৪০৬. আমি এইরূপ শ্রবণ করিয়াছি। একসময়ে আয়ুষ্মান কুমারকস্সপ পঞ্চশত ভিক্ষুসমন্বিত বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত কোশলদেশে ভ্রমণ করিতে করিতে তত্রস্থ সেতব্যা নামক নগরে উপস্থিত হইলেন। তিনি সেতব্যার উত্তরে স্থিত সিংসপা বনে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ওই সময় রাজন্য পায়াসি রাজভোগ্য রাজদায়, ব্রহ্মদেয়রূপে কোশলরাজ পসেনদি কর্তৃক প্রদত্ত জনাকীর্ণ, তৃণ-কাষ্ঠ-উদক-ধান্যসম্পন্ন সেতব্যাতে বাস করিতেছিলেন।

৪০৭. ওই সময় রাজন্য পায়াসির এইরূপ পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছিল, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকর্ম ও কুকর্মের ফল নাই। সেতব্যার ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণ শুনিলেন, “গৌতমের শ্রাবক শ্রমণ কুমারকস্সপ পঞ্চশত ভিক্ষুসমন্বিত বৃহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত ভ্রমণ করিতে করিতে সেতব্যায় উপনীত হইয়া উহার উত্তরস্থ সিংসপ বনে অবস্থান করিতেছেন। সেই পূজনীয় কুমারকস্সপের সম্বন্ধে এইরূপ যশোগীতি বিস্তৃত হইয়াছে, “তিনি পণ্ডিত, অভিজ্ঞ, মেধাবী, বহুশ্রুত, সুবক্তা, সুপ্রতিভ, সম্মানার্হ এবং অর্হৎ। তথারূপ অর্হতের দর্শন কল্যাণজনক।” অনন্তর সেতব্যায় ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণ সেতব্যা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন বহু দলে বিভক্ত হইয়া উত্তর দিকে সিংসপা বনাভিমুখে গমন করিলেন।

৪০৮. ওই সময় রাজন্য পায়াসী দিবা বিশ্রামের নিমিত্ত প্রাসাদোপরি গমন করিয়াছিলেন। তিনি দেখিলেন সেতব্যার ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণ সেতব্যা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন বহু দলে বিভক্ত হইয়া উত্তরে সিংসপা বনাভিমুখে অগ্রসর হইতেছেন। উহা দেখিয়া তিনি মন্ত্রীকে বলিলেন :

“মন্ত্রী, সেতব্যার ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণ কি নিমিত্ত এইরূপে সিংসপা বনাভিমুখে অগ্রসর হইতেছেন”? উত্তরে মন্ত্রী তাঁহাকে সমস্ত বলিলেন। তখন তিনি মন্ত্রীকে বলিলেন, “তুমি সেতব্যার ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণের নিকট গমন করিয়া তাঁহাদিগকে বল, “রাজন্য পায়াসী এইরূপ কহিয়াছেন, আপনারা অপেক্ষা করুন, রাজন্য পায়াসি শ্রমণ কুমারকস্সপকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আসিবেন।” শ্রমণ কুমারকস্সপ সেতব্যার অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণকে পূর্ব হইতেই উপদেশ দিতেছেন, “পরলোকের অস্তিত্ব আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।” কিন্তু, মন্ত্রী, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“তথাস্তু” বলিয়া মন্ত্রী রাজন্য পায়াসির আজ্ঞা পালন করিলেন।

৪০৯. তদনন্তর রাজন্য পায়াসি সেতব্যার ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণ পরিবৃত হইয়া সিংসপা বনে আয়ুষ্মান কুমার কস্সপের নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক প্রীত্যালাপান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। সেতব্যার ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণও কেহ কেহ তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক একান্তে আসন গ্রহণ করিলেন, কেহ কেহ তাঁহার সহিত প্রীত্যালাপপূর্বক ওইরূপে উপবিষ্ট হইলেন, কেহ কেহ তাঁহার দিকে অঞ্জলি প্রণত করিয়া পূর্বোক্তরূপে উপবেশন করিলেন, কেহ কেহ নামগোত্র প্রকাশপূর্বক উক্তবিধরূপে আসন গ্রহণ করিলেন, কেহ কেহ মৌনী হইয়া একান্তে বসিলেন।

৪১০. আসন গ্রহণান্তে রাজন্য পায়াসি আয়ুষ্মান কুমারকস্সপকে বলিলেন,

“হে কস্সপ, আমি এইরূপ মত এইরূপ দৃষ্টি পোষণ করি, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজন্য, এরূপ মত ও দৃষ্টিসম্পন্ন কাহাকেও আমি দেখি নাই, এরূপ কাহারও কথা শুনিও নাই। কিরূপে ইহা বলা সম্ভব; পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই?

৪১১. রাজন্য, এ বিষয়ে আমি আপনাকে প্রশ্ন করিব, আপনি ইচ্ছানুরূপ উত্তর দিন। রাজন্য, আপনি কী মনে করেন? এই যে চন্দ্র ও সূর্য, ইহারা কী ইহলোকে অথবা পরলোকে? ইহারা দেব অথবা মনুষ্য?”

“হে কস্সপ, চন্দ্র ও সূর্য পরলোকে, ইহলোকে নহে, তাহারা দেব, মনুষ্য নহে।”

“হে রাজন্য, ইহা হইতেই আপনার সিদ্ধান্ত করা উচিত, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪১২. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই?”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“রাজপুত্র, কীরূপ প্রমাণ?”

“শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আমার মিত্র ও অমাত্যগণ ছিলেন, রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিগণ ছিলেন, যাঁহারা প্রাণবধ করিতেন, অদত্তের গ্রহণ করিতেন, ব্যভিচার করিতেন, যাঁহারা মিথ্যাভাষী ছিলেন, যাঁহারা পিশুন ও পরুষবাক্য উচ্চারণ করিতেন, তুচ্ছপ্রলাপে রত হইতেন, যাঁহারা লোভযুক্ত, যাঁহারা দ্বেষযুক্ত চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। কোনো সময়ে তাঁহারা রোগগ্রস্ত হইয়া দারুণ দুঃখ প্রাপ্ত হইলে যখন আমি জানিয়াছি যে তাঁহাদের আরোগ্য লাভের আশা নাই তখন আমি তাঁহাদের নিকট গিয়া এইরূপ বলিয়াছি, “কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এইরূপ মত ও এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন, যাঁহারা প্রাণবধ করে, অদত্তের গ্রহণ করে, ব্যভিচার করে, মিথ্যা কহে, পিশুন ও পরুষবাক্য উচ্চারণ করে, তুচ্ছপ্রলাপে রত হয়, যাহারা লোভযুক্ত, দ্বেষযুক্ত চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন, তাহারা দেহের বিনাশে মৃত্যুর পর অপায়-দুর্গতি-বিনিপাত নিরয়ে উৎপন্ন হয়। আপনারা প্রাণবধ করিয়াছেন, অদত্তের গ্রহণ করিয়াছেন, ব্যভিচার করিয়াছেন, মিথ্যা কহিয়াছেন, পিশুন ও পরুষবাক্য উচ্চারণ করিয়াছেন, লোভানুযুক্ত হইয়াছেন, দ্বেষদুষ্ট-চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন হইয়াছেন। যদি আপনাদের ওই সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণের বাক্য সত্য হয়, আপনারা মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে অপায় দুর্গতি-বিনিপাতসম্পন্ন নিরয়ে উৎপন্ন হইবেন। মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে যদি আপনারা ওইরূপ দশাগ্রস্ত হন, তাহা হইলে আমার নিকট আসিয়া কহিবেন, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে। “আমি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধাবান, আপনারা বিশ্বাসাযোগ্য, আপনারা যাহা স্বয়ং দেখিবেন, আমি তাহাই গ্রহণ করিব।” যদিও তাঁহারা আমার অনুরোধ রক্ষা করিতে সম্মত হইয়াছিলেন, তথাপি তাঁহারা আসিয়া আমাকে কিছু কহেন নাই, কোনো দূতও প্রেরণ করেন নাই। এই প্রমাণের দ্বারা আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪১৩. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, আমি আপনাকে প্রশ্ন করিব, আপনি ইচ্ছানুরূপ উত্তর দিতে পারেন। রাজপুত্র, আপনি কী মনে করেন? মনে করুন আপনার কর্মচারীগণ কোনো কুক্রিয়াসক্ত চোরকে ধৃত করিয়া লইয়া আসিয়া বলিল, “দেব, এই পুরুষ কুক্রিয়াসক্ত চোর, আপনি ইচ্ছানুরূপ ইহার দণ্ড বিধান করুন।” আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এরূপ ক্ষেত্রে ইহার বাহুদ্বয় দৃঢ় রজ্জু দ্বারা পশ্চাদ্দিকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া, শির মুণ্ডিত করিয়া, উচ্চ ঢক্কা নিনাদসহ রথ্যা হইতে রথ্যান্তরে, সিংঘাটক হইতে সিংঘাটকে লইয়া গিয়া দক্ষিণ দিকের দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া নগরের দক্ষিণে বধ্যভূমিতে ইহার শিরচ্ছেদন করো।” তাঁহারা “তথাস্তু” বলিয়া আপনার আদেশ পালনে রত হইয়া তাহাকে বধ্যভূমিতে উপবেশন করাইল। সেই পুরুষটি কি ঘাতকগণের নিকট এইরূপ অনুমতি প্রাপ্ত হইবে, “ঘাতক মহাশয়গণ, অমুক গ্রামে অথবা নিগমে আমার বন্ধু-বান্ধব ও রক্তের সম্পর্কবিশিষ্ট জ্ঞাতিগণ আছে, আমি তাহাদিগকে দেখা দিয়া না আসা পর্যন্ত আপনারা অপেক্ষা করুন?” পুরুষটি এইরূপ বলিতে বলিতেই কি ঘাতকগণ উহার শিরচ্ছেদ করিবে না?”

“পূজ্য কস্সপ, সে ওইরূপ অনুমতি পাইবে না, এবং ঘাতকগণ তাহার শিরচ্ছেদ করিবে।”

“হে রাজপুত্র, সেই চোর মনুষ্য হইয়াও যদি মনুষ্য-ভূত ঘাতকগণের নিকট ওইরূপ অনুমতি লাভ না করে, তাহা হইলে কিরূপে আপনার পূর্বোক্তরূপ মিত্র ও অমাত্যগণ, রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিগণ মরণান্তে দেহের বিনাশে দুর্গতিসম্পন্ন নিরয়ে উৎপন্ন হইয়া নরক-পালগণের নিকট এইরূপ অনুমতি প্রাপ্ত হইবে, “ঘাতক মহাশয়গণ, আমরা রাজন্য পায়াসির নিকট গিয়া পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে এই কথা তাঁহার নিকট জ্ঞাপন করিয়া না আসা পর্যন্ত আপনারা অপেক্ষা করুন?”

৪১৪. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই?”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“হে রাজপুত্র, কীরূপ প্রমাণ?”

“শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আমার মিত্র ও অমাত্যগণ ছিলেন, রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিগণ ছিলেন, যাঁহারা প্রাণবধ করিতেন না, অদত্তের গ্রহণ করিতেন না, ব্যভিচার করিতেন না, যাঁহারা মিথ্যাভাষী ছিলেন না, যাঁহারা পিশুন ও পরুষবাক্য উচ্চারণ করিতেন না, তুচ্ছপ্রলাপে রত হইতেন না, যাঁহারা লোভযুক্ত ছিলেন না, যাঁহারা দ্বেষদুষ্ট-চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না। কোনো সময়ে তাঁহারা রোগগ্রস্ত হইয়া দারুণ দুঃখপ্রাপ্ত হইলে যখন আমি জানিয়াছি যে তাঁহাদের আরোগ্য লাভের আশা নাই তখন আমি তাঁহাদের নিকট গিয়া এইরূপ বলিয়াছি, “কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এইরূপ মত ও এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন, যাহারা প্রাণবধ করে না, অদত্তের গ্রহণ করে না, ব্যভিচার করে না, মিথ্যা কহে না, পিশুন ও পরুষবাক্য উচ্চারণ করে না, তুচ্ছপ্রলাপে রত হয় না, যাহারা লোভযুক্ত নহে, দ্বেষদুষ্ট-চিত্ত ও মিথ্যা দৃষ্টিসম্পন্ন নহে, তাহারা মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়। আপনারা প্রাণবধ করেন নাই, অদত্তের গ্রহণ করেন নাই, ব্যভিচার করেন নাই, মিথ্যা কহেন নাই, পিশুন ও পরুষবাক্য উচ্চারণ করেন নাই, লোভানুযুক্ত হন নাই, দ্বেষ-দুষ্ট-চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন হন নাই। যদি আপনাদের ওই সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণের বাক্য সত্য হয়, আপনারা মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবেন। মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে যদি আপনারা ওইরূপ দশা প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে আমার নিকট আসিয়া কহিবেন, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে। আমি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধাবান, আপনারা বিশ্বাসাযোগ্য, আপনারা যাহা স্বয়ং দেখিবেন, আমি তাহাই গ্রহণ করিব।” যদিও তাঁহারা আমার অনুরোধ রক্ষা করিতে সম্মত হইয়াছিলেন, তথাপি তাঁহারা আসিয়া আমাকে কিছু কহেন নাই, কোনো দূতও প্রেরণ করেন নাই। এই প্রমাণের দ্বারা আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪১৫. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি কথিত বাক্যের অর্থ জানিতে পারেন। হে রাজপুত্র, কোনো পুরুষ মলকূপে আশীর্ষ নিমগ্ন। আপনি কর্মচারীগণকে আদেশ করিলেন, “তোমরা পুরুষটিকে মলকূপ হইতে উদ্ধার করো।” তাহারা “তথাস্তু” বলিয়া পুরুষটিকে মলকূপ হইতে উদ্ধার করিল। আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এক্ষণে বংশপেষিকা দ্বারা ওই ব্যক্তির দেহ মার্জিত করিয়া উহা হইতে মল দূরীভূত করো।” তাহারা “তথাস্তু” কহিয়া আপনার আদেশ পালন করিল। আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এক্ষণে পাণ্ডুমৃত্তিকা দ্বারা ওই ব্যক্তির দেহ তিনবার মর্দিত করো।” তাহারা আপনার আদেশ পালন করিল। আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এক্ষণে পুরুষটিকে সূক্ষ্ম চূর্ণ সহযোগে উত্তমরূপে তিনবার স্নাত করো।” তাহারা আপনার আদেশ পালন করিল। আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এক্ষণে ওই ব্যক্তির কেশ ও শ্মশ্রূর বিন্যাস সাধন করো।” তাহারা আপনার আদেশ পালন করিল। আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এক্ষণে পুরুষটিকে মহার্ঘ মাল্য, বিলেপন ও বস্ত্রাদি দ্বারা ভূষিত করো।” তাহারা আপনার আদেশ পালন করিল। আপনি তাহাদিগকে বলিলেন, “এক্ষণে পুরুষটিকে প্রাসাদে লইয়া গিয়া পঞ্চেন্দ্রিয় ভোগ্য দ্রব্যাদির দ্বারা উহার সেবা করো।” তাহারা আপনার আদেশ পালন করিল। রাজপুত্র, আপনি কী মনে করেন? সেই সুৱাত, সুবিলিপ্ত, সুবিন্যস্ত কেশ-শ্মশ্রূ, মাল্যাভরণভূষিত, শুভ্রবস্ত্র পরিহিত, প্রাসাদস্থিত, পঞ্চেন্দ্রিয়-ভোগ্যদ্রব্যাদির দ্বারা পরিবেষ্টিত ও সেবিত পুরুষটি কি পুনরায় সেই মলকূপে নিমগ্ন হইতে চাহিবে?”

“মাননীয় কস্সপ, সে চাহিবে না।”

“কী কারণে?”

“মাননীয় কস্সপ, মলকূপ অশুচি এবং অশুচিরূপে জ্ঞাত, দুর্গন্ধময়, ঘৃণিত, বিপ্রকর্ষক এবং ওইরূপে জ্ঞাত।” “হে রাজপুত্র, এইরূপেই মনুষ্যগণ দেবগণের নিকট অশুচি এবং অশুচিরূপে জ্ঞাত, দুর্গন্ধময়, ঘৃণিত, বিপ্রকর্ষক এবং ওইরূপে জ্ঞাত। হে রাজন্য, শত যোজন দূর হইতে মনুষ্যগন্ধ দেবগণ কর্তৃক অনুভূত হয়। ওই সকল মিত্র ও অমাত্যগণ, রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিগণ যাঁহারা প্রাণবধে বিরত হইয়া, অদত্তের গ্রহণে বিরত হইয়া, ব্যভিচারে বিরত হইয়া, মৃষাবাদ হইতে বিরত হইয়া, পিশুন ও পরুষবাক্য হইতে বিরত হইয়া, তুচ্ছপ্রলাপে বিরত হইয়া, লোভহীন অব্যাপন্ন চিত্ত ও সম্যক দৃষ্টিসম্পন্ন হইয়া মৃত্যুর পর, দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন, তাঁহারা কি আসিয়া কহিবেন, “পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে?” হে রাজপুত্র, এই যুক্তির দ্বারাও আপনার গ্রহণ করা উচিত যে, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪১৬. শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই?”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই।”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“রাজন্য, কীরূপ প্রমাণ?”

“শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আমার মিত্র ও অমাত্যগণ এবং রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিগণ ছিলেন, যাঁহারা প্রাণবধ, অদত্তের গ্রহণ, ব্যভিচার, মৃষাবাদ এবং সুরা-মেরয়-মদ্য পানরূপ প্রমাদে বিরত ছিলেন। কোনো সময়ে তাঁহারা রোগগ্রস্ত হইয়া দারুণ দুঃখপ্রাপ্ত হইলে যখন আমি জানিয়াছি যে তাঁহাদের আরোগ্য লাভের আশা নাই, তখন আমি তাঁহাদের নিকট গিয়া এইরূপ বলিয়াছি, “কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এইরূপ মত ও এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন-যাহারা প্রাণবধ, অদত্তের গ্রহণ, ব্যভিচার, মৃষাবাদ এবং সুরা-মেরয়-মদ্যপানরূপ প্রমাদে বিরত, তাহারা মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সাহচর্য লাভ করে। আপনারা ওই সকল কর্মে বিরত। যদি আপনাদের ওই সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণের বাক্য সত্য হয়, আপনারা মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সাহচর্য লাভ করিবেন। যদি মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে আপনাদের উক্তরূপ সুগতি লাভ হয়, আপনারা আসিয়া আমাকে কহিবেন, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে। আমি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধাবান, আপনারা বিশ্বাসাযোগ্য, আপনারা যাহা স্বয়ং দেখিবেন, আমি তাহাই গ্রহণ করিব।” যদিও তাঁহারা আমার অনুরোধ রক্ষা করিতে সম্মত হইয়াছিলেন, তথাপি তাঁহারা আসিয়া আমাকে কিছু কহেন নাই, কোনো দূতও প্রেরণ করেন নাই। এই প্রমাণের দ্বারা আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪১৭. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, আমি আপনাকে প্রশ্ন করিব, আপনি ইচ্ছানুরূপ উত্তর দিতে পারেন। হে রাজন্য, যাহা মানুষের একশত বৎসর, ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের তাহা একরাত্রি ও একদিন। ওইরূপ ত্রিংশতি দিবা-রাত্রিতে এক মাস, ওইরূপ মাসের দ্বাদশ মাসে বৎসর, ওইরূপ বৎসরের দিব্য সহস্র বৎসর ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের আয়ুপ্রমাণ। আপনার যে সকল মিত্র ও অমাত্যগণ, রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিগণ, প্রাণাতিপাত, অদত্তের গ্রহণ, ব্যভিচার, মৃষাবাদ এবং সুরাপান হইতে বিরত ছিলেন, তাঁহারা মৃত্যুর পর দেহের বিনাশে সুগতি প্রাপ্ত হইয়া স্বর্গে ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের সন্নিধানে পুনর্জন্ম লাভ করিয়াছেন। যদি তাঁহাদের মনে হয়, “আমরা দুই অথবা তিন রাত্রি-দিবা দিব্য পঞ্চেন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুতে লিপ্ত ও লীন হইয়া বিহার করিয়া লই, পরে আমরা রাজন্য পায়াসির নিকট গিয়া জ্ঞাপন করিব, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে,” তাঁহারা কি আসিয়া কহিবেন, পরলোক, ঔপপাতিক সত্ত্ব, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে?”

“অবশ্যই নহে। তাহার বহুপূর্বেই আমাদের মরিয়া যাইবার কথা। কিন্তু পূজ্য কস্সপকে কে বলিল, “ত্রয়স্ত্রিংশ-দেবলোক আছে” অথবা “ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ এইরূপ দীর্ঘায়ু?” আমরা কস্সপের ওইরূপ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করি না।”

৪১৮. “হে রাজন্য, যেরূপ জাত্যন্ধ পুরুষ কৃষ্ণ ও শুক্র পদার্থ, নীল, পীত, লোহিত মঞ্জিষ্ঠ বর্ণবিশিষ্ট পদার্থ দেখিতে পায় না, সম ও বিষম দেখিতে পায় না, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য দেখিতে পায় না। সে যদি এইরূপ কহে, “কৃষ্ণ ও শুক্র পদার্থ নাই, কেহ উহা দেখিতে পায় না; নীল, পীত, লোহিত, মঞ্জিষ্ঠ বর্ণবিশিষ্ট পদার্থ নাই, কেহ ওই সকল দেখিতে পায় না; সম ও বিষম নাই, নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য নাই, কেহ ওই সকল দেখিতে পায় না; আমি উহা জানি না ও দেখিতে পাই না, অতএব উহার অস্তিত্ব নাই।” রাজন্য, পুরুষটি ওইরূপ কহিলে কি তাহার বাক্য যথার্থ হইবে?”

“হে কস্সপ, তাহা হইবে না। আপনি যে সকল পদার্থের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহাদের অস্তিত্ব আছে, এবং তাহাদের দর্শকও আছে। “আমি উহা জানি না ও দেখি না, অতএব উহার অস্তিত্ব নাই” এরূপ কহিলে উহা যথার্থ উক্তি হইবে না।”

“হে রাজন্য, সেইরূপই আপনি জাত্যন্ধের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছেন, যেহেতু আপনি বলিতেছেন, পূজ্য কস্সপকে কে বলিল, “ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোক আছে” অথবা “ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ এইরূপ দীর্ঘায়ু?” আমরা কস্সপের ওইরূপ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করি না।”

“হে রাজন্য, আপনি যেরূপ মনে করিতেছেন সেরূপ মাংসচক্ষু দ্বারা পরলোকের দর্শন সম্ভব নয়। হে রাজন্য, সে সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ অরণ্যে শব্দহীন সুদূর বনপ্রস্থে বাস করেন, তাঁহারা তথায় অপ্রমত্ত, উৎসাহসম্পন্ন ও দৃঢ়সংকল্প হইয়া দিব্যচক্ষু লাভ করেন, তাঁহারা অমানুষী বিশুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারা ইহলোক, পরলোক এবং ঔপপাতিক সত্ত্ব দর্শন করেন। হে রাজন্য, এইরূপেই পরলোক দর্শন করিতে হয়, আপনি যেরূপ মনে করিতেছেন সেরূপ মাংসচক্ষু দ্বারা নহে। হে রাজন্য, এই যুক্তির দ্বারাও আপনার গ্রহণ করা উচিত যে, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪১৯. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই।”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“রাজন্য, কীরূপ প্রমাণ?”

“হে কস্সপ, আমি দেখিতে পাই, এমন শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণ আছেন যাঁহারা শীলসম্পন্ন, সদ্‌গুণান্বিত, জীবনধারণার্থী, মরণবিমুখ, সুখকামী এবং দুঃখপরিহারী; তখন, হে কস্সপ, আমার মনে এইরূপ চিন্তার উদয় হয়, যদি এই সকল শ্রদ্ধেয় শীলসম্পন্ন, সদ্‌গুণান্বিত শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণ এইরূপ জ্ঞাত হইয়া থাকেন, “আমরা মরণের পর শ্রেয় লাভ করিব,” তাহা হইলে তাঁহারা বিষপান করিবেন, অথবা স্বদেহে অস্ত্রাঘাত করিবেন, অথবা উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিবেন, অথবা উত্তুঙ্গ স্থল হইতে পতিত হইবেন। যেহেতু ওই সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ মরণের পর শ্রেয় লাভ করিবেন এরূপ জ্ঞানসম্পন্ন নহেন, সেই হেতু তাঁহারা মরণবিমুখ, সুখকামী এবং দুঃখপরিহারী। এই প্রমাণের দ্বারাও আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪২০. “তাহা হইলে হে রাজপুত্র, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি কথিত বাক্যের অর্থ জানিতে পারেন। হে রাজন্য, অতীতকালে জনৈক ব্রাহ্মণের দুই পত্নী ছিল, এক পত্নীর দশ অথবা দ্বাদশ বর্ষ বয়স্ক পুত্র, অপরা আসন্ন প্রসবা গর্ভিণী, এই সময়ে ব্রাহ্মণের মৃত্যু হইল। তদনন্তর ব্রাহ্মণের পুত্র মাতার সপত্নীকে বলিল, “ভবতি! ধন, ধান্য, রজত অথবা স্বর্ণ যাহা কিছু আছে সকলই আমার। ইহাতে আপনার কিছু্বই নাই, আমার পিতার উত্তরাধিকার আমায় অর্পণ করুন।” এইরূপ উক্ত হইলে সেই ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণকুমারকে বলিল, “বৎস, আমার প্রসবকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো। যদি পুত্র সন্তান হয়, তাহারও এক অংশ হইবে, যদি কন্যা হয় সে তোমার পরিচারিকা হইবে।”

“দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণ কুমার বিমাতাকে বলিল, “ভবতি” ধন, ধান্য, রজত অথবা স্বর্ণ যাহা কিছু আছে সকলই আমার। ইহাতে আপনার কিছু্বই নাই, আমার পিতার উত্তরাধিকার আমায় অর্পণ করুন।” দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণী কুমারকে বলিল, “বৎস, আমার প্রসবকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো। যদি পুত্রসন্তান হয়, তাহারও এক অংশ হইবে, যদি কন্যা হয় সে তোমার পরিচারিকা হইবে।”

“তৃতীয়বার ব্রাহ্মণ কুমার বিমাতাকে পূর্বোক্তরূপ কহিলে ব্রাহ্মণী গর্ভে পুত্র অথবা কন্যা আছে তাহা জানিবার নিমিত্ত অস্ত্র গ্রহণপূর্বক কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া স্বীয় গর্ভ বিদীর্ণ করিল। এইরূপে সেই মূঢ়া জ্ঞানহীনা নারী অনবহিত হইয়া দায়াদ্যের অন্বেষণে স্বীয় জীবন, গর্ভ ও ধন সমস্তই নষ্ট করিল। এইরূপেই, হে রাজন্য, আপনি অনবহিত হইয়া পরলোকের অন্বেষণে স্বীয় নির্ব্বুদ্ধিতা ও জ্ঞানহীনতার জন্য বিনষ্ট হইবেন। হে রাজন্য, শীলবান, ধার্মিক, শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণ যাহা অপরিপক্ব তাহার পরিপক্বতা সাধনের প্রয়াসী হন না, তাঁহারা জ্ঞানী এবং পরিপাকের প্রতীক্ষায় থাকেন। শীলবান, ধার্মিক শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণের জীবনের প্রয়োজন আছে। ওই সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণের আয়ু যতই দীর্ঘ হয় ততই উহা অধিকতররূপে পুণ্যপ্রসূ হয়, বহু জনের হিত ও সুখসাধক হয়, সর্বজগতের এবং একাধারে দেব ও মনুষ্যের মঙ্গল, হিত ও সুখে পর্যবসিত হয়। হে রাজন্য, এই যুক্তির দ্বারাও আপনার গ্রহণ করা উচিত যে, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪২১. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই।”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“রাজন্য, কীরূপ প্রমাণ?”

“হে কস্সপ, মনে করুন আমার পুরুষগণ চোর ধৃত করিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল এবং বলিল, “দেব, এই ব্যক্তি চোর, পাপকারী, আপনার যেরূপ ইচ্ছা ইহার দণ্ডবিধান করুন।” আমি তাহাদিগকে বলিলাম, “ইহাকে জীবিতাবস্থায় কটাহে নিক্ষেপপূর্বক কটাহের মুখ বন্ধ করিয়া উহা আর্দ্র চর্মে আবৃত করণান্তর আর্দ্র মৃত্তিকার অবলেপনপূর্বক ঊর্ধ্ব-নিম্নোপরি রক্ষা করিয়া অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করো।” তাহারা আমার আদেশ পালন করিল। যখন আমরা জানিলাম যে, মানুষটি মৃত, তখন কটাহটি নামাইয়া বন্ধন মোচনপূর্বক উহার মুখ বিবরিত করিয়া উহা হইতে মানুষটির আত্মা নিষ্ক্রান্ত হয় কিনা দেখিবার নিমিত্ত ধীরে ধীরে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম, কিন্তু উহার আত্মাকে বহির্গত হইতে দেখিলাম না। এই প্রমাণের দ্বারাও আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪২২. “তাহা হইলে, হে রাজন্য, আমি আপনাকে প্রশ্ন করিব, আপনি ইচ্ছানুরূপ উত্তর দিতে পারেন। রাজন্য, আপনি কি মধ্যাহ্নে নিদ্রাকালে স্বপ্নে রমণীয় আবাস, বন, ভূমি এবং পুষ্করিণী দেখেন নাই?”

শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আমি দেখিয়াছি।”

“ঐ সময়ে কি অতি তরুণ শিশুস্বভাবসম্পন্ন কুমারীগণ আপনার সেবায় রত থাকে?”

“হে কস্সপ তাহা সত্য।”

“তাহারা কি আপনার আত্মাকে প্রবেশ করিতে অথবা নিষ্ক্রান্ত হইতে দেখে?”

“তাহারা দেখে না।”

“হে রাজন্য, তাহারা জীবন্ত হইয়াও আপনার জীবিতাবস্থায় আপনার আত্মাকে প্রবেশ করিতে অথবা নিষ্ক্রান্ত হইতে দেখে না। আপনি মৃত হইলে কি তাহারা আপনার আত্মার প্রবেশ অথবা বহির্গমন দেখিতে পাইবে? এই যুক্তিদ্বারাও আপনার গ্রহণ করা উচিত যে, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪২৩. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই।”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“রাজন্য, কিরূপ প্রমাণ?”

“হে কস্সপ মনে করুন আমার পুরুষগণ চোর ধৃত করিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল এবং বলিল, “দেব, এই ব্যক্তি চোর, পাপকারী, আপনার যেরূপ ইচ্ছা ইহার দণ্ড বিধান করুন।” আমি তাহাদিগকে বলিলাম, “তোমরা তুলাদণ্ডের সাহায্যে জীবিতাবস্থায় এই পুরুষের দেহভার পরীক্ষাপূর্বক ধণুর্গুণের দ্বারা তাহার শ্বাসরোধ ও তাহাকে হত্যা করিয়া পুনরায় তুলাদণ্ডে তাহার ভার পরীক্ষা করো।” তাহারা আমার আদেশ পালন করিল। জীবিতাবস্থায় মানুষটি লঘুতর, মৃদুতর এবং অধিকতর সুস্থই ছিল। মৃতাবস্থায় সে গুরুতর, পূর্বাপেক্ষা অনম্য এবং দুর্বহ হইল। এই প্রমাণের দ্বারাও আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪২৪. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, একটি উপমা দিতেছি। উপমাদ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞব্যক্তি কথিত বাক্যের অর্থ জানিতে পারেন। হে রাজপুত্র, মনে করুন কেহ তুলাদণ্ডে সর্বদিন ব্যাপিয়া উত্তাপিত, আদীপ্ত, প্রজ্জ্বলিত, জ্বলন্ত আভাযুক্ত লৌহ গোলকের ভার নির্ণয় করিল, পরে ওই গোলক শীতল ও নির্বাপিত হইলে তুলাদণ্ডে উহার ভার পরীক্ষা করিল। গোলকটি কোনো সময় লঘুতর, মৃদুতর এবং অধিকতর নমনীয় হইবে? আদীপ্ত ও প্রজ্জ্বলিত, অবস্থায় অথবা শীতল ও নির্বাপিত অবস্থায়?”

“শ্রদ্ধেয় কস্সপ, গোলকটি যখন তেজ ও বায়ু সহগত, আদীপ্ত, প্রজ্জ্বলিত ও আভাযুক্ত তখনই লঘুতর, মৃদুতর এবং অধিকতর নমনীয় হইবে। গোলকটি যখন তেজ ও বায়ু সহগত নহে, যখন উহা শীতল ও নির্বাপিত তখনই উহা গুরুতর, পূর্বাপেক্ষা অনম্য এবং দুর্বহ হইবে।”

“রাজপুত্র, এইরূপেই যখন এই দেহ আয়ুযুক্ত, তেজযুক্ত ও বিজ্ঞানযুক্ত থাকে, তখন লঘুতর, মৃদুতর এবং অধিকতর নমনীয় থাকে। কিন্তু যখন উহা আয়ু, তেজ ও বিজ্ঞানযুক্ত নহে তখন উহা গুরুতর, পূর্বাপেক্ষা অনম্য এবং দুর্বহ হইবে। এই প্রমাণের দ্বারাও আপনার গ্রহণ করা উচিত যে, পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪২৫. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই।”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“রাজন্য, কিরূপ প্রমাণ?”

“হে কস্সপ, মনে করুন আমার পুরুষগণ চোর ধৃত করিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল এবং বলিল, “দেব, এই ব্যক্তি চোর, পাপকারী, আপনার যেরূপ ইচ্ছা ইহার দণ্ড বিধান করুন।” আমি তাহাদিগকে বলিলাম, “ইহার শল্ক, চর্ম, মাংস, স্নায়ু, অস্থি ও মজ্জা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ইহাকে বধ করো।” তাহারা আমার আদেশ পালন করিল। যখন চোর অর্ধমৃত হইল তখন আমি তাহাদিগকে বলিলাম, “ইহাকে ঊর্ধ্বমুখী হইয়া শায়িত করো, যাহাতে আমরা উহার আত্মার বহির্গমন দেখিতে পাই।” তাহারা সেইরূপই করিল, কিন্তু আমরা তাহার আত্মার বহির্গমন দেখিলাম না। আমি তাহাদিগকে বলিলাম, “উহাকে অধোমুখী হইয়া শায়িত কর… পার্শ্বোপরি শায়িত কর… অপর পার্শ্বের উপর স্থাপিত কর… ঊর্ধ্ব করিয়া স্থাপিত কর… অধোশির করিয়া স্থাপিত কর… হস্ত দ্বারা প্রহার কর… মৃৎপিণ্ড নিক্ষেপে আঘাত কর… দণ্ডাঘাত কর… অস্ত্রাঘাত কর… পার্শ্ব হইতে পার্শ্বোন্তরে সর্বপ্রকারে সঞ্চালিত করো, যাহাতে আমরা তাহার আত্মার বহির্গমন দেখিতে পাই।” তাহারা সেইরূপই করিল, কিন্তু আমরা তাহার আত্মার বহির্গমন দেখিলাম না। তাহার সেই চক্ষুই আছে, রূপাদিও রহিয়াছে, কিন্তু ওই চক্ষু রূপাদি দর্শন করে না; তাহার শ্রোত্র বিদ্যমান শব্দও বিদ্যমান, তথাপি সে শ্রবণ করে না; তাহার নাসিকা রহিয়াছে, গন্ধও রহিয়াছে, কিন্তু সে ঘ্রাণ অনুভব করে না; তাহার জিহ্বা রহিয়াছে, রসও রহিয়াছে, কিন্তু সে রস আস্বাদন করে না; তাহার কায় রহিয়াছে, স্প্রষ্টব্য রহিয়াছে, কিন্তু স্পর্শ নাই। এই প্রমাণের দ্বারাও আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪২৬. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি কথিত বাক্যের অর্থ জানিতে পারেন। হে রাজন্য, পূর্বকালে জনৈক শঙ্খনিনাদক শঙ্খ হস্তে সীমান্ত জনপদে গমন করিয়াছিল। সে এক গ্রামে উপনীত হইয়া গ্রামাভ্যন্তরে দণ্ডায়মান হইয়া তিনবার শঙ্খধ্বনি করিয়া শঙ্খভূমিতে নিক্ষেপপূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিল। তখন জনপদবাসী মনুষ্যগণ চিন্তা করিল, “এই রমণীয়, কমণীয়, মধুর, মনোহর, মুগ্ধকর শব্দ কীসের?” তাহারা একত্রিত হইয়া শঙ্খনিনাদককে জিজ্ঞাসা করিল। সে উত্তর করিল, “এই শব্দ রমণীয়, কমনীয়, মধুর, মনোহর, মুগ্ধকর শব্দ, মনুষ্যগণ যাহাকে শঙ্খ কহে সেই শঙ্খের।” তাহারা শঙ্খটিকে ঊর্ধ্বমুখ করিয়া স্থাপিত করিয়া বলিল, “হে শঙ্খ, বাজ, বাজ।” কিন্তু শঙ্খ শব্দ করিল না। তাহারা শঙ্খকে অধোমুখ করিয়া স্থাপন করিয়া… পার্শ্বোপরি শায়িত করিয়া… অপর পার্শ্বের উপর স্থাপিত করিয়া… ঊর্ধ্ব করিয়া স্থাপিত করিয়া… অধোশির করিয়া স্থাপিত করিয়া… হস্ত দ্বারা প্রহার করিয়া… মৃৎপিণ্ড নিক্ষেপে আঘাত করিয়া… দণ্ডাঘাত করিয়া… অস্ত্রাঘাত করিয়া… পার্শ্ব হইতে পার্শ্বান্তরে সর্বপ্রকারে সঞ্চালিত করিয়া বলিল, “হে শঙ্খ, বাজ, বাজ।” কিন্তু শঙ্খ শব্দ করিল না। হে রাজপুত্র, তখন সেই শঙ্খনিনাদক এইরূপ চিন্তা করিল, “এই সকল সীমান্তবাসী মনুষ্যগণ কি নির্বোধ! তাহারা কেন এইরূপ অবিবেচকের ন্যায় শঙ্খণ্ডশব্দের সন্ধান করিতেছে?” সে তাহাদের সম্মুখেই শঙ্খটি গ্রহণ করিয়া তিন বার উহা বাজাইয়া শঙ্খসহ প্রস্থান করিল। হে রাজন্য, তখন সীমান্তবাসীগণ এইরূপ চিন্তা করিল, “শঙ্খ যখন মনুষ্য, ব্যায়াম এবং বায়ু সহগত হয়, তখনই উহা শব্দ করে। কিন্তু যখন ওই শঙ্খ মনুষ্য, ব্যায়াম এবং বায়ুসহগত না হয়, তখন উহা শব্দ করে না।” হে রাজন্য, এইরূপেই এই দেহ যখন আয়ু, উষ্মা এবং বিজ্ঞানসহগত হয়, তখনই উহা গমনাগমন করে, দণ্ডায়মান হয়, উপবেশন করে, শয়ন করে, চক্ষু দ্বারা রূপ দর্শন করে, শ্রোত্র দ্বারা শব্দ শ্রবণ করে, নাসিকা দ্বারা গন্ধ আঘ্রাণ করে, জিহ্বা দ্বারা রস আস্বাদন করে, কায় দ্বারা স্প্রষ্টব্য স্পর্শ করে, মন দ্বারা ধর্ম অবগত হয়। কিন্তু যখন উহা উক্ত তিন বস্তুর সহিত যুক্ত না হয়, তখন উহা ওই সকল ক্রিয়ার কোনোটিই সম্পাদন করিতে পারে না। এই প্রমাণের দ্বারাও, হে রাজন্য, আপনার গ্রহণ করা উচিত যে পরলোক আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল আছে।”

৪২৭. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ যাহাই বলুন, এ বিষয়ে আমার এই মত, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

“হে রাজপুত্র, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি যাহার বলে আপনি বলিতেছেন উহাদের অস্তিত্ব নাই।”

“হে কস্সপ, প্রমাণ আছে।”

“হে রাজন্য, কিরূপ প্রমাণ?”

“হে কস্সপ, মনে করুন আমার পুরুষগণ চোর ধৃত করিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল এবং বলিল, “দেব, এই ব্যক্তি চোর, পাপকারী, আপনি যেরূপ ইচ্ছা ইহার দণ্ডবিধান করুন।” আমি তাহাদিগকে বলিলাম, ইহা শল্ক উন্মোচন করো, যাহাতে আমরা উহার আত্মাকে দেখিতে পাই।” তাহারা আমার আদেশ পালন করিল, কিন্তু আমরা তাহার আত্মাকে দেখিলাম না। আমি তাহাদিগকে বলিলাম, “এখন ইহার চর্ম উন্মোচন করো,… মাংস, স্নায়ু, অস্থি, মজ্জা ছিন্ন ভিন্ন করো, যাহাতে আমরা তাহার আত্মা দেখিতে পাই।” তাহারা আমার আদেশ পালন করিল, কিন্তু আমরা তাহার আত্মা দেখিলাম না। এই প্রমাণের দ্বারাও আমি বুঝিতে পারি পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।”

৪২৮. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি কথিত বাক্যের অর্থ জানিতে পারেন। হে রাজপুত্র, পূর্বকালে এক অগ্নিপূজক জটিল অরণ্য প্রদেশে পর্ণকুটিরে বাস করিত। এ সময় বণিকগণের এক সার্থ এক গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমন করিতেছিল। ওই সার্থ অগ্নিপূজক জটিলের আশ্রমের নিকটে একরাত্রি বাস করিয়া চলিয়া গেল।

রাজন্য, তখন অগ্নিপূজক জটিল চিন্তা করিল, “আমি সার্থ শিবিরে গমন করিব, সেখানে কিঞ্চিৎ প্রয়োজনীয় দ্রব্য লাভ করা সম্ভব হইবে।” অতঃপর জটিল প্রত্যূষে উত্থান করিয়া সার্থ শিবিরে গমন করিল এবং তথায় দেখিল একটি ললিত শিশু পরিত্যক্ত অবস্থায় উত্তান হইয়া শয়ন করিয়া আছে। ইহা দেখিয়া সে চিন্তা করিল, “আমি যদি কোনো মনুষ্যকে আমার সম্মুখে মরিয়া যাইতে দিই, তাহা হইলে উহা আমার পক্ষে অশোভন হইবে। আমি এই শিশুকে আশ্রমে লইয়া গিয়া সযত্নে ইহার পোষণ ও পালনের বিধান করিব।” এইরূপে সেই জটিল শিশুটিকে আশ্রমে লইয়া গিয়া সযত্নে তাহাকে পুষ্ট ও প্রতিপালিত করিল। শিশুটি যখন দশ অথবা দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ করিল, তখন জটিলের কোনো কার্যোপলক্ষে জনপদে যাইবার প্রয়োজন হইল। তখন সে শিশুটিকে এইরূপ বলিল, “বৎস, আমি জনপদে যাইতে ইচ্ছা করি, তুমি অগ্নির পরিচর্যা করিবে, অগ্নি নির্বাপিত হইতে দিবে না। যদি অগ্নি নির্বাপিত হয়, তাহা হইলে এই কুঠার, এই সকল কাষ্ঠ, এই অরণি রহিল, অগ্নি উৎপাদনপূর্বক উহার পরিচর্যা করিবে।” জটিল বালকটিকে এইরূপ নির্দেশ দিয়া জনপদে গমন করিল। বালকের ক্রীড়ারত অবস্থায় অগ্নি নির্বাপিত হইল। তখন বালক চিন্তা করিল, “পিতা আমাকে বলিয়াছেন, বৎস, অগ্নির পরিচর্যা করিবে, অগ্নি নির্বাপিত হইতে দিবে না। যদি অগ্নি নির্বাপিত হয়, তাহা হইলে এই কুঠার, এই সকল কাষ্ঠ, এই অরণি রহিল, অগ্নি উৎপাদনপূর্বক উহার পরিচর্যা করিবে। অতএব আমি অগ্নি উৎপাদনপূর্বক উহার পরিচর্যা করিব।” তৎপরে বালকটি কুঠার দ্বারা অরণি বিদীর্ণ করিতে লাগিল, সে মনে করিয়াছিল “এইরূপেই আমি অগ্নি লাভ করিব।” কিন্তু সে সফল হইল না। অরণিকে দুই, তিন, চারি, পাঁচ, দশ শতভাগে বিদীর্ণ করিল, খণ্ড খণ্ড করিল, পরে ওই সকল উদুখলে চূর্ণ করিয়া বায়ুতে উড়াইল, সে মনে করিয়াছিল, “আমি এইরূপেই অগ্নি লাভ করিব।” কিন্তু অগ্নির উৎপত্তি হইল না। তদনন্তর জটিল জনপদে কর্ম সম্পাদনান্তে আশ্রমে প্রত্যাবর্তনপূর্বক বালককে জিজ্ঞাসা করিল, “বৎস, অগ্নি নির্বাপিত হয় নাই তো?”

“পিতা, যখন আমি ক্রীড়ারত ছিলাম, তখন অগ্নি নির্বাপিত হইয়াছিল। তখন আপনি আমাকে যে নির্দেশ দিয়াছিলেন উহা স্মরণ করিয়া আমি নির্দেশানুসারে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিতে যত্নবান হইয়াছিলাম। আমি কুঠার দ্বারা অরণি শতধা বিদীর্ণ করিয়া, খণ্ডিত বিখণ্ডিত করিয়া উদুখলে চূর্ণ করিয়া বায়ুতে উড়াইয়াছিলাম, আমি মনে করিয়াছিলাম, “এইরূপেই অগ্নি উৎপন্ন হইবে।” কিন্তু আমি সফল হই নাই।” তখন সেই জটিলের মনে এই চিন্তার উদয় হইল, “এই বালক কি নির্বোধ ও জ্ঞানহীন! কেন সে এইরূপ মূঢ়ের ন্যায় অগ্নির অনুসন্ধান করিবে?” জটিল বালকের সম্মুখেই অরণি লইয়া অগ্নি উৎপাদনপূর্বক বালককে বলিল, “বৎস, এইরূপেই অগ্নি উৎপাদন করিতে হয়, তোমার ন্যায় নির্বোধ জ্ঞানহীন যেরূপে অগ্নির অন্বেষণ করে সেরূপে নয়।” হে রাজপুত্র, এইরূপেই আপনি নির্বোধ জ্ঞানহীনের ন্যায় পরলোকের অন্বেষণ করিতেছেন। হে রাজন্য, এই পাপদৃষ্টি পরিত্যাগ করুন। উহা যেন দীর্ঘকাল আপনার দুঃখ ও দুর্দশার কারণ না হয়।”

৪২৯. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আপনি এইরূপ কহিলেও ওই পাপদৃষ্টি বর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোশলরাজ পসেনদি এবং বৈদেশিক রাজগণও জানেন, “রাজন্য পায়াসি এইরূপ মত, এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।” হে কস্সপ, যদি আমি এই পাপদৃষ্টি বিসর্জন দিই, তাহা হইলে, লোকে বলিবে, “কি নির্বোধ ও জ্ঞানহীন রাজন্য পায়াসি, যাহা গ্রহণের অযোগ্য তিনি তাহাই গ্রহণ করিয়াছিলেন।” আমি ক্রোধ, দ্বেষ ও ঈর্ষাযুক্ত হইয়াও এই মত পোষণ করিব।”

৪৩০. “তাহা হইলে, রাজন্য, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞপুরুষ কথিত বাক্যের অর্থ বুঝিতে পারেন। হে রাজন্য, অতীতে সহস্র শকটসমন্বিত এক বিরাট সার্থ পূর্ব জনপদ হইতে পশ্চিম জনপদে গমন করিয়াছিল। সার্থ যে যে স্থান দিয়া গমন করিতেছিল সেই সেই স্থানের তৃণ, কাষ্ঠ, উদক, শাকাদি উদ্ভিজ্জ সমস্ত নিঃশেষিত হইতেছিল। সেই সার্থের দুইজন নায়ক ছিল, প্রত্যেকেই পাঁচশত শকটের পরিচালক। সেই দুইজনের মনে এই চিন্তার উদয় হইল :

“সহস্র শকটসমন্বিত এই বিরাট সার্থ। আমরা যে যে স্থান দিয়া গমন করিতেছি, সেই সেই স্থানের তৃণ, কাষ্ঠ, উদক, শাকাদি উদ্ভিজ্জ সমস্ত নিঃশেষিত হইতেছে। অতএব আমরা এই সার্থ দুই ভাগে বিভক্ত করিব, এক এক ভাগে পাঁচশত শকট থাকিবে।”

“তাহারা সেই সার্থ দুই ভাগে বিভক্ত করিল, এক এক ভাগে পাঁচশত শকট রহিল। একজন নায়ক বহু তৃণ, কাষ্ঠ ও উদক সংগ্রহ করিয়া যাত্রা করিল। দুই তিন দিন ভ্রমণের পর নায়ক এক কৃষ্ণবর্ণ, লোকিতাক্ষ, তূণসজ্জিত, কুমুদমালী, আর্দ্রবস্ত্র, আর্দ্রকেশ পুরুষকে কর্দমমক্ষিতচক্র গর্দভরথে আরোহণ করিয়া বিপরীত দিক হইতে আসিতে দেখিল। উহা দেখিয়া নায়ক জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন?”

“অমুক জনপদ হইতে।”

“কোথায় যাইবেন?”

“অমুক জনপদে।”

“সম্মুখে কান্তারে কি মহামেঘ উত্থিত হইয়াছে?”

“ইহা সত্য সম্মুখস্থ কান্তারে মহামেঘ উত্থিত হইয়াছে, পথসমূহ জলসিক্ত, বহু তৃণ, কাষ্ঠ ও জল আছে। আপনারা পুরাতন তৃণ, কাষ্ঠ ও জল পরিত্যাগ করিয়া লঘুভার শকটের সহিত শীঘ্র শীঘ্র গমন করুন, বাহনগুলিকে ক্লান্ত হইতে দিবেন না।”

“তখন সেই সার্থবাহ শকট চালকগণকে পূর্বোক্ত পুরুষ কথিত সমস্ত জ্ঞাপন করিয়া আদেশ করিল, “পুরাতন তৃণ, কাষ্ঠ, উদকাদি পরিত্যাগপূর্বক শকটের সহিত অগ্রসর হও।”

“তথাস্তু” কহিয়া চালকগণ নায়কের আদেশ পালন করিল। তাহারা তাহাদের প্রথম শিবির স্থাপনের স্থানে তৃণ, কাষ্ঠ, জল কিছুই পাইল না; দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম স্থানেও কিছুই পাইল না, সকলেই দুর্গতিগ্রস্ত ও বিনষ্ট হইল। সার্থে যত মনুষ্য ও পশু ছিল সকলেই সেই অ-মনুষ্য যক্ষ ভক্ষণ করিল, কেবল মাত্র তাহাদের অস্থি অবশিষ্ট রাখিল।

“অপর নায়ক যখন জানিল যে পূর্বোক্ত সার্থ বহুদূর চলিয়া গিয়াছে তখন সে প্রভূত তৃণ, কাষ্ঠ ও পানীয় লইয়া শকটসহ যাত্রা করিল। দুই তিন দিন চলিবার পর এই সার্থের নায়কও পূর্বের ন্যায় এক কৃষ্ণবর্ণ লোহিতাক্ষ পুরুষকে দেখিয়া তাহার সহিত পূর্বোক্ত প্রকারে বাক্যালাপ করিল এবং পুরুষটিও তাহাকে পূর্বের ন্যায় আপন দ্রব্যসম্ভার পরিত্যাগ করিতে বলিল।

অতঃপর সার্থবাহ শকট চালকগণকে বলিল, “এই পুরুষটি বলিতেছে সম্মুখে মহামেঘ উত্থিত হইয়াছে, পথসমূহ জলসিক্ত, বহু তৃণ, কাষ্ঠ ও পানীয় রহিয়াছে। সে আমাদিগকে পুরাতন তৃণ, কাষ্ঠ ও পানীয় পরিত্যাগ করিয়া শীঘ্র শীঘ্র যাইতে বলিতেছে, যাহাতে বাহনাদি ক্লান্ত না হয়। কিন্তু পুরুষটি আমাদের মিত্রও নয়, রক্তের সম্পর্কযুক্ত জ্ঞাতিও নয়। কিরূপে আমরা ইহার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিয়া চলিব? পুরাতন তৃণ, কাষ্ঠ, পানীয় পরিত্যাগ করা হইবে না, সমস্ত দ্রব্যসম্ভারসহ অগ্রসর হও, আমরা পুরাতন কিছুই পরিত্যাগ করিব না।”

“তথাস্তু” কহিয়া চালকগণ পূর্বাহৃত দ্রব্যসম্ভারের সহিত অগ্রসর হইল। তাহারা ক্রমান্বয়ে সাতটি শিবির স্থাপনের স্থানে তৃণ, কাষ্ঠ পানীয় কিছুই পাইল না। পরন্তু তাহারা পূর্বের সার্থকে বিনষ্ট অবস্থায় দেখিল। তাহারা ওই সার্থের মনুষ্য ও পশুসমূহের রাক্ষস কর্তৃক ভক্ষিত দেহের অস্থিসমূহ দর্শন করিল।

তখন সেই সার্থবাহ শকট চালকগণকে বলিল, “ইহা সেই পূর্বগামী সার্থ যাহা তাহার নির্বোধ নায়ক কর্তৃক চালিত হইয়া বিনষ্ট হইয়াছে। এক্ষণে আমাদিগের সহিত যে অব্যবহার্য পানীয় আছে তাহা পরিত্যাগ করিয়া ওই সার্থের উত্তম পানীয় গ্রহণ করো।” “তথাস্তু” কহিয়া চালকগণ নায়কের আদেশ পালনপূর্বক নিরাপদে কান্তার অতিক্রম করিল, যেহেতু তাহারা বুদ্ধিমান নায়কের দ্বারা পরিচালিত হইয়াছিল। এইরূপেই, হে রাজপুত্র, আপনি নির্বোধ জ্ঞানহীনের ন্যায় পরলোকের অন্বেষণ করিয়া পূর্বোক্ত সার্থবাহের ন্যায় বিনষ্ট হইবেন। যাহারা আপনার বাক্য শ্রবণ ও বিশ্বাসযোগ্য মনে করিবে তাহারাও পূর্বোক্ত শকট চালকগণের ন্যায় বিনষ্ট হইবে। হে রাজপুত্র, এই পাপদৃষ্টি পরিত্যাগ করুন। উহা যেন দীর্ঘকাল আপনার দুঃখ ও দুর্দশার কারণ না হয়।

৪৩১. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আপনি এইরূপ বলিলেও ওই পাপদৃষ্টি বর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোশলরাজ পসেনদি এবং বৈদেশিক রাজগণও জানেন, রাজন্য পায়াসি এইরূপ মত, এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।” হে কস্সপ, যদি আমি এই পাপদৃষ্টি বিসর্জন দিই, তাহা হইলে লোকে বলিবে, “কী নির্বোধ ও জ্ঞানহীন রাজন্য পায়াসি, যাহা গ্রহণের অযোগ্য তিনি তাহাই গ্রহণ করিয়াছিলেন।” আমি ক্রোধ, দ্বেষ ও ঈর্ষাযুক্ত হইয়াও এইমত পোষণ করিব।

৪৩২. “তাহা হইলে, হে রাজপুত্র, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ পুরুষ কথিত বাক্যের অর্থ বুঝিতে পারেন। রাজন্য, পূর্বকালে এক শূকর পালক স্বগ্রাম হইতে অন্য গ্রামে গমন করিয়াছিল। তথায় সে দেখিল প্রভূত শুষ্ক মল বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া তাহার মনে হইল, “বহু শুষ্ক মল বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে, উহা আমার শূকরের খাদ্য হইবে। আমি উহা এই স্থান হইতে লইয়া যাইব।” সে বহির্বাস প্রসারিত করিয়া প্রভূত শুষ্ক মল সংগ্রহপূর্বক পুলিন্দাবদ্ধ করিয়া মস্তকে স্থাপনপূর্বক চলিল। পথিমধ্যে অকালে মহামেঘের বর্ষণ হইল। সে মস্তক হইতে প্রবাহিত বিন্দু বিন্দু মলে নখাগ্র পর্যন্ত মক্ষিত হইয়া মলভার লইয়া চলিতেছিল। তাহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া মনুষ্যগণ তাহাকে বলিল, “তুমি কি উন্মত্ত, জ্ঞানশূন্য? কি নিমিত্ত বিন্দু বিন্দু মলের প্রবাহে নখাগ্র পর্যন্ত মক্ষিত হইয়া মলভার বহিতেছ?” “তোমরাই উন্মত্ত ও জ্ঞানশূন্য। ইহা আমার শূকরের খাদ্য।” রাজন্য, এইরূপে আপনিও মলবাহীরূপে প্রতীয়মান হইতেছেন। হে রাজপুত্র, এই পাপদৃষ্টি পরিত্যাগ করুন। উহা যেন দীর্ঘকাল আপনার দুঃখ ও দুর্দশার কারণ না হয়।”

৪৩৩. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আপনি এইরূপ কহিলেও ওই পাপদৃষ্টি বর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোশলরাজ পসেনদি এবং বৈদেশিক রাজগণও জানেন, “রাজন্য পায়াসি এইরূপ মত, এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।” হে কস্সপ, যদি আমি এই পাপদৃষ্টি বিসর্জন দিই, তাহা হইলে লোকে বলিবে, “কী নির্বোধ ও জ্ঞানহীন রাজন্য পায়াসি, যাহা গ্রহণের অযোগ্য তিনি তাহাই গ্রহণ করিয়াছিলেন।” আমি ক্রোধ, দ্বেষ ও ঈর্ষাযুক্ত হইয়াও এই মত পোষণ করিব।”

৪৩৪. “তাহা হইলে, রাজন্য, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ পুরুষ কথিত বাক্যের অর্থ বুঝিতে পারেন। হে রাজন্য, পূর্বকালে দুইজন অক্ষধূর্ত দ্যূতক্রীড়া করিতেছিল। উহাদের মধ্যে একজন প্রতিকূল অক্ষ দেখিলেই উহা গ্রাস করিতেছিল। দ্বিতীয় ক্রীড়ক উহা দেখিয়া তাহাকে বলিল, “মিত্র, তুমি একান্ত জয়লাভ করিতেছ, অক্ষ আমায় দাও, আমি উহাতে পূজা করিয়া লই।” “উত্তম” কহিয়া সে অক্ষগুলি প্রদান করিল। তখন ওই ক্রীড়ক অক্ষগুলিকে বিষমক্ষিত করিয়া অপরকে বলিল, “মিত্র, এসো, অক্ষক্রীড়া করি।” অপর সম্মত হইলে দ্বিতীয়বার ক্রীড়া হইল, এইবারও পূর্বোক্ত দ্যূতকর প্রতিকূল অক্ষ দেখিলেই উহা গ্রাস করিতে লাগিল। দ্বিতীয় ক্রীড়ক উহা দেখিয়া তাহাকে বলিল :

“পুরুষ বুঝিতেছে না যে সে দারুণ জ্বালা
লিপ্ত অক্ষ গ্রাস করিতেছে, রে পাপ ধূর্ত,
গ্রাস করো, ইহার তিক্ত ফল ভোগ করিতে
হইবে।”

“এইরূপেই, রাজন্য, আপনি অক্ষধূর্তরূপে প্রতীয়মান হইতেছেন। এই পাপদৃষ্টি পরিত্যাগ করুন। ইহা যেন দীর্ঘকাল আপনার দুঃখ ও দুর্দশার কারণ না হয়।”

৪৩৫. “শ্রদ্ধেয় কস্সপ, আপনি এইরূপ কহিলেও ওই পাপদৃষ্টি বর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোশলরাজ পসেনদি এবং বৈদেশিক রাজগণও জানেন, “রাজন্য পায়াসি এইরূপ মত, এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই।” হে কস্সপ, যদি আমি এই পাপদৃষ্টি বিসর্জন দিই, তাহা হইলে লোকে বলিবে, “কি নির্বোধ ও জ্ঞানহীন রাজন্য পায়াসি, যাহা গ্রহণের অযোগ্য তিনি তাহাই গ্রহণ করিয়াছিলেন।” আমি ক্রোধ, দ্বেষ ও ঈর্ষাযুক্ত হইয়াও এই মত পোষণ করিব।”

৪৩৬. “তাহা হইলে, রাজন্য, একটি উপমা দিতেছি। উপমা দ্বারাও কোনো কোনো বিজ্ঞ পুরুষ কথিত বাক্যের অর্থ বুঝিতে পারেন। হে রাজন্য, পূর্বকালে কোনো জনপদের অধিবাসীগণ স্বগ্রাম ত্যাগ করিয়া গ্রামান্তর আশ্রয় করিয়াছিল। ওই সময় এক ব্যক্তি তাহার সহচরকে বলিল, মিত্র, চলো, সেই জনপদে যাই, ওই স্থানে কিঞ্চিৎ ধনলাভ সম্ভব হইবে।” অপর ব্যক্তি সম্মত হইলে তাহারা সেই জনপদের কোনো গ্রামপথে উপনীত হইয়া দেখিল বহু শণ পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, বহু শণ পরিত্যক্ত রহিয়াছে, আমরা প্রত্যেকে একটি শণভার বন্ধন করিয়া লইয়া যাই।” অপর সম্মত হইলে উভয়েই শণভার বন্ধন করিল।

“তাহারা উভয়ে শণভার লইয়া অপর এক গ্রামপথে উপনীত হইল। তথায় তাহারা দেখিল প্রভূত শণসূত্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণের প্রয়োজন সেই শণসূত্র প্রভূত পরিমাণে পরিত্যক্ত রহিয়াছে, আমরা উভয়েই শণভার পরিত্যাগ করিয়া শণসূত্রভার লইয়া যাইব।” “মিত্র, আমি দূর হইতে এই দৃঢ়রূপে বদ্ধ শণভার বহন করিয়া আনিয়াছি, আমার পক্ষে ইহাই পর্যাপ্ত। তুমি ইচ্ছানুরূপ করিতে পার।” ইহা শুনিয়া পূর্বোক্ত ব্যক্তি শণভার পরিত্যাগ করিয়া শণসূত্রভার লইল।

“তাহারা অপর এক গ্রামপথে উপনীত হইল। তাহারা তথায় দেখিল প্রভূত শণবস্ত্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই শণবস্ত্র প্রভূত পরিমাণে পরিত্যক্ত রহিয়াছে। তুমি তোমার শণভার পরিত্যাগ করো, আমি শণসূত্রভার পরিত্যাগ করিব, উভয়ে শণবস্ত্রভার লইয়া যাইব।” “মিত্র, আমি দূর হইতে এই দৃঢ়রূপে বদ্ধ শণভার বহন করিয়া আনিয়াছি, ইহাই আমার পক্ষে পর্যাপ্ত, তুমি ইচ্ছানুরূপ করিতে পার।” ইহা শুনিয়া পূর্বোক্ত ব্যক্তি শণসূত্রভার পরিত্যাগ করিয়া শণবস্ত্রভার লইল।

“তাহারা অপর এক গ্রামপথে উপনীত হইল। তাহারা তথায় দেখিল প্রভূত ক্ষৌম পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যে জন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত ক্ষৌমসূত্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত ক্ষৌমবস্ত্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যে জন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত কার্পাস পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত কার্পাসসূত্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত কার্পাস বস্ত্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত লৌহ পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত তাম্র পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত ত্রপু পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত সীসক পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত রৌপ্য পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “মিত্র, যেজন্য আমাদের শণ অথবা শণসূত্রের প্রয়োজন, সেই প্রভূত সুবর্ণ পরিত্যক্ত রহিয়াছে। উহা দেখিয়া এক অপরকে বলিল, “যেজন্য আমাদের শণ, শণসূত্র, শণবস্ত্র, ক্ষৌম, ক্ষৌমসূত্র, ক্ষৌমবস্ত্র, কার্পাস, কার্পাস সূত্র, কার্পাস বস্ত্র, লৌহ, তাম্র, ত্রপু, সীসক অথবা রৌপ্যের প্রয়োজন, সেই সুবর্ণ প্রভূত পরিমাণে পরিত্যক্ত রহিয়াছে। তুমি শণভার পরিত্যাগ করো, আমি রৌপ্যভার পরিত্যাগ করিব, উভয়ে সুবর্ণভার লইয়া গমন করিব।” “মিত্র, আমি দূর হইতে এই দৃঢ়বদ্ধ শণভার বহন করিয়া আনিয়াছি, আমার পক্ষে ইহাই পর্যাপ্ত, তুমি ইচ্ছানুরূপ করিতে পার। ইহা শুনিয়া পূর্বোক্ত ব্যক্তি রৌপ্যভার পরিত্যাগপূর্বক সুবর্ণভার লইল।

“তাহারা স্বগ্রামে উপনীত হইল। তথায় শণভারবাহী পুরুষকে তাহার মাতা পিতা, স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু-বান্ধব কেহই অভিনন্দিত করিল না, এবং তন্নিমিত্ত সে সুখ ও সৌমনস্য লাভ করিল না। কিন্তু স্বর্ণভারবাহী পুরুষ তাহার মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র বন্ধু-বান্ধব কর্তৃক অভিনন্দিত হইল, এবং তন্নিমিত্ত সে সুখ ও সৌমনস্য প্রাপ্ত হইল।”

“হে রাজন্য, আপনি শণভারবাহীর ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছেন। এই পাপদৃষ্টি পরিত্যাগ করুন। উহা যেন দীর্ঘকাল আপনার দুঃখ ও দুর্দশার কারণ না হয়।”

৪৩৭. “শ্রদ্ধেয় কস্সপের প্রথম উপমা দ্বারাই আমি তাঁহার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছিলাম, কিন্তু আমি এই বিচিত্র প্রশ্নোত্তর শ্রবণে অভিলাষী হইয়া তাঁহার বিরুদ্ধবাদী হইয়াছিলাম। হে কস্সপ, উত্তম, উত্তম! যেরূপ উৎপাতিতের পুনঃ প্রতিষ্ঠা হয়, লুক্কায়িত প্রকাশিত হয়, মূঢ় পথ প্রদর্শিত হয়, চক্ষুষ্মানের দর্শনের নিমিত্ত অন্ধকারে তৈলদীপ ধৃত হয়, সেইরূপই শ্রদ্ধেয় কস্সপ অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশ করিয়াছেন। হে কস্সপ, আমি ভগবান গৌতমের শরণ লইতেছি, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘের শরণ লইতেছি। অদ্য হইতে দেহে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন শ্রদ্ধেয় কস্সপ আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে গ্রহণ করুন। হে কস্সপ, আমি মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে ইচ্ছা করি। পূজ্য কস্সপ দীর্ঘকাল আমার হিত ও সুখের জন্য আমাকে উপদেশ দান করুন।”

৪৩৮. “হে রাজন্য, যে প্রকার যজ্ঞে গো বধ হয়, অজ-মেষ-কুক্কুট-শূকর বধ করা হয়, বিবিধ প্রকার প্রাণীর প্রাণনাশ হয়, এবং প্রতিগ্রাহকগণ মিথ্যাদৃষ্টি, মিথ্যাসংকল্প, মিথ্যাবাক্য, মিথ্যাকর্মান্ত, মিথ্যাআজীব, মিথ্যাব্যায়াম, মিথ্যাস্মৃতি, মিথ্যাসমাধিসম্পন্ন হয়, হে রাজন্য, ওইরূপ যজ্ঞ মহৎ ফল প্রসব করে না, মহোপকারী হয় না, মহাদ্যুতিসম্পন্ন হয় না, উহার ফল দূরপ্রসারী হয় না। হে রাজন্য, মনে করুন কোনো কৃষক বীজ ও লাঙ্গল লইয়া বনে প্রবেশ করিল। সে তথায় অকর্ষিত, নিকৃষ্ট, অনুৎপাটিত-স্থাণুবহুল ক্ষেত্রে ভগ্ন, জীর্ণ, বাতাতপাহত, বিকৃত, রোপণের অনুপযুক্ত বীজ বপন করিল, সময়ে সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিও পড়িল না। ওই সকল বীজ কি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, অঙ্কুরিত ও পূর্ণরূপে বিকশিত হইবে? অথবা উহা হইতে কি কৃষক পর্যাপ্ত ফল লাভ করিবে?”

“শ্রদ্ধেয় কস্সপ, অবশ্যই নহে।”

“এইরূপেই, হে রাজন্য, যে প্রকার যজ্ঞে গো বধ হয়, অজ-মেষ-কুক্কুট-শূকর বধ করা হয়, বিবিধ প্রকার প্রাণীর প্রাণনাশ হয়, এবং প্রতিগ্রাহকগণ মিথ্যাদৃষ্টি, মিথ্যাসংকল্প, মিথ্যাবাক্য, মিথ্যাকর্মান্ত, মিথ্যাআজীব, মিথ্যাব্যায়াম, মিথ্যাস্মৃতি, মিথ্যাসমাধিসম্পন্ন হয়, ওইরূপ যজ্ঞ মহৎ ফল প্রসব করে না, মহোপকারী হয় না, মহাদ্যুতিসম্পন্ন হয় না, উহার ফল দূরপ্রসারী হয় না। হে রাজন্য, যে প্রকার যজ্ঞে গো-বধ হয় না, অজ-মেষ-কুক্কুট-শূকর বধ করা হয় না, বিবিধ প্রকার প্রাণীর প্রাণনাশ হয় না এবং প্রতিগ্রাহকগণ মিথ্যাদৃষ্টি, মিথ্যাসংকল্প, মিথ্যাবাক্য, মিথ্যাকর্মান্ত, মিথ্যাআজীব, মিথ্যাব্যায়াম, মিথ্যাস্মৃতি, মিথ্যাসমাধিসম্পন্ন হয় না; ওইরূপ যজ্ঞ মহৎ ফল প্রসব করে, মহোপকারী হয়, মহাদ্যুতিসম্পন্ন হয়, উহার ফল দূর প্রসারী হয়। মনে করুন কোনো কৃষক বীজ ও লাঙ্গল লইয়া বনে প্রবেশ করিল। সে তথায় সুকর্ষিত, উৎকৃষ্ট, উৎপাটিত-স্থাণু ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ, নবীন, বাতাতপ-অনাহত, অবিকৃত, রোপণানুকুল বীজ বপন করিল। ওই সকল বীজ কি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, অঙ্কুরিত ও পূর্ণরূপে বিকশিত হইবে? অথবা উহা হইতে কি কৃষক পর্যাপ্ত ফল লাভ করিবে?”

“করিবে।”

“হে রাজপুত্র, এইরূপেই যে প্রকার যজ্ঞে গো বধ হয় না, অজ-মেষ-কুক্কুট-শূকর বধ করা হয় না, বিবিধ প্রকার প্রাণীর প্রাণনাশ হয় না এবং প্রতিগ্রাহকগণ সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধিসম্পন্ন হয়, হে রাজপুত্র, ওইরূপ যজ্ঞ মহৎ ফল প্রসব করে, মহোপকারী হয়, মহাদ্যুতিসম্পন্ন হয়, উহার ফল দূর প্রসারী হয়।”

৪৩৯. অতঃপর রাজন্য পায়াসি শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের নিমিত্ত, দীন-দুঃখী-নিরাশ্রয় ভিক্ষুকগণের নিমিত্ত দানের প্রতিষ্ঠা করিলেন। সেই দানে বিড়ঙ্গসহ কণাজক ভোজনরূপে প্রদত্ত হইল, স্থূল, অমসৃণ বস্ত্রাদি বিতরিত হইল। ওই দানে উত্তর নামক ব্রাহ্মণযুবক তত্ত্বাবধায়করূপে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি দান সমাপনান্তে এইরূপে মনোভাব প্রকাশ করিলেন :

“এই দানোপলক্ষে আমার সহিত রাজন্য পায়াসির যে সমাগম হইল, তাহা এই জগতেরই জন্য, পরজগতের জন্য নহে।” উত্তরের এই মন্তব্য রাজন্য পায়াসির কর্ণে প্রবেশ করিল। তখন তিনি উত্তরকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, “তুমি কি সত্যই এইরূপ বলিয়াছ, এই দানোপলক্ষে আমার সহিত রাজন্য পায়াসির যে সমাগম হইল, তাহা এই জগতেরই জন্য, পরজগতের জন্য নহে?”

“সত্যই বলিয়াছি।”

“কেন এরূপ বলিয়াছ, বৎস উত্তর, আমরা কি পুণ্যার্থী এবং দানের ফলাকাঙ্ক্ষী নহি?”

আপনার দানে বিড়ঙ্গণ্ডসহ কণাজক ভোজনরূপে প্রদত্ত হইয়াছে, যাহা আপনি পাদ দ্বারাও স্পর্শ করিবেন না, ভোজনের তো কথাই নাই; স্থূল, অমসৃণ বস্ত্রাদি বিতরিত হইয়াছে, যাহা আপনি পাদ দ্বারাও স্পর্শ করিবেন না, পরিধানের তো কথাই নাই। আপনি আমাদের প্রিয়, প্রীতিপদ। যাহা প্রিয় ও প্রীতিপ্রদ তাহার সহিত কী প্রকারে আমরা অপ্রিয় ও অপ্রীতিকরের যোজনা করিব?”

“তাহা হইলে, বৎস উত্তর, যেরূপ ভোজন আমি গ্রহণ করি এবং যেরূপ বস্ত্রাদি আমি পরিধান করি, তুমি সেইরূপ ভোজন ও বস্ত্রাদি বিতরণ করো।”

এইরূপে রাজন্য পায়াসি সসম্মানে দান না দিয়া, স্বহস্তে না দিয়া, সর্বান্তঃকরণে না দিয়া, অপবিদ্ধ দান দিয়া মরণান্তে দেহের বিনাশে চাতুর্মহারাজিক দেবলোকে শূন্য সেরীসক বিমানে উৎপন্ন হইলেন। যিনি তাঁহার দানে তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সেই ব্রাহ্মণ যুবক উত্তর সসম্মানে, স্বহস্তে সর্বান্তঃকরণে অনপবিদ্ধ দান বিতরণ করিয়া মরণান্তে দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইলেন।

৪৪১. ওই সময়ে আয়ুষ্মান গবম্পতি প্রায়শ দিবাবিহারের নিমিত্ত শূন্য সেরীসক বিমানে গমন করিতেন। দেবপুত্র পায়াসি আয়ুষ্মান গবম্পতির নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইলেন। তখন আয়ুষ্মান গবম্পতি দেবপুত্র পায়াসিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সৌম্য, আপনি কে?”

“দেব, আমি রাজন্য পায়াসি।”

“আপনি কি এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না, পরলোক নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব নাই, সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল নাই?”

“দেব, আমি ওইরূপ দৃষ্টিসম্পন্নই ছিলাম। কিন্তু আমি আর্যকুমার কস্সপ কর্তৃক ওই পাপদৃষ্টি হইতে মুক্ত হইয়াছি।”

“আপনার দানে যিনি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সেই তরুণ ব্রাহ্মণ উত্তর কোথায় উৎপন্ন হইয়াছেন?”

“তিনি সসম্মানে, স্বহস্তে, সর্বান্তঃকরণে অনপবিদ্ধ দান বিতরণ করিয়া মরণান্তে দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন। কিন্তু আমি সসম্মানে দান না দিয়া, স্বহস্তে না দিয়া, সর্বান্তঃকরণে না দিয়া, অপবিদ্ধ দান দিয়া মরণান্তে দেহের বিনাশে চাতুর্মহারাজিক দেবলোকে শূন্য সেরীসক বিমানে উৎপন্ন হইয়াছি। অতএব, শ্রদ্ধেয় গবম্পতি! আপনি মনুষ্যলোকে গমন করিয়া এইরূপ ঘোষণা করুন, “সৎকারপূর্বক দান করো, স্বহস্তে দান করো, সর্বান্তঃকরণে দান করো, অনপবিদ্ধ দান করো। রাজন্য পায়াসি সসম্মানে, স্বহস্তে, সর্বান্তঃকরণে দান না করিয়া, অপবিদ্ধ দান করিয়া মরণান্তে দেহের বিনাশে চাতুর্মহারাজিক দেবলোকে শূন্য সেরীসক বিমানে উৎপন্ন হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহার দানের তত্ত্বাবধায়ক তরুণ উত্তর সসম্মানে, স্বহস্তে, সর্বান্তঃকরণে অনপবিদ্ধ দান করিয়া মরণান্তে দেহের বিনাশে সুগতিসম্পন্ন হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন।”

তদনন্তর আয়ুষ্মান গবম্পতি মনুষ্যলোকে আগমন করিয়া ওই সমস্ত সংবাদ প্রচার করিলেন।

পায়াসি সূত্রান্ত সমাপ্ত।

মহাবর্গ সমাপ্ত।

The Long Discourses

|_II. The Great Chapter

DN23. পায়াসি সূত্রান্ত

Translations [21]

English

繁體字

日本語

Français

Deutsch

Italiano

Português

Русский

Norsk

Srpski

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference

Translations [21]

English

繁體字

日本語

Français

Deutsch

Italiano

Português

Русский

Norsk

Srpski

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference

Commentaries [0]