৩৪৪. আমি এইরূপ শ্রবণ করিয়াছি। একসময় ভগবান মগধ দেশে রাজগৃহের পূর্বদিকে অম্বসণ্ডা নামক ব্রাহ্মণগ্রামের উত্তরে বেদিয়ক পর্বতে ইন্দসাল গুহাতে অবস্থান করিতেছিলেন। ওই সময়ে দেবরাজ শক্র সক্ক ভগবানের দর্শনে অভিলাষী হইয়াছিলেন।

তখন দেবরাজ শক্রের মনে এই চিন্তার উদয় হইল, “ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ এক্ষণে কোথায় অবস্থান করিতেছেন?” দেবরাজ শক্র দেখিলেন যে, ভগবান মগধদেশে রাজগৃহের পূর্বদিকে অম্বসণ্ডা নামক ব্রাহ্মণগ্রামের উত্তরে বেদিয়ক পর্বতে ইন্দসাল গুহাতে অবস্থান করিতেছেন। ইহা দেখিয়া তিনি ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে সম্বোধন করিলেন :

“দেবগণ, ভগবান মগধদেশে রাজগৃহের পূর্বদিকে অম্বস- নামক ব্রাহ্মণগ্রামের উত্তরে বেদিয়ক পর্বতে ইন্দসাল গুহাতে অবস্থান করিতেছেন। যদি আমরা সেই ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধের দর্শনার্থ গমন করি, তাহা হইলে কীরূপ হয়?”

“উত্তম প্রস্তাব” কহিয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ দেবরাজ শক্রের নিকট সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

৩৪৫. তখন দেবরাজ শক্র গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখকে সম্বোধনপূর্বক তাঁহার নিকটও পূর্বোক্ত প্রস্তাব করিলেন, এবং পঞ্চশিখও পূর্বোক্ত প্রকারে

প্রস্তাবের অনুমোদন করিয়া বেলুব-পণ্ডু বীণা হস্তে দেবরাজ শক্রের অনুগামী হইলেন।

৩৪৬. অনন্তর দেবরাজ শক্র ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ কর্তৃক পরিবৃত হইয়া গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখসহ যেরূপ বলবান পুরুষ সংকুচিত বাহু প্রসারিত করে অথবা প্রসারিত বাহু সংকুচিত করে, সেইরূপ ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে অন্তর্হিত হইয়া মগধদেশে রাজগৃহের পূর্বদিকে অম্বসণ্ডা নামক ব্রাহ্মণগ্রামের উত্তরে বেদিয়ক পর্বতে প্রকাশিত হইলেন।

ওই সময় বেদিয়ক পর্বত এবং অম্বসণ্ডা ব্রাহ্মণগ্রাম দেবতাদিগের দেবানুভাব হেতু অতীব জ্যোতির্ময় হইল। এমন কি চতুর্দিকে গ্রামসমূহের অধিবাসীগণ এইরূপ বলিতে লাগিল :

“অদ্য বেদিয়ক পর্বত আদীপ্ত, বেদিয়ক পর্বত অগ্নিময়, বেদিয়ক পর্বত প্রজ্জ্বলিত। কী নিমিত্ত অদ্য বেদিয়ক পর্বত এবং অম্বসণ্ডা ব্রাহ্মণগ্রাম জ্যোতির্ময় হইল?” এইরূপ কহিয়া তাহারা উদ্বিগ্ন ও রোমাঞ্চিত হইল।

৩৪৭. তৎপরে দেবরাজ শক্র গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখকে সম্বোধন করিলেন :

“প্রিয় পঞ্চশিখ, যাঁহারা তথাগত তাঁহাদের নিকট মৎস্যদৃশের পক্ষে উপস্থিত হওয়া সুসাধ্য নহে, তাঁহারা অনুক্ষণ ধ্যান ও নির্জনরত, যদি তুমি প্রথমে ভগবানকে প্রসন্ন করিতে পার, তাহা হইলে তিনি প্রসন্ন হইবার পর আমরা ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধের দর্শনার্থ গমন করিতে পারি।”

“উত্তম, আপনি সাফল্য লাভ করুন”, ইহা কহিয়া গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখ দেবরাজ শক্রের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া বীণা হস্তে ইন্দসাল গুহায় গমন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া “এইস্থানে আমি ভগবান হইতে অতিদূরেও হইব না, অতি নিকটেও হইব না, তিনি আমার স্বর শুনিতে পাইবেন,” এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইলেন।

৩৪৮. পরে তিনি বীণা বাদন এবং তৎসঙ্গে বুদ্ধ, ধর্ম, অর্হৎ এবং ভোগসম্বন্ধীয় এই গাথাগুলিও উচ্চারণ করিতে লাগিলেন :

“ভদ্রে সূর্যবর্চসে! আমি তোমার পিতা তিম্বরুর
বন্দনা করিতেছি, যিনি, হে কল্যাণী! তোমার,
আমার আনন্দদায়িনীর জন্মদাতা। বায়ু যেরূপ
ঘর্মাক্তের নিকট মধুর, পানীয় পিপাসিতের
নিকট মধুর, ধর্ম অরহতের নিকট মধুর, সেইরূপ
জ্যোতির্ময়ী! তুমি আমার প্রিয়। যেরূপ রোগার্তের
ভৈষজ্য, ক্ষুধাতুরের আহার, সেইরূপ তুমি প্রেমবারি
সিঞ্চনে আমার বাসনাগ্নি নির্বাপিত করো। পদ্মরেণুযুক্ত
শীতল-সলিল-পুষ্করিণীর মধ্যে ধর্মসন্তপ্ত নাগের ন্যায়
আমি তোমার বক্ষঃস্থল মধ্যে লীন হইব।
আমি অঙ্কুশাতীত নাগের ন্যায় তোত্র-তোমার জয়ী,
তোমার সৌন্দর্যে উন্মত্ত হইয়া আমার অসংযত
চিত্ত মৎকৃত কর্মের কারণ নির্ণয়ে অক্ষম।
আমার পথভ্রষ্টচিত্ত তোমাতেই বন্ধ, বঙ্কগ্রাসী মৎস্যের
ন্যায় আমি আপনাকে মুক্ত করিতে অক্ষম! সুন্দরি!
ভদ্রে! মন্দলোচনে! আমাকে আলিঙ্গন কর;
কল্যাণী! আমাকে আলিঙ্গন করো, ইহাই আমার
প্রার্থনা। কুঞ্চিতকেশী! আমার অল্পপরিমিত
বাসনা এক্ষণে, অর্হৎগণকে প্রদত্ত দক্ষিণার ন্যায়,
বহুল পরিমাণে বর্ধিত হইয়াছে। অর্হৎগণের
সেবায় আমি যে পুণ্যসঞ্চয় করিয়াছি, ওই পুণ্যফল,
সর্বাঙ্গ কল্যাণী! যেন তোমার সহিত একত্রে
প্রাপ্ত হই। এই পৃথিবীমণ্ডলে আমি যে পুণ্য
সঞ্চয় করিয়াছি, ওই পুণ্যফল, সর্বাঙ্গকল্যাণী!
যেন তোমার সহিত একত্রে প্রাপ্ত হই। ধ্যানলীন,
বিজ্ঞ, স্মৃতিসংযুক্ত, অমৃতগবেষী শাক্যপুত্র মুনির
ন্যায় সূর্যবর্চসে! আমি তোমার অন্বেষী।
মুনি যেরূপ উত্তম সম্বোধি প্রাপ্ত হইয়া আনন্দ লাভ
করেন, সেইরূপ কল্যাণী! আমি তোমার
সহিত মিলিত হইয়া আনন্দ লাভ করিব।
ত্রয়স্ত্রিংশ দেবাধিপতি শক্র যদি আমাকে বর দান
করেন, তাহা হইলে, ভদ্রে! আমি তোমাকেই
প্রার্থনা করিব, আমার প্রেম এতই গভীর।
সুমেধে! সদ্য ফুল্ল সালসম তোমার পিতাকে
বন্দনাসহ নমস্কার করিতেছি যে পিতার এতাদৃশী
সন্তান।”

৩৪৯. পঞ্চশিখের গীত শেষ হইলে ভগবান তাঁহাকে বলিলেন :

“পঞ্চশিখ, তোমার তন্ত্রীর স্বর গীতস্বরের সহিত এবং গীতস্বর তন্ত্রীস্বরের সহিত মিলিয়া যাইতেছে, তন্ত্রীর স্বর গীতস্বরকে অতিক্রম করিতেছে না, গীতস্বরও তন্ত্রীস্বরকে অতিক্রম করিতেছে না। পঞ্চশিখ, বুদ্ধ, ধর্ম, অর্হৎ এবং কাম-সম্বন্ধীয় এই গাথাসমূহ তুমি কোন সময়ে রচনা করিয়াছ?”

“ভন্তে, ভগবান প্রথম সম্বুদ্ধ হইবার কালে একদিন উরুবেলায় নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অজপাল নামক ন্যাগ্রোধ বৃক্ষমূলে অবস্থান করিতেছিলেন। ভন্তে, ওই সময় আমি তিম্বরু নামক গন্ধর্বরাজের কন্যা ভদ্রা সূর্যবর্চসার প্রেমাকাঙ্ক্ষী হইয়াছিলাম। কিন্তু সেই ভগিনী অপরের প্রতি আসক্ত ছিলেন, তিনি সারথি মাতলির পুত্র শিখণ্ডীর প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী ছিলেন। যেহেতু আমি কোনো উপায়েই সেই ভগিনীকে পাইলাম না, সেই হেতু আমি বেলুপণ্ডু বীণা হস্তে গন্ধর্বরাজ তিম্বরুর বাসস্থানে গিয়া বীণার ঝঙ্কারের সহিত এই গাথাগুলি গাহিলাম :

“ভদ্রে সূর্যবর্চসে, আমি তোমার পিতা তিম্বরুকে
বন্দনা করিতেছি, যিনি, হে কল্যাণী! তোমার,
আমার আনন্দদায়িনীর জন্মদাতা। বায়ু যেরূপ
ঘর্মাক্তের নিকট মধুর, পানীয় পিপাসিতের
নিকট মধুর, ধর্ম অর্হতের নিকট মধুর, সেইরূপ
জ্যোতির্ময়ী! তুমি আমার প্রিয়। যেরূপ রোগার্তের
ভৈষজ্য, ক্ষুধাতুরের আহার, সেইরূপ তুমি প্রেমবারি
সিঞ্চনে আমার বাসনাগ্নি নির্বাপিত করো। পদ্মরেণুযুক্ত
শীতল-সলিল-পুষ্করিণীর মধ্যে ধর্মসন্তপ্ত নাগের ন্যায়
আমি তোমার বক্ষঃস্থল মধ্যে লীন হইব।
আমি অঙ্কুশাতীত নাগের ন্যায় তোত্র-তোমার জয়ী,
তোমার সৌন্দর্যে উন্মত্ত হইয়া আমার অসংযত
চিত্ত মৎকৃত কর্মের কারণ নির্ণয়ে অক্ষম।
আমার পথভ্রষ্টচিত্ত তোমাতেই বন্ধ, বঙ্কগ্রাসী মৎস্যের
ন্যায় আমি আপনাকে মুক্ত করিতে অক্ষম! সুন্দরী!
ভদ্রে! মন্দলোচনে! আমাকে আলিঙ্গন কর;
কল্যাণী! আমাকে আলিঙ্গন করো, ইহাই আমার
প্রার্থনা। কুঞ্চিতকেশী! আমার অল্পপরিমিত
বাসনা এক্ষণে, অর্হৎগণকে প্রদত্ত দক্ষিণার ন্যায়,
বহুল পরিমাণে বর্ধিত হইয়াছে। অর্হৎগণের
সেবায় আমি যে পুণ্যসঞ্চয় করিয়াছি, ওই পুণ্যফল,
সর্বাঙ্গ কল্যাণী! যেন তোমার সহিত একত্রে
প্রাপ্ত হই। এই পৃথিবীমণ্ডলে আমি যে পুণ্য
সঞ্চয় করিয়াছি, ওই পুণ্যফল, সর্বাঙ্গকল্যাণী!
যেন তোমার সহিত একত্রে প্রাপ্ত হই। ধ্যানলীন,
বিজ্ঞ, স্মৃতিসংযুক্ত, অমৃতগবেষী শাক্যপুত্র মুনির
ন্যায় সূর্যবর্চসে! আমি তোমার অন্বেষী।
মুনি যেরূপ উত্তম সম্বোধি প্রাপ্ত হইয়া আনন্দ লাভ
করেন, সেইরূপ কল্যাণী! আমি তোমার
সহিত মিলিত হইয়া আনন্দ লাভ করিব।
ত্রায়স্ত্রিংশ দেবাধিপতি শক্র যদি আমাকে বর দান
করেন, তাহা হইলে, ভদ্রে! আমি তোমাকেই
প্রার্থনা করিব, আমার প্রেম এতই গভীর।
সুমেধে, সদ্য ফুল্ল সালসম তোমার পিতাকে
বন্দনাসহ নমস্কার করিতেছি যে পিতার এতাদৃশী সন্তান।”

ভন্তে, তৎপরে ভদ্রা সূর্যবচ্চসা আমাকে বলিলেন :

“ভদ্র, আমি সেই ভগবানের প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করি নাই, তথাপি ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সুধর্মা সভায় নৃত্যপ্রদর্শনার্থ গমনকালে ভগবানের বিষয় শ্রবণ করিয়াছি। তুমি যখন ভগবানের যশোকীর্তন করিলে, তখন আজ আমাদের মিলন হউক।”

“উহাই সেই” ভগিনীর সহিত আমার মিলন, তাহার পর আর কখনো আমরা মিলিত হই নাই।”

৩৫০. অতঃপর দেবরাজ শক্র এইরূপ চিন্তা করিলেন :

“গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখ এবং ভগবান উভয়ে মিত্রভাবে বাক্যালাপ করিতেছেন।”

তখন দেবেন্দ্র শক্র পঞ্চশিখকে সম্বোধন করিলেন :

“প্রিয় পঞ্চশিখ, তুমি আমার পক্ষ হইতে ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক তাঁহার নিকট এইরূপ নিবেদন করো, ভন্তে, দেবেন্দ্র শক্র অমাত্য এবং পরিজনবর্গসহ নত মস্তকে ভগবানের চরণ বন্দনা করিতেছেন।”

“উত্তম”, কহিয়া পঞ্চশিখ শক্রের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক বলিলেন :

“ভন্তে, দেবেন্দ্র শক্র অমাত্য এবং পরিজনবর্গসহ নত মস্তকে ভগবানের চরণ বন্দনা করিতেছেন।”

“পঞ্চশিখ, দেবরাজ শক্র অমাত্য এবং পরিজনবর্গসহ সুখী হউন, দেব, মনুষ্য, অসুর, নাগ, গন্ধর্ব প্রভৃতি সর্বপ্রাণী সুখকামী।”

৩৫১. যাঁহারা তথাগত তাঁহারা মহাশক্তিশালীগণকে এইরূপে আশীর্বাদ করেন। আশীর্বাদ প্রাপ্ত হইয়া দেবরাজ শক্র ভগবানের ইন্দসাল গুহায় প্রবেশপূর্বক ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইলেন, ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ এবং গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখও সেইরূপই করিলেন।

ওই সময় ইন্দসাল গুহার যে সকল স্থান বিষম ছিল সেই সকল স্থান সমতল হইল, সঙ্কীর্ণ স্থানসমূহ বিস্তৃত হইল, অন্ধকার গুহায় আলোক প্রকাশিত হইল, দেবগণের দেবানুভাবই ইহার কারণ।

৩৫২. তখন ভগবান দেবরাজ শক্রকে বলিলেন :

“ইহা আশ্চর্য! অদ্ভুত! যে, আয়ুষ্মান কৌশিক বহু কার্যে, বহু করণীয়ে ব্যাপৃত হইয়াও এইস্থানে আগমন করিতে সমর্থ হইয়াছেন!”

“ভন্তে, আমি বহু দিন হইতে ভগবানের দর্শনার্থ আগমন করিতে অভিলাষী ছিলাম, কিন্তু ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের কোনো না কোনো কার্যে ব্যাপৃত হইয়া আমি ভগবানের দর্শনার্থ আগমন করিতে পারি নাই। ভন্তে, একসময় ভগবান শ্রাবস্তী নগরে সললাগারে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন আমি ভগবানের দর্শনার্থ শ্রাবস্তী নগরে গমন করিয়াছিলাম।

ভন্তে, ওই সময় ভগবান সমাধিস্থ হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন এবং বৈশ্রবণের পরিচারিকা ভুঞ্জতি কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবানকে নমস্কার করিতে রত ছিল। তখন, ভন্তে, আমি ভুঞ্জতিকে এইরূপ বলিয়াছিলাম :

“ভগিনী, তুমি আমার পক্ষ হইতে ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক নিবেদন করো যে, দেবরাজ শক্র অমাত্য ও পরিজনবর্গণ্ডসহকারে নতমস্তকে ভগবানের চরণ বন্দনা করিতেছেন।”

আমি এইরূপ কহিলে ভুঞ্জতি বলিলেন :

“দেব, ভগবানের দর্শনার্থ এখন সময় নয়, তিনি এখন সমাধিস্থ।”

“তাহা হইলে, ভগিনী, ভগবান সমাধি হইতে উত্থিত হইলে আমার পক্ষ হইতে তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক আমার উক্ত অভিপ্রায়ানুরূপ তাঁহাকে কহিবে।” ভন্তে, সেই ভগিনী, কি আমার পক্ষ হইতে ভগবানকে অভিবাদন করিয়াছিলেন? তাঁহার বাক্য কি ভগবানের স্মরণ আছে?”

“দেবেন্দ্র, তিনি আমাকে অভিবাদন করিয়াছিলেন। তাঁহার বাক্য আমার স্মরণে আছে। অধিকন্তু আয়ুষ্মানের রথচক্রের শব্দে আমার ধ্যানভঙ্গ হইয়াছিল।”

ভন্তে, যে সকল দেবতা আমার পূর্বে ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন, আমি তাঁহাদের মুখে শ্রবণ করিয়া বুঝিয়াছি যে, “যখন অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ তথাগতগণ জগতে আবির্ভূত হন, তখন দেবগণের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং অসুরগণের সংখ্যা হ্রাস প্রাপ্ত হয়।” ভন্তে, আমিও ইহা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়াছি যে, যেহেতু অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, তথাগত জগতে আবির্ভূত হইয়াছেন, সেই হেতু দেবগণের সংখ্যা বর্ধিত হইয়াছে এবং অসুরগণের সংখ্যা হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়াছে।

৩৫৩. ভন্তে, এই কপিলবাস্তু নগরেই গোপিকা নাম্নী এক শাক্যকন্যা ছিলেন। তিনি বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘে শ্রদ্ধাবতী এবং শীলসমন্বিতা ছিলেন। তিনি নারীসুলভ চিত্ত বর্জন করিয়া পুরুষ-চিত্তের ভাবনাপূর্বক মরণান্তে সুগতিসম্পন্ন ও স্বর্গে উৎপন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সহবাস লাভ করিয়া আমাদিগের পুত্র স্থানীয় হইয়াছেন। ওই স্থানেও তিনি “গোপক দেবপুত্র”রূপে অভিহিত হইয়াছেন। ভন্তে, অপর তিনজন ভিক্ষুও ভগবানের শাসনে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া হীন গন্ধর্বলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন। তাঁহারা পঞ্চেন্দ্রিয় সম্পর্কিত ভোগে রত হইয়া আমাদিগের সেবা ও পরিচর্যা করিতে আসিয়া থাকেন। এইরূপে আমাদের সেবা পরিচর্যায় আগতকালে তাঁহারা গোপক দেবপুত্র কর্তৃক তিরস্কৃত হইয়াছিলেন, “ভদ্রগণ, আপনাদের মুখ কোন দিকে ছিল যে আপনারা ভগবানের ধর্ম শ্রবণ করেন নাই? আমি নারী হইয়াও বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘে শ্রদ্ধাবতী হইয়া, শীলপালনকারিনী হইয়া নারীসুলভ চিত্ত বর্জন করিয়া পুরুষ-চিত্তের ভাবনাপূর্বক মরণান্তে সুগতিসম্পন্ন ও স্বর্গে উৎপন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সহবাস লাভ করিয়া দেবেন্দ্র শক্রের পুত্রস্থানীয় হইয়াছি। এই স্থানেও আমি “গোপক দেবপুত্র”রূপে অভিহিত হইয়াছি। আপনারা ভগবানের শাসনে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়াও হীন গন্ধর্বলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন। আমার সহধর্মীগণ যে হীন গন্ধর্ব দেহ ধারণ করিয়াছেন, এ দৃশ্য সত্যই অশোভন।” ভন্তে, গোপক কর্তৃক তিরস্কৃত দেবগণের দুইজন সেই জন্মেই স্মৃতি লাভপূর্বক ব্রহ্মপুরোহিত দেবলোকে উৎপন্ন হইলেন। কিন্তু একজন দেব ইন্দ্রিয় সম্পর্কিত ভোগে রত হইয়া রহিলেন।”

৩৫৪. “আমি চক্ষুষ্মানের উপাসিকা ছিলাম, আমার
নাম ছিল গোপিকা,
বুদ্ধ ও ধর্মে শ্রদ্ধাবতী হইয়া আমি প্রসন্নচিত্তে সংঘের
সেবানিরতা ছিলাম।
সেই বুদ্ধেরই ধর্মবলে আমি শক্রের মহানুভাব পুত্র
হইয়াছি,
মহাতেজস্বী হইয়া স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়াছি, এইস্থানে
আমি গোপক নামে অভিহিত।
অতঃপর দেখিলাম আমার পূর্বপরিচিত ভিক্ষুগণ
গন্ধর্বলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন।
পূর্বে মনুষ্যজন্মে অন্নপান এবং পাদপরিচর্যাদ্বারা
আমরা স্বকীয় নিবাসে যাহার সেবা করিয়াছিলাম,
ইঁহারা সেই গৌতমের শ্রাবক।
ইঁহাদের মুখ কোন দিকে ছিল যে ইঁহারা বুদ্ধের
ধর্ম শ্রবণ করেন নাই?
সর্বদর্শী কর্তৃক প্রত্যক্ষীভূত এবং সুপ্রচারিত ধর্ম
প্রত্যেককে স্বয়ং হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে।
আমি আপনাদের সেবারতা হইয়া আর্যগণের
সুভাষিত বাক্য শ্রবণ করিয়া
শক্রের মহানুভাব পুত্র হইয়াছি, মহাতেজস্বী হইয়া
স্বর্গে উৎপন্ন হইয়াছি।
কিন্তু আপনারা শ্রেষ্ঠের পূজা করিয়া, অনুত্তর
ব্রহ্মচর্যের পালন করিয়া,
হীন কায় প্রাপ্ত হইয়াছেন, অযোগ্য আপনাদের
এই উৎপত্তি।
সহধর্মীর হীনদেহ ধারণ অপ্রীতিকর দৃশ্য,
আপনারা গন্ধর্বলোকে উৎপন্ন হইয়া
দেবগণের পরিচর্যারত।
আমি পূর্বে গৃহবাসী হইলেও আমার বর্তমান
বৈশিষ্ট্য অবলোকন করুন,
পূর্বে স্ত্রী হইয়াও আজ আমি দেবপুরুষ,
দিব্যকামভোগী।
গৌতম শ্রাবক গোপক কর্তৃক তিরষ্কৃত হইয়া
তাঁহাদের চিত্ত উদ্বেলিত হইল:
“এইস্থান ত্যাগ করিতে হইবে, বীর্যবান হইতে হইবে,
আমাদের যেন আর অপরের দাসত্ব
করিতে না হয়!”
গৌতমশাসন অনুস্মরণপূর্বক তাঁহাদের দুইজন
উদ্যোগসম্পন্ন হইলেন।
এই স্থানেই চিত্তের বিশুদ্ধি সাধনপূর্বক তাঁহারা
ভোগের বিপত্তি দর্শন করিলেন।
তাঁহারা কামসংযোজন বন্ধনরূপ দুরতিক্রম্য মারের
বন্ধনসমূহ, বন্ধনী ও রজ্জু ভেদকারী নাগের ন্যায়,
ছিন্ন করিয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে অতিক্রম করিলেন।
ইন্দ্র এবং প্রজাপতিসহ সর্বদেবগণ সুধর্মা সভায়
উপবিষ্ট ছিলেন।
বৈরাগ্য-বিশুদ্ধ বীরদ্বয় উপবিষ্ট দেবগণকে অতিক্রম করিলেন।
তাঁহাদিগকে দেখিয়া দেবগণমধ্যে দেবাধিপতি
বাসব উদ্বিগ্ন হইলেন :
“হীনদেহধারী এই দুইজন ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণকে
অতিক্রম করিয়াছে।”
ইন্দ্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া গোপক বাসবকে
সম্বোধন করিলেন :
“হে ইন্দ্র, মনুষ্যলোকে কামবিজয়ী
শাক্যমুনি নামে জ্ঞাত বুদ্ধ বিদ্যমান,
এই দুইজন তাঁহারই পুত্র, তাঁহারা স্মৃতিচ্যুত
হইয়াছিলেন, আমারই কারণে তাঁহারা
পুনরায় স্মৃতি লাভ করিয়াছেন।
তাঁহাদের তিনজনের একজন এখনও গন্ধর্বদেহ
ধারণ করিয়া এইস্থানে বাস করিতেছেন,
দুইজন সম্বোধিপথানুসারী ও শান্তেন্দ্রিয় হইয়া
দেবগণকেও উপেক্ষা করেন।
এরূপ ধর্মোপদেশ কোনো শিষ্যের কোনো প্রকার
সংশয় থাকে না।
প্লাবনোত্তীর্ণ ছিন্ন-সংশয় বিজয়ী জনেন্দ্র বুদ্ধকে
নমস্কার!”
তাঁহারা এইস্থানেই ধর্মের জ্ঞান লাভ করিয়া
শ্রেষ্ঠ স্থান প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং দুইজনেই
ব্রহ্মপুরোহিতরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।
দেব, আমরাও সেই ধর্মেরই প্রাপ্তির জন্য আসিয়াছি,
ভগবানের অনুমতি প্রাপ্ত হইলে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব।

৩৫৫. তখন ভগবান চিন্তা করিলেন, “শক্র বহুদিন হইতে শুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি আমাকে যে প্রশ্নই করিবেন, তাহা সার্থকই হইবে নিরর্থক হইবে না, জিজ্ঞাসিত হইয়া আমি তাঁহাকে যে উত্তর দিব তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা বুঝিতে পারিবেন।”

৩৫৬. অনন্তর ভগবান দেবরাজ শক্রকে গাথায় সম্বোধন করিলেন :

“হে বাসব, তোমার যাহা ইচ্ছা আমাকে প্রশ্ন করো,
আমি সকল প্রশ্নেরই উত্তর দিব।”

প্রথম ভাণবার সমাপ্ত

দ্বিতীয় অধ্যায়

৩৫৭. অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া দেবরাজ শক্র ভগবানকে এইরূপ প্রথম প্রশ্ন করিলেন, “ভগবান! দেব, মনুষ্য, অসুর, নাগ, গন্ধর্বগণ এবং অপরাপর প্রাণীগণ বৈরহীন, দণ্ডহীন, শত্রুতাহীন, হিংসাহীন, বিদ্বেষহীন হইবার ইচ্ছা করিয়াও কোন বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া ওই সকল দোষযুক্ত হইয়া বাস করে?”

দেবেন্দ্র শক্র ভগবানকে এই প্রথম প্রশ্ন করিলেন। ভগবান তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিলেন, “হে দেবেন্দ্র, দেব, মনুষ্য, অসুর, নাগ, গন্ধর্ব এবং অপরাপর প্রাণীগণ ঈর্ষা ও মাৎসর্যরূপ শৃঙ্খলে বদ্ধ হইয়া বৈরহীন, দণ্ডহীন, শত্রুতাহীন, হিংসাহীন, বিদ্বেষহীন হইবার ইচ্ছা করিয়াও ওই সকল দোষযুক্ত হইয়া বাস করে।”

ভগবান দেবরাজ শক্রের প্রশ্নের এইরূপ উত্তর দিলেন। আনন্দিত হইয়া শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিলেন, “হে ভগবান্‌, ইহা সত্য, হে সুগত, ইহা সত্য। প্রশ্নের ভগবান প্রদত্ত উত্তর শ্রবণ করিয়া আমার সংশয় ও বিচিকিৎসা দূর হইয়াছে।”

৩৫৮. এইরূপে দেবরাজ শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন এবং অনুমোদন করিয়া পুনরায় ভগবানকে প্রশ্ন করিলেন :

“দেব, ঈর্ষা ও মাৎসর্যের কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল কী? কীসের বর্তমানে ঈর্ষা ও মাৎসর্য হয়? কীসের অবর্তমানে ঈর্ষা ও মাৎসর্য হয় না?”

“হে দেবেন্দ্র, প্রিয়-অপ্রিয় ঈর্ষা ও মাৎসর্যের কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি ও মূল। প্রিয়-অপ্রিয় বর্তমানে ঈর্ষা ও মাৎসর্য হয়, প্রিয়-অপ্রিয় অবর্তমানে ঈর্ষা ও মাৎসর্য হয় না।”

“দেব, প্রিয়-অপ্রিয়ের কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল কী? কীসের বর্তমানে প্রিয়-অপ্রিয়ের উদ্ভব হয়? কীসের অবর্তমানে প্রিয়-অপ্রিয়ের উদ্ভব হয় না?”

“হে দেবেন্দ্র, তৃষ্ণা প্রিয়-অপ্রিয়ের কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল। তৃষ্ণা বর্তমানে প্রিয়-অপ্রিয়ের উদ্ভব হয়, তৃষ্ণা অবর্তমানে উহার উদ্ভব হয় না।”

“দেব, তৃষ্ণার কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল কী? কীসের বর্তমানে তৃষ্ণার উদ্ভব হয়? কীসের অবর্তমানে উহার উদ্ভব হয় না?”

“হে দেবেন্দ্র, বিতর্ক তৃষ্ণার কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল। বিতর্ক বর্তমানে তৃষ্ণার উদ্ভব হয়, বিতর্ক অবর্তমানে উহার উদ্ভব হয় না।”

“দেব, বিতর্কের কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল কী? কীসের বর্তমানে বিতর্কের উদ্ভব হয়? কীসের অবর্তমানে উহার উদ্ভব হয় না?”

“হে দেবেন্দ্র, অলীক দর্শনরূপ চিত্ত-গ্লানি বিতর্কের কারণ, সমুদয়, উৎপত্তি এবং মূল। ওই চিত্ত-গ্লানি বর্তমানে বিতর্কের উদ্ভব হয়, উহা অবর্তমানে বিতর্কের উদ্ভব হয় না।”

“দেব, কোন পথ অবলম্বন করিয়া ভিক্ষু অলীক দর্শনরূপ, চিত্তগ্লানির নিরোধ প্রদায়ী মার্গে আরূঢ় হন?”

৩৫৯. “হে দেবেন্দ্র, সৌমনস্য দুই প্রকার-সেবিতব্য ও অসেবিতব্য। দৌর্মনস্যও দুই প্রকার-সেবিতব্য ও অসেবিতব্য। উপেক্ষাও দুই প্রকার-সেবিতব্য ও অসেবিতব্য।

৩৬০. “হে দেবেন্দ্র, সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে সৌমনস্য দুই প্রকার কথিত হইয়াছে। কী কারণে? যখন জানিবে কোনো সৌমনস্য হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ সৌমনস্য সেবিতব্য নহে। যখন জানিবে কোনো সৌমনস্য হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ সৌমনস্য সেবিতব্য। এবং যে সৌমনস্য সবিতর্ক এবং সবিচার, এবং যাহা অবিতর্ক এবং অবিচার, এই উভয়ের মধ্যে দ্বিতীয়োক্ত সৌমনস্য শ্রেষ্ঠতর।

“হে দেবেন্দ্র, আমি যে বলিয়াছি সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে সৌমনস্য দুই প্রকার, তাহা এই কারণে।

৩৬১. “হে দেবেন্দ্র, দৌর্মনস্যও সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দ্বিবিধ কথিত হইয়াছে। কী কারণে? যখন জানিবে কোনো দৌর্মনস্য হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ দৌর্মনস্য সেবিতব্য নহে। যখন জানিবে কোনো দৌর্মনস্য হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ দৌর্মনস্য সেবিতব্য। এবং যে দৌর্মনস্য সবিতর্ক সবিচার, এবং যাহা অবিতর্ক অবিচার, এই উভয়ের মধ্যে দ্বিতীয়োক্ত দৌর্মনস্য শ্রেষ্ঠতর।

“হে দেবেন্দ্র, আমি যে বলিয়াছি সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দৌর্মনস্য দ্বিবিধ, তাহা এই কারণে।

৩৬২. “হে দেবেন্দ্র, সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে উপেক্ষাও দ্বিবিধ কথিত হইয়াছে। কী কারণে? যখন জানিবে কোনো উপেক্ষা হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ উপেক্ষা সেবিতব্য নহে। যখন জানিবে কোনো উপেক্ষা হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ উপেক্ষা সেবিতব্য। এবং যে উপেক্ষা সবিতর্ক সবিচার, এবং যাহা অবিতর্ক অবিচার, এই উভয়ের মধ্যে দ্বিতীয়োক্ত উপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।

“হে দেবেন্দ্র, আমি যে বলিয়াছি সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে উপেক্ষা দ্বিবিধ, তাহা এই কারণে।

৩৬৩. “হে দেবেন্দ্র, এই প্রকার আচরণসম্পন্ন ভিক্ষু অলীক দর্শনরূপ চিত্ত-গ্লানির নিরোধ প্রদায়ী মার্গে আরূঢ় হন।”

দেবেন্দ্র শক্র কর্তৃক জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের ভগবান এইরূপ উত্তর দিলেন। আনন্দিত হইয়া দেবরাজ শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিলেন, “হে ভগবান, ইহা সত্য! হে সুগত, ইহা সত্য! প্রশ্নের ভগবান কর্তৃক ব্যাখ্যাত উত্তর শ্রবণ করিয়া আমার সংশয় দূর হইয়াছে।”

৩৬৪. এইরূপে দেবরাজ শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া ভগবানকে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন :

“দেব, কী প্রকারে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ-সংযমসম্পন্ন হন?”

“হে দেবেন্দ্র, কায় সম্পর্কিত এবং বাক্য সম্পর্কিত আচরণ এবং পর্যেষণাও সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দুই প্রকার।

“হে দেবেন্দ্র, সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে কায়সম্পর্কিত আচরণ দ্বিবিধ কথিত হইয়াছে। কী কারণে? যখন জানিবে আচরণ বিশেষ হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ আচরণ সেবিতব্য নহে। যখন জানিবে আচরণ বিশেষ হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ আচরণ সেবিতব্য।

“হে দেবেন্দ্র, আমি যে বলিয়াছি সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে কায়-সম্পর্কিত আচরণ দ্বিবিধ, তাহা এই কারণে।

“হে দেবেন্দ্র বাক্য-সম্পর্কিত আচরণও সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দ্বিবিধ কথিত হইয়াছে। কী কারণে? যখন জানিবে আচরণ বিশেষ হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাস প্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ আচরণ সেবিতব্য নহে। যখন জানিবে আচরণ বিশেষ হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ আচরণ সেবিতব্য।

“হে দেবেন্দ্র, আমি যে বলিয়াছি সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে বাক্য-সম্পর্কিত আচরণ দ্বিবিধ, তাহা এই কারণে।

“হে দেবেন্দ্র, পর্যেষণাও সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দ্বিবিধ কথিত হইয়াছে। কী কারণে? যখন জানিবে পর্যেষণা বিশেষ হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ পর্যেষণা সেবিতব্য নহে। যখন জানিবে পর্যেষণা বিশেষ হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত, কুশলধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন ওইরূপ পর্যেষণা সেবিতব্য।

“হে দেবেন্দ্র, আমি যে বলিয়াছি সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে পর্যেষণা দ্বিবিধ, তাহা এই কারণে।

“হে দেবেন্দ্র, এইরূপ আচরণসম্পন্ন ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ-সংযমসম্পন্ন হন।”

ভগবান দেবরাজ শক্রের প্রশ্নের এইরূপ উত্তর দিলেন। আনন্দিত হইয়া শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিলেন :

“হে ভগবান, ইহা সত্য; হে সুগত, ইহা সত্য। প্রশ্নের ভগবান কর্তৃক ব্যাখ্যাত উত্তর শ্রবণ করিয়া আমার সংশয় দূর হইয়াছে।”

৩৬৫. এইরূপে দেবরাজ শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া ভগবানকে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন :

“দেব, কী প্রকারে ভিক্ষু ইন্দ্রিয়-সংযমসম্পন্ন হন?”

“হে দেবেন্দ্র, চক্ষু-বিজ্ঞেয় রূপও সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দুই প্রকার। শ্রোত্র-বিজ্ঞেয় শব্দও দুই প্রকার। ঘ্রাণ-বিজ্ঞেয় গন্ধ, জিহ্বা-বিজ্ঞেয় রস, কায়-বিজ্ঞেয় স্পর্শ, মন-বিজ্ঞেয় ধর্ম, এই সকলই সেবিতব্য ও অসেবিতব্য ভেদে দুই প্রকার।

এইরূপ কথিত হইলে দেবেন্দ্র শক্র ভগবানকে বলিলেন :

“দেব, ভগবান কর্তৃক সংক্ষেপে যাহা কথিত হইল, আমি তাহার বিস্তৃত অর্থ জ্ঞাত হইয়াছি। চক্ষু-বিজ্ঞেয় যে রূপের অনুসরণে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, সে রূপ সেবিতব্য নহে; চক্ষু-বিজ্ঞেয় যে রূপের অনুসরণে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বর্ধিত হয়, সেই রূপ সেবিতব্য। ইন্দ্রিয়ানুভূত যে সকল বস্তু হইতে অকুশলধর্ম বর্ধিত হয়, কুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত ওই সকল সেবিতব্য নহে; যে সকল বস্তু হইতে অকুশলধর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, কুশলধর্ম বর্ধিত হয়, ওই সকল সেবিতব্য। ভগবান সংক্ষেপে যাহা কহিয়াছেন তাহার বিস্তৃত অর্থ জ্ঞাত হইয়া, প্রশ্নের ভগবান কর্তৃক মীমাংসিত অর্থ শ্রবণ করিয়া আমার সংশয় দূর হইয়াছে।”

৩৬৬. এইরূপে দেবরাজ শক্র ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদনপূর্বক ভগবানকে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন :

“দেব, সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণই কি একই মতবাদী, একই শীলসমন্বিত, একই প্রত্যয়বিশিষ্ট, একই লক্ষ্যানুসারী?”

“হে দেবেন্দ্র, তাহা নয়।”

“দেব, কেন নয়?

“হে দেবেন্দ্র, পৃথিবীর মনুষ্যগণ একাধিক এবং নানাবিধ প্রকৃতিসম্পন্ন। সেই কারণে যে ব্যক্তি যে প্রকৃতিবিশিষ্ট সে সেই প্রকৃতিকেই দৃঢ়তার সহিত আশ্রয় করিয়া তাহাতেই লগ্ন হইয়া স্থির করে, “ইহাই সত্য, আর সকল মিথ্যা।” এই নিমিত্ত সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ একই মতবাদী, একই শীলসমন্বিত, একই প্রত্যয়বিশিষ্ট, একই লক্ষ্যানুসারী নহে।”

“দেব, সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণই কি চরম নিষ্ঠাবান, চরম মুক্তিলব্ধ, চরম ব্রহ্মচারী, চরম পূর্ণতা প্রাপ্ত?”

“হে দেবেন্দ্র, তাহা নয়।”

“দেব, কেন নয়?”

“হে দেবেন্দ্র, যে সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ তৃষ্ণাক্ষয় হেতু বিমুক্ত তাঁহারাই চরম নিষ্ঠাবান, চরম মুক্তিলব্ধ, চরম ব্রহ্মচারী, চরম পূর্ণতাপ্রাপ্ত। সেইজন্য সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণই চরম নিষ্ঠাবান, চরম মুক্তিলব্ধ, চরম ব্রহ্মচারী, চরম পূর্ণতা প্রাপ্ত নহে।”

এইরূপে ভগবান দেবেন্দ্র শক্রের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। দেবেন্দ্র শক্র আনন্দিত হইয়া ভগবদ্বাক্যের অভিনন্দন ও অনুমোদন করিলেন, “হে ভগবান, ইহা সত্য; হে সুগত, ইহা সত্য। প্রশ্নের ভগবান কর্তৃক ব্যাখ্যাত উত্তর শ্রবণ করিয়া আমার সংশয় দূর হইয়াছে।”

৩৬৭. এইরূপে দেবরাজ শক্র ভগবানের বাক্যের অনুমোদন ও অভিনন্দন করিয়া ভগবানকে এইরূপ বলিলেন :

“দেব, তৃষ্ণা রোগ, গ-, শল্য; তৃষ্ণাই পুরুষকে জন্ম হইতে জন্মান্তরে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আকর্ষণ করিয়া থাকে, সেই কারণে পুরুষ কখনো উচ্চাবস্থায় কখনো হীনাবস্থায় নীত হয়। দেব, অন্যান্য শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণ যাহারা ভগবানের অনুবর্তী নহে, তাহাদের যে সকল প্রশ্ন করিবার সুযোগ মাত্র আমি লাভ করি নাই, ভগবান দীর্ঘকাল সংশয়াভিভূত আমার নিকট সেই সকল প্রশ্নের মীমাংসা করিয়াছেন, আমার বিচিকিৎসা এবং সংশয়রূপ শল্য ভগবান কর্তৃক উৎপাটিত হইয়াছে।”

“হে দেবেন্দ্র, এই সকল প্রশ্ন তুমি অপর শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণকে জিজ্ঞাসা করিয়াছ কি?”

“দেব, জিজ্ঞাসা করিয়াছি।”

“হে দেবেন্দ্র, যদি তোমার পক্ষে ক্লেশজনক না হয়, তাহা হইলে তাঁহারা কি উত্তর দিয়াছেন প্রকাশ করো।”

হে দেব, যে স্থানে ভগবান অথবা তৎসদৃশগণ উপবিষ্ট সে স্থানে ইহা আমার পক্ষে ক্লেশজনক নহে।”

“তাহা হইলে, হে দেবেন্দ্র, প্রকাশ করো।

“দেব, যে সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণকে আমি নির্জন অরণ্যবাসী বলিয়া মনে করি, তাঁহাদের নিকট গমন করিয়া আমি এই সকল প্রশ্ন করিয়াছিলাম, জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহারা প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হন নাই, অসমর্থ হইয়া তাঁহারা আমাকেই প্রতিপ্রশ্ন করিয়াছিলেন, “আয়ুষ্মানের নাম কি?” আমি উত্তর করিয়াছিলাম, “মহাশয়, আমি দেবেন্দ্র শক্র।” তাঁহারা পুনরায় আমাকেই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আয়ুষ্মান দেবেন্দ্র, কোন কর্মের ফলে আপনি এই পদ প্রাপ্ত হইয়াছেন?” আমি ধর্ম যেরূপ শ্রবণ করিয়াছি এবং আয়ত্ত করিয়াছি তাঁহাদিগকে সেইরূপ উপদেশ দিয়াছিলাম। তাঁহারা তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া বলিয়াছিলেন, “আমরা দেবেন্দ্র শক্রকে দেখিলাম, তিনি আমাদিগের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দিয়াছেন।” তাঁহারা আমারই শ্রাবক হইয়াছিলেন, আমি তাঁহাদের শ্রাবক হই নাই, আমি ভগবানের শ্রাবক, স্রোতাপন্ন, অবিনিপাত-ধর্ম, নিশ্চিতরূপে সম্বোধিপরায়ণ।”

৩৬৮. “হে দেবেন্দ্র, তুমি ইতিপূর্বে কখনো এরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য অনুভব করিয়াছ কি?”

“দেব, করিয়াছি।”

“কিরূপে তুমি এইরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য ইতিপূর্বে অনুভব করিয়াছ?”

“দেব? অতীতে দেবাসুর সংগ্রাম হইয়াছিল। ওই সংগ্রামে দেবগণ জয়লাভ করিয়াছিলেন, অসুরগণের পরাজয় হইয়াছিল। সংগ্রামে জয়লাভ করিবার পর আমার মনে এই চিন্তার উদয় হইয়াছিল, “দেবভোগ্য অমৃত এবং অসুরভোগ্য অমৃত উভয় অমৃতই দেবগণ পান করিবেন।” কিন্তু, দেব, দণ্ড ও শস্ত্র প্রয়োগ দ্বারা লব্ধ আমার এই সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভ নির্বেদ, বিরাগ, নিরোধ, শান্তি, অভিজ্ঞা, সম্বোধি এবং নির্বাণের অনুকূল নহে। কিন্তু, ভগবানের নিকট হইতে ধর্ম শ্রবণ করিয়া আমার যে সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভ হইয়াছে, যাহা দণ্ড ও শস্ত্র দ্বারা অর্জিত নয়, সেই সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য একান্তরূপে নির্বেদ, বিরাগ, নিরোধ, শান্তি, অভিজ্ঞা, সম্বোধি এবং নির্বাণের অনুকূল।”

৩৬৯. “হে দেবেন্দ্র, কীরূপ অনুভূতির দ্বারা তুমি এই প্রকার সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছ?”

“দেব, ছয় প্রকার অনুভূতির দ্বারা আমি এই প্রকার সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি :

“দেবরূপে এইস্থানেই স্থিতিকালে আমি পুনরায়

আয়ুলব্ধ দেব, এইরূপ অবগত হউন।

“দেব, ইহাই প্রথম অনুভূতি যাহার দ্বারা আমি উক্তরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি।

“দেব-কায় হইতে চ্যুত হইয়া অমনুষ্য জীবন

পরিত্যাগ করিয়া আমি স্বীয় ইচ্ছানুরূপ গর্ভে

প্রবেশ করিব।

“দেব, ইহাই দ্বিতীয় অনুভূতি যাহার দ্বারা আমি উক্তরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি।

“আমার প্রশ্নসমূহ মীমাংসিত; আমি শাসনে

রত হইয়া অবস্থানপূর্বক স্মৃতি ও

সম্প্রজ্ঞানসমন্বিত হইয়া আর্যমার্গের অনুসরণ করিব।

“দেব, ইহাই তৃতীয় অনুভূতি যাহার দ্বারা আমি উক্তরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি।

“আর্যমার্গে ভ্রমণ করিয়া সম্বোধি প্রাপ্ত হইলে

আমি জ্ঞাতা হইয়া বিহার করিব, উহাই চরম

পরিণতি।

“দেব, ইহাই চতুর্থ অনুভূতি যাহার দ্বারা আমি উক্তরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি।

“মনুষ্য দেহ হইতে চ্যুত হইয়া, মনুষ্য জীবন

পরিত্যাগ করিয়া আমি উত্তম দেবলোকে

দেবরূপে উৎপন্ন হইব।

“দেব, ইহাই পঞ্চম অনুভূতি যাহার দ্বারা আমি উক্তরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি।

“ওই সকল অকনিষ্ঠ দেবগণ অপরাপর দেবতা
হইতে শ্রেষ্ঠ; যখন আমার অন্তিম জন্ম হইবে,
তখন ওই দেবলোকেই আমার বাসস্থান হইবে।

“দেব, ইহাই ষষ্ঠ অনুভূতি যাহার দ্বারা আমি উক্তরূপ সন্তুষ্টি ও সৌমনস্য লাভে উপনীত হইয়াছি।

৩৭০. সংশয় বিহ্বলচিত্তে তথাগতের অন্বেষণে দীর্ঘকাল বিচরণ করিয়াছি, আমার সংকল্প পূর্ণ হয় নাই।

যে সকল শ্রমণকে নির্জনবাসী মনে করিয়াছিলাম,
তাঁহারা সম্বুদ্ধ এইরূপ স্থির করিয়া আমি
তাঁহাদের উপাসনায় যাইতাম।
“কিসে সিদ্ধিলাভ হয়? কিসেই বা ব্যর্থতা হয়?”
ইহা জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহারা মার্গ অথবা
প্রতিপদা কোনো বিষয়েই আমাকে শিক্ষাদানে
সমর্থ হন নাই।
যখন তাঁহারা জানিতে পাইতেন আমি দেবরাজ শক্র,
তখন তাঁহারা আমাকেই জিজ্ঞাসা করিতেন
কীরূপ কর্মের ফলে আমি এইরূপ অবস্থা প্রাপ্ত
হইয়াছি।
আমি তাঁহাদিগকে যেরূপ আমি শ্রবণ করিয়াছি এবং
যেরূপ সকলেই শ্রবণ করিতে পারে,
সেইরূপ ধর্মের উপদেশ দান করিতাম।
তাঁহারা আনন্দিত হইয়া বলিতেন, “আমরা বাসবের
দর্শন লাভ করিলাম।”
কিন্তু সংশয়-তারণ বুদ্ধকে দেখিয়া, সম্বুদ্ধের
পূজা করিয়া আজ আমি নির্ভয়।
তৃষ্ণারূপ শল্যের উৎপাটক অতুলনীয় মহাবীর
আদিত্যবন্ধু-বুদ্ধকে বন্দনা করিতেছি। ভগবান্‌!
দেবগণসহ যে নমস্কার ব্রহ্মাকে করিতাম,
আজ হইতে সেই নমস্কার আপনাকে করিব।
আপনিই সম্বুদ্ধ, আপনিই সর্বোত্তম শাস্তা, দেবগণসহ
সর্বলোকে আপনার ন্যায় পুরুষ নাই।”

৩৭১. অতঃপর দেবেন্দ্র শক্র গন্ধর্বপুত্র পঞ্চশিখকে সম্বোধন করিলেন :

“প্রিয় পঞ্চশিখ, ভগবানকে প্রথমে প্রসন্ন করিয়া তুমি আমার বহু উপকার করিয়াছ। তুমি ভগবানকে প্রথমে প্রসন্ন করিবার পর আমরা ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধের দর্শনার্থ গমনে সক্ষম হইয়াছিলাম। তোমাকে তোমার পৈতৃক স্থানে রক্ষা করিব, তুমি গন্ধর্বরাজ হইবে, তোমার প্রার্থিত ভদ্রা সূর্যবর্চসাকে তোমায় দান করিতেছি।”

অনন্তর দেবরাজ শক্র হস্ত দ্বারা ভূমি স্পর্শ করিয়া বারত্রয় উচ্চৈঃস্বরে ভাবোচ্ছ্বাস প্রকাশ করিলেন :

“ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধকে নমস্কার!
ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধকে নমস্কার!
ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধকে নমস্কার!”

এই উচ্ছ্বাস ব্যক্ত হইবারকালে দেবরাজ শক্রের বিরজ বীতমল ধর্মচক্ষু উৎপন্ন হইল, “উৎপত্তিশীল সর্ববস্তুই বিনাশশীল।” অপরাপর অশীতি সহস্র দেবগণেরও এইরূপই হইল। এইরূপ দেবরাজ শক্র কর্তৃক তাঁহার বাঞ্ছিত প্রশ্ন সমুদয় জিজ্ঞাসিত হইলে ভগবান ওই সকলের উত্তর দিলেন। এই কারণে এই প্রশ্নোত্তরের নাম “সক্র-প্রশ্ন” হইয়াছে।

সক্র-প্রশ্ন সূত্রান্ত সমাপ্ত।

The Long Discourses

|_II. The Great Chapter

DN21. শক্রপ্রশ্ন সূত্রান্ত

Translations [21]

English

繁體字

日本語

Deutsch

Italiano

Português

Русский

Norsk

Srpski

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference