায় বেদনানুদর্শী, চিত্তে চিত্তানুদর্শী, ধর্মে ধর্মানুদর্শী হইয়া বিহার করেন এবং উদ্যমশীল, সম্প্রজ্ঞান-যুক্ত এবং স্মৃতিমান হইয়া লোকে অভিধ্যা এবং দৌর্মনস্যের দমন করেন।”

“কিরূপে ভিক্ষু সম্প্রজ্ঞান-সমন্বিত হন? ভিক্ষু পুরোগমনে ও প্রত্যাগমনে সম্প্রজ্ঞানযুক্ত হন, অবলোকনে বিলোকনে, সঙ্কোচন ও প্রসারণে, সংঘাটি-পাত্র-চীবর ধারণে, ভুক্তি, পান, ভোজন ও আস্বাদনে, শৌচকর্মে, গতিতে, স্থিতিতে, উপবেশনে, সুপ্তি ও জাগরণে, ভাষণে, তূষ্ণীম্ভাবে, সম্প্রজ্ঞান যুক্ত হন। ভিক্ষু এইরূপে সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হন। ভিক্ষুগণ, ভিক্ষু স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইবেন, তোমাদের প্রতি আমার এই উপদেশ।”

১৬১. গণিকা অম্বপালি শুনিলেন যে, ভগবান বৈশালিতে আগমনপূর্বক তাঁহার আম্রবনে অবস্থান করিতেছেন। তখন তিনি উত্তম উত্তম যানাদি প্রস্তুত করাইয়া স্বয়ং এক রথে আরোহণপূর্বক যানাদির সহিত বৈশালি হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া স্বকীয় উদ্যানের দিকে অগ্রসর হইলেন। ভূমি যতদূর যানাদির গতির পক্ষে উপযুক্ত ততদূর রথারোহণে গমন করিয়া তথায় অবতরণপূর্বক পদব্রজে ভগবানের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। তিনি আসন গ্রহণ করিলে ভগবান তাঁহাকে ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উৎসাহিত ও হর্ষান্বিত করিলেন।

তৎপরে অম্বপালি ভগবান কর্তৃক ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উৎসাহিত ও হর্ষান্বিত হইয়া ভগবানকে এইরূপ বলিলেন :

“ভগবান আগামীকল্য ভিক্ষুসংঘের সহিত আমার গৃহে আহার গ্রহণ করুন।”

ভগবান মৌন দ্বারা সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। অম্বপালি ভগবানের সম্মতি বিদিত হইয়া আসন হইতে উত্থানপূর্বক ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণপূর্বক প্রস্থান করিলেন।

বৈশালির লিচ্ছবিগণ শুনিল ভগবান বৈশালিতে আগমনপূর্বক তথায় অম্বপালির আম্রবনে অবস্থান করিতেছেন। তখন তাহারা উত্তম উত্তম যানাদি প্রস্তুত করাইয়া উত্তম রথে আরোহণপূর্বক যানাদিসহ বৈশালি হইতে যাত্রা করিল। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ নীলাঙ্গ, নীলবস্ত্র পরিহিত ও নীলালংকারভূষিত, কেহ কেহ পীতাঙ্গ, পীতবস্ত্র পরিহিত, পীতালংকারভূষিত, কেহ কেহ লোহিতাঙ্গ, লোহিতবস্ত্র পরিহিত, লোহিতালংকারভূষিত, কেহ কেহ শ্বেতাঙ্গ, শ্বেতবস্ত্র পরিহিত, শ্বেত অলংকারভূষিত।

অম্বপালি তরুণ লিচ্ছবিগণের অভিমুখে অগ্রসর হইলেন, অক্ষে অক্ষে, চক্রে চক্রে, যুগে যুগে ঘর্ষণ হইল। তখন লিচ্ছবিগণ অম্বপালিকে বলিলেন :

“অম্বপালি, তুমি কি নিমিত্ত এরূপভাবে রথ চালনা করিলে?”

“আর্যপুত্রগণ, যেহেতু আমি আগামীকল্য আহার গ্রহণের জন্য ভিক্ষুসংঘসহ ভগবানকে নিমন্ত্রণ করিয়াছি।”

“অম্বপালি, লক্ষ মুদ্রার বিনিময়ে এই নিমন্ত্রণ আমাদিগকে দাও।”

আর্যপুত্রগণ, আপনারা সমগ্র বৈশালি অধীনস্থ সামন্ত রাজ্যসমূহের সহিত আমাকে দান করিলেও আমি এই মহৎ ভোজোৎসব বিক্রয় করিব না।”

তখন লিচ্ছবিগণ অঙ্গুলিস্ফোটনসহ বলিল, “আমরা এই ক্ষুদ্র আম্রপালিকা দ্বারা পরাজিত ও বঞ্চিত।”

অনন্তর লিচ্ছবিগণ অম্বপালির উদ্যানের দিকে অগ্রসর হইল।

ভগবান দূর হইতে লিচ্ছবিগণের আগমন দেখিয়া ভিক্ষুগণকে বলিলেন, “ভিক্ষুগণ, যে সকল ভিক্ষুর ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের দর্শন লাভ হয় নাই, তাঁহারা লিচ্ছবি পরিষদের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। তাঁহারা লিচ্ছবি পরিষদকে ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণরূপে জ্ঞান করুন।”

অতঃপর লিচ্ছবিগণ ভূমি যতদূর যানাদির গমনের উপযুক্ত ততদূর যানারোহণে গিয়া পরে অবতরণপূর্বক পদব্রজে ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলেন। ভগবান তাঁহাদিগকে ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উৎসাহিত ও হর্ষান্বিত করিলেন।

তখন লিচ্ছবিগণ ভগবানকে বলিলেন, “দেব, ভগবান আগামীকল্য ভিক্ষুসংঘের সহিত আমাদের গৃহে আহার গ্রহণ করুন।”

“লিচ্ছবিগণ, আগামীকল্য আহারের জন্য আমি গণিকা অম্বপালির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছি।”

তখন লিচ্ছবিগণ অঙ্গুলিস্ফোটনপূর্বক বলিল, “ক্ষুদ্র আম্রপালিকা দ্বারা আমরা পরাজিত ও বঞ্চিত।”

তৎপরে লিচ্ছবিগণ ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উত্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণপূর্বক প্রস্থান করিলেন।

১৬২. অনন্তর গণিকা অম্বপালি রাত্রির অবসানে স্বকীয় গৃহে উৎকৃষ্ট খাদ্য ও ভোজ্য প্রস্তুত করাইয়া ভগবানের নিকট সংবাদ প্রেরণ করিল, “দেব, আহারের সময় হইয়াছে, অন্ন প্রস্তুত।” তখন পূর্বাহ্নে পরিহিত বস্ত্র ভগবান পাত্র ও চীবর হস্তে ভিক্ষুগণসহ অম্বপালির আহার পরিবেশনের স্থানে উপস্থিত হইয়া নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন। তখন অম্বপালি বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে উৎকৃষ্ট খাদ্য ও ভোজ্য স্বহস্তে পরিবেশন করিয়া তাঁহাদিগকে তৃপ্ত করিলেন।

তৎপরে অম্বপালি, ভগবান আহারান্তে পাত্র হইতে হস্ত অপসারিত করিলে, নিম্ন আসন গ্রহণপূর্বক একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলেন। তৎপরে তিনি ভগবানকে বলিলেন, “দেব, এই উদ্যান আমি বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে দান করিতেছি।”

ভগবান দান গ্রহণ করিলেন। অতঃপর ভগবান গণিকা অম্বপালিকে ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উৎসাহিত ও হর্ষান্বিত করিয়া প্রস্থান করিলেন।

ভগবান বৈশালিতে অবস্থান করিবারকালেও ভিক্ষুগণকে বিস্তৃতরূপে ধর্মোপদেশ দিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা; শীল-পরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; প্রজ্ঞা পরিভাবিত চিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যা-আসব হইতে বিমুক্ত হয়।

১৬৩. অনন্তর ভগবান অম্বপালির উদ্যানে যথেচ্ছা অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, চলো, আমরা বেলুব গ্রামে গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। তখন ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত বেলুব গ্রামের দিকে অগ্রসর হইলেন। ভগবান ওই গ্রামেই অবস্থান করিতে লাগিলেন।

ওই স্থানে ভগবান ভিক্ষুগণকে বলিলেন, “ভিক্ষুগণ, বৈশালির চতুর্দিকে যাহার যেখানে মিত্র অথবা পরিচিত অথবা অন্তরঙ্গ আছে, সে সেখানে বর্ষাবাস করুক, আমি এই বেলুব গ্রামেই বর্ষাবাস করিব।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া ভিক্ষুগণ সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক বৈশালির চতুর্দিকে যাহার যেখানে মিত্র অথবা পরিচিত অথবা অন্তরঙ্গ আছে, সে সেইখানে বর্ষাবাস করিল, ভগবান স্বয়ং সেই বেলুব গ্রামেই বর্ষাবাস করিলেন।

১৬৪. এইরূপে বর্ষাবাসকালে ভগবান মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক ভীষণ রোগে আক্রান্ত হইলেন। কিন্তু তিনি সতর্ক ও শান্তভাবে উহা নীরবে সহ্য করিলেন।

তৎপরে ভগবানের মনে এই চিন্তার উদয় হইল :

“ভিক্ষুদিগকে সম্বোধন করিবার পূর্বে, তাহাদের নিকট বিদায় গ্রহণ না করিয়া পরিনির্বাণে প্রবেশ করা উচিত হইবে না। অতএব আমি ইচ্ছাশক্তির প্রবল প্রয়োগ দ্বারা এই ব্যাধিকে দমন করিয়া, যতদিন নির্দিষ্ট সময় আগত না হয়, ততদিন জীবন রক্ষা করিব।”

এইরূপে ভগবান বীর্যের প্রয়োগে ব্যাধি দমন করিয়া নির্দিষ্ট সময়ের আগমনের প্রতীক্ষায় জীবনকে আয়ত্তাধীনে রাখিলেন। ভগবানের ব্যাধির প্রাবল্য হ্রাস হইল।

ভগবান সুস্থ হইলেন। রোগমুক্ত হইবার অব্যবহিত পরেই তিনি বিহার হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া উহার ছায়ায় নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন। অতঃপর আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। তৎপরে তিনি ভগবানকে বলিলেন :

“দেব, আমি ভগবানের সুস্থ অবস্থা দেখিয়াছি, তাঁহার অসুস্থ অবস্থাও দেখিয়াছি। যদিও তাঁহার পীড়ার দৃশ্যে আমার দেহ অবশ হইয়াছিল, জগৎ আমার নিকট অন্ধকার হইয়াছিল, আমার মনোবৃত্তিসমূহ ক্ষীণ হইয়াছিল, তথাপি ভগবান যে অন্তত সংঘ সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া পর্যন্ত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিবেন না, এই চিন্তায় আমি কিয়ৎ পরিমাণ সান্ত্বনা পাইয়াছিলাম।”

১৬৫. আনন্দ, ভিক্ষুসংঘ আমার নিকট কী প্রত্যাশা করেন? আমি ধর্মপ্রচার করিবারকালে বাহ্য ও গুপ্ত মতের প্রভেদ করি নাই; আনন্দ, ধর্মের বিষয়ে তথাগতের আচার্য-মুষ্টি নাই। নিশ্চয়ই, আনন্দ, যিনি মনে করেন “আমিই ভিক্ষুসংঘের নেতৃত্ব করিব,” অথবা “ভিক্ষুসংঘ আমার উপর নির্ভর করে,” তিনিই ভিক্ষুসংঘ সম্বন্ধীয় যেকোনো বিষয়ে বিধি বিধান করিবেন। কিন্তু তথাগতের মনে কখনোই এরূপ হয় না যে, “আমি ভিক্ষুসংঘের নেতৃত্ব করিব” অথবা ভিক্ষুসংঘ আমার উপর নির্ভর করে।” তাহা হইলে কেন তথাগত সংঘের সম্বন্ধে নিয়মের ব্যবস্থা করিবেন? আনন্দ, আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, আমার বয়স অনেক হইয়াছে, আমার ভ্রমণের অবসান নিকটবর্তী হইতেছে, আমার নির্দিষ্টকাল পূর্ণ হইয়াছে, আমি অশীতি বৎসরে উপনীত হইয়াছি। আনন্দ, যেরূপ জীর্ণ শকটের গতি বিঘ্ন সঙ্কুল, সেইরূপ তথাগতের দেহের রক্ষাও কষ্টসাধ্য। আনন্দ, যখন তথাগত বাহ্য জগতের প্রতি মনোনিবেশে বিরত হইয়া বেদনাসমূহের নিরোধে অনিমিত্ত চিত্ত সমাধিতে উপনীত হইয়া বিহার করেন, তখনই তথাগতের দেহ স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে।

অতএব, আনন্দ, তোমরা আত্মদ্বীপ হইয়া, আত্মশরণ হইয়া, অনন্যশরণ হইয়া বিহার করো, ধর্মদ্বীপ, ধর্মশরণ, অনন্যশরণ হও। আনন্দ, কিরূপে ভিক্ষু আত্মদ্বীপ, আত্মশরণ, অনন্যশরণ; ধর্মদ্বীপ, ধর্মশরণ, অনন্যশরণ হইয়া বিহার করেন?

আনন্দ, ভিক্ষু কায়ে কায়ানুদর্শী হইয়া বিহার করেন, তিনি উদ্যমশীল, সম্প্রজ্ঞানযুক্ত এবং স্মৃতিমান হইয়া লোকে অভিধ্যা এবং দৌর্মনস্যের দমন করেন, তিনি বেদনায় বেদনানুদর্শী, চিত্তে চিত্তানুদর্শী, ধর্মে ধর্মানুদর্শী হইয়া বিহার করেন এবং উদ্যমশীল, সম্প্রজ্ঞান-যুক্ত এবং স্মৃতিমান হইয়া লোকে অভিধ্যা এবং দৌর্মনস্যের দমন করেন।” এইরূপেই ভিক্ষু আত্মদ্বীপ, আত্মশরণ, অনন্যশরণ; ধর্মদ্বীপ, ধর্মশরণ অনন্যশরণ হইয়া বিহার করেন।

আনন্দ, যাঁহারা এক্ষণে অথবা আমার দেহাবসানে আত্মদ্বীপ, আত্মশরণ, অনন্যশরণ; ধর্মদ্বীপ, ধর্মশরণ, অনন্যশরণ হইয়া বিহার করিবেন, আমার সেই সকল ভিক্ষুগণ জন্মের অতীত হইবেন, তবে তাঁহাদিগকে জ্ঞান-পিপাসু হইতে হইবে।

দ্বিতীয় ভাণবার সমাপ্ত

তৃতীয় অধ্যায়

১৬৬. পূর্বাহ্নে পরিহিত বস্ত্র ভগবান পাত্র ও চীবর হস্তে বৈশালিতে পিণ্ডার্থ প্রবেশ করিলেন। সেই স্থানে ভিক্ষার্থ ভ্রমণ করিয়া প্রত্যাবর্তনপূর্বক আহারান্তে ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, কুশাসন গ্রহণ করো। আমি দিবা বিহারার্থ চাপাল-চৈত্যে গমন করিব।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক আসন হস্তে ভগবানের পশ্চাদনুসরণ করিলেন।

ভগবান চাপাল চৈত্যে উপনীত হইয়া নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন। আয়ুষ্মান আনন্দও ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন।

১৬৭. তৎপর ভগবান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, বৈশালি রমণীয় স্থান, রমণীয় উদেন চৈত্য, রমণীয় গৌতমক চৈত্য, রমণীয় সত্তম্বক চৈত্য, রমণীয় বহুপুত্ত চৈত্য, রমণীয় সারন্দদ চৈত্য, রমণীয় চাপাল চৈত্য!”

“আনন্দ, যাঁহার চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন। আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ। তথাগত ইচ্ছাক্রমে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণধারণ করিতে পারেন।”

ভগবান স্পষ্ট ইঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও আয়ুষ্মান আনন্দ উহা বুঝিতে সক্ষম হইলেন না, তিনি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিলেন না-বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন!” ইহার কারণ তাঁহার চিত্ত মার কর্তৃক অভিভূত হইয়াছিল।

দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার ভগবান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, বৈশালি রমণীয় স্থান, রমণীয় উদেন চৈত্য, রমণীয় গৌতমক চৈত্য, রমণীয় সত্তম্বক চৈত্য, রমণীয় বহুপুত্ত চৈত্য, রমণীয় সারন্দদ চৈত্য, রমণীয় চাপাল চৈত্য।”

আনন্দ, যাঁহার চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন।

ভগবান স্পষ্ট ইঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও আয়ুষ্মান আনন্দ উহা বুঝিতে সক্ষম হইলেন না, তিনি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিলেন না-বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন! ইহার কারণ তাঁহার চিত্ত মার কর্তৃক অভিভূত হইয়াছিল।

তৎপরে ভগবান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, তুমি যাও, এখন তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক আসন হইতে উত্থান করিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করণান্তে নিকটস্থ এক বৃক্ষমূলে উপবেশন করিলেন।

১৬৮. আয়ুষ্মান আনন্দের প্রস্থানের অব্যবহিত পরে দুষ্ট মার ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইয়া ভগবানকে বলিল :

দেব, ভগবান এইবার পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন, সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন, ভগবানের পরিনির্বাণের কাল উপস্থিত হইয়াছে। ভগবান পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছেন, “হে দুষ্ট, যতদিন আমার ভিক্ষুগণ প্রকৃত শ্রাবক না হইবেন, যতদিন তাঁহারা জ্ঞানী ও উপযুক্তরূপে নিয়ন্ত্রিত, দক্ষ ও সুশিক্ষিত, ধর্মগ্রন্থসমূহে পারদর্শী হইয়া বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্যের পালন না করিবেন, উপদেশাবলীর অনুবর্তী হইয়া জীবনে শুদ্ধাচারী না হইবেন, যতদিন তাঁহারা স্বয়ং ধর্মকে আয়ত্ত করিয়া ওই ধর্ম সম্বন্ধে অপরকে শিক্ষাদান করিতে না পারিবেন, উহা প্রচার করিতে, ঘোষণা করিতে, প্রতিষ্ঠিত করিতে, উন্মুক্ত করিতে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করিতে ও উহার অর্থ সুস্পষ্ট করিতে না পারিবেন, যতদিন তাঁহারা অপরে মিথ্যা মত প্রচার করিলে উহাকে পরাভূত ও বিনষ্ট করিয়া বিস্ময়কর সত্যের বিস্তৃতি সাধন করিতে না পারিবেন, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না।”

দেব, ভগবানের ভিক্ষুগণ এক্ষণে ভগবানের ইচ্ছানুরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং তাঁহার ইচ্ছানুরূপ সমস্তই করিতে সক্ষম। অতএব দেব, ভগবান সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন, ভগবানের পরিনির্বাণের কাল উপস্থিত হইয়াছে।

ভগবান পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছেন, “হে দুষ্ট, যতদিন আমার ভিক্ষুণীগণ প্রকৃত শ্রাবিকা না হইবেন, জ্ঞানী ও উপযুক্তরূপে নিয়ন্ত্রিত, দক্ষ ও সুশিক্ষিত, ধর্মগ্রন্থসমূহে পারদর্শী হইয়া বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্যের পালন না করিবেন, উপদেশাবলীর অনুবর্তী হইয়া জীবনে শুদ্ধাচারী না হইবেন, যতদিন তাঁহারা স্বয়ং ধর্মকে আয়ত্ত করিয়া ওই ধর্ম সম্বন্ধে অপরকে শিক্ষাদান করিতে না পারিবেন, উহা প্রচার করিতে, ঘোষণা করিতে, প্রতিষ্ঠিত করিতে, উন্মুক্ত করিতে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করিতে ও উহার অর্থ সস্পষ্ট করিতে না পারিবেন, যতদিন তাঁহারা অপরে মিথ্যা মত প্রচার করিলে উহাকে পরাভূত ও বিনষ্ট করিয়া বিস্ময়কর সত্যেও বিস্তৃতি সাধন করিতে না পারিবেন, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না।”

যতদিন আমার গৃহস্থ উপাসকগণ প্রকৃত শ্রাবক না হইবেন, জ্ঞানী ও উপযুক্তরূপে নিয়ন্ত্রিত, দক্ষ ও সুশিক্ষিত, ধর্মগ্রন্থসমূহে পারদর্শী হইয়া বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্যের পালন না করিবেন, উপদেশাবলীর অনুবর্তী হইয়া জীবনে শুদ্ধাচারী না হইবেন, যতদিন তাঁহারা স্বয়ং ধর্মকে আয়ত্ত করিয়া ওই ধর্ম সম্বন্ধে অপরকে শিক্ষাদান করিতে না পারিবেন, উহা প্রচার করিতে, ঘোষণা করিতে, প্রতিষ্ঠিত করিতে, উন্মুক্ত করিতে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করিতে ও উহার অর্থ সুস্পষ্ট করিতে না পারিবেন, যতদিন তাঁহারা অপরে মিথ্যা মত প্রচার করিলে উহাকে পরাভূত ও বিনষ্ট করিয়া বিস্ময়কর সত্যের বিস্তৃতি সাধন করিতে না পারিবেন, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না।” দেব, উপাসকগণ এক্ষণে ভগবানের ইচ্ছানুরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং তাঁহার ইচ্ছানুরূপ সমস্তই করিতে সক্ষম। অতএব দেব, ভগবান পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন, ভগবানের পরিনির্বাণের কাল উপস্থিত হইয়াছে।

ভগবান পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছেন, “হে দুষ্ট, যতদিন আমার উপাসিকাগণ প্রকৃত শ্রাবিকা না হইবেন, জ্ঞানী ও উপযুক্তরূপে নিয়ন্ত্রিত, দক্ষ ও সুশিক্ষিত, ধর্মগ্রন্থসমূহে পারদর্শী হইয়া বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্যের পালন না করিবেন, উপদেশাবলীর অনুবর্তী হইয়া জীবনে শুদ্ধাচারী না হইবেন, যতদিন তাঁহারা স্বয়ং ধর্মকে আয়ত্ত করিয়া ওই ধর্ম সম্বন্ধে অপরকে শিক্ষাদান করিতে না পারিবেন, উহা প্রচার করিতে, ঘোষণা করিতে, প্রতিষ্ঠিত করিতে, উন্মুক্ত করিতে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করিতে ও উহার অর্থ সুস্পষ্ট করিতে না পারিবেন, যতদিন তাঁহারা অপরে মিথ্যা মত প্রচার করিলে উহাকে পরাভূত ও বিনষ্ট করিয়া বিস্ময়কর সত্যের বিস্তৃতি সাধন করিতে না পারিবেন, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না। দেব, উপাসিকাগণ এক্ষণে ভগবানের ইচ্ছানুরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং তাঁহার ইচ্ছানুরূপ সমস্তই করিতে সক্ষম। অতএব ভগবান সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন, ভগবানের পরিনির্বাণের কাল উপস্থিত হইয়াছে।

ভগবান, পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছেন, “হে দুষ্ট, যতদিন মৎ-প্রচারিত ব্রহ্মচর্য্য ঋদ্ধ, স্ফীত, প্রখ্যাত, বহুজনাদৃত, দূরবিস্তৃত না হয়, যতদিন উহা সমগ্র মানব-সমাজে সুপ্রকাশিত না হয়, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না।” এক্ষণে ভগবানের প্রচারিত ব্রহ্মচর্য্য তাঁহার ইচ্ছানুরূপ অবস্থায় উপনীত। অতএব ভগবান সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন, ভগবানের পরিনির্বাণের কাল উপস্থিত হইয়াছে।

মার এইরূপ কহিলে ভগবান দুষ্টকে বলিলেন :

“দুষ্ট! তুমি সুখী হও; অচিরে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে, অদ্য হইতে তিন মাসের অবসানে তথাগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিবেন।”

১৬৯. অনন্তর ভগবান চাপাল চৈত্যে স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইয়া অবশিষ্ট আয়ুষ্কাল প্রত্যাখ্যান করিলেন। ওই সময়ে মহাভূমিকম্প হইল, ভীষণ লোমহর্ষক, বজ্রপাত হইল। ভগবান উহা অবগত হইলে তাঁহার মুখ হইতে উদান নির্গত হইল :

“জাতি ও জাতির হেতু অপরিমেয় অথবা স্বল্প মুনি বিসর্জন দিয়াছেন; তিনি অধ্যাত্মরত ও সমাহিত হইয়া আত্মোদ্ভূত বর্ম ছিন্ন করিয়াছেন।”

১৭০. তদনন্তর আয়ুষ্মান আনন্দ এইরূপ চিন্তা করিলেন, “আশ্চর্য অদ্ভুত এই মহাভূমিকম্প, ভীষণ ও লোমহর্ষক, বজ্রপাতও হইল! এই ভূমিকম্পের হেতু ও প্রত্যয় কী?”

অতঃপর আনন্দ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবেশনপূর্বক বলিলেন :

“আশ্চর্য অদ্ভুত এই মহাভূমিকম্প, ভীষণ ও লোমহর্ষক, বজ্রপাতও হইল! এই মহাভূমিকম্পের হেতু ও প্রত্যয় কী?”

১৭১. আনন্দ, মহাভূমিকম্পের আট হেতু এবং আট প্রত্যয়। এই আট হেতু এবং আট প্রত্যয় কী কী? এই মহা-পৃথিবী জলে প্রতিষ্ঠিত, জল বায়ুতে প্রতিষ্ঠিত, এবং বায়ু আকাশাশ্রিত। যখন মহাবাত প্রবাহিত হয়, তখন ওই বাতের প্রবাহে জল কম্পিত হয় এবং পৃথিবীকে কম্পিত করে। ইহাই মহাভূমিকম্পের প্রথম হেতু, প্রথম প্রত্যয়।

“পুনশ্চ, ঋদ্ধিমান বশীভূত-চিত্ত শ্রমণ অথবা ব্রাহ্মণ, অথবা মহাবলশালী মহাপরাক্রান্ত দেবতা, যাঁহার প্ররিক্ত সূক্ষ্ম পৃথিবী-সংজ্ঞা এবং অপ্রমাণ আপ-সংজ্ঞা অনুশীলিত হইয়াছে, তিনি এই পৃথিবীকে কম্পিত, সংকম্পিত, সংপ্রকম্পিত এবং সঞ্চালিত করিতে সমর্থ। ইহাই মহাভূমিকম্পের দ্বিতীয় হেতু, দ্বিতীয় প্রত্যয়।”

“পুনশ্চ, যখন বোধিসত্ত্ব তুষিত দেবলোক হইতে চ্যুত হইয়া স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সহকারে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করেন, তখন এই পৃথিবী কম্পিত হয়, সংকম্পিত হয়, সংপ্রকম্পিত হয়, সঞ্চালিত হয়। ইহাই মহাভূমিকম্পের তৃতীয় হেতু, তৃতীয় প্রত্যয়।”

“পুনশ্চ, যখন বোধিসত্ত্ব স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইয়া মাতৃগর্ভ হইতে নিষ্ক্রান্ত হন, তখন এই পৃথিবী কম্পিত হয়, সংকম্পিত হয়, সংপ্রকম্পিত হয়, সঞ্চালিত হয়। ইহাই মহাভূমিকম্পের চতুর্থ হেতু, চতুর্থ প্রত্যয়।”

“পুনশ্চ, যখন তথাগত অনুত্তর সম্যক সম্বোধি প্রাপ্ত হন, তখন এই পৃথিবী কম্পিত হয়, সংকম্পিত হয়, সংপ্রকম্পিত হয়, সঞ্চালিত হয়। ইহাই মহাভূমিকম্পের পঞ্চম হেতু, পঞ্চম প্রত্যয়।”

“পুনশ্চ, যখন তথাগত অনুত্তর ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেন, তখন এই পৃথিবী কম্পিত হয়, সংকম্পিত হয়, সম্প্রকম্পিত হয়, সঞ্চালিত হয়। ইহাই মহাভূমিকম্পের ষষ্ঠ হেতু, ষষ্ঠ প্রত্যয়।”

“পুনশ্চ, যখন তথাগত স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইয়া অবশিষ্ট আয়ুষ্কাল প্রত্যাখ্যান করেন, তখন এই পৃথিবী কম্পিত, সংকম্পিত, সংপ্রকম্পিত ও সঞ্চালিত হয়। ইহাই মহাভূমিকম্পের সপ্তম হেতু, সপ্তম প্রত্যয়।”

“পুনশ্চ, যখন তথাগত অনুপাদিশেষ পরিনির্বাণে প্রবেশ করেন, তখন এই পৃথিবী কম্পিত হয়, সংকম্পিত হয়, সংপ্রকম্পিত হয়, সঞ্চালিত হয়। ইহাই মহাভূমিকম্পের অষ্টম হেতু, অষ্টম প্রত্যয়। আনন্দ, এই সকলই মহাভূমিকম্পের অষ্ট হেতু এবং অষ্ট প্রত্যয়।”

১৭২. আনন্দ, পরিষদ আট প্রকার। কী কী? ক্ষত্রিয় পরিষদ, ব্রাহ্মণ পরিষদ, গৃহপতি পরিষদ, শ্রমণ পরিষদ, চাতুর্মহারাজিক পরিষদ, ত্রয়ত্রিংশ পরিষদ, মার পরিষদ, ব্রহ্ম পরিষদ।

আনন্দ, আমার স্মরণ আছে আমি শতাধিক ক্ষত্রিয় পরিষদে গমন করিয়াছি, ওই সকল স্থানে আসন গ্রহণের পূর্বে, উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সহিত বাক্যালাপ আরম্ভ করিবার পূর্বে, আমি বর্ণে ও স্বরে তাহাদিগেরই মত হইতাম। আমি তাহাদিগকে ধর্মকথা দ্বারা উপদিষ্ট, উৎসাহিত ও আনন্দিত করিতাম। কিন্তু আমি কথা কহিলে কেহ আমাকে চিনিত না; তাহারা বলিত, “ইনি কে? মনুষ্য অথবা দেব?” তাহাদিগকে ধর্মকথা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উৎসাহিত ও হর্ষান্বিত করিয়া আমি অদৃশ্য হইতাম। তখনও তাহারা আমাকে চিনিতে পারিত না, তাহারা বলিত, “যিনি অদৃশ্য হইলেন ইনি কে? দেব অথবা মনুষ্য?”

আনন্দ, আমার স্মরণ আছে, আমি শতাধিক ব্রাহ্মণ পরিষদে গমন করিয়াছি, গৃহপতি পরিষদে গমন করিয়াছি, শ্রমণ পরিষদে গমন করিয়াছি, চাতুর্মহারাজিক পরিষদে গমন করিয়াছি, ত্রয়ত্রিংশ পরিষদে গমন করিয়াছি, মার পরিষদে গমন করিয়াছি, ব্রহ্ম পরিষদে গমন করিয়াছি, ওই সকল স্থানে আসন গ্রহণের পূর্বে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সহিত বাক্যালাপ আরম্ভ করিবার পূর্বে, আমি বর্ণে ও স্বরে তাহাদিগেরই মত হইতাম। আমি তাহাদিগকে ধর্মকথা দ্বারা উপদিষ্ট, উৎসাহিত ও আনন্দিত করিতাম। কিন্তু আমি কথা কহিলে কেহ আমাকে চিনিত না; তাহারা বলিত “ইনি কে? মনুষ্য অথবা দেব?” তাহাদিগকে ধর্মকথা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উৎসাহিত ও হর্ষান্বিত করিয়া আমি অদৃশ্য হইতাম। তখনও তাহারা আমাকে চিনিতে পারিত না, তাহারা বলিত, “যিনি অদৃশ্য হইলেন ইনি কে? দেব অথবা মনুষ্য? আনন্দ, এই আট প্রকার পরিষদ।

১৭৩. আনন্দ, অভিভূ-আয়তন (জয়-স্থান) আট প্রকার। কী কী?

কেহ অধ্যাত্মে রূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : সীমাবদ্ধ, সুদৃশ্য অথবা তদ্বিপরীত রূপ; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই প্রথম অভিভূ-আয়তন।

কেহ অধ্যাত্মে রূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : অসীম, সুদৃশ্য অথবা তদ্বিপরীত রূপ; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই দ্বিতীয় অভিভূ-আয়তন।

কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : সীমাবদ্ধ, সুদৃশ্য অথবা তদ্বিপরীত রূপ; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই তৃতীয় অভিভূ-আয়তন।”

কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : অসীম, সুদৃশ্য অথবা তদ্বিপরীত রূপ; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই চতুর্থ অভিভূ-আয়তন।

কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন, নীল, নীলবর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস; যথা : উমা পুষ্প নীল, নীল-বর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস “অথবা যেরূপ বারাণসীর বস্ত্র উভয় পৃষ্ঠ সুমৃষ্ট, নীল, নীলবর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস-এইরূপ কেহ অধ্যাত্মে অরূপ সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন, নীল, নীল, নীলবর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস; যথা : উমা পুষ্প নীল, নীল-বর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই পঞ্চম অভিভূ-আয়তন।

কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : পীত, পীতবর্ণ, পীত-নিদর্শন, পীত-নিভাস; যথা : কর্ণিকার পুষ্প পীত, পীতবর্ণ, পীতনিদর্শন, পীত-নিভাস; অথবা যেরূপ বারাণসীর বস্ত্র-উভয় পৃষ্ঠ সুমৃষ্ট পীত, পীতবর্ণ, পীতনিদর্শন, পীত-নিভাস-এইরূপ কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন, পীত, পীতবর্ণ, পীত-নিদর্শন, পীত-নিভাস; যথা : কর্ণিকার পুষ্প পীত, পীতবর্ণ, পীতনিদর্শন, পীত-নিভাস; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই ষষ্ঠ অভিভূ-আয়তন।

কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : রক্ত, রক্তবর্ণ, রক্ত-নিদর্শন, রক্ত নিভাস; যথা : বন্ধুজীব পুষ্প রক্ত, রক্তবর্ণ, রক্ত-নিদর্শন, রক্ত নিভাস; অথবা যেরূপ বারাণসীর বস্ত্র উভয় পৃষ্ঠ সুমৃষ্ট, রক্ত, রক্তবর্ণ, রক্ত-নিদর্শন, রক্ত-নিভাস-এইরূপ কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপদর্শন করেন, রক্ত, রক্তবর্ণ, রক্ত-নিদর্শন, রক্ত-নিভাস; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই সপ্তম অভিভূ-আয়তন।

কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন : শুভ্র, শুভ্রবর্ণ, শুভ্র-নিদর্শন, শুভ্র-নিভাস; যথা : ঔষধি তারকা শুভ্র, শুভ্রবর্ণ, শুভ্র-নিদর্শন, শুভ্র-নিভাস; অথবা যেরূপ বারাণসীর বস্ত্র-উভয় পৃষ্ঠ সুমৃষ্ট, শুভ্র, শুভ্রবর্ণ, শুভ্র-নিদর্শন, শুভ্র-নিভাস, এইরূপ কেহ অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী হইয়া বাহিরে রূপ দর্শন করেন, শুভ্র, শুভ্রবর্ণ, শুভ্র-নিদর্শন, শুভ্র-নিভাস; “ওই সকল অভিভূত করিয়া জানিতেছি এবং দেখিতেছি” তিনি এইরূপ সংজ্ঞা লাভ করেন। ইহাই অষ্টম অভিভূ-আয়তন। আনন্দ, এই অষ্ট অভিভূ-আয়তন।

১৭৪. “আনন্দ, আট বিমোক্ষ। কী কী?”

“রূপী রূপ দর্শন করে, ইহা প্রথম বিমোক্ষ।”

অধ্যাত্মে অরূপ-সংজ্ঞী বাহিরে রূপ দর্শন করে, ইহা দ্বিতীয় বিমোক্ষ।

“সুন্দর” এই চিন্তায় অভিনিবিষ্ট হয়, ইহা তৃতীয় বিমোক্ষ।

“রূপ-সংজ্ঞাকে সর্বতোভাবে অতিক্রম করিয়া, প্রতিঘ-সংজ্ঞা বিনাশ করিয়া, নানাত্ব-সংজ্ঞায় উদাসীন হইয়া, “আকাশ-অনন্ত” এই অনুভূতির সহিত আকাশ-অনন্ত-আয়তন উপলব্ধি করিয়া বিহার করে। ইহা চতুর্থ বিমোক্ষ।”

আকাশ-অনন্ত-আয়তন সর্বতোভাবে অতিক্রম করিয়া “বিজ্ঞান-অনন্ত” এই অনুভূতির সহিত বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তন উপলব্ধি করিয়া বিহার করে। ইহা পঞ্চম বিমোক্ষ।

“বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তন সর্বতোভাবে অতিক্রম করিয়া “কিছুই নাই” এই অনুভূতির সহিত আকিঞ্চন-আয়তন উপলব্ধি করিয়া বিহার করে, ইহা ষষ্ঠ বিমোক্ষ।”

“আকিঞ্চন-আয়তন সর্বতোভাবে অতিক্রম করিয়া নৈবসংজ্ঞা-না-অসংজ্ঞা আয়তন উপলব্ধি করিয়া বিহার করে, ইহা সপ্তম বিমোক্ষ।”

“নৈবসংজ্ঞা-না-অসংজ্ঞা-আয়তন সর্বতোভাবে অতিক্রম করিয়া সংজ্ঞা-বেদয়িত-নিরোধ উপলব্ধি করিয়া বিহার করে, ইহা অষ্টম বিমোক্ষ।”

“আনন্দ, এই সকল আট বিমোক্ষ।”

১৭৫. আনন্দ, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির পরক্ষণেই এক দিন আমি উরুবেলায় নিরঞ্জন নদীর তীরস্থ ন্যাগ্রোধবৃক্ষের তলে বিশ্রাম করিতেছিলাম। ওই সময় দুষ্ট মার আমার নিকট উপস্থিত হইয়া একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইল এবং আমাকে বলিল, “ভগবান সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করুন। ভগবানের পরিনির্বাণের কাল উপস্থিত হইয়াছে।”

আনন্দ, মার এইরূপ কহিলে আমি তাহাকে বলিলাম :

“রে দুষ্ট! যতদিন সংঘভুক্ত ভ্রাতা-ভগ্নীগণ এবং স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে গৃহস্থ শিষ্যগণ প্রকৃত শ্রাবক না হইবেন, যতদিন তাঁহারা জ্ঞানী ও উপযুক্তরূপে নিয়ন্ত্রিত, দক্ষ ও সুশিক্ষিত, ধর্মগ্রন্থসমূহে পারদর্শী হইয়া বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্যের পালন না করিবেন, উপদেশাবলীর অনুবর্তী হইয়া জীবনে শুদ্ধাচারী না হইবেন, যতদিন তাঁহারা স্বয়ং ধর্মকে আয়ত্ত করিয়া ওই ধর্ম সম্বন্ধে অপরকে শিক্ষাদান করিতে না পারিবেন, উহা প্রচার করিতে, ঘোষণা করিতে, প্রতিষ্ঠা করিতে, উন্মুক্ত করিতে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করিতে ও উহার অর্থ সুস্পষ্ট করিতে না পারিবেন, যতদিন তাঁহারা, অপরে মিথ্যা মত প্রচার করিলে উহাকে পরাভূত ও বিনষ্ট করিয়া বিস্ময়কর সত্যের দূরদূরান্তরে বিস্তৃতি সাধন করিতে না পারিবেন, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না।”

“হে দুষ্ট! যতদিন মৎপ্রচারিত ব্রহ্মচর্য্য ঋদ্ধ, স্ফীত, প্রখ্যাত, বহুজনাদৃত, দূরবিস্তৃত না হয়, যতদিন উহা সমগ্র মানব সমাজে সুপ্রকাশিত না হয়, ততদিন আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করিব না।”

১৭৬. আনন্দ, পুনরায় অদ্য চাপাল চৈত্যে দুষ্ট মার আমার নিকট আসিয়া একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া আমাকে পূর্বের ন্যায় সম্বোধন করিল।

১৭৭. আনন্দ, তদুত্তরে আমি তাহাকে বলিলাম :

“দুষ্ট! সুখী হও, অনতিবিলম্বে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে! অদ্য হইতে তিন মাসের অবসানে তথাগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিবেন।”

“পুনশ্চ, আনন্দ, অদ্য চাপাল চৈত্যে তথাগত জীবনের অবশিষ্টকাল স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইয়া প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।”

১৭৮. তখন আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে বলিলেন :

“বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব ও মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন।”

“আনন্দ, ক্ষান্ত হও, তথাগতকে অনুনয় করিও না, এই প্রার্থনার সময় অতীত হইয়াছে।”

দ্বিতীয়বার আনন্দ ভগবানকে পূর্বোক্তরূপে অনুনয় করিলেন এবং ভগবানের নিকট হইতে একই প্রকার উত্তর প্রাপ্ত হইলেন।

তৃতীয়বার আনন্দ ভগবানকে পূর্বের ন্যায় অনুনয় করিলেন।

“আনন্দ, তথাগতের জ্ঞানে তোমার শ্রদ্ধা আছে?”

“দেব, আছে।”

“তবে তুমি কেন তথাগতকে তৃতীয়বার নিপীড়িত করিতেছ?”

“ভগবানের মুখ হইতে আমি যাহা শুনিয়াছি, যাহা গ্রহণ করিয়াছি তাহা এই : “আনন্দ, যাঁহার চারি ঋদ্ধি-পাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন। আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ। তথাগত ইচ্ছাক্রমে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন।”

“আনন্দ, তোমার শ্রদ্ধা আছে?”

“দেব, আছে।”

“আনন্দ, তাহা হইলে ইহা তোমারই দুষ্কৃতি, তোমারই অপরাধ যে ভগবান স্পষ্ট ইঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও তুমি বুঝিতে সক্ষম হইলে না” ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিলে না :

“বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন!”

“আনন্দ, যদি তুমি তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিতে, তাহা হইলে দুইবার তথাগত তোমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিতেন, কিন্তু তৃতীয় অনুরোধ রক্ষা করিতেন। অতএব, আনন্দ, ইহা তোমারই দুষ্কৃতি, তোমারই অপরাধ।”

১৭৯. “আনন্দ, আমি একসময় রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করিতেছিলাম। ওই স্থানেও, আনন্দ, আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম, “রাজগৃহ রমণীয় স্থান, গৃধ্রকূট পর্বত রমণীয় স্থান! আনন্দ, যাঁহার চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন। আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ। তথাগত ইচ্ছাক্রমে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন।” আনন্দ, তথাগত স্পষ্ট ঈঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও তুমি বুঝিতে সক্ষম হইলে না; তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিলে না, “বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন!” আনন্দ, যদি তুমি তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিতে, তাহা হইলে দুইবার তথাগত তোমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিতেন, কিন্তু তৃতীয় অনুরোধ রক্ষা করিতেন। অতএব, আনন্দ, ইহা তোমারই দুষ্কৃতি, তোমারই অপরাধ।”

১৮০. “আনন্দ, একসময় আমি রাজগৃহের নিগ্রোধারামে, ওই স্থানেই চোর-প্রপাতে, ওই স্থানেই সপ্তপর্ণী গুহায় বেভার-পার্শ্বে, ওই স্থানেই কাল শিলায় ইসিগিলি পার্শ্বে, ওই স্থানেই শীতবনে সপ্পসোণ্ডিক গুহায়, ওই স্থানেই তপোদারামে, ওই স্থানেই বেলুবনে কলন্দক নিবাপে, ওই স্থানেই জীবকের আম্রবনে, ওই স্থানেই মদ্দকুচ্ছির মৃগদাবে, অবস্থান করিতেছিলাম!”

“আনন্দ, ওই স্থানেও আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম, “রমণীয় রাজগৃহ, রমণীয় গৃধ্রকূট পর্বত, গৌতম নিগ্রোধ, চোর প্রপাত, সপ্তপর্ণী গুহায় বেভার পার্শ্বে, কালশিলায় ইসিগিলি পার্শ্ব, শীতবনে সপ্পসোণ্ডিক গুহা, তপোদারামে, বেলুবনে কলন্দক নিবাপ, জীবকের আম্রবন, মদ্দকুচ্ছির মৃগদাব!”

“আনন্দ, যাঁহার ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন। আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ। তথাগত ইচ্ছাক্রমে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন।” ভগবান স্পষ্ট ঈঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও, আনন্দ তুমি উহা বুঝিতে সক্ষম হইলে না, তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিলে না, “বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন।” আনন্দ, যদি তুমি তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিতে, তাহা হইলে দুইবার তথাগত তোমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিতেন, কিন্তু তৃতীয় অনুরোধ রক্ষা করিতেন। অতএব, আনন্দ ইহা তোমারই দুষ্কৃতি, তোমারই অপরাধ।”

১৮১. “আনন্দ, একসময় আমি বৈশালির উদেন চৈত্যে অবস্থান করিতেছিলাম, ওই স্থানেও আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম, “আনন্দ, বৈশালি রমণীয় স্থান, রমণীয় উদেন চৈত্য। আনন্দ, যাঁহার ঋদ্ধি-পাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন। আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধি-পাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ। তথাগত ইচ্ছাক্রমে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন।” তথাগত স্পষ্ট ইঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও, আনন্দ, তুমি উহা বুঝিতে সক্ষম হইলে না, তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিলেন না-“বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন।” আনন্দ, যদি তুমি তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিতে, তাহা হইলে দুইবার তিনি তোমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিতেন, কিন্তু তৃতীয় অনুরোধ রক্ষা করিতেন। অতএব, আনন্দ, ইহা তোমারই দুষ্কৃতি, তোমারই অপরাধ।”

১৮২. আনন্দ, একসময় আমি বৈশালির গৌতমক চৈত্যে, ওই স্থানেই সত্তম্বক চৈত্যে, ওই স্থানেই বহুপুত্ত চৈত্যে, ওই স্থানেই সারন্দদ চৈত্যে অবস্থান করিতেছিলাম।

আনন্দ, অদ্য চাপাল চৈত্যে আমি তোমাকে বলিয়াছি, “আনন্দ, বৈশালি রমণীয় স্থান, রমণীয় উদেন চৈত্য, রমণীয় গৌতমক চৈত্য, রমণীয় সত্তম্বক চৈত্য, রমণীয় বহুপুত্ত চৈত্য, রমণীয় সারন্দদ চৈত্য, রমণীয় চাপাল চৈত্য! আনন্দ, যাঁহার চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ, তিনি ইচ্ছা করিলে কল্পব্যাপী জীবন-যাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন। আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধিপাদ বিকশিত, অনুশীলিত, আয়ত্তীভূত, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, অনুষ্ঠিত, পুষ্ট, সুসমারব্ধ। তথাগত ইচ্ছাক্রমে কল্পব্যাপী জীবনযাপন করিতে পারেন, অথবা কল্পের অবশিষ্টকাল প্রাণ ধারণ করিতে পারেন।” তথাগত স্পষ্ট ইঙ্গিতসহ এইরূপ সুস্পষ্ট উক্তি করিলেও, আনন্দ, তুমি উহা বুঝিতে সক্ষম হইলে না তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিলেন না-“বহুজনের হিতার্থ, বহুজনের সুখার্থ, জগতের প্রতি অনুকম্পা করণার্থ, দেব-মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখের জন্য ভগবান কল্পস্থায়ী হউন, সুগত কল্পস্থায়ী হউন!” আনন্দ, যদি তুমি তথাগতের নিকট প্রার্থনা করিতে, তাহা হইলে দুইবার তিনি তোমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিতেন, কিন্তু তৃতীয় অনুরোধ রক্ষা করিতেন। অতএব, আনন্দ, ইহা তোমারই দুষ্কৃতি, তোমারই অপরাধ।”

১৮৩. “আনন্দ, আমি কি তোমাকে পূর্বে বলি নাই যে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সকল বস্তুরই স্বভাব এই যে আমাদিগকে তৎসমূহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে? তবে, আনন্দ, কী প্রকারে আমার পক্ষে বাঁচিয়া থাকা সম্ভব, যখন জাত এবং গঠিত বস্তু মাত্রেরই মধ্যে বিনাশের স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান? তবে আমার এই দেহ যে ধ্বংস হইবে না তাহা কী প্রকারে সম্ভব? এরূপ অবস্থা অসম্ভব! আনন্দ, এই মরজীবন তথাগত কর্তৃক পরিত্যক্ত, দূরে নিক্ষিপ্ত, বর্জিত ও প্রত্যাখ্যাত হইয়াছে! তথাগত নিশ্চিতরূপে কহিয়াছেন, “অচিরেই তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে, অদ্য হইতে তিন মাসের অবসানে তথাগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিবেন।” তথাগত জীবিত হেতু যে ওই বাক্যের প্রতিসংহার করিবেন, তাহা সম্ভব নহে।

“আনন্দ, এসো, আমরা মহাবনে কূটাগারশালায় গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

অনন্তর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দের সহিত মহাবনে কূটাগারশালায় গমনপূর্বক আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :

“আনন্দ, যাও, বৈশালির নিকটবর্তী স্থানে যে সকল ভিক্ষু অবস্থান করিতেছেন, তাঁহাদিগকে উপস্থানশালায় একত্রিত করো।”

“তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ বৈশালির নিকটস্থ ভিক্ষুগণকে উপস্থানশালায় একত্রিত করিয়া ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে এক পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন :

“দেব, ভিক্ষুসংঘ একত্রিত হইয়াছে, এক্ষণে ভগবানের যেরূপ ইচ্ছা।”

১৮৪. তখন ভগবান উপস্থানশালায় গমনপূর্বক নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিয়া ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

যে জ্ঞানলব্ধ সত্য আমি প্রচার করিয়াছি, জগতের প্রতি করুণা-পরবশ হইয়া, সর্ব প্রাণীর হিত ও উপকারের জন্য, উহা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিয়া কার্যে পরিণত করো, উহাকে ধ্যানের বিষয়ীভূত করো, দেশ দেশান্তরে উহার বিস্তৃতি সাধন করো, যাহাতে এই বিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য্য দীর্ঘকাল স্থায়ী ও সযত্নে রক্ষিত হয়, যাহাতে উহা অসংখ্য প্রাণীর মঙ্গল ও কল্যাণে নিয়োজিত হয়।

মৎ প্রচারিত জ্ঞানলব্ধ সত্য কী কী? উহা এই সকল চারি স্মৃতি প্রস্থান; চারি সম্যক প্রধান; চারি ঋদ্ধিপাদ; পঞ্চ ইন্দ্রিয়; পঞ্চ বল; সপ্ত বোজ্ঝাঙ্গ; আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গ।

ওই সকল জ্ঞানলব্ধ সত্য আমি প্রচার করিয়াছি। উহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিয়া কার্যে পরিণত করো, উহাকে ধ্যানের বিষয়ীভূত করো, দেশ-দেশান্তরে উহার বিস্তৃতি সাধন করো, যাহাতে এই বিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য্য দীর্ঘকাল স্থায়ী ও সযত্নে রক্ষিত হয়, যাহাতে উহা অসংখ্য প্রাণীর মঙ্গল ও কল্যাণে নিয়োজিত হয়।”

১৮৫. অতঃপর ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

ভিক্ষুগণ, তোমাদিগকে বলিতেছি, “সংযোগ মাত্রই বিপ্রযোগান্ত। অপ্রমত্ত হইয়া মুক্তির পথ পরিষ্কৃত করো। অচিরে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে, অদ্য হইতে তিন মাসের অবসানে তথাগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিবেন।”

ভগবান এইরূপ বলিলেন। সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“আমি পরিপক্ব বয়সে উপনীত; আমার অবশিষ্ট আয়ু অল্প; আমি তোমাদিগকে ত্যাগ করিয়া যাইব; আমার আশ্রয়স্থান প্রস্তুত; ভিক্ষুগণ। অপ্রমত্ত, স্মৃতিমান এবং সুশীল হও; সুসমাহিত-সংকল্প হইয়া স্বচিত্তের পরিরক্ষণ কর; যিনি এই ধর্মবিনয়ে অপ্রমত্ত হইয়া বিহার করিবেন, তিনি জাতি-সংসার পরিহারপূর্বক দুঃখের বিনাশ সাধন করিবেন।”

তৃতীয় ভাণবার সমাপ্ত

চতুর্থ অধ্যায়

১৮৬. ভগবান পূর্বাহ্ণে পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর হস্তে বৈশালিতে পিণ্ডার্থ প্রবেশ করিলেন। ওই স্থানে ভ্রমণপূর্বক আহারান্তে প্রত্যাবর্তনকালে নাগভঙ্গীতে বৈশালির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, ইহাই তথাগতের সর্বশেষ বৈশালি দর্শন হইবে, এস আমরা ভণ্ডগ্রামে গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। তখন ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত ভণ্ডগ্রামে গমন করিলেন এবং গ্রামেই বাস গ্রহণ করিলেন।

ওই স্থানে ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

“ভিক্ষুগণ, চারি সত্যের সম্যক জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাবে আমার এবং তোমাদিগের দীর্ঘকাল সংসার ভ্রমণ হইয়াছে। ওই চারি সত্য কী কী? ভিক্ষুগণ, আর্য শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ও বিমুক্তির সম্যক জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাবে আমার এবং তোমাদিগের দীর্ঘকাল সংসার ভ্রমণ হইয়াছে। ওই আর্য শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ও বিমুক্তি সম্যকরূপে জ্ঞাত ও উপলব্ধ হইলে ভবতৃষ্ণা উচ্ছিন্ন হয়, পুনর্জন্মের মূল বিনষ্ট হয়, তখন আর জন্মান্তর নাই।”

ভগবান এইরূপ বলিলেন। পরে সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“অনুত্তর শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ও বিমুক্তি যশস্বী গৌতম কর্তৃক উপলব্ধ। স্বয়ং উপলব্ধি করিয়া বুদ্ধ উহা ভিক্ষুদিগের নিকট প্রচার করিয়াছেন। দুঃখান্তকারী, চক্ষুষ্মান শাস্তা শান্ত।”

ভণ্ডগ্রামে অবস্থানকালেও ভগবান ভিক্ষুগণকে বিস্তৃতরূপে ধর্মোপদেশ দিলেন : ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা; শীল পরিভাবিত সমাধি মহৎফলোৎপাদক, মহোপকারী; সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহৎ ফলোৎপাদক, মহোপকারী; প্রজ্ঞা পরিভাবিত চিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যাসব হইতে বিমুক্তি হয়।

ভগবান ভণ্ডগ্রামে যথেচ্ছা অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, এস, আমরা হস্তীগ্রামে… অম্বগ্রামে… জম্বুগ্রামে… ভোগ নগরে গমন করিব।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলে ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত ভোগ নগরে গমন করিলেন।

১৮৭. ভগবান ভোগনগরে আনন্দ চৈত্যে বাস গ্রহণ করিলেন। ওই স্থানে তিনি ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

“ভিক্ষুগণ, আমি তোমাদিগকে চারি মহাপ্রদেশ শিক্ষা দিব। শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো, আমি বলিতেছি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া ভিক্ষুগণ সম্মতি জ্ঞাপন করিলে ভগবান বলিলেন :

১৮৮. “ভিক্ষুগণ, কোনো ভিক্ষু বলিতে পারেন, “আমি স্বয়ং ভগবানের মুখ হইতে শ্রবণ করিয়াছি, তাঁহার মুখ হইতে গ্রহণ করিয়াছি : ইহা ধর্ম, ইহা বিনয়, ইহা শাস্তার শাসন।” ওই ভিক্ষুর বাক্যের অভিনন্দনও করিবে না, উহা অগ্রাহ্যও করিবে না। অভিনন্দন না করিয়া, অগ্রাহ্য না করিয়া ওই সকল পদ-ব্যঞ্জন উত্তমরূপে বুঝিয়া সূত্রসমূহের পার্শ্বে স্থাপিত করিবে এবং বিনয়ের সহিত উহাদের তুলনা করিবে। এইরূপ করিবার পর যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট না হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা কখনোই ভগবানের বচন নহে, ভিক্ষুই ভ্রান্ত।” অতএব, ভিক্ষুগণ, উহা অগ্রাহ্য করিবে। যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা নিশ্চিতরূপে ভগবানের বচন, ভিক্ষু সত্যই কহিয়াছেন।” ভিক্ষুগণ, ইহাই প্রথম মহা-প্রদেশরূপে গ্রহণ করিবে।”

“ভিক্ষুগণ, কোনো ভিক্ষু বলিতে পারেন, “অমুক আবাসে থের এবং প্রধানসহ সংঘ অবস্থান করিতেছেন। আমি সাক্ষাৎ সংঘের মুখ হইতে শ্রবণ এবং গ্রহণ করিয়াছি : ইহা ধর্ম, ইহা বিনয়, ইহা শাস্তার শাসন।” ওই ভিক্ষুর বাক্যের অভিনন্দনও করিবে না, উহা অগ্রাহ্যও করিবে না। অভিনন্দন না করিয়া, অগ্রাহ্য না করিয়া ওই সকল পদ-ব্যঞ্জন উত্তমরূপে বুঝিয়া সূত্রসমূহের পার্শ্বে স্থাপিত করিবে এবং বিনয়ের সহিত উহাদের তুলনা করিবে। এইরূপ করিবার পর যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট না হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা কখনোই ভগবানের বচন নহে, সংঘই ভ্রান্ত।” অতএব, ভিক্ষুগণ, উহা অগ্রাহ্য করিবে। যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা নিশ্চিতরূপে ভগবানের বচন, সংঘ সত্যই কহিয়াছেন।” ভিক্ষুগণ, ইহাই দ্বিতীয় মহা-প্রদেশরূপে গ্রহণ করিবে।”

“ভিক্ষুগণ কোনো ভিক্ষু বলিতে পারেন, “অমুক আবাসে বহুসংখ্যক থের ভিক্ষু অবস্থান করিতেছেন, তাঁহারা বহুশ্রুত, বুদ্ধশাসন-পারদর্শী, ধর্মধর, বিনয়ধর, মাতৃকাধর। আমি ওই সকল থেরগণের মুখ হইতে শ্রবণ এবং গ্রহণ করিয়াছি : ইহা ধর্ম, ইহা বিনয়, ইহা শাস্তার শাসন।” ওই ভিক্ষুর বাক্যের অভিনন্দনও করিবে না, উহা অগ্রাহ্যও করিবে না। অভিনন্দন না করিয়া, অগ্রাহ্য না করিয়া ওই সকল পদ-ব্যঞ্জন উত্তমরূপে বুঝিয়া সূত্রসমূহের পার্শ্বে স্থাপিত করিবে এবং বিনয়ের সহিত উহাদের তুলনা করিবে। এইরূপ করিবার পর যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট না হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা কখনোই ভগবানের বচন নহে, থেরগণ ভ্রান্ত।” সুতরাং, ভিক্ষুগণ, উহা অগ্রাহ্য করিবে। যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা নিশ্চিতরূপে ভগবানের বচন, থেরগণ সত্যই কহিয়াছেন।” ভিক্ষুগণ, ইহাই তৃতীয় মহা-প্রদেশরূপে গ্রহণ করিবে।

“ভিক্ষুগণ, কোনো ভিক্ষু বলিতে পারেন, “অমুক আবাসে এক থের ভিক্ষু অবস্থান করিতেছেন, তিনি বহুশ্রুত, বুদ্ধশাসন পারদর্শী, ধর্মধর, বিনয়ধর, মাতৃকাধর। আমি সেই থের ভিক্ষুর মুখ হইতে শ্রবণ ও গ্রহণ করিয়াছি : ইহা ধর্ম, ইহা বিনয়, ইহা শাস্তার শাসন।” ভিক্ষুগণ, ওই ভিক্ষুর বাক্যের অভিনন্দনও করিবে না, উহা অগ্রাহ্যও করিবে না। অভিনন্দন ও অগ্রাহ্য না করিয়া ওই সকল পদ-ব্যঞ্জন উত্তমরূপে বুঝিয়া সূত্রসমূহের পার্শ্বে স্থাপিত করিবে এবং বিনয়ের সহিত উহাদের তুলনা করিবে। এইরূপ করিবার পর যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সামঞ্জস্য দৃষ্ট না হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা কখনোই ভগবানের বচন নহে, ভিক্ষুই ভ্রান্ত।” সুতরাং, ভিক্ষুগণ, উহা অগ্রাহ্য করিবে। যদি সূত্র ও বিনয়ের সহিত উহাদের সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়, তাহা হইলে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, “ইহা নিশ্চিতরূপে ভগবানের বচন, থের সত্যই কহিয়াছেন।” ভিক্ষুগণ, ইহাই চতুর্থ মহা-প্রদেশরূপে গ্রহণ করিবে।

“ভিক্ষুগণ, এই সকলই চারি মহা-প্রদেশ।”

ওই স্থানেও ভোগনগরে আনন্দ চৈত্যে অবস্থান করিবার কালে ভগবান বিস্তৃতভাবে ভিক্ষুগণকে ধর্মোপদেশ দিলেন, ইহা শীল, ইহা সমাধি, ইহা প্রজ্ঞা; শীলপরিভাবিত সমাধি মহাফলোৎপাদক, মহোপকারী, সমাধি পরিভাবিত প্রজ্ঞা মহাফলোৎপাদক, মহোপকারী, প্রজ্ঞা পরিভাবিত চিত্ত সম্যকরূপে আসবসমূহ হইতে; যথা : কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি-আসব এবং অবিদ্যাসব হইতে মুক্ত হয়।

১৮৯. অতঃপর ভগবান ভোগনগরে যতদিন ইচ্ছা অবস্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “এসো, আনন্দ, আমরা পাবায় গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

তৎপরে ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত পাবায় গমন করিলেন। ওই স্থানে তিনি কর্মকার চুন্দের আম্রবনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

কর্মকার পুত্র চুন্দ শ্রবণ করিল, “ভগবান পাবাতে উপনীত হইয়া আমার আম্রবনে অবস্থান করিতেছেন।” তখন কর্মকারপুত্র চুন্দ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলে ভগবান তাহাকে ধর্মালোচনার দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উত্তেজিত এবং হর্ষান্বিত করিলেন।

তৎপরে কর্মকারপুত্র চুন্দ ভগবান কর্তৃক ধর্মালোচনার দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উত্তেজিত এবং হর্ষান্বিত হইয়া ভগবানকে বলিল, “ভগবান অনুগ্রহপূর্বক আগামীকল্য ভিক্ষুসংঘের সহিত আমার গৃহে আহার গ্রহণ করিবেন।” ভগবান মৌন দ্বারা সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

অনন্তর কর্মকারপুত্র চুন্দ ভগবানের সম্মতি অবগত হইয়া আসন হইতে উত্থানপূর্বক ভগবানকে অভিবাদন এবং প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিল।

কর্মকারপুত্র চুন্দ রাত্রির অবসানে স্বকীয় আবাসে বহুবিধ উৎকৃষ্ট খাদ্য ও ভোজ্য প্রভূত পরিমাণে শূকরকন্দণ্ডপাকের সহিত প্রস্তুত করাইয়া ভগবানের নিকট সংবাদ প্রেরণ করিল, “দেব, সময় হইয়াছে, আহার প্রস্তুত।”

তখন ভগবান পূর্বাহ্নে পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া পাত্র ও চীবর হস্তে ভিক্ষুসংঘের সহিত কর্মকারপুত্র চুন্দের বাসস্থানে গমনপূর্বক নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিয়া চুন্দকে বলিলেন, “তুমি যে শূকরকন্দণ্ডপাক প্রস্তুত করিয়াছ, তাহা আমাকে পরিবেশন করো, অপর খাদ্য ও ভোজ্য ভিক্ষুসংঘকে পরিবেশন করো।”

“দেব, তথাস্তু,” বলিয়া চুন্দ ভগবানকে প্রতিশ্রুতি দিয়া শূকরকন্দণ্ডপাক ভগবানকে পরিবেশন করিল এবং অপরাপর খাদ্য ও ভোজ্য ভিক্ষুসংঘকে পরিবেশন করিল।

তৎপরে ভগবান চুন্দকে বলিলেন, “চুন্দ, অবশিষ্ট শূকরকন্দণ্ডপাক মৃত্তিকার নিম্নে প্রোথিত করো। দেবলোকসহ পৃথিবীতে, মারলোকে, ব্রহ্মলোকে, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অথবা দেব-মনুষ্যের মধ্যে তথাগত ব্যতীত আমি এমন কাহাকেও দেখিতেছি না যে উহা আহার করিয়া জীর্ণ করিতে পারে।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া চুন্দ অবশিষ্ট শূকরকন্দণ্ডপাক মৃত্তিকার নিম্নে প্রোথিত করিয়া ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইল। তখন ভগবান তাহাকে ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উত্তেজিত এবং হর্ষান্বিত করিয়া আসন হইতে উত্থানপূর্বক প্রস্থান করিলেন।

১৯০. কর্মকার চুন্দ কর্তৃক প্রস্তুত খাদ্য গ্রহণ করিয়া ভগবান রক্তামাশয়রূপ ভীষণ রোগে আক্রান্ত হইলেন, মারাত্মক তীব্র যাতনা তাঁহাকে ক্লিষ্ট করিল। কিন্তু তিনি স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞানসহকারে নীরবে উহা সহ্য করিলেন।

তদনন্তর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, চল, আমরা কুশিনারায় গমন করি।” “দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

আমি এইরূপ শুনিয়াছি, কর্মকার চুন্দের আহার গ্রহণ করিয়া ভগবান ভীষণ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হইলেন। শূকরকন্দণ্ডপাক ভোজন করিয়া শাস্তার প্রবল ব্যাধি উৎপন্ন হইল; বিরেচনান্তে ভগবান বলিলেন “আমি কুশিনারা নগরে গমন করিতেছি।”

১৯১. ভগবান পথের পার্শ্বস্থ এক বৃক্ষতলে গমন করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে কাতরতার সহিত বলিলেন, “আনন্দ, আমার অঙ্গবস্ত্র চারি পাট করিয়া বিস্তৃত কর; আনন্দ, আমি ক্লান্ত, বিশ্রাম লাভার্থী।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক আনন্দ ভগবানের নিমিত্ত চতুর্গুণ করিয়া অঙ্গবস্ত্র বিস্তৃত করিলেন।

ভগবান নির্দিষ্ট আসনে উপবেশনপূর্বক পূজ্যপাদ আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আনন্দ, পানীয় সংগ্রহ করো, আমি পিপাসিত, পানেচ্ছু।”

ভগবান এইরূপ কহিলে আনন্দ তাঁহাকে বলিলেন, “দেব, এইমাত্র পঞ্চশত শকট এই স্থান দিয়া গমন করিয়াছে, চক্রচ্ছিন্ন জল প্ররিক্ত, আলোড়িত, আবিল হইয়া বহিতেছে। অদূরে ককুত্থা নদী, স্বচ্ছ প্রীতিকর, শীতল, শুভ্র, সুপ্রতীর্থ, রমণীয়। এই স্থানে ভগবান পানীয় গ্রহণ করিবেন, গাত্রও শীতল করিবেন।”

দ্বিতীয়বার ভগবান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, পানীয় সংগ্রহ করো, আমি পিপাসিত, পানেচ্ছু।”

দ্বিতীয়বার আনন্দ ভগবানকে পূর্বের ন্যায় উত্তর দিলেন [দেব, এইমাত্র পঞ্চশত শকট এই স্থান দিয়া গমন করিয়াছে, চক্রচ্ছিন্ন জল প্ররিক্ত, আলোড়িত, আবিল হইয়া বহিতেছে। অদূরে ককুত্থা নদী স্বচ্ছ প্রীতিকর, শীতল, শুভ্র, সুপ্রতীর্থ, রমণীয়। এই স্থানে ভগবান পানীয় গ্রহণ করিবেন, গাত্র ও শীতল করিবেন]।

তৃতীয়বার ভগবান আনন্দকে পূর্বের ন্যায় অনুরোধ করিলেন।

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ ভগবানের নিকট অঙ্গীকৃত হইয়া পাত্র হস্তে উপর্যুক্ত নদীতে গমন করিলেন। তখন শকট চক্রালোড়িত কর্দমাক্ত ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী, আনন্দ তৎসন্নিকটে আগমন করিলে, স্বচ্ছ উজ্জ্বল ও সর্বপ্রকার মালিন্য বর্জিত হইয়া বহিতে লাগিল।

অতঃপর আয়ুষ্মান আনন্দের মনে এই চিন্তার উদয় হইল, “আশ্চর্য! অদ্ভুত, তথাগতের পরাক্রম ও শক্তি! চক্রচ্ছিন্ন, স্বল্পোদক, আলোড়িত, আবিল এই স্রোতস্বিনী আমার আগমন মাত্র স্বচ্ছ, উজ্জ্বল ও অনাবিল হইয়া বহিতেছে!” পাত্রে পানীয় সংগ্রহ করিয়া আনন্দ ভগবানের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলিলেন :

“দেব, আশ্চর্য! অদ্ভুত, তথাগতের পরাক্রম ও শক্তি! দেব এইমাত্র সেই নদী চক্রচ্ছিন্ন, প্ররিক্ত, আলোড়িত, আবিল হইয়া বহিতেছিল, কিন্তু আমার ওই স্থানে গমনমাত্র স্রোতস্বিনী স্বচ্ছ, উজ্জ্বল ও অনাবিল হইয়া বহিতেছে! ভগবান পানীয় গ্রহণ করুন, সুগত পানীয় গ্রহণ করুন।”

তখন ভগবান পানীয় গ্রহণ করিলেন।

১৯২. ওই সময় আঢ়ার কালামের শিষ্য মল্লপুত্র পক্কুস কুশিনারা হইতে রাজপথ ধরিয়া পাবায় গমন করিতেছিল।

পক্কুস ভগবানকে এক বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট দেখিয়া তাঁহার সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইল। পরে সে ভগবানকে বলিল :

দেব, আশ্চর্য! অদ্ভুত! যাঁহারা প্রব্রজিত তাঁহাদের জীবন সত্যই শান্তিময়!

“দেব, পূর্বে একসময় আঢ়ার কালাম রাজপথ দিয়া চলিতে চলিতে, পথ হইতে সরিয়া দিবাবিহারের নিমিত্ত নিকটস্থ এক বৃক্ষমূলে উপবেশন করিলেন। ওই সময় পঞ্চশত শকট একে একে তাঁহার নিকট দিয়া গমন করিল। তখন এক পুরুষ সেই শকট-সার্থের পশ্চাত হইতে আগমন করিয়া আঢ়ার কালামের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলিল :

“দেব, পাঁচশত শকটকে যাইতে দেখিয়াছেন কি?”

“আমি দেখি নাই।”

“উহাদের শব্দ শুনিয়াছেন কি?”

“আমি শুনি নাই।”

“আপনি কি নিদ্রিত ছিলেন?”

“আমি নিদ্রিত ছিলাম না।”

“আপনার কি সংজ্ঞা ছিল?”

“ছিল।”

“দেব, আপনি সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত থাকিয়াও পাঁচশত শকটের একে একে নিকট দিয়া গমন দর্শন করেন নাই, উহাদের শব্দও শ্রবণ করেন নাই, অথচ আপনার অঙ্গবস্ত্র পর্যন্ত রজোকীর্ণ হইয়াছে।”

“তাহা সত্য।”

“দেব, তখন সেই পুরুষের মনে এই চিন্তার উদয় হইল, “আশ্চর্য! অদ্ভুত! যাঁহারা প্রব্রজিত তাঁহাদের জীবন সত্যই শান্তিময়। যেহেতু মানুষ সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত থাকিয়াও পাঁচশত শকটের একে একে নিকট দিয়া গমন দর্শনও করে নাই, তাহাদের শব্দও শ্রবণ করে নাই।” আঢ়ার কালামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া সে প্রস্থান করিল।”

১৯৩. “পক্কুস, তুমি কি মনে কর? কোনটি অধিকতর দুষ্কর অথবা দুরভিভব, মানুষের পক্ষে সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত হইয়াও পাঁচশত শকট একে একে নিকট দিয়া গমন করিলেও উহা দেখিতেও না পাওয়া এবং উহার শব্দও শুনিতে না পাওয়া; অথবা সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত হইয়াও বারিবর্ষণে, মেঘ গর্জনে, বিদ্যুতের স্ফুরণে, অশনিপাতে দেখিতে না পাওয়া এবং উহার শব্দও শুনিতে না পাওয়া?”

“দেব, ওই সকল শকট পাঁচশত অথবা ছয়, সাত, আট, নয়, দশ শত, শত শত এবং সহস্র সহস্র শকট কী করিবে? কিন্তু মানুষের পক্ষে সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত হইয়াও বারিবর্ষণে, মেঘ গর্জনে, বিদ্যুতের স্ফুরণে, অশনিপাতে দেখিতে না পাওয়া এবং উহার শব্দও শুনিতে না পাওয়া, ইহাই অধিকতর দুষ্কর এবং দুরভিভব।

“পক্কুস, একসময় আমি আতুমায় ভুষাগারে অবস্থান করিতেছিলাম। ওই সময় বারিবর্ষণে, মেঘ গর্জনে, বিদ্যুতের স্ফুরণে, অশনি পাতে দুই কৃষক ভ্রাতা এবং চারিটি বলিবর্দ হত হইয়াছিল। তখন আতুমা হইতে মহা জনতা নিষ্ক্রান্ত হইয়া কৃষক ভ্রাতাদ্বয় এবং চারি বলিবর্দ যে স্থানে হত হইয়াছিল ওই স্থানে গমন করিল।

“পুক্কুস, ওই সময় আমি ভুষাগার হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া উহার দ্বারদেশে উন্মুক্ত স্থানে বিচরণ করিতেছিলাম। পুক্কুস, মহা জনতা হইতে জনৈক ব্যক্তি আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইল। তখন আমি তাহাকে বলিলাম :

“আবুস, এই বৃহৎ জনতার কারণ কী?”

“দেব, এই মাত্র বৃষ্টিপাতে, মেঘ গর্জনে, বিদ্যুতের স্ফুরণে, অশনিপাতে দুই কৃষক ভ্রাতা এবং চারি বলিবর্দ হত হইয়াছে। এই জন্যই এই বৃহৎ জনতার সন্নিপাত হইয়াছে। কিন্তু, দেব, আপনি কোথায় ছিলেন?”

“আমি এই স্থানেই ছিলাম।”

“কিন্তু, দেব, আপনি উহা দেখিয়াছেন কি?”

“আমি দেখি নাই।”

“শব্দ শুনিয়াছেন কি?”

“আমি শব্দ শুনি নাই।”

“দেব, তবে কি আপনি নিদ্রিত ছিলেন?”

“আমি নিদ্রিত ছিলাম না।”

“আপনার সংজ্ঞা ছিল কি?”

“ছিল।”

“তাহা হইলে, দেব, আপনি সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত হইয়াও বৃষ্টিপাত, মেঘগর্জন, বিদ্যুতের স্ফুরণ এবং অশনিপাত দেখিতেও পান নাই এবং উহার শব্দও শুনিতে পান নাই।”

“তাহা সত্য।”

“পুক্কুস, তখন সেই পুরুষের মনে এই চিন্তার উদয় হইল, “আশ্চর্য! অদ্ভুত! যাঁহারা প্রব্রজিত তাঁহাদের জীবন সত্যই শান্তিময়! যেহেতু মানুষ সংজ্ঞাসম্পন্ন এবং জাগরিত থাকিয়াও বৃষ্টিপাত, মেঘগর্জন, বিদ্যুতের স্ফুরণ, অশনিপাত দেখিতেও পায় না এবং উহার শব্দও শুনিতে পায় না।” সে আমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনপূর্বক আমাকে অভিবাদন এবং প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিল।”

ভগবানের এই উক্তির পর মল্লপুত্র পুক্কুস তাঁহাকে বলিল :

“দেব, আঢ়ার কালামের প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা ছিল তাহা তুষের ন্যায় বাতাসে উড়াইয়া দিতেছি, খরস্রোত নদীতে ভাসাইয়া দিতেছি। অতি উত্তম, দেব, অতি উত্তম! যেরূপ উৎপাতিতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, লুক্কায়িত প্রকাশিত হয়, মূঢ় পথ প্রদর্শিত হয়, চক্ষুষ্মানের দেখিবার নিমিত্ত অন্ধকারে তৈলদীপ ধৃত হয়, সেইরূপ ভগবান অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশিত করিয়াছেন। আমি ভগবানের, ধর্মের এবং ভিক্ষুসংঘের শরণ লইতেছি। ভগবান আজ হইতে জীবনের অন্তকাল পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে গ্রহণ করুন।”

১৯৪. অতঃপর পুক্কুস জনৈক পুরুষকে বলিল, “স্বর্ণবর্ণ বস্ত্র নির্মিত পরিধানোপযোগী মৃষ্ট দুইটি পরিচ্ছদ আমাকে আনিয়া দাও।”

“তথাস্তু দেব” বলিয়া পুরুষটি আদেশানুরূপ বস্ত্র লইয়া আসিল।

তখন মল্লপুত্র পুক্কুস পরিচ্ছদ দুইটি ভগবানকে উপহার দিয়া বলিল, “দেব, বস্ত্র দুইখানি ভগবান কৃপা করিয়া আমার নিকট হইতে গ্রহণ করুন।”

তাহা হইলে, পুক্কুস, একখানি দ্বারা আমাকে আচ্ছাদিত করো, অপরখানি দ্বারা আনন্দকে।

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া পুক্কুস একখানি দ্বারা ভগবানকে এবং অপরখানি দ্বারা আয়ুষ্মান আনন্দকে আচ্ছাদিত করিল।

অনন্তর ভগবান মল্লপুত্র পুক্কুসকে ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত উত্তেজিত এবং হর্ষান্বিত করিলেন। তখন পুক্কুস ভগবান কর্তৃক ধর্মালোচনা দ্বারা উপদিষ্ট, উদ্দীপিত, উত্তেজিত এবং হর্ষান্বিত হইয়া আসন হইতে উত্থানপূর্বক ভগবানকে অভিবাদন এবং প্রদক্ষিণপূর্বক প্রস্থান করিল।

১৯৫. পুক্কুস প্রস্থান করিবার অল্পকাল পরে আয়ুষ্মান আনন্দ পূর্বোক্ত পরিচ্ছদ দুইটি ভগবানের দেহে স্থাপিত করিলেন। ভগবানের দেহে স্থাপিত পরিচ্ছদ হৃতৌজ্জ্বল্যরূপে প্রতীয়মান হইল।

তখন আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে বলিলেন, “দেব, আশ্চর্য! অদ্ভুত! ভগবানের দেহবর্ণ কতই পরিশুদ্ধ, কতই পর্যবদাত! এই স্বর্ণবর্ণ, মৃষ্ট, পরিধানোপযোগী বস্ত্র ভগবানের দেহে স্থাপিত করিলাম, অমনি উহা নিষ্প্রভ প্রতীয়মান হইল!”

“আনন্দ, ইহা সত্য। আনন্দ, দুইটি সময়ে তথাগতের দেববর্ণ অতীব পরিশুদ্ধ, পর্যবদাত হয়। কোন কোন সময়ে? আনন্দ, যে রাত্রিতে তথাগত চরম দিব্যদৃষ্টি লাভ করেন সেই রাত্রে, এবং যে রাত্রিতে তাঁহার চরম অন্তর্ধান হয়, যে অন্তর্ধানে তাঁহার পার্থিব-জীবনের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না সেই রাত্রে। আনন্দ, এই দুইটি সময়ে তথাগতের দেহবর্ণ অতীব পরিশুদ্ধ ও পর্যবদাত হয়।”

“আনন্দ, অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে কুশিনারায় মল্লগণের উপবর্তন নামক শালবনে যুগ্ম শালতরুর অন্তরে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে। আনন্দ, চল, আমরা ককুত্থা নদীতে গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

পুক্কুস আহৃত স্বর্ণবর্ণ মৃষ্ট বসনে
আচ্ছাদিত হইয়া শাস্তা হেমবর্ণ
হইয়া শোভা পাইলেন।

১৯৬. তদনন্তর ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত কুকত্থা নদীতে গমন করিলেন। নদীতে অবগাহন ও স্নান করিয়া পানান্তে উত্তরণপূর্বক ভগবান আম্রবনে গমন করিলেন এবং আয়ুষ্মান চুন্দককে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :

“চুন্দক, অঙ্গবস্ত্র চতুর্গুণ করিয়া বিস্তৃত করো, আমি ক্লান্ত ও শয়নেচ্ছু।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আয়ুষ্মান চুন্দক চতুর্গুণ করিয়া অঙ্গবস্ত্র বিস্তৃত করিলেন।

তখন ভগবান স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইয়া উত্থান-সংজ্ঞা মনস্থ করিয়া পাদোপরি পাদ রক্ষাপূর্বক দক্ষিণ পার্শ্বোপরি সিংহশয্যা আশ্রয় করিলেন। আয়ুষ্মান চুন্দক সেই স্থানেই ভগবানের সম্মুখে উপবেশন করিলেন।

জগতে অতুলনীয় শাস্তা তথাগত বুদ্ধ স্বচ্ছ, মনোরম,
নির্মল সলিলা ককুত্থা নদীতে গমনপূর্বক ক্লান্ত
দেহে অবগাহন করিলেন। শাস্তা স্নান ও পানান্তে
ভিক্ষুগণ পরিবেষ্টিত হইয়া উত্তরণ করিলেন।
শাস্তা, ধর্ম প্রবক্তা, ভগবান মহর্ষি আম্রকুঞ্জে
উপনীত হইয়া ভিক্ষু চুন্দককে সম্বোধন করিয়া
বলিলেন, “চতুর্গুণ করিয়া অঙ্গবস্ত্র বিস্তৃত করো,
আমি শয়ন করিব।” ভাবিতাত্মা হইতে
প্রেরণাপ্রাপ্ত চুন্দ তৎক্ষণাৎ চতুর্গুণ করিয়া
বস্ত্র বিস্তৃত করিলেন। ক্লান্ত দেহে শাস্তা-শয়ন
করিলেন, চুন্দও সেইস্থানে তাঁহার সম্মুখে
উপবেশন করিলেন।

১৯৭. তখন ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে সম্বোধন করিলেন, “আনন্দ, কেহ কর্মকারপুত্র চুন্দকে এইরূপ কহিয়া তাহার হৃদয়ে অনুতাপ আনয়ন করিতে পারে, “চুন্দ, তথাগত যে তোমার নিকট শেষ আহার গ্রহণ করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছেন, ইহা তোমার অমঙ্গলকর, হানিকর।” আনন্দ, চুন্দের অনুশোচনা এইরূপে দূর করিতে হইবে :

“চুন্দ, তথাগত যে তোমার নিকট শেষ অন্ন গ্রহণ করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছেন, তাহা তোমার মঙ্গলকর এবং লাভজনক। আমি স্বয়ং ভগবানের মুখ হইতে এইরূপ শ্রবণ এবং গ্রহণ করিয়াছি, “এই দুই প্রকার আহারদান সমফলপ্রদায়ী; সমবিপাকান্ত এবং অপরাপর দান অপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রদায়ী ও উপকারক। ওই দুই প্রকার কী কী? বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির কালে তথাগত যে আহার গ্রহণ করেন তাহা এবং তাঁহার অন্তর্ধানকালে যে চরম অন্তর্ধানে তাঁহার পার্থিব জীবনের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তিনি যে আহার গ্রহণ করেন তাহা, এই দুই দান সমফলপ্রদায়ী, সমবিপাকান্ত এবং অপরাপর দান অপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রদায়ী ও উপকারক। কর্মকার চুন্দের কৃত কর্ম দীর্ঘ জীবন, উচ্চ জন্ম, সৌভাগ্য, সুযশ, স্বর্গপ্রাপ্তি এবং বৃহৎ ক্ষমতায় পর্যবসিত হইবে।”

“আনন্দ, কর্মকারপুত্র চুন্দের অনুশোচনা এইরূপে শান্ত করিতে হইবে।”

অতঃপর ভগবান তৎকালীন পরিস্থিতি বিদিত হইয়া সেই ক্ষণে এই উদান ব্যক্ত করিলেন :

দানকারীর পুণ্য বর্ধিত হয়, সংযমকারীর
হৃদয়ে দ্বেষের উৎপত্তি হয় না,
সজ্জন পাপ পরিহার করেন,
রাগ-দ্বেষ-মোহের ক্ষয় হেতু তিনি নির্বৃত।

চতুর্থ ভাণবার সমাপ্ত

পঞ্চম অধ্যায়

১৯৮. অনন্তর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে সম্বোধন করিলেন, “আনন্দ, চল আমরা হিরণ্যবতী নদীর অপরপার্শ্বস্থিত কুশিনারার উপবর্তন মল্লদিগের শালবনে গমন করি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

তখন ভগবান বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত উক্ত শালবনে গমনপূর্বক আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, যুগ্ম শালতরুর মধ্যবর্তী স্থানে উত্তর দিকে মস্তক রক্ষা করিয়া আমার শয্যা প্রস্তুত করো। আনন্দ, আমি ক্লান্ত ও শয়নেচ্ছু।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক যমক শালতরুর মধ্যবর্তী স্থানে আনন্দ উত্তর-শীর্য শয্যা প্রস্তুত করিলেন। তখন ভগবান স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হইয়া পাদোপরি পাদ রক্ষাপূর্বক দক্ষিণ পার্শ্বোপরি সিংহশয্যা আশ্রয় করিলেন।

ওই সময় যুগ্ম শালতরু মুকুলিত হইয়া অকালে পুষ্পে শোভিত হইয়াছিল। পুষ্প সকল তথাগতের পূজার নিমিত্ত তাঁহার দেহোপরি পতিত ও বিক্ষিপ্ত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিয়াছিল। অন্তরীক্ষ হইতে দিব্য মন্দার পুষ্পসমূহ তথাগতের পূজার নিমিত্ত তাঁহার দেহোপরি পতিত ও বিক্ষিপ্ত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিল। অন্তরীক্ষ হইতে দিব্য চন্দন চূর্ণ পতিত হইল, উহারাও তথাগতের পূজার নিমিত্ত তাঁহার দেহোপরি পতিত ও বিক্ষিপ্ত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিল। অন্তরীক্ষ হইতে তথাগতের পূজার নিমিত্ত দিব্য তূর্যধ্বনি হইতে লাগিল। তথাগতের পূজার নিমিত্ত অন্তরীক্ষে দিব্য সঙ্গীত গীত হইল।

১৯৯. তখন ভগবান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, অকাল পুষ্প শোভিত যুগ্ম শালতরু হইতে পুষ্পসকল তথাগতের পূজার নিমিত্ত তাঁহার দেহোপরি পতিত ও বিক্ষিপ্ত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিয়াছে। অন্তরীক্ষ হইতে দিব্য মন্দার পুষ্পসমূহ তথাগতের পূজার নিমিত্ত তাঁহার দেহোপরি পতিত ও বিক্ষিপ্ত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিয়াছে। অন্তরীক্ষ হইতে দিব্য চন্দনচূর্ণ তথাগতের পূজার নিমিত্ত তাঁহার দেহোপরি পতিত ও বিক্ষিপ্ত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিয়াছে। অন্তরীক্ষ হইতে তথাগতের পূজার নিমিত্ত দিব্য তূর্যধ্বনি শ্রুত হইতেছে। তথাগতের পূজার নিমিত্ত অন্তরীক্ষে দিব্য সঙ্গীত গীত হইতেছে।”

“আনন্দ, কেবল মাত্র এইরূপ ঘটনা দ্বারা তথাগতকে যথার্থরূপে সম্মান, শ্রদ্ধা ও পূজা করা হয় না। যে ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী, ধর্মনিষ্ঠ নর বা নারী, উপদেশাবলী অনুসারে বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্যসমূহকে অবিরত পালন করেন, তাঁহারাই যথার্থরূপে তথাগতকে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন, তাঁহারাই তথাগতকে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত অর্ঘ্য দান করেন। অতএব, আনন্দ, অবিচ্ছিন্নভাবে বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর কর্তব্য পালনে রত হও। উপদেশাবলির অনুশরণ কর; এইরূপ করিলে তোমরা বুদ্ধের সম্মান করিবে।”

২০০. ওই সময় আয়ুষ্মান উপবাণ ভগবানের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহাকে ব্যজনে রত ছিলেন। ভগবান উপবাণের প্রতি বিরক্ত প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “ভিক্ষু, স্থানান্তরে গমন করো, আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইও না।”

তখন আনন্দের মনে এইরূপ হইল, “আয়ুষ্মান উপবাণ বহুদিন হইতে ভগবানের সমীপে অবস্থান করিয়া পার্শ্বচররূপে ভগবানের সেবা করিয়াছেন, অথচ অন্তিমকালে ভগবান উপবাণের প্রতি বিরক্তি হইয়া তাঁহাকে বলিলেন, “ভিক্ষু, স্থানান্তরে গমন করো, আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইও না। উপবাণের প্রতি ভগবানের এইরূপ বিরক্তির কী হেতু, কী প্রত্যয়?”

অনন্তর আনন্দ ভগবানকে বলিলেন, “দেব, আয়ুষ্মান উপবান বহুদিন হইতে ভগবানের সমীপে অবস্থান করিয়া পার্শ্বচররূপে ভগবানের সেবা করিয়াছেন, অথচ অন্তিমকালে ভগবান উপবানের প্রতি বিরক্ত হইয়া বলিলেন :

“ভিক্ষু, স্থানান্তরে গমন করো, আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইও না।” দেব, ইহার কী হেতু, কী প্রত্যয়?

“আনন্দ, দশ লোকধাতু হইতে বহুসংখ্যক দেবতা তথাগতের দর্শনার্থ সন্নিপতিত হইয়াছেন। আনন্দ, কুশিনারার উপবর্তন মল্লদিগের শালবনের চতুর্দিকস্থ দ্বাদশ যোজনব্যাপী ভূমির মধ্যে কেশাগ্র পরিমিত এমন স্থানও নাই যেখানে মহেশাখ্য দেবতাগণের আগমন হয় নাই। আনন্দ, দেবতাগণ অসন্তোষ প্রকাশ করিতেছেন, “তথাগতের দর্শনার্থ আমরা দূর হইতে আসিয়াছি। যাঁহারা তথাগত, অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, কদাচিৎ পৃথিবীতে তাঁহাদের উৎপত্তি হয়; অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে, তথাপি এই মহেশাখ্য ভিক্ষু ভগবানের সম্মুখে স্থিত হইয়া তাঁহার দর্শন রোধ করিতেছেন, আমরা অন্তিমকালে তথাগতের দর্শন লাভ করিতে সমর্থ হইতেছি না।” আনন্দ, দেবতাগণ এইরূপে অসন্তোষ প্রকাশ করিতেছেন।”

২০১. “ভগবান কী প্রকার দেবতার কথা মনে করিতেছেন?”

আনন্দ, আকাশে পৃথিবী-সংজ্ঞী দেবতাগণ আছেন, তাঁহারা আলুলায়িত কেশে ক্রন্দন করিতেছেন, প্রসারিত বাহু হইয়া ক্রন্দন করিতেছেন, সাষ্টাঙ্গে পতিত ও অবলুন্ঠিত হইয়া বিলাপ করিতেছেন : “অতি শীঘ্র ভগবান পরিনির্বাণে প্রবেশ করিবেন, অতি শীঘ্র সুগত পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইবেন, অতি শীঘ্র জগতের আলোক নির্বাপিত হইবে!”

আনন্দ, পৃথিবীতে দেবতাগণ আছেন, তাঁহারা পৃথিবী-সংজ্ঞী, তাঁহারা আলুলায়িত কেশ এবং প্রসারিত বাহু হইয়া ক্রন্দন করিতেছেন, তাঁহারা সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে পতিত ও অবলুন্ঠিত হইয়া বিলাপ করিতেছেন, অতি শীঘ্র ভগবান সুগত পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইবেন, অতি শীঘ্র জগতের আলোক নির্বাপিত হইবে!” যে সকল দেবতা বীতরাগ ও স্মৃতিসম্প্রজ্ঞান সমন্বিত, তাঁহারা “সর্বসংস্কার অনিত্য, ইহার অন্যথা কী প্রকারে সম্ভব?” চিন্তা করিয়া শান্ত রহিয়াছেন।”

২০২. “দেব, পূর্বে বর্ষাবাসান্তে চতুর্দিকস্থ ভিক্ষুগণ তথাগতের দর্শনার্থ আগমন করিতেন, আমরা ওই সকল মাননীয় ভিক্ষুগণের দর্শন পাইতাম, তাঁহাদের পূজা করিবার অবসর পাইতাম। ভগবানের অবর্তমানে, আমরা ওই সকল ভিক্ষুর দর্শনও পাইব না, তাঁহাদের পূজা করিবারও অবসর পাইব না।”

আনন্দ, শ্রদ্ধাবান কুলপুত্রগণের জন্য চারিটি দর্শনীয় সংবেগোৎপাদক স্থান আছে। ওই চারিটি কী কী?

“এইস্থানে তথাগত জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন,” এইস্থান শ্রদ্ধাবান কুলপুত্রগণের পক্ষে দর্শনীয়, সংবেগোৎপাদক।

“এইস্থানে তথাগত অনুত্তর সম্যক সম্বোধি লাভ করিয়াছিলেন,” এইস্থান শ্রদ্ধাবান কুলপুত্রগণের পক্ষে দর্শনীয়, সংবেগোৎপাদক।

“এইস্থানে তথাগত কর্তৃক অনুত্তর ধর্মচক্র প্রবর্তিত হইয়াছিল,” এই স্থান শ্রদ্ধাবান কুলপুত্রগণের পক্ষে দর্শনীয়, সংবেগোৎপাদক।

“এইস্থানে তথাগত অনুপাদিশেষ, নির্বাণ ধাতুতে পরিনির্বৃত হইয়াছিলেন,” এইস্থান শ্রদ্ধাবান কুলপুত্রগণের পক্ষে দর্শনীয়, সংবেগোৎপাদক।

আনন্দ, এই চারিটি স্থান শ্রদ্ধাবান কুলপুত্রগণের পক্ষে দর্শনীয়, সংবেগোৎপাদক। আনন্দ, শ্রদ্ধাসম্পন্ন ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ, উপাসক-উপাসিকাগণ আসিবেন, তাঁহারা বলিবেন “এইস্থানে তথাগত জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন”, অথবা “এইস্থানে তথাগত সম্যক সম্বোধি লাভ করিয়াছিলেন, অথবা “এইস্থানে তথাগত কর্তৃক অনুত্তর ধর্মচক্র প্রবর্তিত হইয়াছিল” অথবা “এইস্থানে তথাগত অনুপাদিশেষ নির্বাণ ধাতুতে পরিনির্বৃত হইয়াছিলেন”।

“আনন্দ, তীর্থ ভ্রমণকালে যাঁহারা প্রসন্ন চিত্তে দেহত্যাগ করিবেন, তাঁহারা সকলেই মরণান্তে দেহের বিনাশে সুখময় স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবেন।”

২০৩. “দেব, নারীগণের প্রতি আমরা কীরূপ আচরণ করিব?”

“তাহাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিও না।”

“যদি তাহারা দৃষ্টিপথে পতিত হয়, তাহা হইলে কীরূপ আচরণ কর্তব্য?”

“তাহাদের সহিত বাক্যালাপ করিও না।”

“বাক্যালাপ অপরিহার্য হইলে কীরূপ আচরণ কর্তব্য?”

“স্মৃতি উপস্থাপিত করিতে হইবে।”

২০৪. “তথাগতের দেহ সম্বন্ধে আমাদের কর্তব্য কী?”

“আনন্দ, তোমরা তথাগতের শরীর পূজায় ব্যাপৃত হইও না, সদর্থে প্রযুক্ত হও, সদর্থের অনুসরণ করো, সদর্থে অপ্রমত্ত হও, দৃঢ়সংকল্প হও। আনন্দ, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিদিগের মধ্যে পণ্ডিতগণ আছেন, তাঁহারা তথাগতের প্রতি অতি প্রসন্নচিত্ত; তাঁহারা তথাগতের শরীর পূজা করিবেন।

২০৫. “কিন্তু, দেব, তথাগতের শরীরের সম্বন্ধে কী কর্তব্য?”

“আনন্দ, রাজচক্রবর্তীর শরীর সম্বন্ধে যাহা কৃত হয়, তথাগতের শরীর সম্বন্ধেও তাহাই কর্তব্য।”

“দেব, চক্রবর্তী রাজার শরীর সম্বন্ধে কীরূপ কৃত হয়?”

“আনন্দ, রাজচক্রবর্তীর দেহ নতুন বস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়, পরে বিহত কার্পাস দ্বারা এবং তৎপরে নতুন বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। এইরূপে পাঁচশত বস্ত্রখণ্ড দ্বারা রাজচক্রবর্তীর দেহ আচ্ছাদিত করিয়া লৌহ-নির্মিত তৈল দ্রোণীতে নিক্ষেপপূর্বক ওইরূপ অপর দ্রোণী দ্বারা উহা আবৃত করিয়া সর্বপ্রকার সুগন্ধ কাষ্ঠে নির্মিত চিতায় রাজচক্রবর্তীর দেহ দাহ করা হয়। চতুর্মহাপথে রাজচক্রবর্তীর স্তূপ নির্মিত হয়।

“আনন্দ, রাজচক্রবর্তীর শরীর সম্বন্ধে যে বিধি অবলম্বিত হয়, তথাগতের শরীর সম্বন্ধেও সেই বিধি অবলম্বন করিতে হইবে। চতুর্মহাপথে তথাগতের স্তূপ নির্মাণ করিতে হইবে। যাহারা উহাতে মালা, গন্ধ অথবা রঞ্জনোপকরণ স্থাপন করিবে, উহাকে অভিবাদন করিবে, অথবা উহাতে প্রসন্নচিত্ত হইবে, তাহাদের উহা দীর্ঘকাল হিত ও সুখবিধায়ক হইবে।

২০৬. “আনন্দ, চারিজন স্তূপার্হ। কে কে? তথাগত অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, প্রত্যেক-বুদ্ধ, তথাগত-শ্রাবক এবং রাজচক্রবর্তী।

“আনন্দ, কোন হেতুবশত তথাগতের অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ স্তূপার্হ? “ইহাই ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধের স্তূপ” এইরূপ মনে করিয়া, আনন্দ, বহুজন চিত্তকে নির্মল করণে সক্ষম হয়, তাহারা ওইস্থানে চিত্তের নির্মলতা প্রাপ্ত হইয়া মরণান্তে দেহের ধ্বংসে সুগতি লাভ করিয়া স্বর্গে গমন করে। আনন্দ, এই হেতু তথাগত অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ স্তূপার্হ।

“আনন্দ, কোন হেতুবশত প্রত্যেক-সম্বুদ্ধ স্তূপার্হ? “ইহাই ভগবান প্রত্যেক সম্বুদ্ধের স্তূপ” এইরূপ চিন্তা করিয়া, আনন্দ, বহুজন-চিত্তকে নির্মল করণে সক্ষম হয়, তাহারা ওইস্থানে চিত্তের নির্মলতা প্রাপ্ত হইয়া মরণান্তে দেহের ধ্বংসে সুগতি লাভ করিয়া স্বর্গে গমন করে। আনন্দ, এই হেতু প্রত্যেক সম্বুদ্ধ স্তূপার্হ।

“আনন্দ, কোন হেতুবশত তথাগত-শ্রাবক স্তূপার্হ? “ইহাই ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধের শ্রাবক স্তূপ” এইরূপ চিন্তা করিয়া আনন্দ বহুজন চিত্তকে নির্মল করণে সক্ষম হয়, তাহারা ওইস্থানে চিত্তের নির্মলতা প্রাপ্ত হইয়া মরণান্তে দেহের ধ্বংসে সুগতি লাভ করিয়া স্বর্গে গমন করে। “আনন্দ, এই হেতু তথাগত-শ্রাবক স্তূপার্হ।”

“আনন্দ, কোন হেতুবশত রাজচক্রবর্ত্তী স্তূপার্হ? ইহাই সেই ধার্মিক ধর্মরাজের স্তূপ” এইরূপ চিন্তা করিয়া, আনন্দ, বহুজন চিত্তকে নির্মল করণে সক্ষম হয়, তাহারা ওইস্থানে চিত্তের নির্মলতা প্রাপ্ত হইয়া মরণান্তে দেহের ধ্বংসে সুগতি লাভ করিয়া স্বর্গে গমন করে। আনন্দ, এই হেতু রাজাচক্রবর্তী স্তূপার্হ।

“আনন্দ, এই চারিজন স্তূপার্হ।”

২০৭. অনন্তর আনন্দ বিহারে প্রবেশপূর্বক কপিশীর্ষ অবলম্বন করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তিনি চিন্তা করিলেন, “আমি এখনও শিক্ষার্থী, এখনও আমার নিজের সম্পূর্ণতার জন্য প্রয়াস করিতে হইবে। আমার প্রতি কৃপাবান ভগবানের পরিনির্বাণ হইবে।”

তখন ভগবান একজন ভিক্ষুকে বলিলেন :

“ভিক্ষু, যাও, আমার নাম করিয়া আনন্দকে বলো “আনন্দ, শাস্তা আপনাকে আহ্বান করিতেছেন।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া সেই ভিক্ষু ভগবানের নিকট সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক আয়ুষ্মান আনন্দের সন্নিধানে উপনীত হইয়া তাঁহাকে বলিল, “ভ্রাত আনন্দ, শাস্তা আপনাকে আহ্বান করিতেছেন।”

“উত্তম, কহিয়া আনন্দ ভগবানের সমীপে উপনীত হইয়া ভগবানকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন।

তখন ভগবান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, ক্ষান্ত হও; শোক করিও না, বিলাপ করিও না। আমি কি তোমাকে ইতিপূর্বে বলি নাই যে, যে সকল বস্তু আমাদের প্রিয়, মনোজ্ঞ, তাহাদের ধর্মই এই যে আমরা তাহাদের সহিত বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহাদিগকে ত্যাগ করিব? তবে, আনন্দ, ইহা কী প্রকারে সম্ভব যে, যাহা জাত, ভূত, গঠিত এবং ক্ষয়ধর্মসম্পন্ন, তাহা বিনষ্ট হইবে না? ইহা অসম্ভব। আনন্দ, তুমি দীর্ঘকাল অপরিবর্তনীয় ও অপরিমেয় প্রীতিপূর্ণ চিন্তা ও কর্ম দ্বারা আমার অতিশয় প্রিয় হইয়াছ, আনন্দ, তুমি কৃতপুণ্য, প্রধানের অনুশীলনে রত হও, অবিলম্বে অনাসব হইবে।”

২০৮. তৎপরে ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

“ভিক্ষুগণ, আনন্দ, যেরূপ আমার পরম ভক্ত উপস্থাপক, সেইরূপ অতীত কালে যাঁহারা অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ হইয়াছিলেন, সেই সকল ভগবানেরও পরম ভক্ত উপস্থাপক ছিল। ভিক্ষুগণ, যাঁহারা ভবিষ্যতে অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ হইবেন, ওই সকল ভগবানেরও আনন্দেরই ন্যায় উপস্থাপক লাভ হইবে।

“ভিক্ষুগণ, আনন্দ পণ্ডিত, তিনি জানেন, “ইহাই তথাগতকে দর্শনার্থ ভিক্ষুদিগের যাইবার সময়, ইহা ভিক্ষুণীদিগের, ইহা উপাসকদিগের, ইহা উপাসিকাদিগের, ইহা রাজার, ইহা অমাত্যগণের, ইহা তীর্থিয়গণের, ইহা তীর্থিয়-শ্রাবকগণের যাইবার সময়।”

২০৯. “ভিক্ষুগণ, আনন্দের চারিটি আশ্চর্য অদ্ভুত গুণ আছে। কী কী?

“যদি ভিক্ষু-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, দর্শন মাত্রেই পরিষদ আনন্দিত হন, যদি সেইস্থানে আনন্দ ধর্মালোচনা করেন তাহা হইলেও পরিষদ আনন্দিত হন, আনন্দ বাক্যালাপে বিরত হইলে ভিক্ষু-পরিষদ তৃপ্তি লাভ করেন না।”

“ভিক্ষুগণ, যদি ভিক্ষুণী-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, উপাসক-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, উপাসিকা-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, দর্শন মাত্রেই পরিষদ আনন্দিত হয়, যদি সে স্থানে আনন্দ ধর্মালোচনা করেন, তাহা হইলেও পরিষদ আনন্দিত হন, আনন্দ বাক্যালাপে বিরত হইলে পরিষদ তৃপ্তি লাভ করেন না।”

“ভিক্ষুগণ, রাজচক্রবর্তীর চারিটি আশ্চর্য অদ্ভুত গুণ আছে।”

“ভিক্ষুগণ, যদি ক্ষত্রিয়-পরিষদ রাজচক্রবর্তীর দর্শনার্থ গমন করেন, ব্রাহ্মণ-পরিষদ রাজচক্রবর্তীর দর্শনার্থ গমন করেন, গৃহপতি-পরিষদ রাজচক্রবর্তীর দর্শনার্থ গমন করেন, শ্রমণ-পরিষদ রাজচক্রবর্তীর দর্শনার্থ গমন করেন, দর্শন মাত্রেই পরিষদ আনন্দিত হন, যদি সেস্থানে রাজচক্রবর্তী বাক্যালাপ করেন, তাহা হইলেও পরিষদ আনন্দিত হন, তিনি বাক্যালাপে বিরত হইলে পরিষদ তৃপ্তি লাভ করেন না।

“এইরূপই, ভিক্ষুগণ, আনন্দের চারিটি আশ্চর্য অদ্ভুত গুণ আছে। যদি ভিক্ষু-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, ভিক্ষুণী-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, উপাসক-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, উপাসিকা-পরিষদ আনন্দের দর্শনার্থ গমন করেন, দর্শন মাত্রেই পরিষদ আনন্দিত হন, যদি আনন্দ সেস্থানে ধর্মালাপ করেন তাহা হইলেও পরিষদ আনন্দিত হন, আনন্দ বাক্যালাপে বিরত হইলে পরিষদ তৃপ্তি লাভ করেন না।”

“ভিক্ষুগণ, আনন্দের এই চারিটি আশ্চর্য অদ্ভুত গুণ আছে।”

২১০. এইরূপ উক্ত হইলে আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে বলিলেন, “দেব, এই ক্ষুদ্র, পরিত্যক্ত, শাখানগরে যেন ভগবান পরিনির্বৃত না হন। অন্যান্য মহানগরসমূহ বিদ্যমান; যথা : চম্পা, রাজগৃহ, শ্রাবস্তী, সাকেত কৌশাম্বী, বারাণসী। এই সকলের যেকোনো স্থানে ভগবানের পরিনির্বাণ হউক, এই সকল স্থানের বহু ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও গৃহপতি মহাশালগণ তথাগতে অভিপ্রসন্ন, তাঁহারা তথাগতের শরীর পূজা করিবেন।”

“আনন্দ, ইহা ক্ষুদ্র, পরিত্যক্ত, শাখানগর, এরূপ কথা বলিও না।”

“আনন্দ, পূর্বকালে মহাসুদর্শন নামে রাজা ছিলেন। তিনি রাজচক্রবর্তী, ধার্মিক, ধর্মরাজ, চতুরন্তবিজেতা, প্রজাবর্গের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত, সপ্তরত্ন সমন্বিত ছিলেন। আনন্দ, এই কুশিনারা কুশাবতী নামে রাজা মহাসুদর্শনের রাজধানী ছিল; উহা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দৈর্ঘে দ্বাদশ যোজন পরিমিত ছিল, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সপ্ত যোজন বিস্তৃত ছিল।

“আনন্দ, কুশাবতী রাজধানী সমৃদ্ধ, স্ফীত, জনবহুল, মনুষ্যাকীর্ণ এবং সুভিক্ষ ছিল। আনন্দ, যেরূপ দেবতাদিগের আলকনন্দা নামক রাজধানী, সমৃদ্ধ, স্ফীত, জনবহুল, যক্ষাকীর্ণ এবং সুভিক্ষ; সেইরূপ রাজধানী কুশাবতী সমৃদ্ধ, স্ফীত, জনবহুল মনুষ্যাকীর্ণ এবং সুভিক্ষ ছিল।”

“আনন্দ, রাজধানী কুশাবতী দিবা-রাত্রি অবিশ্রান্ত দশবিধ শব্দে ধ্বনিত হইত; যথা : হস্তীশব্দ, রথশব্দ, ভেরীশব্দ, মৃদঙ্গশব্দ, বীণাশব্দ, গীতশব্দ, করতালশব্দ, খঞ্জনীশব্দ, “আহার করো, পান করো, চর্বণ কর” ইত্যাদি দশবিধ শব্দে ধ্বনিত হইত।

“আনন্দ, যাও, কুশিনারায় প্রবেশপূর্বক তত্রস্থ মল্লগণের নিকট ঘোষণা করো : “বাশিষ্ঠগণ, আজ রাত্রির পশ্চিম যামে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে। বাশিষ্ঠগণ, নির্গত হও! নির্গত হও! পরে অনুতাপ করিয়া বলিও না-“আমাদিগের আপন গ্রামক্ষেত্রে তথাগতের পরিনির্বাণ হইল, আমরা অন্তিমকালে তথাগতের দর্শন লাভ করিলাম না।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপন ও পরিচ্ছদ পরিধানপূর্বক পাত্র-চীবর হস্তে একাকী কুশিনারায় প্রবেশ করিলেন।

২১১. ওই সময় কুশিনারার মল্লগণ কোনো কার্যোপলক্ষে মন্ত্রণাসভায় সমবেত হইয়াছিল। আয়ুষ্মান আনন্দ তাহাদের মন্ত্রণাসভায় উপস্থিত হইয়া মল্লগণের নিকট ঘোষণা করিলেন :

“বাশিষ্ঠগণ, অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে তথাগতের পরিনির্বাণ হইবে। বাশিষ্ঠগণ, নির্গত হও, নির্গত হও! পরে অনুতাপ করিয়া বলিও না, “আমাদিগের আপন গ্রামক্ষেত্রে তথাগতের পরিনির্বাণ হইল, আমরা অন্তিমকালে তথাগতের দর্শন লাভ করিলাম না।”

আয়ুষ্মান আনন্দের নিকট এইরূপ শ্রবণ করিয়া মল্লগণ এবং তাহাদের পুত্র, বধূ ও ভার্যাগণ শোকার্ত, দুর্মনা হইয়া দুঃখ-পীড়িত চিত্তে কেহ কেহ আলুলায়িত কেশে ক্রন্দন করিতে লাগিল, প্রসারিত বাহু হইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল, সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে পতিত হইয়া অবলুন্ঠিত হইতে লাগিল, “অতি শীঘ্র ভগবানের পরিনির্বাণ হইবে, অতি শীঘ্র সুগতের পরিনির্বাণ হইবে, অতি শীঘ্র জগতের আলোক নির্বাপিত হইবে।”

তৎপরে মল্লগণ পুত্র-বধূ-ভার্যাগণসহ শোকার্ত, দুর্মনা ও দুঃখপীড়িত হইয়া উপবর্তনে মল্লদিগের শালবনে আয়ুষ্মান আনন্দের নিকট উপস্থিত হইল।

তখন আয়ুষ্মান আনন্দের মনে এইরূপ হইল :

“যদি আমি মল্লগণকে এক এক করিয়া ভগবানকে বন্দনা করিতে দিই, রাত্রি প্রভাত হইয়া যাইবে, তথাপি মল্লদিগের ভগবান-বন্দনা শেষ হইবে না। অতএব আমি মল্লগণকে তাহাদের কুলক্রমানুসারে স্থাপিত করিয়া ভগবানের বন্দনার অবসর দিব :

“দেব, এই নামবিশিষ্ট মল্ল সপুত্র, সভার্যা, সপরিষদ, সামাত্য ভগবানের পাদে মস্তক নত করিতেছেন।”

অনন্তর আয়ুষ্মান আনন্দ কুশিনারার মল্লগণকে কুলক্রমানুসারে স্থাপিত করিয়া ভগবানকে বন্দনা করিতে দিলেন, “দেব, এই নামবিশিষ্ট মল্ল সপুত্র, সভার্যা, সপরিষদ, সামাত্য, ভগবানের পাদে মস্তক নত করিতেছেন।”

এইরূপে আয়ুষ্মান আনন্দ রাত্রির প্রথম যামেই কুশিনারার মল্লগণকে ভগবানের বন্দনা করাইলেন।

২১২. ওই সময়ে সুভদ্র নামক পরিব্রাজক কুশিনারায় বাস করিতেছিলেন। তিনি শুনিলেন, “অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে শ্রমণ গৌতমের পরিনির্বাণ হইবে।”

তখন পরিব্রাজক সুভদ্র চিন্তা করিলেন :

“আমি অভিজ্ঞ বয়োবৃদ্ধ আচার্য প্রাচার্যগণকে বলিতে শুনিয়াছি, “তথাগত অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধগণ কদাচিৎ কখন জগতে আবির্ভূত হন।” অথচ অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে শ্রমণ গৌতমের পরিনির্বাণ হইবে। আমার মনে সংশয় উৎপন্ন হইয়াছে, তথাপি শ্রমণ গৌতমে আমার এতই শ্রদ্ধা যে, আমি আশা করি তিনি এরূপভাবে সত্যকে উপস্থাপিত করিবেন যাহাতে আমার সংশয় দূরীভূত হয়।”

তখন পরিব্রাজক সুভদ্র উপবর্তনে মল্লদিগের শালবনে আয়ুষ্মান আনন্দের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলিলেন :

“আনন্দ, আমি অভিজ্ঞ বয়োবৃদ্ধ আচার্য প্রাচার্যগণকে বলিতে শুনিয়াছি, “তথাগত অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধগণ কদাচিৎ কখন জগতে আবির্ভূত হন।” অথচ অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে শ্রমণ গৌতমের পরিনির্বাণ হইবে। আমার মনে সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, তথাপি শ্রমণ গৌতমের প্রতি আমার এতই শ্রদ্ধা যে, আমি আশা করি তিনি আমাকে এরূপভাবে ধর্মোপদেশ দিবেন যাহাতে আমার সংশয় দূরীভূত হয়। আনন্দ, আমি শ্রমণ গৌতমের দর্শন প্রার্থী।”

সুভদ্র এইরূপ কহিলে আয়ুষ্মান আনন্দ তাঁহাকে বলিলেন, “সৌম্য সুভদ্র, ক্ষান্ত হও, তথাগতকে কষ্ট দিও না, ভগবান ক্লান্ত।”

দ্বিতীয়বার পরিব্রাজক সুভদ্র… তৃতীয়বার পরিব্রাজক সুভদ্র আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, আমি অভিজ্ঞ বয়োবৃদ্ধ আচার্য প্রাচার্যগণকে বলিতে শুনিয়াছি, “তথাগত অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধগণ কদাচিৎ কখন জগতে আবির্ভূত হন।” অথচ অদ্য রাত্রির পশ্চিম যামে শ্রমণ গৌতমের পরিনির্বাণ হইবে। আমার মনে সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, তথাপি শ্রমণ গৌতমে আমার এতই শ্রদ্ধা যে, আমি আশা করি তিনি আমাকে এরূপভাবে ধর্মোপদেশ দিবেন যাহাতে আমার সংশয় দূরীভূত হয়। আনন্দ, আমি শ্রমণ গৌতমের দর্শন প্রার্থী।”

তৃতীয়বারও আয়ুষ্মান আনন্দ পরিব্রাজক সুভদ্রকে বলিলেন, “সৌম্য সুভদ্র, ক্ষান্ত হও, তথাগতকে কষ্ট দিও না, ভগবান ক্লান্ত।”

২১৩. ভগবান পরিব্রাজক সুভদ্রের সহিত আয়ুষ্মান আনন্দের এই কথোপকথন শ্রবণ করিলেন। অনন্তর ভগবান আনন্দকে সম্বোধন করিলেন :

“আনন্দ, ক্ষান্ত হও, সুভদ্রকে বাধা দিও না, তথাগতের দর্শনার্থ, তাহাকে আসিতে দাও। সুভদ্র জ্ঞানান্বেষী হইয়া আমাকে প্রশ্ন করিবে আমাকে বিরক্ত করিবার জন্য নয়; জিজ্ঞাসিত হইয়া আমি তাহাকে যে উত্তর দিব তাহা তৎক্ষণাৎ তাহার বোধ্য হইবে।”

তখন আয়ুষ্মান আনন্দ পরিব্রাজক সুভদ্রকে বলিলেন, সৌম্য সুভদ্র, তুমি যাও, ভগবান তোমাকে অনুমতি দিয়াছেন।”

অনন্তর পরিব্রাজক সুভদ্র ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত সহৃদয়তা এবং সৌজন্যসূচক বাক্যালাপান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। পরে সুভদ্র ভগবানকে বলিলেন :

“হে গৌতম, যে সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ সংঘী, গণী, গণাচার্য, সুবিজ্ঞাত, যশস্বী, তীর্থকর, সাধুরূপে বহুজনাদৃত; যথা : পূরণ কশ্যপ, মক্ষলি গোশাল, অজিত-কেশকম্বলী, পকুধ-কচ্চায়ন, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্র, নিগন্ঠ নাথপুত্র তাঁহারা কী স্ব স্ব মতানুসারী হইয়া পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিয়াছেন অথবা করেন নাই? অথবা কেহ কেহ করিয়াছেন এবং কেহ কেহ করেন নাই?”

“সুভদ্র, ক্ষান্ত হও, এরূপ প্রশ্নের প্রয়োজন নাই। আমি তোমাকে ধর্মোপদেশ দিব, শ্রবণ করো, মনঃসংযোগ করো, আমি বলিতেছি।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া সুভদ্র সম্মত হইলেন। তখন ভগবান বলিলেন :

২১৪. সুভদ্র, যে ধর্ম-বিনয়ে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অস্তিত্ব নাই, সে ধর্ম-বিনয়ে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণির শ্রমণও নাই ; সুভদ্র, যে ধর্ম-বিনয়ে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অস্তিত্ব আছে, সে ধর্ম-বিনয়ে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, অথবা চতুর্থ শ্রেণির শ্রমণও আছে। সুভদ্র, এই ধর্ম-বিনয়ে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অস্তিত্ব আছে; সুভদ্র, ইহাতেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণির শ্রমণ বিদ্যমান। অন্যান্য ধর্মমতসমূহ শ্রমণশূন্য, সুভদ্র এই ধর্মে ভিক্ষুগণ যথার্থ জীবন-যাপন করিতে পারেন, এবং সে ক্ষেত্রে জগৎ অর্হৎ শূন্য হইবে না।

সুভদ্র, একোনত্রিংশ বৎসর বয়সে কুশলের অন্বেষণে আমি প্রব্রজিত হইয়াছিলাম।

সুভদ্র, আমার প্রব্রজ্যা গ্রহণের সময় হইতে আজ পর্যন্ত পঞ্চাশৎ বৎসরের অধিক হইয়াছে, ওই সময় ব্যাপিয়া আমি ন্যায়-ধর্মের প্রদেশ-বর্তী হইয়াছি।

এই ধর্মের বাহিরে শ্রমণ নাই!

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ কোনো শ্রেণিরই শ্রমণ নাই। অপরাপর ধর্মমত শ্রমণশূন্য; সুভদ্র, এই ধর্মে ভিক্ষুগণ যথার্থ জীবন-যাপন করিতে পারেন, এবং সে ক্ষেত্রে জগৎ অর্হৎশূন্য হইবে না।”

২১৫. এইরূপ কথিত হইলে পরিব্রাজক সুভদ্র ভগবানকে বলিলেন, “উত্তম, দেব, উত্তম! যেরূপ উৎপাতিতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, লুক্কায়িত প্রকাশিত হয়, পথভ্রান্ত পথ প্রদর্শিত হয়, চক্ষুষ্মানের দেখিবার নিমিত্ত অন্ধকারে তৈলদীপ ধৃত হয়, সেইরূপই ভগবান অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশিত করিয়াছেন। দেব, আমি ভগবানের, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘের শরণ লইতেছি। আমি ভগবানের নিকট প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদার প্রার্থী।”

“সুভদ্র, পূর্বে অন্য মতাবলম্বী হইয়া যদি কেহ এই ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদার প্রার্থী হয়, তাহাকে চারি মাস শিক্ষার্থীরূপে অতিবাহিত করিতে হয়, পরে আরদ্ধ-চিত্ত ভিক্ষুগণ তাঁহাকে ভিক্ষু হইবার নিমিত্ত প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা দান করেন। তথাপি এই বিষয়ে আমি মনুষ্যের মধ্যে পার্থক্য জ্ঞাত আছি।”

“দেব, পূর্বের অন্য মতাবলম্বীগণ এই ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদার প্রার্থী হইলে যদি তাঁহাদিগকে চারি মাস পরিবাস করিতে হয় এবং পরে আরদ্ধ-চিত্ত ভিক্ষুগণ তাঁহাদিগকে ভিক্ষু হইবার নিমিত্ত প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা দান করেন, তাহা হইলে আমি চারি বৎসর পরিবাসের নিমিত্ত প্রস্তুত আছি, চারি বৎসরের অন্তে আরদ্ধ-চিত্ত ভিক্ষুগণ আমাকে ভিক্ষু হইবার নিমিত্ত প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা দান করুন।”

তখন ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “তাহা হইলে, আনন্দ, সুভদ্রকে প্রব্রজ্যা দাও।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ সম্মত হইলেন।

অতঃপর পরিব্রাজক সুভদ্র আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, আপনাদের লাভ অসামান্য, সৌভাগ্য মহৎ; এই ধর্ম-বিনয়ে স্বয়ং বুদ্ধের হস্ত হইতে সংঘভুক্ত শিষ্যত্বের বারি আপনাদের উপর বর্ষিত হইয়াছে।”

পরিব্রাজক সুভদ্র ভগবানের নিকট হইতে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিলেন এবং একাকী, নির্জনরত, অপ্রমত্ত, উৎসাহী, প্রহিতাত্মা হইয়া অচিরে কুলপুত্রগণ যাহা লাভ করিবার জন্য সম্যকরূপে গৃহত্যাগপূর্বক গৃহহীন প্রব্রজ্যা আশ্রয় করেন, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্য্য-সিদ্ধি এই জগতেই স্বয়ং উপলব্ধি এবং সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে প্রতিষ্ঠিত হইলেন, “জাতি ধ্বংস হইয়াছে, ব্রহ্মচর্য্য উদ্‌যাপিত হইয়াছে, কর্তব্য সম্পাদিত হইয়াছে, পুনর্জন্ম আর নাই” এইরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করিলেন। আয়ুষ্মান সুভদ্র অর্হৎদিগের অন্যতর হইলেন। তিনিই ভগবানের সর্বশেষ সাক্ষাৎ-শ্রাবক হইলেন।

পঞ্চম ভাণবার সমাপ্ত

ষষ্ঠ অধ্যায়

২১৬. অনন্তর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “আনন্দ, তোমাদের মনে এরূপ হইতে পারে, “প্রাবচন-বক্তা আর নাই, আমাদের শাস্তা আর নাই।” কিন্তু, আনন্দ, এই বিষয়কে সেরূপভাবে দেখিবে না। আনন্দ, আমি যে ধর্ম ও বিনয় উপদেশ দিয়াছি ও ঘোষণা করিয়াছি, আমার দেহান্তে তাহাই তোমাদের শাস্তা।

“আনন্দ, বর্তমানে যেরূপ ভিক্ষুগণ পরস্পরকে “আবুস” কহিয়া সম্বোধন করে, আমার দেহান্তে তাহারা যেন সেরূপ না করে। আনন্দ, নবদীক্ষিত ভিক্ষু থেরতর ভিক্ষু কর্তৃক নাম, গোত্র অথবা “আবুস” বাক্য দ্বারা সম্বোধিত হইবেন, থেরতর ভিক্ষু নবদীক্ষিত ভিক্ষু কর্তৃক “ভন্তে” অথবা “আয়ুষ্মান” বাক্যের দ্বারা সম্বোধিত হইবেন।

“আনন্দ, আমার দেহান্তে, সংঘ ইচ্ছানুরূপে ক্ষুদ্র ও অপ্রধান বিধিসমূহের বর্জন করিতে পারেন।”

“আনন্দ, আমার দেহান্তে ভিক্ষু ছন্নকে ব্রহ্মদণ্ড দিতে হইবে।

“দেব, ব্রহ্মদণ্ড কী?”

“আনন্দ, ভিক্ষু ছন্ন যাহা ইচ্ছা বলিতে পারেন, ভিক্ষুগণ তাঁহার সহিত বাক্যালাপও করিবে না, তাঁহাকে উপদেশও দিবে না, তাঁহার অনুশাসনও করিবে না।”

২১৭. তদনন্তর ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

“ভিক্ষুগণ, তোমাদের মধ্যে কাহারও মনে বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, মার্গ অথবা বিধি সম্বন্ধে সংশয় অথবা বিমতি থাকিতে পারে। ভিক্ষুগণ, জিজ্ঞাসা করো। পরে অনুতপ্ত হইয়া কহিও না, “শাস্তা আমাদের সম্মুখেই ছিলেন, তথাপি আমরা সম্মুখে তাঁহাকে কোনো প্রশ্নই করি নাই।”

ভিক্ষুগণ নীরব রহিলেন।

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার ভগবান ভিক্ষুগণকে বলিলেন :

“তোমাদের মধ্যে কাহারও মনে বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, মার্গ অথবা বিধি সম্বন্ধে সংশয় অথবা বিমতি থাকিতে পারে। ভিক্ষুগণ, জিজ্ঞাসা করো। পরে অনুতপ্ত হইয়া কহিও না, “শাস্তা আমাদের সম্মুখেই ছিলেন, তথাপি আমরা সম্মুখে তাঁহাকে কোনো প্রশ্নই করি নাই।”

তখনও ভিক্ষুগণ নীরব রহিলেন।

তখন ভগবান ভিক্ষুগণকে বলিলেন :

“ভিক্ষুগণ, এরূপ হইতে পারে যে, তোমরা শাস্তার প্রতি সম্মানবশত কিছু জিজ্ঞাসা করিতেছ না। এরূপ ক্ষেত্রে তোমরা পরস্পর পরস্পরের নিকট জ্ঞাপন করো।”

তথাপি ভিক্ষুগণ নীরব রহিলেন।

তখন আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে বলিলেন :

“দেব, আশ্চর্য! অদ্ভুত! এই ভিক্ষুসংঘে আমার শ্রদ্ধা এতই গভীর যে, ইহাতে আমি এখন একজন ভিক্ষুও দেখিতেছি না যাঁহার বুদ্ধে, ধর্মে, সংঘে, মার্গে এবং বিধিসমূহে কোনো সংশয় অথবা বিমতি আছে।”

“আনন্দ, তুমি শ্রদ্ধার গভীরতায় ইহা বলিতেছ। কিন্তু, আনন্দ, তথাগত নিশ্চিত জানেন যে এই সমগ্র ভিক্ষুমণ্ডলে এমন কোনো ভিক্ষু নাই যিনি বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, মার্গ অথবা বিধিসমূহ সম্বন্ধে সংশয় অথবা বিমতি পোষণ করেন। আনন্দ, এই পাঁচশত ভিক্ষুদিগের মধ্যে যিনি সর্বপশ্চাতে তিনিও স্রোতাপন্ন, দুঃখজনক পুনরুৎপত্তি হইতে মুক্ত এবং নিয়ত সম্বোধিপরায়ণ।”

২১৮. তৎপরে ভগবান ভিক্ষুদিগকে বলিলেন :

“ভিক্ষুগণ, শ্রবণ করো, “ধ্বংসই সর্বপ্রকার মিশ্র পদার্থের ধর্ম। যত্নসহকারে নিজের মুক্তির মার্গ পরিষ্কৃত করো।”

ইহাই তথাগতের শেষ বাক্য।

২১৯. অনন্তর ভগবান প্রথম ধ্যানে প্রবেশ করিলেন। উহা হইতে দ্বিতীয় ধ্যানে, উহা হইতে তৃতীয় ধ্যানে, উহা হইতে চতুর্থ ধ্যানে প্রবেশ করিলেন। চতুর্থ ধ্যান হইতে “আকাশ-অনন্ত-আয়তন” সমাপত্তিতে, উহা হইতে “বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তন”, উহা হইতে “আকিঞ্চন-আয়তন”, উহা হইতে “নৈবসংজ্ঞা-না-অসংজ্ঞা” আয়তন, উহা হইতে “সংজ্ঞা-বেদয়িত-নিরোধ” সমাপত্তিতে প্রবেশ করিলেন।

অতঃপর আয়ুষ্মান আনন্দ আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধকে বলিলেন :

“দেব অনুরুদ্ধ, ভগবান পরিনির্বৃত।”

“সৌম্য আনন্দ, ভগবান পরিনির্বৃত নহেন, তিনি সংজ্ঞা-বেদয়িত-নিরোধ সমাপত্তি লাভ করিয়াছেন।”

অনন্তর ভগবান সংজ্ঞা-বেদয়িত-নিরোধ সমাপত্তি হইতে নৈবসংজ্ঞা-না-অসংজ্ঞা আয়তন, উহা হইতে আকিঞ্চন আয়তন, উহা হইতে বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তন, উহা হইতে আকাশ-অনন্ত-আয়তন, উহা হইতে চতুর্থ ধ্যানে উপনীত হইলেন, উহা হইতে তৃতীয় ধ্যান, উহা হইতে দ্বিতীয় ধ্যান, উহা হইতে প্রথম ধ্যানে উপনীত হইলেন। প্রথম ধ্যান হইতে দ্বিতীয় ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান হইতে তৃতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান হইতে চতুর্থ ধ্যানে উপনীত হইলেন। সেই মুহূর্তেই ভগবানের পরিনির্বাণ হইল।

২২০. ভগবান পরিনির্বৃত হইলে সেই মুহূর্তেই ভীষণ লোমহর্ষক প্রবল ভূমিকম্প হইল, বজ্রপাত হইল।

সেই মুহূর্তেই ব্রহ্মা সহম্পতি এই গাথা বলিলেন :

“জগতের সর্বপ্রাণীই দেহত্যাগ করিবে,
যেরূপ জগতের এতাদৃশ অপ্রতিম
শাস্তা বলসম্পন্ন তথাগত সম্বুদ্ধ
পরিনির্বৃত হইয়াছেন।”
২২১. তৎক্ষণেই দেবেন্দ্র শক্র এই গাথা বলিলেন :
“সংস্কারসমূহ অনিত্য” তাহারা
উৎপত্তি ও বিনাশশীল; উৎপন্ন
হইয়া তাহারা ধ্বংসে পর্যবসিত
হয়, তাহাদের উপশমই সুখ।”
২২২. তৎক্ষণেই আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধ এই গাথাগুলি বলিলেন :
“যখন শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত নিষ্কম্প
মুনি প্রাণত্যাগ করিলেন, তখন
স্থিতচিত্ত তথাগতের আশ্বাস-
প্রশ্বাস ছিল না। তিনি অবিচলিত
চিত্তে বেদনা সহ্য করিয়াছিলেন,
দীপের নির্বাণের ন্যায় তাঁহার
চিত্তের বিমুক্তি হইয়াছিল।”

২২৩. তৎক্ষণেই আয়ুষ্মান আনন্দ এই গাথা বলিলেন :

“সর্বসৌন্দর্যাকর সম্বুদ্ধের
পরিনির্বাণে মহাভয় ও রোমহর্ষ অনুভূত হইল।”

২২৪. ভগবান পরিনির্বাণে প্রবেশ করিলে যে সকল ভিক্ষু রাগমুক্ত ছিলেন না, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বাহু প্রসারিত করিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন, সাষ্টাঙ্গে ভূমিতে পতিত ও অবলুন্ঠিত হইলেন, “অতি শীঘ্র ভগবান সুগত পরিনির্বৃত হইয়াছেন, অতি শীঘ্র জগতের আলোক অন্তর্হিত হইয়াছে।

যে সকল ভিক্ষু বীতরাগ ছিলেন তাঁহারা স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সহকারে “সংস্কারসমূহ অনিত্য, কিরূপে ইহার অন্যথা হইবে!” চিন্তা করিয়া সহ্য করিলেন।

২২৫. অনন্তর আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধ ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করিলেন :

“বন্ধুগণ, ক্ষান্ত হও, শোক করিও না, বিলাপ করিও না। ভগবান কি পূর্বেই বলেন নাই যে, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সকল বস্তুরই স্বভাব এই যে আমাদিগকে তৎসমূহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে? তাহা হইলে ইহা কী প্রকারে সম্ভব যে, যাহা জাত, ভূত, গঠিত এবং ক্ষয়ধর্মসম্পন্ন তাহার বিনাশ হইবে না? ইহা অসম্ভব। দেবগণ বিরক্ত হইতেছেন।”

“কিন্তু, ভন্তে, আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধ কোন প্রকার দেবগণের কথা মনে করিতেছেন?”

“আনন্দ, আকাশে পৃথিবীসংজ্ঞী দেবগণ আছেন, তাঁহারা আলুলায়িত কেশে ক্রন্দন করিতেছেন, প্রসারিত বাহু হইয়া ক্রন্দন করিতেছেন, সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে পতিত ও অবলুণ্ঠিত হইয়া “অতি শীঘ্র ভগবান সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন, অতি শীঘ্র জগতের আলোক নির্বাপিত হইয়াছে” কহিয়া বিলাপ করিতেছেন।

“আনন্দ, পৃথিবীতে পৃথিবী-সংজ্ঞী দেবগণ আছেন, তাঁহারা আয়ুলায়িত কেশ, প্রসারিত বাহু এবং সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে পতিত ও অবলুন্ঠিত হইয়া “অতি শীঘ্র ভগবান সুগত পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন, অতি শীঘ্র জগতের আলোক নির্বাপিত হইয়াছে” কহিয়া ক্রন্দন করিতেছেন।”

“কিন্তু যে সকল দেবতা বীতরাগ তাঁহারা স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান সহকারে “সংস্কারসমূহ অনিত্য, কিরূপে ইহার অন্যথা হইবে? চিন্তা করিয়া সহ্য করিতেছেন।

অতঃপর মাননীয় অনুরুদ্ধ ও আনন্দ অবশিষ্ট রাত্রি ধর্মালোচনায় অতিবাহিত করিলেন।

২২৬. পরে অনুরুদ্ধ আনন্দকে বলিলেন :

“আনন্দ, যাও, কুশিনারায় প্রবেশপূর্বক তত্রস্থ মল্লগণের নিকট ঘোষণা করো, “বাশিষ্ঠগণ, ভগবান পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন, যাহা ক্ষেত্রোচিত তাহার অনুষ্ঠান করো।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া আনন্দ সম্মতি জ্ঞাপনপূর্বক পূর্বাহ্নে পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর হস্তে একাকী কুশিনারায় প্রবেশ করিলেন।

ওই সময়ে কুশিনারায় মল্লগণ মন্ত্রণা সভায় সমবেত হইয়া ওই বিষয়েরই আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন। আনন্দ সভায় উপস্থিত হইয়া মল্লগণকে বলিলেন, “বাশিষ্ঠগণ, ভগবান পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন। এক্ষণে যাহা ক্ষেত্রোচিত তাহার অনুষ্ঠান করো।”

আয়ুষ্মান আনন্দের নিকট এইরূপ শ্রবণ করিয়া মল্লগণ এবং তাহাদের পুত্র, বধূ ও ভার্যাগণ শোকার্ত ও দুর্মনা হইয়া দুঃখপীড়িত চিত্তে কেহ কেহ আলুলায়িত কেশ ও প্রসারিত বাহু হইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল; “অতি শীঘ্র ভগবানের পরিনির্বাণ হইয়াছে, অতি শীঘ্র সুগতের পরিনির্বাণ হইয়াছে, অতি শীঘ্র জগতের আলোক নিষ্প্রভ হইয়াছে!” কহিয়া সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে পতিত ও অবলুন্ঠিত হইতে লাগিল।

২২৭. তৎপরে কুশিনারার মল্লগণ ভৃত্যগণকে আদেশ দিল, “সুগন্ধি দ্রব্য, পুষ্পমাল্য ও কুশিনারার সমস্ত বাদ্যভা- সংগ্রহ করো।”

ওই সকল সুগন্ধি দ্রব্য, পুষ্পমাল্য এবং বাদ্য-যন্ত্রাদিসহ পাঁচশত খণ্ড পরিচ্ছদের বস্ত্র লইয়া মল্লগণ উপবর্তনে তাহাদের শালবনে যেখানে ভগবানের দেহ রক্ষিত ছিল তথায় গমন করিল। সেখানে তাহারা নৃত্য, স্তুতিগান, বাদ্য, পুষ্পমাল্য ও সুগন্ধি দ্রব্য দ্বারা ভগবানের পার্থিব অবশেষের পূজার্চনায় এবং পরিচ্ছদ বস্ত্র সাহায্যে চন্দ্রাতপ নির্মাণ ও ইহাতে লম্বিত করিবার জন্য প্রসাধক মাল্যাদি প্রস্তুত করিয়া সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিল।

তৎপরে মল্লগণ চিন্তা করিল :

“অদ্য আর ভগবানের দেহ দাহ করিবার সময় নাই। আগামীকল্য দাহ করিব।” অতঃপর ভগবানের দেহের পূজার্চনায় দ্বিতীয় দিবসও পূর্বোক্তরূপে অতিবাহিত হইল; তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিবসও একই প্রকারে অতিবাহিত হইল।

সপ্তম দিবসে মল্লগণ চিন্তা করিল :

“আমরা নৃত্য, গীত, বাদ্য, মালা, গন্ধাদি দ্বারা ভগবানের দেহের পূজা ও অর্চনা করিতে করিতে উহা দক্ষিণ দিক দিয়া বহন করিয়া নগরের বাহিরে দক্ষিণস্থ স্থানে দাহ করিব।”

ওই সময় মল্লগণের আটজন প্রধান স্নান ও নববস্ত্র পরিধান করিয়া ভগবানের দেহ উত্তোলন করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সমর্থ হইল না।

২২৮. তখন মল্লগণ অনুরুদ্ধকে বলিল, “দেব, মল্লগণের আটজন প্রধান স্নান ও নববস্ত্র পরিধানপূর্বক ভগবানের দেহ উত্তোলন করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সমর্থ হইল না। ইহার কী হেতু, কী প্রত্যয়?”

“বাশিষ্ঠগণ, তোমাদের অভিপ্রায় একরূপ, দেবতাগণের অন্যরূপ।”

“দেব, দেবতাগণের অভিপ্রায় কীরূপ?”

“বাশিষ্ঠগণ, তোমাদের অভিপ্রায়ও, “আমরা নৃত্য, গীত, বাদ্য, মালা, গন্ধাদি দ্বারা ভগবানের দেহের পূজা অর্চনা করিতে করিতে উহা দক্ষিণ দিক দিয়া বহন করিয়া নগরের বাহিরে দক্ষিণস্থ স্থানে দাহ করিব।” দেবতাগণের অভিপ্রায়, “আমরা দিব্য নৃত্য, গীত, বাদ্য, মাল্য, গন্ধাদি দ্বারা ভগবানের দেহের পূজা ও অর্চনা করিতে করিতে উহা উত্তর দিক দিয়া নগরের উত্তরে বহন করিয়া উত্তর দ্বার দিয়া নগরে প্রবেশ করাইয়া নগরের মধ্যদেশে লইয়া গিয়া পূর্বদ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া পূর্বদিকেস্থিত মল্লদিগের মকুটবন্ধন নামক চৈত্যে দাহ করিব।”

“দেব, দেবতাগণের যেরূপ অভিপ্রায়, তাহাই হউক।”

২২৯. ওই সময়ে কুশিনারা জঞ্জাল-স্তূপ এবং অবস্কারাধার পর্যন্ত মন্দার পুষ্পের আজানু গভীর স্তূপে আবৃত হইয়াছিল। অনন্তর দেবতা ও মল্লগণ ভগবানের দেহ দিব্য ও মানুষিক নৃত্য, গীত, বাদ্য, এবং মালা গন্ধাদির দ্বারা পূজা ও অর্চনা করিতে করিতে উহা উত্তর দিক দিয়া নগরের উত্তরে বহন করিয়া উত্তর দ্বার দিয়া নগরে প্রবেশ করাইয়া নগরের মধ্যদেশে লইয়া গিয়া পূর্বদ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া পূর্বদিকে স্থিত মল্লদিগের মকুটবন্ধন নামক চৈত্যে রক্ষা করিলেন।

২৩০. অতঃপর কুশিনারার মল্লগণ আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিল, “পূজ্য আনন্দ, তথাগতের দেহ সম্বন্ধে আমাদের কী কর্তব্য?”

“বাশিষ্ঠগণ, রাজচক্রবর্তীর শরীর সম্বন্ধে যাহা কৃত হয়, তথাগতের শরীর সম্বন্ধেও তাহাই কর্তব্য।”

“প্রভু আনন্দ, চক্রবর্তী রাজার শরীর সম্বন্ধে কীরূপ কৃত হয়?”

“বাশিষ্ঠগণ, রাজচক্রবর্তীর দেহ নতুনবস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়, পরে বিহত কার্পাস দ্বারা এবং তৎপরে নতুন বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। এইরূপে পাঁচশত বস্ত্রখণ্ড দ্বারা রাজচক্রবর্তীর দেহ আচ্ছাদিত করিয়া লৌহনির্মিত তৈল দ্রোণীতে নিক্ষেপপূর্বক ওইরূপ অপর দ্রোণী দ্বারা উহা আবৃত করিয়া সর্বপ্রকার সুগন্ধ কাষ্ঠে নির্মিত চিতায় রাজচক্রবর্তীর দেহ দাহ করা হয়। চতুর্মহাপথে রাজচক্রবর্তীর স্তূপ নির্মিত হয়। বাশিষ্ঠগণ, রাজচক্রবর্তীর শরীর সম্বন্ধে এইরূপ উপায় অবলম্বিত হয়।

“বাশিষ্ঠগণ, রাজচক্রবর্তীর শরীর সম্বন্ধে যাহা কৃত হয়, তথাগতের শরীর সম্বন্ধেও তাহাই কর্তব্য। চতুর্মহাপথে তথাগতের স্তূপ নির্মাণ করিতে হইবে। যাহারা উহাতে মালা, গন্ধ, অথবা রঞ্জনোপকরণ স্থাপন করিবে, উহাকে অভিবাদন করিবে, অথবা উহাতে প্রসন্নচিত্ত হইবে, তাহাদের উহা দীর্ঘকাল হিত ও সুখ বিধায়ক হইবে।”

তদনন্তর মল্লগণ ভৃত্যগণকে আদেশ করিল :

“মল্লদিগের নিকট হইতে বিহত কার্পাস সংগ্রহ করো।”

তৎপরে মল্লগণ ভগবানের দেহ নতুন বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করিল, পরে বিহত কার্পাস দ্বারা এবং তৎপরে নতুন বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করিল। এইরূপে পাঁচশত বস্ত্রখণ্ড দ্বারা ভগবানের দেহ আচ্ছাদিত করিয়া লৌহনির্মিত তৈল দ্রোণীতে নিক্ষেপপূর্বক ওইরূপ অপর দ্রোণীর দ্বারা উহা আবৃত করিয়া সর্বপ্রকার সুগন্ধ কাষ্ঠে নির্মিত চিতায় স্থাপিত করিল।

২৩১. ওই সময় আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ পঞ্চশত ভিক্ষু সমন্বিত বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত পাবা হইতে কুশিনারার পথে চলিবার কালে মার্গ হইতে অপসৃত হইয়া এক বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট ছিলেন।

ওই সময়েই জনৈক আজীবক কুশিনারা হইতে মন্দার পুষ্প সংগ্রহ করিয়া পাবাভিমুখী পথে চলিতেছিলেন।

আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ দূর হইতে আজীবককে আসিতে দেখিয়া তাঁহাকে বলিলেন, “আয়ুষ্মান, আপনি অবশ্যই আমাদের শাস্তাকে জানেন?”

“জানি। অদ্য সপ্তাহ হইল শ্রমণ গৌতম পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন। সেই কারণেই এই মন্দার পুষ্প আমি প্রাপ্ত হইয়াছি।”

ভিক্ষুদিগের মধ্যে যাঁহারা রাগমুক্ত ছিলেন না, তাঁহাদের কেহ কেহ বাহু প্রসারিত করিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন; “অতি শীঘ্র ভগবান সুগত পরিনির্বৃত হইয়াছেন, অতি শীঘ্র জগতের আলোক অন্তর্হিত হইয়াছে” কহিয়া সাষ্টাঙ্গে ভূমিতে পতিত ও অবলুণ্ঠিত হইলেন।

যাঁহারা বীতরাগ ছিলেন তাঁহারা স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান-সহকারে “সংস্কারসমূহ অনিত্য, কিরূপে ইহার অন্যথা হইবে?” চিন্তা করিয়া সহ্য করিলেন।

২৩২. ওই সময়ে বৃদ্ধ বয়সে প্রব্রজিত সুভদ্র নামক জনৈক ভিক্ষু ওই পরিষদে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি ভিক্ষুগণকে বলিলেন :

“আয়ুষ্মানগণ, ক্ষান্ত হও, শোক করিও না, বিলাপ করিও না। সেই মহাশ্রমণ হইতে মুক্ত হইয়া আমরা রক্ষা পাইয়াছি। “ইহা তোমাদের উপযুক্ত, ইহা অনুপযুক্ত” এইরূপ বাক্যের দ্বারা আমরা নিপীড়িত হইতেছিলাম, এক্ষণে আমরা যাহা ইচ্ছা তাহা করিব, যাহা ইচ্ছা নয় তাহা করিব না।

তখন আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ ভিক্ষুদিগকে বলিলেন, ভ্রাতৃগণ, ক্ষান্ত হও, শোক করিও না, বিলাপ করিও না। ভগবান কি পূর্বেই কহেন নাই যে, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সকল বস্তুরই স্বভাব এই যে আমাদিগকে তৎসমূহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে? তবে ইহা কী প্রকারে সম্ভব যে যাহা জাত, ভূত, গঠিত এবং ক্ষয়ধর্মসম্পন্ন তাহার বিনাশ হইবে না? ইহা অসম্ভব।”

২৩৩. ওই সময়ে চারিজন মল্লপ্রধান স্নাত ও নববস্ত্র পরিহিত হইয়া ভগবানের চিতায় অগ্নি সংযোগ করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সমর্থ হইল না।

তখন কুশিনারার মল্লগণ আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধকে বলিল,

“পূজ্য অনুরুদ্ধ, চারিজন মল্ল-প্রধান স্নাত ও নববস্ত্র পরিহিত হইয়া ভগবানের চিতায় অগ্নিসংযোগ করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সমর্থ হইল না। ইহার কী হেতু, কী প্রত্যয়?”

“বাশিষ্ঠগণ, দেবতাদিগের অভিপ্রায় অন্যরূপ।”

“দেব, দেবতাগণের অভিপ্রায় কীরূপ?”

“বাশিষ্ঠগণ, দেবতাদিগের অভিপ্রায় এইরূপ, “আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ পঞ্চশত ভিক্ষু সমন্বিত মহাভিক্ষুসংঘের সহিত পাবা হইতে কুশিনারার পথে চলিতেছেন, যতক্ষণ তিনি ভগবানের পাদে মস্তক স্থাপনপূর্বক বন্দনা না করিতেছেন ততক্ষণ চিতা জ্বলিবে না।”

“দেব, দেবতাগণের যেরূপ অভিপ্রায় তাহাই হউক।”

২৩৪. অনন্তর আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ কুশিনারার মকুটবন্ধন নামক মল্লগণের চৈত্যে, যে-স্থানে ভগবানের চিতা রক্ষিত ছিল, তথায় উপস্থিত হইয়া একাংস চীবরাবৃত এবং অঞ্জলি প্রণত করিয়া তিনবার চিতা প্রদক্ষিণপূর্বক ভগবানের পাদে মস্তক স্থাপনপূর্বক বন্দনা করিলেন।

সেই সকল পঞ্চশত ভিক্ষুও একই প্রকারে ভগবানের পাদ বন্দনা করিলেন।

আয়ুষ্মান মহাকাশ্যপ এবং পঞ্চশত ভিক্ষুর বন্দনা সমাপ্ত হইলে চিতা স্বয়ং জ্বলিয়া উঠিল।

২৩৫. ভগবানের দেহ দগ্ধীভূত হইলেও ছবি বহিস্তক, চর্ম, মাংস, স্নায়ু অথবা লসীকা হইতে ক্ষার অথবা মসির উৎপত্তি দৃষ্ট হইল না, মাত্র অস্থি অবশিষ্ট রহিল।

যেরূপ জ্বলন্ত ঘৃত অথবা তৈলের ক্ষার অথবা মসি দৃষ্ট হয় না, সেইরূপই ভগবানের দেহ দগ্ধীভূত হইলেও উহার ছবি, চর্ম, মাংস, স্নায়ু, লসীকা হইতে ক্ষার অথবা মসির উৎপত্তি দৃষ্ট হইল না। অস্থি মাত্র অবশিষ্ট রহিল। পাঁচশত বস্ত্রখণ্ডের দুইখানি মাত্র দগ্ধ হইল-অন্তস্তলীন এবং সর্ববহিস্থ।

ভগবানের দেহ দগ্ধ হইলে অন্তরীক্ষ হইতে জলধারা পতিত হইয়া ভগবানের চিতা নির্বাপিত করিল, উদকশালা হইতেও জলধারা উত্থিত হইয়া ভগবানের চিতা নির্বাপিত করিল। কুশিনারার মল্লগণও সর্বপ্রকার সুগন্ধি বারিসেকে ভগবানের চিতা নির্বাপিত করিল।

তদনন্তর কুশিনারার মল্লগণ ভগবানের অস্থিসমূহ সপ্তাহ মন্ত্রণাশালায় শক্তি-পিঞ্জর এবং ধনুপ্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত করিয়া নৃত্য, গীত, বাদ্য, মালা, গন্ধাদি দ্বারা ওই সকলের সৎকার, সেবা, সম্মান ও পূজা করিল।

২৩৬. মগধরাজ অজাতশত্রু বৈদেহী-পুত্র শ্রবণ করিলেন যে ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন।

তখন তিনি কুশিনারার মল্লগণের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া তাহাদিগকে জানাইলেন, “ভগবানও ক্ষত্রিয়, আমিও ক্ষত্রিয়, আমিও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমিও ভগবানের অস্থিসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

বৈশালির লিচ্ছবিগণ শ্রবণ করিল, “ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইয়াছেন।” তখন তাঁহারা কুশিনারার মল্লগণের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া তাহাদিগকে জানাইলেন, “ভগবানও ক্ষত্রিয়, আমরাও ক্ষত্রিয়, আমরাও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমরাও ভগবানের অস্থিসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

কপিলবাস্তুর শাক্যগণ শ্রবণ করিলেন, “ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বাণে প্রবেশ করিয়াছেন।” ইহা শ্রবণ করিয়া শাক্যগণ কুশিনারার মল্লদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া তাহাদিগকে জানাইলেন, “ভগবান আমাদের জাতি-শ্রেষ্ঠ। আমারাও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমারাও ভগবানের অস্থিসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।

অল্লকপ্পের বুলিগণ শ্রবণ করিল, “ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বৃত হইয়াছেন।” তৎশ্রবণে বুলিগণ কুশিনারার মল্লদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া জানাইল, “ভগবানও ক্ষত্রিয়, আমরাও ক্ষত্রিয়, আমরাও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমরাও ভগবানের অস্থিসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

রামগ্রামের কোলিয়গণ শ্রবণ করিল, “ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বৃত হইয়াছেন। তৎশ্রবণে তাঁহারা কুশিনারার মল্লদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া জানাইলেন, “ভগবানও ক্ষত্রিয়, আমরাও ক্ষত্রিয়, আমরাও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমরাও ভগবানের অস্থিসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

ব্রাহ্মণ বেঠদীপক শ্রবণ করিলেন, “ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বৃত হইয়াছেন।” ইহা শ্রবণে তিনি কুশিনারার মল্লদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া জানাইলেন, “ভগবান ক্ষত্রিয়, আমি ব্রাহ্মণ। আমিও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমিও ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

পাবায় মল্লগণ শ্রবণ করিল, “ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বৃত হইয়াছেন।” ইহা শ্রবণান্তে তাঁহারা কুশিনারার মল্লগণের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া জানাইলেন, “ভগবানও ক্ষত্রিয়, আমরাও ক্ষত্রিয়। আমরাও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমরাও ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

এইরূপ উক্ত হইলে কুশিনারার মল্লগণ সমবেত জন-মণ্ডলীকে বলিলেন :

“ভগবান আমাদিগের গ্রামক্ষেত্রে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হইয়াছেন। আমরা ভগবানের অস্থির অংশ দিব না।”

২৩৭. তৎপরে ব্রাহ্মণ দ্রোণ সেই জনমণ্ডলীকে বলিলেন :

“মহোদয়গণ, আমার একটি বাক্য শ্রবণ করুন।
আমাদিগের বুদ্ধ ক্ষান্তিবাদী ছিলেন। পুরুষ শ্রেষ্ঠের
অস্থির বিভাগে কলহ অবাঞ্ছনীয়। আমরা সকলে
একত্রে সমগ্রভাবে প্রীতিপূর্ণচিত্তে আটটি ভাগ করিব,
দিকে দিকে স্তূপসমূহ বিস্তৃত হউক, মনুষ্য জাতি
চক্ষুষ্মানের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত হউক।”

২৩৮. “ব্রাহ্মণ, তাহা হইলে তুমিই ভগবানের অস্থি আটটি সমান ভাগে উত্তমরূপে বিভক্ত করো।”

“তথাস্তু” বলিয়া ব্রাহ্মণ দ্রোণ সম্মত হইয়া ভগবানের অস্থিসমূহ আটটি সমান ভাগে উত্তমরূপে বিভক্ত করিয়া উপস্থিত জনমণ্ডলীকে বলিলেন :

“মহোদয়গণ, এই কুম্ভটি আমায় দান করুন, আমি এই কুম্ভের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

জনগণ ব্রাহ্মণকে কুম্ভ দান করিল।

পিপ্ফল বনের মোরিয়গণ শ্রবণ করিল।

“ভগবান কুশিনারায় পরিনির্বৃত হইয়াছেন।” তৎশ্রবণে তাঁহারা কুশিনারার মল্লগণের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া জানাইলেন, “ভগবানও ক্ষত্রিয়, আমরাও ক্ষত্রিয়। আমরাও ভগবানের অস্থির অংশ পাইবার উপযুক্ত, আমরাও ভগবানের অস্থিসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ করিব এবং মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিব।”

“ভগবানের অস্থির অংশ আর নাই, সমস্তই বিতরিত হইয়াছে। এইস্থানের অঙ্গার গ্রহণ করো।” তাহারা অঙ্গার লইল।

২৩৯. তদনন্তর মগধরাজ অজাতশত্রু রাজগৃহে ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণপূর্বক মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

বৈশালির লিচ্ছবিগণ বৈশালিতে ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

কপিলবাস্তুর শাক্যগণ কপিলবাস্তু নগরে ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

অল্লকপ্পের বুলিগণ অল্লকপ্পে ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

রামগ্রামের কোলিয়গণ রামগ্রামে ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

ব্রাহ্মণ বেঠদীপ বেঠদীপে ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

পাবার মল্লগণ পাবায় ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

কুশিনারার মল্লগণ কুশিনারায় ভগবানের অস্থির উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

ব্রাহ্মণ দ্রোণ কুম্ভের উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

পিপ্ফল বনের মোরিয়গণ পিপ্‌ফলবনে অঙ্গারসমূহের উপর স্তূপ নির্মাণ ও মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন।

এইরূপে অস্থিসমূহের উপর আটটি স্তূপ, কুম্ভের উপর নবম এবং অঙ্গারসমূহের উপর দশম স্তূপ নির্মিত হইল।

পূর্বকালে ইহাই ছিল।

২৪০. অষ্টদ্রোণ পরিমিত চক্ষুষ্মানের অস্থি, সপ্ত দ্রোণ জম্বুদ্বীপে পূজিত।

এক দ্রোণ রাম গ্রামে নাগরাজগণ কর্তৃক পূজিত।

একটি দন্ত ত্রিদিবে পূজিত, একটি গন্ধার নগরে।

কলিঙ্গ রাজার রাজ্যে একটি এবং নাগরাজগণ কর্তৃক আরও একটি পূজিত।

উহারই তেজে এই মহী বসুন্ধরা যাগ শ্রেষ্ঠে অলংকৃত।

এইরূপে চক্ষুষ্মানের অস্থি পূজার্হগণ কর্তৃক সম্যকরূপে পূজিত”

এইরূপেই ইহা দেবেন্দ্র-নাগেন্দ্র-নরেন্দ্রগণ কর্তৃক এবং শ্রেষ্ঠ মনুষ্যগণ কর্তৃক পূজিত।

কৃতাঞ্জলি হইয়া উহার বন্দনা করো, শত শত কল্পে বুদ্ধের দর্শন দুর্লভ।

মহাপরিনির্বাণ সূত্রান্ত সমাপ্ত

The Long Discourses

|_II. The Great Chapter

DN16. মহাপরিনির্বাণ সূত্রান্ত

Translations [30]

English

繁體字

日本語

Français

Deutsch

Italiano

Español

Português

Русский

Nederlands

Norsk

Magyar

Svenska

Srpski

Čeština

Română

Slovenščina

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference

Translations [30]

English

繁體字

日本語

Français

Deutsch

Italiano

Español

Português

Русский

Nederlands

Norsk

Magyar

Svenska

Srpski

Čeština

Română

Slovenščina

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference

Commentaries [0]