২৯৩. আমি এইরূপ শ্রবণ করিয়াছি। একসময় ভগবান রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করিতেছিলেন। ওই সময় পরম সৌন্দর্যশালী গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখ রাত্রির অবসানে সমগ্র গৃধ্রকূট পর্বত আলোকিত করিয়া ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইলেন। তৎপরে তিনি ভগবানকে বলিলেন :

“দেব, ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের মুখ হইতে আমি যাহা শ্রবণ ও গ্রহণ করিয়াছি তাহা ভগবানের নিকট নিবেদন করিব।”

ভগবান বলিলেন, “পঞ্চশিখ, তুমি নিবেদন করো।”

২৯৪. দেব, পূর্বে বহু পূর্বে পঞ্চদশীর উপোসথ দিবসে প্রবারণা উৎসবে পূর্ণিমা রাত্রিতে ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ সকলে একত্রিত হইয়া সুধর্মা সভায় উপবিষ্ট ছিলেন, তাঁহাদের বৃহৎ দিব্য-পরিষদ চারি মহারাজসহ চতুর্দিকে সমাসীন ছিল। পূর্বদিকে দেবগণ পরিবেষ্টিত মহারাজ ধৃতরাষ্ট পশ্চিমাভিমুখী হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন। দক্ষিণ দিকে দেবগণ পরিবেষ্টিত মহারাজ বিরূঢ়ক উত্তরাভিমুখী হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন। পশ্চিমদিকে দেবগণ পরিবেষ্টিত মহারাজ বিরূপাক্ষ পূর্বাভিমুখী হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন। উত্তরদিকে দেবগণ পরিবেষ্টিত মহারাজ বৈশ্রবণ দক্ষিণাভিমুখী হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন। দেব, যখন সর্ব ত্রয়স্ত্রিংশ দেবতা সুধর্মা সভায় একত্রিত হইয়া উপবেশন করিতেন, এবং তাঁহাদের বৃহৎ দিব্য-পরিষদ চারি মহারাজসহ চতুর্দিকে সমাসীন হইত, তখন তাঁহাদের আসন গ্রহণ করিবার বিধি এইরূপই ছিল। পশ্চাতে আমাদের আসন হইত। দেব, যে সকল দেবতা ভগবানের শাসনে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া সম্প্রতি ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন, তাঁহারা বর্ণে ও যশে অপরাপর দেবগণকে অতিক্রম করিয়াছেন। দেব, উহাতে ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ “দেবগণের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে, অসুরগণের সংখ্যা হ্রাস হইতেছে” কহিয়া হৃষ্ট, প্রমুদিত, প্রীতি-সৌমনস্য-যুক্ত হইলেন।

২৯৫. দেব তখন দেবরাজ ইন্দ্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে প্রসন্ন দেখিয়া এই সকল গাথায় স্বকীয় অনুমোদন প্রকাশ করিলেন :

ইন্দ্রসহ ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ তথাগত এবং ধর্মের
সুধর্মতার পূজারত হইয়া প্রমুদিত হইয়াছেন।
সুগত-শাসনে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া এই স্থানে
উৎপন্ন সৌন্দর্যশালী যশস্বী নতুন দেবগণ বর্ণ,
আয়ু ও যশে অন্য দেবগণকে অতিক্রম করিয়াছেন,
তাঁহারা ভূরিপ্রাজ্ঞের শ্রাবক এবং প্রসিদ্ধি প্রাপ্ত;
ইহা দেখিয়া ইন্দ্রসহ ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ তথাগত
এবং ধর্মের সুধর্মতার পূজারত হইয়া প্রমুদিত
হইয়াছেন।

দেব, উহাতে ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ অধিকতর হৃষ্ট, প্রমুদিত, প্রীতি-সৌমনস্যযুক্ত হইলেন, “দেবগণের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে, অসুরগণের সংখ্যা হ্রাস হইতেছে।”

২৯৬. দেব, তখন দেবরাজ শক্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের চিত্তের সন্তুষ্টি জ্ঞাত হইয়া তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিলেন :

“দেবগণ, আপনার সেই ভগবানের যথার্থ আটটি গুণ শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করেন?”

“দেব, আমরা উহা শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি” তখন দেবরাজ শক্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের নিকট ভগবানের আটটি যথার্থ গুণ ঘোষণা করিলেন।”

“ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ, আপনারা কী মনে করেন? ভগবান জগতের প্রতি অনুকম্পা পরবশ হইয়া দেবতা ও মনুষ্যের হিত ও মঙ্গল সাধনে, বহু জনের সুখ ও স্বচ্ছন্দ্য বিধানে কতই নিরত! এরূপ গুণসম্পন্ন শাস্তা; একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও না।”

“ভগবানের ধর্ম স্বাখ্যাত, সাংদৃষ্টিক, অকালিক, সর্বজগৎকে সাদরে আহ্বানকারী, মুক্তিপ্রদায়ী, বিজ্ঞগণ কর্তৃক স্ব স্ব চেষ্টায় জ্ঞাতব্য। এরূপ মুক্তিপ্রদায়ী উপদেষ্টা, এরূপ গুণসম্পন্ন শাস্তা; একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

“ইহা কুশল, ইহা অকুশল” ইহা ভগবান কর্তৃক উত্তমরূপে প্রদর্শিত হইয়াছে। ইহা নিন্দনীয়, ইহা অনিন্দ্য, ইহা অনুসরণের যোগ্য, ইহা যোগ্য নহে; ইহা হীন, ইহা প্রণীত; ইহা সমাংশযুক্ত অমঙ্গল ও মঙ্গলের মিশ্রণ ভগবান ইহা উত্তমরূপে প্রদর্শন করিয়াছেন। বস্তুসমূহের গুণের এতাদৃশ প্রকাশক শাস্তা; একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

“ভগবান শ্রাবকদিগের নিকট নির্বাণগামী মার্গ উত্তমরূপে প্রকাশ করিয়াছেন, ওই মার্গ ও নির্বাণ সহগামী। যেরূপ গঙ্গাজল ও যমুনাজল একত্রে প্রবাহিত হইয়া এক হইয়া যায়, সেইরূপই ভগবান কর্তৃক শ্রাবকগণের নিকট প্রকাশিত নির্বাণগামী মার্গ, নির্বাণ এবং উহার মার্গ সহগামী। নির্বাণগামী মার্গের এরূপ প্রকাশক শাস্তা; একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

“ভগবান সহায়সম্পন্ন, মার্গে ভ্রাম্যমান শিক্ষার্থী এবং উদ্‌যাপিত ব্রহ্মচর্য্য ক্ষীণাসব উভয়ই তাঁহার সহচর। ভগবান তাঁহাদের সহিত বিচ্ছিন্ন না হইয়া একত্রবাসে আনন্দলাভ করিয়া অবস্থান করেন। এরূপ সহবাসানন্দরত শাস্তা, একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

“ভগবানের লাভ সুপ্রতিষ্ঠিত, তাঁহার যশ এতই বিস্তৃত যে, মনে হয়, ক্ষত্রিয়গণের সকলেই তাঁহার অনুরাগী, মদহীন হইয়া ভগবান আহার গ্রহণ করেন। এরূপ বিগত মদ হইয়া আহার গ্রহণশীল শাস্তা, একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

“ভগবান বাক্যানুরূপ কর্মের কারক, কর্মানুরূপ বাক্যের কথনকারী, এরূপ যথাবাদী তথাকারী, যথাকারী তথাবাদী, ধর্মানুধর্ম প্রতিপন্ন শাস্তা, একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

“ভগবান বিচিকিৎসোত্তীর্ণ, নিঃশঙ্ক, আদি-ব্রহ্মচর্যের উদ্‌যাপনরূপ সংকল্পে সিদ্ধি প্রাপ্ত। এরূপ গুণসম্পন্ন শাস্তা, একমাত্র ভগবান ব্যতীত অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও দেখা যায় না, বর্তমানেও নাই।”

২৯৭. দেব, দেবরাজ শক্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের নিকট ভগবানের এই আটটি যথার্থ গুণ ঘোষণা করিলেন। দেবগণ ভগবানের আটটি যথার্থ গুণের এই বর্ণনা শ্রবণ করিয়া অধিকতর আনন্দিত প্রমুদিত, প্রীতি ও সৌমনস্যযুক্ত হইলেন।

দেব, তৎপরে কোনো কোনো দেবতা এইরূপ বলিলেন :

“অহো দেবগণ, যদি চারিজন সম্যকসম্বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়া ভগবানের ন্যায় ধর্মোপদেশ দিতেন! তাহা হইলে উহা বহুজনের হিত ও সুখকর হইত, জগতের পক্ষে করুণার উৎস হইত, দেব মনুষ্যের লাভ, হিত ও সুখজনক হইত।”

কোনো কোনো দেবতা এইরূপ বলিলেন :

“দেবগণ, চারি সম্যকসম্বুদ্ধের তো কথাই নাই, যদি তিনজন সম্যকসম্বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়া ভগবানের ন্যায় ধর্মোপদেশ দিতেন, তাহা হইলে উহা বহুজনের হিত ও সুখকর হইত, জগতের পক্ষে করুণার উৎস হইত, দেব-মনুষ্যের লাভ, হিত ও সুখজনক হইত।”

কোনো কোনো দেবতা এইরূপ বলিলেন :

“দেবগণ, তিনজন সম্যকসম্বুদ্ধের তো কথাই নাই। যদি দুইজন সম্যকসম্বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়া ভগবানের ন্যায় ধর্মোপদেশ দিতেন; তাহা হইলে উহা বহুজনের হিত ও সুখকর হইত, জগতের পক্ষে করুণার উৎস হইত, দেব-মনুষ্যের লাভ, হিত ও সুখজনক হইত।”

২৯৮. দেব, এইরূপ উক্ত হইলে দেবরাজ শক্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে এইরূপ বলিলেন, “দেবগণ, একই লোকধাতুতে যে দুইজন অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ একই সময়ে আবির্ভূত হইবেন, তাহা অসম্ভব, এরূপ পরিস্থিতির অবকাশ নাই। ইহা সম্ভব নহে। দেবগণ, ভগবান নীরোগ, স্বাস্থ্যসম্পন্ন ও দীর্ঘজীবী হইয়া অবস্থান করুন! উহা বহুজনের হিত ও সুখকর হইবে, জগতের পক্ষে করুণার উৎস হইবে, দেব-মনুষ্যের লাভ, হিত ও সুখজনক হইবে।”

অতঃপর, দেব, যে বিষয়ের নিমিত্ত ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ সুধর্মা সভায় একত্রিত হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন, ওই বিষয়ে চিন্তা ও মন্ত্রণা করিয়া ওই সম্পর্কে যাহা কথিত ও উপদিষ্ট হইল, চারি মহারাজ, স্বীয় স্বীয় আসনে স্থিত হইয়, স্থানান্তরে গমন না করিয়া, উহা গ্রহণ করিলেন।

কথিত বাক্য ও উপদেশ গ্রহণ করিয়া রাজগণ

প্রসন্ন চিত্তে স্বীয় স্বীয় আসনে দণ্ডায়মান রহিলেন।

২৯৯. অনন্তর, দেব, উত্তর দিকে বিশাল আলোক উৎপন্ন হইল, দেবগণের দেবানুভাব অতিক্রমকারী দীপ্তি প্রাদুর্ভূত হইল। তখন দেবরাজ শক্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে সম্বোধন করিলেন :

“দেবগণ, যখন নিমিত্তসমূহ দৃষ্ট হইতেছে, আলোক উৎপন্ন হইয়াছে, দীপ্তি প্রাদুর্ভূত হইয়াছে, তখন ব্রহ্মার আবির্ভাব হইবে। আলোকের উৎপত্তি, দীপ্তির প্রাদুর্ভাব ব্রহ্মার আবির্ভাবের পূর্বনিমিত্ত।

যখন নিমিত্ত দৃষ্ট হইতেছে, তখন ব্রহ্মার আবির্ভাব

হইবে, বিপুল মহান দীপ্তি ব্রহ্মার আবির্ভাবের লক্ষণ

৩০০. দেব, তখন ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ স্ব স্ব আসনে উপবেশন করিলেন, “এই দীপ্তির পরিণতি জ্ঞাত হইব, উহা হইতে প্রসূত ফল দর্শন করিয়া যাইব।” চারি মহারাজও আপন আপন আসনে উপবিষ্ট হইয়া উক্তরূপ সংকল্প করিলেন। ইহা শ্রবণ করিয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ সকলেই সম্মত হইয়া অনুরূপ সংকল্প গ্রহণ করিলেন।”

দেব, যখন ব্রহ্মা সনৎকুমার ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের নিকট আবির্ভূত হন, তখন তিনি তদুদ্দেশ্যে নির্মিত স্থূল দেহে আত্মপ্রকাশ করেন। যাহা ব্রহ্মার স্বাভাবিক রূপ তাহা ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের চক্ষুপথের অতীত। যখন ব্রহ্মা সনৎকুমার ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন তখন তিনি অন্যান্য দেবগণকে বর্ণে ও যশে অতিক্রম করেন। দেব, যেরূপ সুবর্ণ বিগ্রহ মনুষ্য দেহকে ঔজ্জ্বল্যে পরাভূত করে, সেইরূপেই ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের নিকট আবির্ভূত হইবার কালে ব্রহ্মা সনৎকুমার অন্যান্য দেবগণকে বর্ণে ও যশে অতিক্রম করেন। যখন ব্রহ্মা সনৎকুমার ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সম্মুখে আবির্ভূত হন, তখন দেবসভার কেহই তাঁহাকে অভিবাদন করে না, আসন গ্রহণ করিতে নিমন্ত্রণও করে না। সকলেই নীরবে কৃতাঞ্জলিপুটে পর্যঙ্কাবদ্ধ হইয়া উপবিষ্ট থাকেন, “ব্রহ্মা সনৎকুমার ইচ্ছামত যেকোন দেবতার পালঙ্কে উপবেশন করিবেন।” ব্রহ্মা সনৎকুমার যে দেবতার পালঙ্কে উপবেশন করেন, সেই দেবতা বিপুল আনন্দ ও সৌমনস্য অনুভব করেন। দেব, নবাভিষিক্ত ক্ষত্রিয় রাজা যেরূপ বিপুল আনন্দ ও সৌমনস্য অনুভব করেন, সেইরূপ যে দেবতার পালঙ্কে ব্রহ্মা সনৎকুমার উপবেশন করেন, সেই দেবতা বিপুল আনন্দ ও সৌমনস্য অনুভব করেন।

দেব, অতঃপর ব্রহ্মা সনৎকুমার ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের চিত্তের প্রসন্নতা জ্ঞাত হইয়া অদৃশ্য থাকিয়া এই সকল গাথার দ্বারা অনুমোদন করিলেন :

ইন্দ্রসহ ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ তথাগত এবং ধর্মের
সুধর্মতার পূজারত হইয়া প্রমুদিত হইয়াছেন।
সুগত-শাসনে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া এই স্থানে
উৎপন্ন সৌন্দর্যশালী যশস্বী নতুন দেবগণ বর্ণ,
আয়ু ও যশে অন্য দেবগণকে অতিক্রম করিয়াছেন,
তাঁহারা ভূরিপ্রাজ্ঞের শ্রাবক এবং প্রসিদ্ধি প্রাপ্ত;
ইহা দেখিয়া ইন্দ্রসহ ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ তথাগত
এবং ধর্মের সুধর্মতার পূজারত হইয়া প্রমুদিত
হইয়াছেন।

৩০১. দেব, ব্রহ্মা সনৎকুমার এইরূপ বলিলেন। এইরূপ ভাষণকালে তাঁহার স্বর অষ্টাঙ্গ সমন্বিত হইয়াছিল, সুস্পষ্ট, সুবোধ্য, সুমিষ্ট, শ্রবণীয়, অব্যাহত, অবিক্ষিপ্ত, গম্ভীর এবং প্রতিধ্বননক্ষম হইয়াছিল। যেহেতু ব্রহ্মা সনৎকুমার স্বকীয় স্বরে দেবসভাকেই সম্বোধন করিয়াছিলেন, সেই হেতু তাঁহার নির্ঘোষ পরিষদের বাহিরে গমন করে নাই। যাঁহার স্বর এইরূপ অষ্টাঙ্গণ্ডসমন্বিত হয়, তিনি ব্রহ্মস্বর কথিত হন।

৩০২. দেব, অতঃপর ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ ব্রহ্মা সনৎকুমারকে এইরূপ বলিলেন :

“হে ব্রহ্মা, সাধু, আমরা ইহা উত্তমরূপে বিচার করিয়া আনন্দিত হইয়াছি, দেবরাজ ইন্দ্রও ভগবানের অষ্টবিধ যথার্থ গুণ বর্ণনা করিয়াছেন, উহাও চিন্তা করিয়া আমরা আনন্দিত হইয়াছি।”

দেব, তখন ব্রহ্মা সনৎকুমার দেবরাজ ইন্দ্রকে এইরূপ বলিলেন :

“দেবরাজ, সাধু, আমরাও ভগবানের অষ্টবিধ যথার্থ গুণ শ্রবণ করিব।”

“মহাব্রহ্মা, তথাস্তু” বলিয়া দেবরাজ শক্র ব্রহ্মা সনৎকুমারের নিকট ভগবানের অষ্টবিধ যথার্থ গুণ বর্ণনা করিলেন।”

“মহাব্রহ্মা কী মনে করেন?” [এইরূপ কহিয়া শক্র পুনরায় ভগবানের অষ্টবিধ যথার্থ গুণের বর্ণনা করিলেন] ব্রহ্মা সনৎকুমার ভগবানের অষ্টবিধ যথার্থ গুণের বর্ণনা শ্রবণ করিয়া আনন্দিত, প্রমুদিত, প্রীতি-সৌমনস্যযুক্ত হইলেন।”

৩০৩. দেব, তৎপরে ব্রহ্মা সনৎকুমার স্থূল আত্মভাব নির্মাণ করিয়া কুমার পঞ্চশিখের ন্যায় হইয়া শূন্যে উঠিয়া আকাশে অন্তরীক্ষে পর্যঙ্কাবদ্ধ হইয়া উপবেশনপূর্বক ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের নিকট আবির্ভূত হইলেন। যেরূপ বলবান পুরুষ উত্তম প্রত্যস্তরণাচ্ছাদিত পালঙ্কে অথবা সমতল ভূমিভাগে উপবেশন করে, সেইরূপই, দেব, ব্রহ্মা সনৎকুমার শূন্যে উঠিয়া আকাশে অন্তরীক্ষে পর্যঙ্কাবদ্ধ হইয়া উপবেশনপূর্বক ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে সম্বোধন করিলেন :

৩০৪. ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ কী মনে করেন? ভগবান কতকাল ধরিয়া মহাপ্রজ্ঞাসম্পন্ন হইয়াছেন?

অতীতে দিসম্পতি নামে রাজা ছিলেন। রাজা দিসম্পতির গোবিন্দ নামক ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছিল। রাজা দিসম্পতির রেণু নামে পুত্র ছিল, ব্রাহ্মণ গোবিন্দের জোতিপাল নামক পুত্র ছিল। রাজকুমার রেণু, তরুণ জোতিপাল এবং অন্য ছয়জন ক্ষত্রিয় পুত্র, এই আটজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। কালক্রমে ব্রাহ্মণ গোবিন্দের মৃত্যু হইল। ব্রাহ্মণের মৃত্যুতে রাজা দিসম্পতি বিলাপপরায়ণ হইলেন :

“যে সময়ে আমরা ব্রাহ্মণ গোবিন্দের হস্তে সমস্ত কর্তব্য সমর্পণ করিয়া ভোগসুখ নিরত ছিলাম, ওই সময়েই ব্রাহ্মণ গোবিন্দের মৃত্যু হইল!”

তখন রাজপুত্র রেণু রাজা দিসম্পতিকে বলিলেন :

“দেব, ব্রাহ্মণ গোবিন্দের মৃত্যুর জন্য আপনি অত্যধিক বিলাপ করিবেন না! ব্রাহ্মণ গোবিন্দের জোতিপাল নামক পুত্র আছে, ওই পুত্র পিতা অপেক্ষাও অধিকতর পণ্ডিত ও অর্থদর্শী। যে সকল কর্ম তাহার পিতার হস্তে ন্যস্ত ছিল, ওই সকল জোতিপালের উপর সমর্পিত হউক।”

“কুমার, তুমি কি তাহাই উচিত মনে করো?”

“আমি সেইরূপই মনে করি।”

৩০৫. অতঃপর রাজা দিসম্পতি জনৈক কর্মচারীকে বলিলেন :

“তুমি ব্রাহ্মণ জোতিপালের নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে বল, ব্রাহ্মণ জোতিপালের মঙ্গল হউক, রাজা দিসম্পতি ব্রাহ্মণ জোতিপালকে আহ্বান করিতেছেন, রাজা ব্রাহ্মণ জোতিপালের দর্শনকামী।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া কর্মচারী জোতিপালের নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে উক্ত সংবাদ জ্ঞাপন করিল।

জোতিপাল সম্মত হইয়া রাজা দিসম্পতির নিকট গমনপূর্বক তাঁহার সহিত শিষ্টাচার সঙ্গত বাক্যালাপান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলেন। তখন রাজা জোতিপালকে বলিলেন :

“জোতিপাল আমাদের অনুশাসক হউন। তিনি যেন ওই কার্য করিতে অসম্মত না হন। তাঁহার পৈতৃক স্থানে তাঁহাকে স্থাপিত করিব, তাঁহাকে গোবিন্দের পদে অভিষিক্ত করিব।”

জোতিপাল সম্মত হইলেন।

অতঃপর রাজা দিসম্পতি জোতিপালকে গোবিন্দের পদে অভিষিক্ত করিয়া তাঁহাকে পৈতৃক স্থানে স্থাপিত করিলেন। অভিষিক্ত ও পৈতৃক স্থানে স্থাপিত হইয়া জোতিপাল যে সকল বিষয় পিতার অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল”, ওই সকলের অনুশাসন করিতে লাগিলেন; যাহা পিতার অনুশাসনের বহির্ভূত ছিল, তাহার অনুশাসন করিলেন না। যে সকল কর্ম তাঁহার পিতা সম্পাদন করিতেন, তিনিও ওই সকল কর্ম সম্পাদন করিতে লাগিলেন, যাহা তাঁহার পিতা করিতেন না, তিনিও উহা করিতে ক্ষান্ত হইলেন। মনুষ্যগণ বলিতে লাগিল :

“এই ব্রাহ্মণ গোবিন্দ, মহাগোবিন্দ।” এইরূপে জোতিপালের মহাগোবিন্দ নামের উৎপত্তি হইল।

৩০৬. অনন্তর মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণ পূর্বোক্ত ছয়জন ক্ষত্রিয়ের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাদিগকে বলিলেন :

“রাজা দিসম্পতি জীর্ণ, বৃদ্ধ, আয়ুষ্কালের পূর্ণতায় উপনীত। জীবনের স্থিতিকাল সম্বন্ধে কে নিশ্চিত হইতে পারে? রাজা দিসম্পতির মৃত্যু হইলে কর্তৃপক্ষগণ রাজপুত্র রেণুকেই তাঁহার স্থলে সম্ভবত অভিষিক্ত করিবেন। ক্ষত্রিয়গণ, আপনারা রাজপুত্র রেণুর নিকট গমনপূর্বক এইরূপ নিবেদন করুন, “আমরা কুমারের প্রিয়, মনোজ্ঞ ও অপ্রতিকুল মিত্র, যাহাতে কুমারের সুখ তাহাতে আমাদের সুখ, যাহাতে কুমারের দুঃখ তাহাতে আমাদের দুঃখ। রাজা দিসম্পতি জীর্ণ, বৃদ্ধ, আয়ুষ্কালের পূর্ণতায় উপনীত। জীবনের স্থিতিকাল সম্বন্ধে কে নিশ্চিত হইতে পারে? রাজা দিসম্পতির মৃত্যু হইলে কর্তৃপক্ষগণ সম্ভবত রাজকুমার রেণুকেই রাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন। যদি কুমার রাজ্য লাভ করেন, তাহা হইলে আমরাও যেন উহার অংশ প্রাপ্ত হই।”

ক্ষত্রিয়গণ সম্মত হইয়া মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণের সমীপে গমনপূর্বক পূর্বোক্তরূপে তাঁহার নিকট সমস্ত জ্ঞাপন করিলেন।

“আমার রাজ্যে যদি তোমরা সমৃদ্ধ না হইবে, তবে আর কে হইবে? যদি আমি রাজ্য লাভ করি, তোমরা তাহার অংশ পাইবে।”

৩০৭. সময়ক্রমে রাজা দিসম্পতির মৃত্যু হইল। কর্তৃপক্ষগণ রাজপুত্র রেণুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া রেণু সর্ববিধ ভোগসুখে লিপ্ত হইলেন। তদনন্তর মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণ পূর্বোক্ত ছয় ক্ষত্রিয়ের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাদিগকে বলিলেন :

“ভদ্রগণ, রাজা দিসম্পতি লোকান্তরিত, রাজ্যে অভিষিক্ত রেণু সর্ববিধ ভোগসুখে লিপ্ত। কে জানে? ভোগানন্দের উন্মাদনা আছে। আপনারা রাজা রেণুর নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলুন, “রাজা দিসম্পতি মৃত, রেণু রাজ্যে অভিষিক্ত, দেব স্বীয় অঙ্গীকার স্মরণ করেন?”

৩০৮. ক্ষত্রিয়গণ মহাগোবিন্দের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া রাজা রেণুর নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলিলেন :

“দেব, রাজা দিসম্পতি মৃত, আপনি রাজ্যে অভিষিক্ত, আপনার পূর্ব অঙ্গীকার স্মরণ করুন?”

“আমি স্মরণ করি। উত্তরে আয়ত এবং দক্ষিণে শকটমুখ এই মহাপৃথিবী সমান সাত ভাগে বিভক্ত করিতে কে সমর্থ?”

“একমাত্র মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণ ব্যতীত আর কে উহা করিতে পারে?”

অতঃপর রাজা রেণু একজন পুরুষকে আদেশ করিলেন :

“তুমি মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলো : “রাজা রেণু আপনাকে আহ্বান করিতেছেন।”

“দেব, তথাস্তু” বলিয়া সেই পুরুষটি মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণের নিকট গমনপূর্বক উক্ত বার্তা তাঁহাকে প্রদান করিল।

মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণ রাজা রেণুর নিকট গমনপূর্বক তাঁহার সহিত যথারীতি বাক্যালাপান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলেন। তখন রাজা রেণু তাঁহাকে বলিলেন :

“গোবিন্দ, উত্তরে আয়ত এবং দক্ষিণে শকটমুখ এই মহাপৃথিবী সাত সমান ভাগে বিভক্ত করো।”

“তথাস্তু” কহিয়া ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ উত্তরে আয়ত এবং দক্ষিণে শকটমুখ এই মহাপৃথিবী সাত সমান ভাগে বিভক্ত করিলেন, প্রত্যেক ভাগ শকটমুখাকৃতিসম্পন্ন হইল।

৩০৯. ওই বিভাগে রাজা রেণুর জনপদ মধ্যস্থলে অবস্থিত হইল।

কলিঙ্গদিগের দন্তপুর, অস্সকগণের পোতন,
অবন্তীগণের মহিস্সতী; সোবীরগণের রোরুক,
বিদেহদিগের মিথিলা, অঙ্গে চম্পা,
কাশীর বারাণসী, এই সকল মহাগোবিন্দ কৃত।

৩১০. ওই ছয়জন ক্ষত্রিয় আপন আপন লাভে আনন্দিত ও পরিপূর্ণ সংকল্প হইলেন, “যাহা আমাদিগের ইচ্ছিত, আকাঙ্ক্ষিত, অভিপ্রেত এবং প্রার্থিত ছিল, তাহা আমরা লাভ করিয়াছি।”

সত্তভু, ব্রহ্মদত্ত, বেস্সভূ, ভরত,
রেণু এবং দুই ধৃতরাষ্ট্র এই
সাতজন রাজা ওই সময়ে ছিলেন।

প্রথম ভাণবার সমাপ্ত।

৩১১. অনন্তর সেই ছয় ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলিলেন :

“ব্রাহ্মণ গোবিন্দ যেরূপ রাজা রেণুর প্রিয়, আদৃত এবং অপ্রতিকূল সহায়, আমাদিগেরও ওইরূপ সহায়। গোবিন্দ আমাদের অনুশাসন করুন, উহাতে অস্বীকৃত হইবেন না।”

ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ সম্মত হইলেন। তিনি ওই সাতজন মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয় রাজার অনুশাসন কার্য করিতে লাগিলেন, সাতজন ব্রাহ্মণ মহাশাল এবং সাতশত স্নাতককে মন্ত্রশিক্ষা দিতে লাগিলেন।

৩১২. পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের এইরূপ খ্যাতি ঘোষিত হইল, “ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ স্বচক্ষে ব্রহ্মাকে দর্শন করেন, ব্রহ্মার সহিত বিশ্রম্ভালাপ করেন, তাঁহার সহিত মন্ত্রণা করেন।” তখন ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ চিন্তা করিলেন, “আমি ব্রহ্মাকে স্বচক্ষে দর্শন করি, তাঁহার সহিত বাক্যালাপ ও মন্ত্রণা করি, এইরূপ প্রীতিকর খ্যাতি আমার সম্বন্ধে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে। আমি কিন্তু ব্রহ্মাকে দর্শন করি না, তাঁহার সহিত বাক্যালাপ ও মন্ত্রণাও করি না। কিন্তু আমি বয়োবৃদ্ধ সম্মানার্হ ব্রাহ্মণ আচার্য প্রাচার্যগণকে বলিতে শুনিয়াছি :

“যিনি বর্ষার চারি মাস ধ্যানানুযুক্ত থাকেন, করুণার ধ্যানের অনুশীলন করেন, তিনি ব্রহ্মাকে দর্শন করেন এবং তাঁহার সহিত বাক্যালাপ ও মন্ত্রণা করেন।” অতএব আমি বর্ষার চারি মাস ধ্যানরত হইয়া করুণার ধ্যানের অনুশীলন করিব।”

৩১৩. অতঃপর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ রাজা রেণুর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে এইরূপ বলিলেন, “আমার সম্বন্ধে প্রীতিকর খ্যাতি বিস্তৃত হইয়াছে যে, আমি ব্রহ্মাকে দর্শন করি, ব্রহ্মার সহিত বিশ্রম্ভালাপ এবং মন্ত্রণা করি। কিন্তু আমি ব্রহ্মাকে দর্শন করি না, তাঁহার সহিত বাক্যালাপ ও মন্ত্রণাও করি না। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ সম্মানার্হ ব্রাহ্মণ আচার্য প্রাচার্যগণকে বলিতে শুনিয়াছি যে, যিনি বর্ষার চারি মাস ধ্যানরত হইয়া করুণার ধ্যানের অনুশীলন করেন, তিনি ব্রহ্মাকে দর্শন করেন, তাঁহার সহিত বাক্যালাপ ও মন্ত্রণা করেন। আমি বর্ষার চারিমাস ধ্যানরত হইয়া করুণার ধ্যানের অনুশীলন করিতে ইচ্ছা করি। একমাত্র আমার খাদ্যবাহক ভিন্ন অপর কেহ আমার নিকট আসিতে পারিবে না।”

“গোবিন্দ, তোমার যাহা ইচ্ছা।”

৩১৪. অতঃপর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ ছয়জন ক্ষত্রিয়ের নিকট গিয়া রাজা রেণুর নিকট যাহা বলিয়াছিলেন তাহাই বলিলেন এবং তাঁহাদের নিকটও বিদায় গ্রহণ করিলেন।

৩১৫. পরে মহাগোবিন্দ সাতজন ব্রাহ্মণ মহাশাল এবং সাতশত স্নাতকের নিকট গমন করিয়া আপনার সম্বন্ধে ঘোষিত প্রীতিকর খ্যাতির কথা এবং ব্রহ্মার সহিত দর্শন, বাক্যালাপ ও মন্ত্রণার উপায় বিবৃত করিলেন। এই সমস্ত বিবৃত হইলে তিনি বলিলেন, “আপনারা যাহা শিক্ষা এবং হৃদয়স্থ করিয়াছেন, উহা পুনঃপুন আবৃত্তি করুন এবং পরস্পরকে মন্ত্রশিক্ষা দিন। আমি বর্ষার চারি মাস ধ্যানরত হইয়া করুণার ধ্যানের অনুশীলন করিতে ইচ্ছা করি। একমাত্র আমার খাদ্যবাহক ভিন্ন অপর কেহ আমার নিকট আসিতে পারিবে না।”

“আপনার যাহা ইচ্ছা।”

৩১৬. অতঃপর মহাগোবিন্দ তাঁহার সমমর্যাদাসম্পন্ন চত্বারিংশ পত্নীর নিকট গমনপূর্বক তাঁহাদিগকে পূর্বোক্ত জনরব এবং নির্জনে ধ্যাননিবিষ্ট হইবার নিমিত্ত আপনার সংকল্প জ্ঞাপন করিলেন। তাঁহারাও তাঁহাদের সম্মতি প্রকাশ করিলেন।

৩১৭. তৎপরে মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণ নগরের পূর্বদিকে নতুন বিশ্রামাগার নির্মাণ করাইয়া বর্ষার চারি মাস ধ্যানরত হইয়া করুণার ধ্যানের অনুশীলন করিলেন, একমাত্র খাদ্যবাহক ভিন্ন অপর কেহ তাঁহার নিকট গমন করিতে পারিল না। চারিমাস অতীত হইবার পর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের চিত্ত-চাঞ্চল্য ও মানসিক উদ্বেগ হইল, “আমি বৃদ্ধ সম্মানার্হ ব্রাহ্মণ আচার্য-প্রাচার্যগণকে বলিতে শুনিয়াছি যে, যিনি বর্ষার চারি মাস ধ্যানরত হইয়া করুণার ধ্যানের অনুশীলন করেন, তিনি ব্রহ্মার দর্শন লাভ করেন এবং তাঁহার সহিত বাক্যালাপ ও মন্ত্রণা করেন। কিন্তু আমি ব্রহ্মাকে দেখিলাম না, এবং তাঁহার সহিত বাক্যালাপ অথবা মন্ত্রণা করিলাম না।”

৩১৮. তখন ব্রহ্মা সনৎকুমার স্বচিত্তে মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণের চিত্তবিতর্ক জ্ঞাত হইয়া যেরূপ বলবান পুরুষ সংকুচিত বাহু প্রসারিত করে অথবা প্রসারিত বাহু সংকুচিত করে, সেইরূপ ব্রহ্মলোক হইতে অন্তর্হিত হইয়া মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। ওই অদৃষ্টপূর্ব রূপ দেখিয়া মহাগোবিন্দ ভীত, স্তম্ভিত ও লোমহর্ষযুক্ত হইলেন। তিনি সভয়ে, সোদ্বেগে ও রোমাঞ্চকলেবরে ব্রহ্মা সনৎকুমারকে গাথায় সম্বোধন করিলেন :

“দেব, সুন্দর, যশস্বী, শ্রীমান আপনি কে?
আমরা জানি না, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি
কী প্রকারে আপনাকে জানিব?”
“ব্রহ্মলোকে আমি সনৎকুমার নামে
জ্ঞাত, সর্বদেবতার নিকট আমি
পরিচিত, গোবিন্দ, তুমিও আমাকে
সেই রূপেই জানিবে।”
“ব্রহ্মার নিমিত্ত আসন, জল, পাদ্য,
মধু-পাক ইত্যাদি প্রস্তুত,
আপনাকে অর্ঘ
গ্রহণে অনুরোধ করিতেছি, উহা
গ্রহণ করুন।”
“গোবিন্দ, তোমার দত্ত অর্ঘ গ্রহণ করিতেছি।
ঐহিক মঙ্গল এবং পারলৌকিক সুখের
জন্য তুমি যাহা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করিতে
পার, আমি অনুমতি দিতেছি।”

৩১৯. অতঃপর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ চিন্তা করিলেন, “আমি ব্রহ্মা সনৎকুমারের অনুমতি প্রাপ্ত। আমি তাঁহার নিকট কি প্রার্থনা করিব? ঐহিক অথবা পারলৌকিক মঙ্গল?”

তৎপরে তিনি চিন্তা করিলেন, “এই জগতে যাহা কাম্য তাহা আমার সুবিদিত। অপরেও আমাকে ইহজগতের কাম্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। অতএব আমি তাঁহার নিকট পারলৌকিক মঙ্গল প্রার্থনা করিব।”

এইরূপ চিন্তা করিয়া ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ ব্রহ্মা সনৎকুমারকে গাথায় সম্বোধন করিলেন :

“আমি সংশয়পূর্ণ হইয়া সংশয়োত্তীর্ণ
ব্রহ্মা সনৎকুমারকে অপরের জ্ঞাতব্য
বিষয়ে প্রশ্ন করিতেছি, কী প্রকার
অবস্থায় স্থিত হইয়া এবং কীরূপ
শিক্ষা লাভ করিয়া মনুষ্য মৃত্যুহীন
ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়?”
“হে ব্রাহ্মণ, মনুষ্যলোকে মমত্বের
বর্জন, একাগ্রচিত্তে করুণার ধ্যানে
রতি, সর্বপ্রকার অপবিত্রতা এবং
মৈথুন হইতে বিরতি, এইরূপ
অবস্থায় স্থিত হইয়া এবং এইরূপ
শিক্ষা লাভ করিয়া মনুষ্য মৃত্যুহীন
ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়।”

৩২০. “মমত্বের বর্জন সম্বন্ধে দেব যাহা বলিলেন আমি তাহা বুঝিয়াছি। কেহ অল্প কিংবা মহৎ ভোগ পরিত্যাগ করিয়া, স্বল্প অথবা বহুসংখ্যক জ্ঞাতিবর্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, কেশ ও শ্মশ্রূ মোচনপূর্বক কাষায় বস্ত্র পরিহিত হইয়া গৃহত্যাগ করিয়া গৃহহীন প্রব্রজ্যা আশ্রয় করেন। ইহাকেই আমি দেব কথিত মমত্বের বর্জনরূপ গ্রহণ করি।

“একাগ্রতা সম্বন্ধে দেব যাহা ব্যক্ত করিয়াছেন আমি তাহা বুঝিয়াছি। কেহ নির্জন বাসস্থান আশ্রয় করেন, অরণ্য, বৃক্ষমূল, পর্বত, কন্দর, গিরি-গুহা, শ্মশান, বনপ্রস্থ, উন্মুক্ত স্থান, পলালপুঞ্জ আশ্রয় করেন। ইহাকেই আমি দেব-কথিত একাগ্র অবস্থারূপে গ্রহণ করি।

“দেব কথিত করুণার ধ্যানে রতি, ইহাও আমি বুঝিয়াছি। কেহ করুণাসহগত চিত্তে একদিক হইতে আরম্ভ করিয়া যথাক্রমে দুই, তিন, চারিদিক স্ফুরিত করিয়া বিহার করেন। এইরূপে তিনি ঊর্ধ্বে, অধোদিকে, সর্বদিকে, সর্বত্র, সর্বব্যাপী করুণাসহগত চিত্তে বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয় অবৈর এবং মৈত্রী দ্বারা সর্বজগৎকে স্ফুরিত করিয়া বিহার করেন। ইহাকেই আমি দেবকথিত করুণার ধ্যানে রতিরূপে গ্রহণ করি।

“অপবিত্রতা সম্বন্ধে দেব যাহা বলিলেন, আমি তাহা বুঝিলাম না।”

“হে ব্রহ্মা, মনুষ্যলোকে অপবিত্রতা
কী কী? ইহা আমার অজ্ঞাত। হে
ধীর ব্যক্ত করো। কীসের দ্বারা আচ্ছন্ন
হইয়া ক্রুরকর্মা মনুষ্য নিরয়গামী
হয়? ব্রহ্মলোকের দ্বার তাহার
নিকট রুদ্ধ হয়?”
“ক্রোধ, মৃষাবাদ, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা,
কৃপণতা, অভিমান, ঈর্ষা, তৃষ্ণা, বিচিকিৎসা,
পরপীড়ন, লোভ, দ্বেষ, মদ, মোহ এই
সকলে যুক্ত অপবিত্র মনুষ্য নিরয়গামী
হয়, ব্রহ্মলোকের দ্বার তাহাদের
নিকট রুদ্ধ হয়।”

“দেব কথিত অপবিত্রতা সম্বন্ধে আমি যাহা ভাবিলাম তাহাতে ওই সকল অপবিত্রতা গৃহবাসীর পক্ষে দূরীভূত করা দুঃসাধ্য, আমি গৃহত্যাগ করিয়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“গোবিন্দ, তোমার যেরূপ অভিরুচি।”

৩২১. অনন্তর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ রাজা রেণুর নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলিলেন, আপনার রাজ্যের অনুশাসনের নিমিত্ত আপনি অন্য পুরোহিতের অন্বেষণ করুন। আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করি। ব্রহ্মা অপবিত্রতাসমূহ সম্বন্ধে যে উক্তি করিয়াছেন, তাহা হইতে আমি বুঝিয়াছি যে ওই সকল অপবিত্রতা গৃহবাসীর পক্ষে দূরীভূত করা দুঃসাধ্য। আমি গৃহত্যাগ করিয়া প্রব্রজ্যা আশ্রয় করিব।”

“ভূমিপতি রাজা রেণু! আপনাকে বলিতেছি :

রাজ্যের অনুশাসনের চিন্তা আপনিই
করুন, পৌরহিত্য করিতে আর আমার
রুচি নাই।”
“যদি আপনার ভোগ পর্যাপ্ত
না হয়, আমি উহা পূর্ণ করিব,
যদি কেহ আপনার অনিষ্ট সাধন
করে, আমি উহার নিবারণ করিব
আমি ভূমিপতি ও সেনাপতি,
আপনি পিতা আমি পুত্র, গোবিন্দ,
আমাদিগকে পরিত্যাগ করিবেন না।”
“আমার ভোগের অভাব নাই,
আমাকে কেহ হিংসাও করে না,
আমি অমনুষ্য-বাক্য শ্রবণ করিয়াছি,
তজ্জন্য গৃহবাসে আমার রতি নাই।”
“কী প্রকার অমনুষ্য? উহা আপনাকে
কি বলিয়াছে যাহা শুনিয়া আপনি
আপনার গৃহ এবং আমাদের
সকলকে পরিত্যাগ করিতেছেন?”
“উপবসথের পূর্বে আমি যজ্ঞকরণেচ্ছু
হইয়াছিলাম, আমার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত
ও কুশ তৃণ বিক্ষিপ্ত ছিল। ওই সময়
ব্রহ্মলোক হইতে ব্রহ্মা সনৎকুমার
আমার নিকট আবির্ভূত হইলেন।
তিনি আমার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
উহা শুনিয়া গৃহে আমার রতি হইতেছে না।”

“গোবিন্দ আপনি যাহা বলিলেন তাহা আমি বিশ্বাস করি, অপার্থিব বাক্য শ্রবণ করিয়া আপনি কী প্রকারে উহার অন্যথা করিবেন? আমরা আপনার অনুগামী হইব, শান্ত হউন। বৈদূর্যমণি যেরূপ স্বচ্ছ, বিমল, শুভ্র হয়, সেইরূপ আমরা শুদ্ধ হইয়া গোবিন্দের অনুশাসন দ্বারা চালিত হইব।”

“যদি, গোবিন্দ, আপনি গৃহত্যাগ করিয়া গৃহহীন প্রব্রজ্যা আশ্রয় করেন, আমিও উহাই করিব, তৎপরে আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি।”

৩২২. তৎপরে ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ পূর্বোক্ত ছয় ক্ষত্রিয়ের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাদিগকে বলিলেন, “আপনারা এক্ষণে আপনাদের রাজ্যের অনুশাসনের নিমিত্ত অন্য পুরোহিতের অনুসন্ধান করুন। আমি গৃহত্যাগ করিয়া প্রব্রজ্যা গ্রহণে ইচ্ছুক। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি গৃহত্যাগপূর্বক প্রব্রজ্যা আশ্রয় করিব।”

তখন ক্ষত্রিয়গণ একপ্রান্তে গমনপূর্বক একত্রে চিন্তা করিলেন, “এই সকল ব্রাহ্মণ ধনলুব্ধ, অতএব আমরা ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দকে ধনলোভ প্রদর্শন করিব।”

তাঁহারা ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, এই সকল সাতটি রাজ্যে প্রভূত ধন-সম্পত্তি বিদ্যমান, উহা হইতে আপনার যত ইচ্ছা গ্রহণ করুন।”

“ক্ষান্ত হউন! আমারও প্রভূত সম্পত্তি আছে, উহা আপনাদেরই কল্যাণে লব্ধ, ওই সমস্ত বর্জন করিয়া আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

তখন ওই ছয়জন ক্ষত্রিয় একপ্রান্তে গমনপূর্বক একত্রে চিন্তা করিলেন, “ওই সকল ব্রাহ্মণ স্ত্রী-লুব্ধ, অতএব আমরা ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দকে স্ত্রী-লোভ প্রদর্শন করিব।

তাঁহারা ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “এই সপ্তরাজ্যে বহুসংখ্যক নারী বিদ্যমান। উহাদের মধ্যে আপনার যত ইচ্ছা লইতে পারেন।”

“ক্ষান্ত হউন! আমার চত্বারিংশ সমমর্যাদা-সম্পন্ন ভার্যা আছে। উহাদের সকলকেই পরিত্যাগ করিয়া আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা কহিয়াছেন তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

৩২৩. “যদি গোবিন্দ গৃহত্যাগপূর্বক প্রব্রজ্যা অবলম্বন করেন, আমরাও তাহাই করিব, তৎপরে আপনার যে গতি, আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

“যদি সাংসারিক সেবিত কাম বর্জন করিতে ইচ্ছা করো, তাহা হইলে উদ্যোগসম্পন্ন ও দৃঢ় হও, ক্ষান্তিবল-সমাহিত হও, ইহা ঋজুমার্গ, অনুত্তর মার্গ, ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির নিমিত্ত সাধুজন-রক্ষিত সদ্ধর্ম।”

“তাহা হইলে গোবিন্দ সাত বৎসর অপেক্ষা করুন, সাত বৎসর অতীত হইলে আমরাও প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব, তৎপরে আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

“সাত বৎসর অতি দীর্ঘকাল আমি সাত বৎসর আপনাদের জন্য অপেক্ষা করিতে পারিব না। জীবনের স্থিতিকাল সম্বন্ধে কে নিশ্চিত হইতে পারে? মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রজ্ঞা দ্বারা প্রবুদ্ধ হইতে হইবে, কুশলকর্ম করিতে হইবে, ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতে হইবে, যাহা জাত তাহার মৃত্যু হইতে মুক্তি নাই। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা কহিয়াছেন তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

তাহা হইলে পূজ্য গোবিন্দ ছয় বৎসর অপেক্ষা করুন… পাঁচ বৎসর অপেক্ষা করুন… চারি বৎসর অপেক্ষা করুন… তিন বৎসর… দুই বৎসর… এক বৎসর অপেক্ষা করুন। এক বৎসর অবসানে আমরাও প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব, তখন আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

“এক বৎসর অতি দীর্ঘকাল। আমি আপনাদের জন্য এক বৎসর অপেক্ষা করিতে পারিব না। জীবনের স্থিতিকাল সম্বন্ধে কে নিশ্চিত হইতে পারে? মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রজ্ঞা দ্বারা প্রবুদ্ধ হইতে হইবে, কুশলকর্ম করিতে হইবে, ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতে হইবে, যাহা জাত তাহার মৃত্যু হইতে মুক্তি নাই। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“তাহা হইলে পূজ্য গোবিন্দ সাত মাস অপেক্ষা করুন। সাত মাস অতীত হইলে আমরাও প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব, তখন আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

“সাত মাস অতি দীর্ঘকাল। আমি সাত মাস আপনাদের জন্য অপেক্ষা করিতে পারিব না। জীবনের স্থিতিকাল সম্বন্ধে কে নিশ্চিত হইতে পারে? মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রজ্ঞা দ্বারা প্রবুদ্ধ হইতে হইবে, কুশলকর্ম করিতে হইবে, ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতে হইবে, যাহা জাত তাহার মৃত্যু হইতে মুক্তি নাই। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা কহিয়াছেন তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“তাহা হইলে পূজ্য গোবিন্দ ছয় মাস… পাঁচ মাস… চারি মাস… তিন মাস… দুই মাস… এক মাস… অর্ধমাস অপেক্ষা করুন। অর্ধমাস অতীত হইলে আমরাও প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব, তখন আপনার যে গতি, আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

“অর্ধমাস অতি দীর্ঘকাল। আমি অর্ধমাস আপনাদের জন্য অপেক্ষা করিতে পারিব না। জীবনের স্থিতিকাল সম্বন্ধে কে নিশ্চিত হইতে পারে? মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রজ্ঞা দ্বারা প্রবুদ্ধ হইতে হইবে, কুশলকর্ম করিতে হইবে, ব্রহ্মচর্য্য পালন করিতে হইবে, যাহা জাত তাহার মৃত্যু হইতে মুক্তি নাই। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা কহিয়াছেন তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“তাহা হইলে পূজ্য গোবিন্দ সপ্তাহ অপেক্ষা করুন, ওই সময়ের মধ্যে আমরা পুত্র-ভ্রাতৃগণকে রাজ্যশাসন সম্বন্ধে উপদেশ দিব। সপ্তাহ হইলে আমরাও প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব, তখন আপনার যে গতি, আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

“সপ্তাহ দীর্ঘকাল নহে, আমি আপনাদিগের জন্য সপ্তাহ অপেক্ষা করিব।”

৩২৪. অনন্তর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ পূর্বোক্ত সাত ব্রাহ্মণ মহাশাল এবং সাত শত স্নাতকের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাদিগকে এইরূপ বলিলেন :

“আপনাদিগকে মন্ত্র শিক্ষা দিবার জন্য আপনারা এক্ষণে অন্য আচার্যের অনুসন্ধান করুন। আমি গৃহত্যাগপূর্বক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করি। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা কহিয়াছেন, তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“আপনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিবেন না। প্রব্রজ্যায় স্বল্প ক্ষমতা, স্বল্প লাভ; ব্রাহ্মণত্বে প্রভূত ক্ষমতা এবং প্রভূত লাভ।”

“আপনারা এরূপ বলিবেন না, “প্রব্রজ্যায় স্বল্প ক্ষমতা, স্বল্প লাভ; ব্রাহ্মণত্বে প্রভূত ক্ষমতা এবং প্রভূত লাভ।” আমা অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতাশালী অথবা অধিকতর লাভবান কে আছে? আমি এক্ষণে রাজগণের রাজা, ব্রাহ্মণদিগের ব্রহ্মা এবং গৃহপতিগণের দেবতা, এই সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজসাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“যদি পূজ্য গোবিন্দ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, আমরাও তাহাই করিব, তখন আপনার যে গতি, আমাদেরও সেই গতি হইবে।”

৩২৫. অতঃপর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ সমমর্যাদা-সম্পন্না চত্বারিংশ ভার্যার নিকট গমন করিয়া তাঁহাদিগকে বলিলেন, “নারীগণ ইচ্ছানুসারে স্ব স্ব জ্ঞাতিকুলে গমন করিতে পারেন, অথবা অন্য পতির অন্বেষণ করিতে পারেন, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করি। ব্রহ্মা অপবিত্রতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা শুনিয়া আমি বুঝিয়াছি যে, গৃহবাসীর পক্ষে ওই সকল অপবিত্রতার দূরীকরণ সহজ সাধ্য নয়, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব।”

“আপনিই আমাদের বাঞ্ছিত জ্ঞাতি, আপনিই আমাদের বাঞ্ছিত ভর্তা। যদি পূজ্য গোবিন্দ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমরাও তাহাই করিব, তৎপরে আপনার যে গতি, আমাদেরও সে গতি হইবে।”

৩২৬. তদনন্তর ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ সপ্তাহ অতীত হইলে কেশ ও শ্মশ্রূ মোচনপূর্বক কাষায়বস্ত্র পরিধান করিয়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিলেন। তিনি এইরূপ করিলে সপ্ত মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয়, সপ্ত ব্রাহ্মণ মহাশাল, সপ্তশত স্নাতক, চত্বারিংশ সম-মর্যাদাসম্পন্না ভার্যা, অনেক সহস্র ক্ষত্রিয়, অনেক সহস্র ব্রাহ্মণ, অনেক সহস্র গৃহপতি, অন্তঃপুরবাসিনী বহুসংখ্যক নারী কেশ ও শ্মশ্রূ মোচনপূর্বক কাষায়বস্ত্র পরিধান করিয়া ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের সহিত প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিলেন। সেই পরিষদ পরিবৃত হইয়া ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ গ্রাম, নগর, রাজধানীসমূহে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। ওই সময় ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ যে গ্রাম অথবা নগরে গমন করিলেন, তথায় রাজার রাজা হইলেন, ব্রাহ্মণদিগের ব্রহ্মা হইলেন, গৃহপতিগণের দেবতা হইলেন। ওই সময়ে কেহ জৃম্ভণ করিলে অথবা কাহারও পদস্খলন হইলে তাহারা এইরূপ কহিত, “ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দকে নমস্কার, সপ্ত পুরোহিতকে নমস্কার।”

৩২৭. ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দ মৈত্রীসহগত চিত্তে যথাক্রমে এক দিক, দুই, তিন, চারি দিক স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে ঊর্ধ্ব, অধঃ, সর্বদিক, সর্বত্র, সর্বলোক মৈত্রীসহগত চিত্তে বিপুল মহদ্গত অপ্রমেয় বৈর ও বিদ্বেষহীনতা দ্বারা স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। করণাসহগত চিত্তে… মুদিতাসহগত চিত্তে… উপেক্ষাসহগত চিত্তে যথাক্রমে এক দিক, দুই, তিন, চারি দিক স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে ঊর্ধ্ব, অধঃ সর্বদিক, সর্বত্র, সর্বলোক উপেক্ষাসহগত চিত্তে বিপুল মহদ্গত অপ্রমেয় অবৈর এবং মৈত্রী দ্বারা স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন, এবং শ্রাবকগণকে ব্রহ্মলোকের সহিত মিলিত হইবার মার্গ উপদেশ দিতে লাগিলেন।

৩২৮. ওই সময়ে ব্রাহ্মণ মহাগোবিন্দের যে সকল শ্রাবক শাসনের সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিলেন, তাঁহারা মরণান্তে দেহের ধ্বংসে সুগতি প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইলেন। যাঁহারা শাসনের সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিলেন না, তাঁহাদের কেহ কেহ মরণান্তে পরনির্মিত-বশবর্তী দেবলোকে উৎপন্ন হইলেন, কেহ কেহ নির্মাণরতি দেবলোকে, কেহ কেহ তুষিত দেবলোকে, কেহ কেহ যাম দেবলোকে, কেহ কেহ ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে, কেহ কেহ চাতুর্মহারাজিক দেবলোকে উৎপন্ন হইলেন। যাঁহারা হীনতম দেহ প্রাপ্ত হইলেন, তাঁহারা গন্ধর্বলোকে উৎপন্ন হইলেন।

এইরূপে ওই সকল কুলপুত্রের প্রব্রজ্যা বৃথা অথবা নিষ্ফল হইল না, উহা সফল ও সার্থক হইল।

৩২৯. “ভগবানের স্মরণ হয়?”

“পঞ্চশিখ, আমার স্মরণ হয়। ওই সময়ে আমি মহাগোবিন্দ ব্রাহ্মণ ছিলাম। আমি ওই সকল শ্রাবকদিগকে ব্রহ্মলোক গমনের মার্গ উপদেশ দিয়াছিলাম। কিন্তু পঞ্চশিখ, ওই ব্রহ্মচর্য্য নির্বেদের অনুকূল ছিল না, বিরাগ, নিরোধ, উপশম, অভিজ্ঞা, সম্বোধি ও নির্বাণের অনুকূল ছিল না, উহা কেবল ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির অনুকূল ছিল। পঞ্চশিখ, আমার এই ব্রহ্মচর্য্য একান্ত, নির্বেদ, বিরাগ, নিরোধ, উপশম, অভিজ্ঞা, সম্বোধি এবং নির্বাণের অনুকূল। উহা আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গ; যথা : সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। পঞ্চশিখ, এই ব্রহ্মচর্য্য একান্ত নির্বেদ, বিরাগ, নিরোধ, উপশম, অভিজ্ঞা, সম্বোধি এবং নির্বাণের অনুকূল।

৩৩০. “পঞ্চশিখ, আমার যে সকল শ্রাবক শাসনের সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিয়াছেন তাঁহারা তৃষ্ণার ক্ষয় হেতু অনাসব চেতবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি এই জগতেই স্বয়ং জ্ঞাত হইয়া, উপলব্ধি করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করেন। যাঁহারা শাসনে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেন নাই তাঁহাদের কেহ কেহ পঞ্চ অবরভাগীয় সংযোজনের ক্ষয়হেতু ঔপপাতিক থাকেন, এবং উহা হইতে অচ্যুত হইয়া ওই অবস্থাতেই নির্বাণ প্রাপ্ত হন; কেহ কেহ ত্রিবিধ সংযোজনের ক্ষয় হেতু রাগ-দ্বেষ-মোহের ক্ষীণতা প্রাপ্তির ফলে সকৃদাগামী হইয়া থাকেন, একবার মাত্র এই পৃথিবীতে আগমন করিয়া দুঃখ হইতে মুক্ত হন; কেহ কেহ ত্রিবিধ সংযোজনের ক্ষয় হেতু স্রোতাপন্ন হইয়া থাকেন, তাঁহারা সর্ববিধ দুর্গতি হইতে মুক্ত এবং সম্বোধি তাঁহাদের নিয়তি। এইরূপে, পঞ্চশিখ, এই সকল কুল পুত্রের প্রব্রজ্যা বৃথা অথবা নিষ্ফল হয় নাই, উহা সফল ও সার্থক হইয়াছে।”

ভগবান এইরূপ বলিলেন। গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখ আনন্দিত হইয়া ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন এবং অনুমোদন করিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণপূর্বক ওই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।

মহাগোবিন্দ সূত্রান্ত সমাপ্ত।

The Long Discourses

|_II. The Great Chapter

DN19. মহাগোবিন্দ সূত্রান্ত

Translations [19]

English

繁體字

日本語

Deutsch

Italiano

Português

Norsk

Srpski

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference