১. আমি এইরূপ শ্রবণ করিয়াছি। এক সময় ভগবান মল্লদিগের দেশে অবস্থান করিতেছিলেন। অনুপিয় নামক মল্লদিগের নগর। ভগবান পূর্বাহ্ণের বেশ ধারণপূর্বক পাত্র ও চীবর হস্তে অনুপিয় নগরে পিণ্ডার্থ প্রবেশ করিলেন। তখন তাঁহার মনে হইল, “ভিক্ষার্থ অনুপিয়তে ভ্রমণের জন্য এখনো অতিপ্রাক, অতএব ভগ্গব-গোত্ত পরিব্রাজকের আরামে তাহার নিকট গমন করিব।” এইরূপ চিন্তা করিয়া ভগবান ভগ্গবগোত্ত পরিব্রাজকের আরামে পরিব্রাজকের নিকট গমন করিলেন।

২. তখন পরিব্রাজক ভগ্গব-গোত্ত ভগবানকে বলিলেন, “ভন্তে, ভগবান আগমন করুন, স্বাগত ভগবান, বহুদিন ভগবানের এই স্থানে আগমন হয় নাই। ভগবান উপবেশন করুন, এই আসন প্রস্তুত।”

ভগবান নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন। পরিব্রাজক ভগ্গব-গোত্তও অন্যতর অনুচ্চ আসন গ্রহণপূর্বক এক প্রান্তে উপবেশন করিলেন। পরে তিনি ভগবানকে বলিলেন, ভন্তে, কিছুদিন পূর্বে লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত আমার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিয়াছিলেন, “ভগ্গব, আমি এক্ষণে ভগবানকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছি। আমি আর এখন ভগবানের অনুসরণ করি না।” “ভন্তে, লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত যাহা বলিয়াছেন তাহা কি সত্য?”

“ভগ্গব, তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহা সত্য।”

৩. ভগ্গব, কিছুকাল পূর্বে লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন, “আমি এক্ষণে ভগবানকে প্রত্যাখ্যান করি, আমি এখন আর ভগবানের অনুসরণ করিব না।”

ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলে আমি তাহাকে বলিলাম, সুনক্ষত্ত, আমি কি এইরূপ বলিয়াছি, সুনক্ষত্ত, তুমি এসো, আমার অনুসরণ করো?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“তুমি কি আমাকে এইরূপ বলিয়াছ, ভন্তে, আমি ভগবানের অনুসরণ করিব?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“তাহা হইলে, সুনক্ষত্ত, আমিও তোমাকে এইরূপ কহি নাই : সুনক্ষত্ত, এসো, আমার অনুসরণ করো; তুমিও আমাকে কহ নাই : ভন্তে, আমি ভগবানের অনুসরণ করিব। হে নির্বোধ, এইরূপ হইলে তুমি কে এবং কাহাকে প্রত্যাখ্যান করিতেছ? মূঢ়, এইস্থানে তোমার ভ্রম দেখো।”

৪. “ভন্তে, ভগবান আমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করেন না।”

“সুনক্ষত্ত, আমি কি তোমাকে এইরূপ বলিয়াছি, সুনক্ষত্ত, এসো, আমার অনুসরণ করো, আমি তোমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“তুমি কি আমাকে এইরূপ বলিয়াছ, ভন্তে, আমি ভগবানের অনুসরণ করিব, ভগবান আমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“এইরূপে, সুনক্ষত্ত, আমিও তোমাকে কহি নাই : সুনক্ষত্ত, এসো, আমার অনুসরণ করো, আমি তোমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব; তুমিও আমাকে কহ নাই : ভন্তে, আমি ভগবানের অনুসরণ করিব, ভগবান আমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন। হে নির্বোধ, এইরূপ হইলে তুমি কে এবং কাহাকে প্রত্যাখ্যান করিতেছ? সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, আমি অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করি বা না করি, যে নিমিত্ত আমি ধর্মোপদেশ দিয়াছি তাহা পালনকারীর দুঃখ সম্যকরূপে অপনোদন করে?”

“আপনি ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করুন বা না করুন, যে নিমিত্ত আপনি ধর্মোপদেশ দিয়াছেন, তাহা পালনকারীর দুঃখ সম্যকরূপে অপনোদন করে।”

“তাহা হইলে, সুনক্ষত্ত, অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন কী করিবে? মূঢ়, এইস্থানে তোমার ভ্রম দেখো।”

৫. “ভগবান আমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করেন না।”

“সুনক্ষত্ত, আমি কি তোমাকে এইরূপ বলিয়াছি, এসো, সুনক্ষত্ত, আমার অনুসরণ করো, আমি তোমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করিব?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“তুমি কি আমাকে এইরূপ বলিয়াছ, আমি ভগবানের অনুসরণ করিব, ভগবান আমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করিবেন?”

“ভন্তে, তাহা নহে।”

“এইরূপ হইলে, সুনক্ষত্ত, আমিও তোমাকে কহি নাই : সুনক্ষত্ত, এসো, আমার অনুসরণ করো, আমি তোমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করিব। তুমিও আমাকে কহ নাই : আমি ভগবানের অনুসরণ করিব, ভগবান আমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করিবেন। হে নির্বোধ, এইরূপ হইলে তুমি কে এবং কাহাকে প্রত্যাখ্যান করিতেছ? সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, আমি তোমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করি বা না করি, যে নিমিত্ত আমি ধর্মোপদেশ দিয়াছি তাহা পালনকারীর দুঃখ সম্যকরূপে অপনোদন করে?”

“আপনি আমার নিকট পুরাতত্ত্বের বর্ণনা করুন বা না করুন, যে নিমিত্ত আপনি ধর্মোপদেশ দিয়াছেন তাহা পালনকারীর দুঃখ সম্যকরূপে অপনোদন করে।”

“তাহা হইলে, সুনক্ষত্ত, পুরাতত্ত্বের বর্ণনা কী করিবে? মূঢ়, এইস্থানে তোমার ভ্রম দেখো।”

৬. “সুনক্ষত্ত, তুমি বজ্জীগ্রামে অনেক প্রকারে আমার প্রশংসা কীর্তন করিয়াছ, ইনিই ভগবান, অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকজ্ঞ, অতুলনীয়, দম্যপুরুষসারথি, দেবমনুষ্যের শাস্তা, বুদ্ধ, ভগবন্ত। এইরূপে, সুনক্ষত্ত, তুমি বজ্জীগ্রামে অনেক প্রকারে আমার প্রশংসা কীর্তন করিয়াছ।

“সুনক্ষত্ত, তুমি বজ্জীগ্রামে অনেক প্রকারে ধর্মের প্রশংসা কীর্তন করিয়াছ, ধর্ম ভগবান কর্তৃক স্বাখ্যাত, উহা সাংদৃষ্টিক, অবিলম্বে ফলপ্রসূ, সর্বজগৎকে আহ্বানকারী, নির্বাণ প্রদায়ী, বিজ্ঞগণ কর্তৃক স্ব স্ব অন্তরে জ্ঞাতব্য। এইরূপে, সুনক্ষত্ত, তুমি অনেক প্রকারে বজ্জীগ্রামে ধর্মের প্রশংসা কীর্তন করিয়াছ।”

“সুনক্ষত্ত, তুমি বজ্জীগ্রামে অনেক প্রকারে সংঘের প্রশংসা কীর্তন করিয়াছ, চারি পুরুষ-যুগ অষ্ট পুরুষ সম্বলিত ভগবানের শ্রাবকসংঘ সুপ্রতিপন্ন, ঋজুপ্রতিপন্ন, ন্যায়-প্রতিপন্ন, সামীচি-প্রতিপন্ন, তাঁহারা দান, আতিথেয়তা, দক্ষিণা ও অঞ্জলিকরণের যোগ্য, তাঁহারা জগতের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র। এইরূপে, সুনক্ষত্ত, তুমি বজ্জীগ্রামে অনেক প্রকারে সংঘের প্রশংসা কীর্তন করিয়াছ।”

“সুনক্ষত্ত, আমি বলিতেছি তোমার সম্বন্ধে জনগণ ঘোষণা করিবে, লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত শ্রমণ গৌতমের শাসনে ব্রহ্মচর্য্য পালনে অসমর্থ হইয়া হীনার্থের সেবায় নিযুক্ত হইয়াছেন।”

ভগ্গব, আমি এইরূপ কহিলে লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত এই ধর্মবিনয় পরিত্যাগপূর্বক অপায় নিরয়োন্মুখ হইয়া প্রস্থান করিলেন।

৭. ভগ্গব, এক সময় আমি বুমূদিগের দেশে অবস্থান করিতেছিলাম। তথায় উত্তরকা নামক বুমূদিগের নগর। ভগ্গব, আমি পূর্বাহ্নের বেশধারণপূর্বক পাত্র ও চীবর হস্তে পশ্চাচ্ছ্রমণ লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্তের সহিত উত্তরকায় ভিক্ষার্থ প্রবেশ করিয়াছিলাম। ওই সময়ে অচেল কোরক্ষত্তিয় কুক্কুর ব্রত অবলম্বনপূর্বক চতুকুণ্ডিক হইয়া ভূমিতে নিক্ষিপ্ত ভক্ষ্য মুখ দ্বারা গ্রহণপূর্বক ভোজন করিতেন।

“ভগ্গব, লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত দেখিলেন অচেল, কুক্কুরব্রতী, কোরক্ষত্তিয় চতুকুণ্ডিক হইয়া ভূমিতে নিক্ষিপ্ত ভক্ষ্যমুখ দ্বারা গ্রহণপূর্বক ভোজন করিতেছেন। উহা দেখিয়া তাহার মনে হইল, “অর্হৎ, শ্রমণ চতুকুণ্ডিক হইয়া ভূমিতে নিক্ষিপ্ত ভক্ষ্য মুখ দ্বারা গ্রহণপূর্বক ভোজন করিতেছেন, ইনি সম্মানের যোগ্য।”

ভগ্গব, তখন আমি স্বচিত্তে সুনক্ষত্তের চিন্তা জ্ঞাত হইয়া তাহাকে বলিলাম, “মূঢ়, তুমি আপনাকে শাক্যপুত্রীয়রূপে স্বীকার করো?”

“ভগবান কেন আমাকে এইরূপ বলিলেন, মূঢ়, তুমি আপনাকে শাক্যপুত্রীয়রূপে স্বীকার করো?”

“সুনক্ষত্ত, এই নগ্ন কুক্কুরব্রতী চতুকুণ্ডিক কোরক্ষত্তিয়কে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত ভক্ষ্য মুখ দ্বারা গ্রহণপূর্বক ভোজন করিতে দেখিয়া তুমি কী মনে করো নাই, অর্হৎ শ্রমণ চতুকুণ্ডিক হইয়া ভূমিতে নিক্ষিপ্ত ভক্ষ্য মুখ দ্বারা গ্রহণপূর্বক ভোজন করিতেছেন, ইনি সম্মানের যোগ্য?”

“ভন্তে, তাহা সত্য। আপনি কি অপরের অর্হত্ত্বে ঈর্ষা অনুভব করিতেছেন?”

“মূঢ়, আমি অপরের অর্হত্ত্বে ঈর্ষা অনুভব করিতেছি না। কিন্তু তোমারই পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে, উহা পরিত্যাগ করো, উহা যেন দীর্ঘকাল তোমার অমঙ্গল ও দুঃখের কারণ না হয়। সুনক্ষত্ত, যে নগ্ন কোরক্ষত্তিয়কে তুমি সম্মানের যোগ্য অর্হৎ শ্রমণ মনে করিতেছ, তিনি সপ্তম দিবসে অলসক রোগাক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইবেন এবং কালকঞ্জ নামক সর্বনিকৃষ্ট অসুরদিগের মধ্যে উৎপন্ন হইবেন, মৃত্যুর পর তিনি বীরণগুল্মাবৃত শ্মশানে নিক্ষিপ্ত হইবেন। সুনক্ষত্ত, যদি ইচ্ছা হয় তুমি অচেল কোরক্ষত্তিয়ের নিকট গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে পারো, সৌম্য কোরক্ষত্তিয়, আপনার গতি অবগত আছেন? সুনক্ষত্ত, ইহা সম্ভব যে নগ্ন কোরক্ষত্তিয় তোমাকে বলিবেন, সৌম্য সুনক্ষত্ত, আমি নিজের গতি জানি, কালকঞ্জ নামক সর্বনিকৃষ্ট অসুরদিগের মধ্যে আমি উৎপন্ন হইব।”

ভগ্গব, তৎপরে লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত অচেল কোরক্ষত্তিয়ের নিকট গমনপূর্বক তাহাকে বলিল, “সৌম্য কোরক্ষত্তিয়, শ্রমণ গৌতম বলিয়াছেন অচেল কোরক্ষত্তিয় সপ্তম দিবসে অলসক রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হইবেন এবং কালকঞ্জ নামক সর্বনিকৃষ্ট অসুরদিগের মধ্যে উৎপন্ন হইবেন, মৃত্যুর পর তিনি বীরণগুল্মাবৃত শ্মশানে নিক্ষিপ্ত হইবেন। সৌম্য কোরক্ষত্তিয়, আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে আহার ও পান করুন, যাহাতে শ্রমণ গৌতমের বাক্য মিথ্যা হয়।”

৮. “অনন্তর, ভগ্গব, সুনক্ষত্ত এক দুই দিন করিয়া সাত দিবারাত্রি গণনা করিল, সে তথাগতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিল না। অতঃপর সপ্তম দিবসে অচেলক কোরক্ষত্তিয় অলসক রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া কালকঞ্জ নামক সর্বনিকৃষ্ট অসুরদিগের মধ্যে উৎপন্ন হইল, মৃত্যুর পর সে বীরণগুল্মাবৃত শ্মশানে নিক্ষিপ্ত হইল।”

৯. ভগ্গব, সুনক্ষত্ত শুনিলেন, অচেল কোরক্ষত্তিয় অলসক রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া বীরণগুল্মাবৃত শ্মশানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছেন। তখন, ভগ্গব, লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত বীরণগুল্মাবৃত শ্মশানে কোরক্ষত্তিয়ের নিকট গমনপূর্বক তাহাকে তিনবার পাণি দ্বারা প্রহার করিয়া বলিলেন, “সৌম্য কোরক্ষত্তিয়, আপনার কী গতি জানেন?” অতঃপর, ভগ্গব, অচেল কোরক্ষত্তিয় হস্ত দ্বারা পৃষ্ঠদেশ মুছিয়া উত্থান করিল এবং বলিল, “সৌম্য সুনক্ষত্ত, আমি স্বীয় গতি জানি। কালকঞ্জ নামক সর্বনিকৃষ্ট অসুরদিগের মধ্যে আমি উৎপন্ন হইয়াছি।” ইহা বলিয়াই সে উত্তান হইয়া পতিত হইল।

১০. অনন্তর, ভগ্গব, লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে অভিবাদনান্তে এক প্রান্তে উপবিষ্ট হইলেন। পরে আমি তাহাকে বলিলাম, “সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, অচেল কোরক্ষত্তিয়ের সম্বন্ধে আমি যাহা বলিয়াছিলাম, ঠিক সেইরূপই হইয়াছে, অথবা তাহার অন্যথা হইয়াছে?”

“ভগবান যাহা বলিয়াছিলেন, ঠিক সেইরূপই হইয়াছে, তাহার অন্যথা হয় নাই।”

“সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, এইরূপ হইলে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইয়াছে অথবা না?”

“ভন্তে, এইরূপ অবস্থায় অবশ্যই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইয়াছে, হয় নাই তাহা নয়।”

“মূঢ়, আমি এইরূপ অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলেও তুমি বলিয়াছ, ভগবান আমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করেন না। নির্বোধ, এইস্থানে তোমার ভ্রম দেখো।”

“ভগ্গব, আমি এইরূপ কহিলে লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত এই ধর্মবিনয় পরিত্যাগপূর্বক অপায়-নিরয়োন্মুখ হইয়া প্রস্থান করিলেন।

১১. ভগ্গব, এক সময় আমি বৈশালির মহাবনে কূটাগারশালায় অবস্থান করিতেছিলাম। ওই সময়ে অচেল কন্দরমসুক বজ্জীগ্রাম বৈশালিতে বিপুল লাভ ও যশ সমন্বিত হইয়া বাস করিতেছিলেন। তিনি সপ্তবিধ ব্রত সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন, “যাবজ্জীবন অচেলক রহিব, বস্ত্র পরিধান করিব না, যাবজ্জীবন ব্রহ্মচারী রহিব, মৈথুন ধর্মের সেবা করিব না, যাবজ্জীবন সুরা ও মাংসে জীবন ধারণ করিব, পক্বান্ন মিষ্টান্নাদি ভোজন করিব না, বৈশালির পূর্বদিকস্থ উদেন চৈত্য অতিক্রম করিব না, বৈশালির দক্ষিণস্থ গোতমক চৈত্য অতিক্রম করিব না, বৈশালির পশ্চিমস্থ সত্তম্ব নামক চৈত্য অতিক্রম করিব না, বৈশালির উত্তরস্থ বহুপুত্ত নামক চৈত্য অতিক্রম করিব না।” তিনি এই সপ্তবিধ ব্রত সমাদান হেতু বজ্জীগ্রামে বিপুল লাভ ও যশ অর্জন করিয়াছিলেন।

১২. অতঃপর, ভগ্গব, লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত অচেল কন্দরমসুকের নিকট গমনপূর্বক তাহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল। প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া অচেল কন্দরমসুক উত্তরদানে অসমর্থ হইয়া তাহার প্রতি ক্রোধ, বিদ্বেষ ও বিরক্তি প্রকাশ করিল। তখন সুনক্ষত্ত চিন্তা করিল, “সাধু, অর্হৎ, শ্রমণের বিরক্তি উৎপাদন করিয়াছি, ইহা যেন দীর্ঘকাল আমার অমঙ্গল ও দুঃখের কারণ না হয়।”

১৩. ভগ্গব, তদনন্তর সুনক্ষত্ত আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলে আমি তাহাকে বলিলাম, “মূঢ়, তুমি আপনাকে শাক্যপুত্রীয়রূপে স্বীকার করো?” “ভগবান কেন এইরূপ বলিতেছেন?”

“সুনক্ষত্ত, তুমি অচেল কন্দরমসুকের নিকট গমন করিয়া তাহাকে প্রশ্ন করো নাই? সে তোমার প্রশ্নের উত্তরদানে অসমর্থ হইয়া ক্রোধ, বিদ্বেষ ও বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছিল। তুমি এইরূপ চিন্তা করিয়াছিলে, সাধু, অর্হৎ, শ্রমণের বিরক্তি উৎপাদন করিয়াছি, ইহা যেন দীর্ঘকাল আমার অমঙ্গল ও দুঃখের কারণ না হয়।”

“ভন্তে, তাহা সত্য। আপনি কি অপরের অর্হত্ত্বে ঈর্ষা অনুভব করিতেছেন?”

“মূঢ়, আমি অপরের অর্হত্ত্বে ঈর্ষা অনুভব করিতেছি না। কিন্তু তোমারই পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে, উহা পরিত্যাগ করো, উহা যেন দীর্ঘকাল তোমার অমঙ্গল ও দুঃখের কারণ না হয়। সুনক্ষত্ত, যে অচেল কন্দরমসুককে তুমি সাধু, অর্হৎ, শ্রমণ মনে করিতেছ, তিনি অচিরে বস্ত্রপরিহিত হইয়া নারীগণসহ বিচরণ করিবেন এবং সুপক্ব অন্নাদি ভোজনে রত হইয়া বৈশালির সর্ব চৈত্য অতিক্রম করিয়া যশোহীন হইয়া দেহত্যাগ করিবেন।

অনন্তর, ভগ্গব, অচেল কন্দরমসুক অচিরে বস্ত্রধারণ করিয়া নারীগণসহ বিচরণ এবং সুপক্ব অন্নাদি ভোজনে রত হইয়া বৈশালির সর্ব চৈত্য অতিক্রমপূর্বক যশোহীন হইয়া দেহত্যাগ করিলেন।

১৪. লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত শ্রবণ করিলেন, অচেল কন্দরমসুক বস্ত্রধারণ করিয়া নারীগণসহ বিচরণ এবং সুপক্ব অন্নাদি ভোজনে রত হইয়া বৈশালির সর্ব চৈত্য অতিক্রমপূর্বক যশোহীন হইয়া দেহত্যাগ করিয়াছেন। ভগ্গব, তখন সুনক্ষত্ত আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবিষ্ট হইলে আমি তাহাকে বলিলাম :

“সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, অচেল কন্দরমসুকের সম্বন্ধে আমি যাহা ব্যক্ত করিয়াছিলাম, সেইরূপই হইয়াছে, অথবা তাহার অন্যথা হইয়াছে?

“ওই সম্বন্ধে ভগবান যাহা ব্যক্ত করিয়াছিলেন, সেইরূপই হইয়াছে, তাহার অন্যথা হয় নাই।”

“সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, এইরূপ ক্ষেত্রে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইয়াছে, অথবা না?”

“ভন্তে, অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহা যে হয় নাই তাহা নয়।

মূঢ়, আমি এইরূপ অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলেও তুমি বলিয়াছ, ভগবান আমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করেন না। নির্বোধ, এই স্থানে তোমার ভ্রম দেখো।”

ভগ্গব, আমি এইরূপ কহিলে লিচ্ছবিপুত্র সুনক্ষত্ত এই ধর্মবিনয় পরিত্যাগপূর্বক অপায়-নিরয়োন্মুখ হইয়া প্রস্থান করিলেন।

১৫. ভগ্গব, একসময় আমি বৈশালিতেই মহাবনে কূটাগারশালায় অবস্থান করিতেছিলাম। ওই সময়ে অচেল পাথিক-পুত্ত বজ্জীগ্রাম বৈশালিতে বিপুল লাভ ও যশসমন্বিত হইয়া বাস করিতেছিলেন। তিনি বৈশালিতে সভামধ্যে এইরূপ বলিতেছিলেন, “শ্রমণ গৌতমও জ্ঞানবাদী, আমিও জ্ঞানবাদী, জ্ঞানবাদীর উচিত জ্ঞানবাদীর সহিত ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করা। শ্রমণ গৌতম অর্ধপথ আগমন করুন, আমিও অর্ধপথ গমন করিব। আমরা উভয়েই ওইস্থানে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব। শ্রমণ গৌতম একটি অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলে আমি দুইটি করিব। তিনি দুইটি প্রদর্শন করিলে আমি চারিটি করিব। তিনি চারিটি প্রদর্শন করিলে আমি আটটি করিব। এইরূপে শ্রমণ গৌতম যতই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন, আমি তাহার দ্বিগুণ দ্বিগুণ করিব।”

১৬. ভগ্গব, অনন্তর সুনক্ষত্ত আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিয়া আমাকে এইরূপ বলিল, “ভন্তে, অচেল পাথিক-পুত্ত বজ্জীগ্রাম বৈশালিতে বিপুল লাভ ও যশসমন্বিত হইয়া বাস করিতেছেন। তিনি বৈশালিতে সভামধ্যে এইরূপ বলিতেছেন, শ্রমণ গৌতমও জ্ঞানবাদী, আমিও জ্ঞানবাদী, জ্ঞানবাদীর উচিত জ্ঞানবাদীর সহিত ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করা। শ্রমণ গৌতম অর্ধপথ আগমন করুন, আমিও অর্ধপথ গমন করিব। আমরা উভয়েই ওইস্থানে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব। শ্রমণ গৌতম একটি অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলে আমি দুইটি করিব। তিনি দুইটি প্রদর্শন করিলে আমি চারিটি করিব। তিনি চারিটি প্রদর্শন করিলে আমি আটটি করিব। এইরূপে শ্রমণ গৌতম যতই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন, আমি তাহার দ্বিগুণ দ্বিগুণ করিব।”

ভগ্গব, এইরূপ কথিত হইলে আমি সুনক্ষত্তকে বলিলাম, “সুনক্ষত্ত, অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।”

১৭. “ভন্তে, ভগবান এইরূপ বলিবেন না, সুগত এইরূপ বলিবেন না।”

“সুনক্ষত্ত, তুমি কেন এইরূপ বলিতেছ?”

“ভন্তে, ভগবান দৃঢ়রূপে ব্যক্ত করিয়াছেন-অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।” ভন্তে, অচেল পাথিক-পুত্ত বিরূপবেশে ভগবানের সম্মুখীন হইলে ভগবানের বাক্য মিথ্যা হইবে।”

১৮. “সুনক্ষত্ত, তথাগত এইরূপ বাক্য বলিতে পারেন যাহা মিথ্যা হইবে?”

“ভন্তে, ভগবান কি স্বচিত্তে অচেল পাথিক-পুত্তের চিত্ত পরিজ্ঞাত হইয়াছেন-অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।” অথবা দেবতাগণ আপনাকে ইহা বলিয়াছেন?”

১৯. “সুনক্ষত্ত, আমি স্বচিত্তেও পাথিক-পুত্তের চিত্ত বিদিত হইয়া উহা বলিয়াছি এবং দেবতাগণও আমাকে ওইরূপ বলিয়াছেন। লিচ্ছবিদিগের সেনাপতি অজিতও সম্প্রতি দেহত্যাগ করিয়া ত্রয়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইয়াছেন। তিনিও আমার নিকট আগমনপূর্বক বলিয়াছেন, “ভন্তে, অচেল পাথিক-পুত্ত নির্লজ্জ, মিথ্যাবাদী, সে আমার সম্বন্ধেও বজ্জীগ্রামে ঘোষণা করিয়াছে, লিচ্ছবিদিগের সেনাপতি অজিত মহানিরয়ে উৎপন্ন হইয়াছেন। ভন্তে, আমি কিন্তু মহা-নিরয়ে উৎপন্ন হই নাই, ত্রায়স্ত্রিংশ দেবলোকে উৎপন্ন হইয়াছি, অচেল পাথিক-পুত্ত নির্লজ্জ ও মিথ্যাবাদী, সে যে ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া ভগবানের সম্মুখীন হইবে তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে, আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।” এইরূপে, সুনক্ষত্ত, আমি স্বচিত্তেও পাথিক-পুত্তের চিত্ত বিদিত হইয়া উহা বলিয়াছি এবং দেবতাগণও আমাকে এইরূপ বলিয়াছেন।

“সুনক্ষত্ত, আমি বৈশালিতে ভিক্ষার্থে ভ্রমণ করিয়া আহারান্তে প্রত্যাবর্তনকালে দিবাবিহারের নিমিত্ত পাথিক-পুত্তের আরামে গমন করিব। তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাকে কহিও।”

২০. ভগ্গব, তদনন্তর আমি পূর্বাহ্নের বেশধারণ পূর্বক পাত্র ও চীবর হস্তে বৈশালিতে ভিক্ষার্থে প্রবেশ করিলাম। ভিক্ষাচারাবসানে আহারান্তে প্রত্যাবর্তনকালে দিবাবিহারের নিমিত্ত অচেল পাথিক-পুত্তের আরামে গমন করিলাম। ভগ্গব, তখন লিচ্ছবি-পুত্র সুনক্ষত্ত ত্বরিতে বৈশালি প্রবেশপূর্বক খ্যাতনামা লিচ্ছবিগণের নিকট গমন করিয়া তাঁহাদিগকে বলিল, “ভগবান বৈশালিতে পিণ্ডার্থ ভ্রমণ করিয়া আহারান্তে প্রত্যাবর্তনকালে অচেল পাথিক-পুত্তের আরামে দিবাবিহারার্থ গমন করিয়াছেন। আপনারা অগ্রসর হউন, সাধু শ্রমণগণের অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইবে।”

ভগ্গব, তখন ওই সকল লিচ্ছবিগণ চিন্তা করিলেন, “সাধু শ্রমণগণের অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইবে, আমরা যাই।”

সুনক্ষত্ত প্রথিতনামা ব্রাহ্মণ মহাশাল, গৃহপতিগণ এবং নানা তীর্থিয় শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণের নিকট গমনপূর্বক পূর্বোক্তরূপ ঘোষণা করিল।

ভগ্গব, তখন ওই সকল খ্যাতনামা নানাতীর্থিয় শ্রমণ ও ব্রাহ্মণগণ অলৌকিক ঋদ্ধিবলের প্রদর্শনীতে গমন করিতে মনস্থ করিলেন।

ভগ্গব, এইরূপে খ্যাতনামা লিচ্ছবিগণ, ব্রাহ্মণ মহাশাল ও গৃহপতিগণ এবং নানাতীর্থিয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ অচেল পাথিক-পুত্তের আরামে গমন করিলেন। সেই পরিষদে শতাধিক সহস্রাধিকের সমাগম হইয়াছিল।

২১. ভগ্গব, অচেল পাথিক-পুত্ত শ্রবণ করিল যে প্রথিত নামা লিচ্ছবিগণ, ব্রাহ্মণ-মহাশাল ও গৃহপতিগণ ও নানাতীর্থিয় শ্রমণ ব্রাহ্মণগণ সমাগত হইয়াছেন, শ্রমণ গৌতমও তাহার আরামে দিবাবিহারার্থ উপবিষ্ট। ইহা শ্রবণ করিয়া সে ভীত, নিস্পন্দ ও রোমাঞ্চিত হইল এবং এইরূপ অবস্থায় সে তিণ্ডুক্খানু নামক পরিব্রাজকারামে গমন করিল।

ভগ্গব, সেই পরিষদ শ্রবণ করিল যে অচেল পাথিক-পুত্ত ভীত, উদ্বিগ্ন, রোমাঞ্চিত হইয়া তিণ্ডুক্খানু পরিব্রাজকারামে গমননিরত। তখন পরিষদ জনৈক পুরুষকে বলিল, হে পুরুষ, তিণ্ডুক্খানু পরিব্রাজকারামে অচেল পাথিক-পুত্তের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে কহ, সৌম্য পাথিক-পুত্ত, অগ্রসর হউন, খ্যাতনামা লিচ্ছবিগণ, ব্রাহ্মণ-মহাশাল ও গৃহপতিগণ, নানাতীর্থিয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ সমাগত, শ্রমণ গৌতমও দিবাবিহারার্থ আয়ুষ্মানের আরামে উপবিষ্ট। সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনি বৈশালিতে সভামধ্যে এইরূপ ঘোষণা করিয়াছেন, “শ্রমণ গৌতমও জ্ঞানবাদী, আমিও জ্ঞানবাদী। জ্ঞানবাদীর উচিত জ্ঞানবাদীর সহিত ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করা। শ্রমণ গৌতম অর্ধপথ আগমন করুন, আমিও অর্ধপথ গমন করিব। আমরা উভয়েই ওইস্থানে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব। শ্রমণ গৌতম একটি অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলে আমি দুইটি করিব। তিনি দুইটি প্রদর্শন করিলে আমি চারিটি করিব। তিনি চারিটি প্রদর্শন করিলে আমি আটটি করিব। এইরূপে শ্রমণ গৌতম যতই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন, আমি তাঁহার দ্বিগুণ দ্বিগুণ করিব।” সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনি অর্ধপথ আগমন করুন, সর্বপ্রথমেই শ্রমণ গৌতম আপনার আরামে আসিয়া দিবাবিহারার্থ উপবিষ্ট আছেন।”

২২. ভগ্গব, “তথাস্তু” বলিয়া সেই পুরুষ সম্মত হইয়া তিণ্ডুক্খানু পরিব্রাজকারামে অচেল পাথিক-পুত্তের নিকট গমনপূর্বক তাহাকে বলিল, “সৌম্য পাথিক-পুত্ত, অগ্রসর হউন, খ্যাতনামা লিচ্ছবিগণ, ব্রাহ্মণ-মহাশাল ও গৃহপতিগণ, নানাতীর্থিয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ সমাগত, শ্রমণ গৌতমও দিবাবিহারার্থ আয়ুষ্মানের আরামে উপবিষ্ট আছেন।

ভগ্গব, এইরূপ কথিত হইলে অচেল পাথিক-পুত্ত “আমি আসিতেছি, আমি আসিতেছি” এইরূপ বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিল, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইল না। তখন সেই পুরুষ পাথিক-পুত্তকে বলিল, “সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনার কী হইয়াছে? আপনার দেহ-লোম কি আসনে লগ্ন হইয়াছে, অথবা আসন দেহলোমে লগ্ন হইয়াছে? “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া ওই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছেন, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছেন না।”

ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলে পাথিক-পুত্ত “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিল, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইল না।

২৩. ভগ্গব, যখন সেই পুরুষ বুঝিল যে পাথিক-পুত্ত পরাজিত হইয়াছে, “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া ওই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছে, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছে না, তখন সে পরিষদে প্রত্যাবর্তনপূর্বক বলিল, “অচেল পাথিক-পুত্ত পরাজিত, “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছে, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছে না।”

ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলে আমি সেই পরিষদকে বলিলাম, “অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।”

প্রথম ভাণবার সমাপ্ত।

২৪. অতঃপর, ভগ্গব, এক লিচ্ছবি মহামাত্র আসন হইতে উত্থান করিয়া পরিষদকে বলিলেন, “আপনারা ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি যাইতেছি, ইহা সম্ভব যে আমি অচেল পাথিক-পুত্তকে এই পরিষদে আনিতে সমর্থ হইব।”

তখন ভগ্গব, সেই লিচ্ছবি মহামাত্র তিণ্ডুক্খানু পরিব্রাজকারামে অচেল পাথিক-পুত্তের নিকট গমনপূর্বক তাঁহাকে বলিলেন, “সৌম্য পাথিক-পুত্ত, অগ্রসর হউন, উহাই আপনার শ্রেয়, খ্যাতনামা লিচ্ছবিগণ, ব্রাহ্মণ-মহাশাল ও গৃহপতিগণ এবং নানাতীর্থিয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ সমাগত, শ্রমণ গৌতমও দিবাবিহারার্থ আপনার আরামে উপবিষ্ট। বৈশালির পরিষদে আপনি ঘোষণা করিয়াছেন, “শ্রমণ গৌতমও জ্ঞানবাদী, আমিও জ্ঞানবাদী। জ্ঞানবাদীর উচিত জ্ঞানবাদীর সহিত ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করা। শ্রমণ গৌতম অর্ধপথ আগমন করুন, আমিও অর্ধপথ গমন করিব। আমরা উভয়েই ওইস্থানে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব। শ্রমণ গৌতম একটি অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলে আমি দুইটি করিব। তিনি দুইটি প্রদর্শন করিলে আমি চারিটি করিব। তিনি চারিটি প্রদর্শন করিলে আমি আটটি করিব। এইরূপে শ্রমণ গৌতম যতই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন, আমি তাহার দ্বিগুণ দ্বিগুণ করিব।” সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনি অর্ধপথ আগমন করুন, সর্বপ্রথমেই শ্রমণ গৌতম আপনার আরামে আসিয়া দিবাবিহারার্থ উপবিষ্ট আছেন। তিনি পরিষদে ঘোষণা করিয়াছেন, “অচেল পাথিক-পুত্ত যে এইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।” সেইজন্য পাথিক-পুত্ত, অগ্রসর হউন, এইরূপ করিলে আপনার জয় এবং শ্রমণ গৌতমের পরাজয়ের বিধান করিব।”

ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলে অচেল পাথিক-পুত্ত “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেইস্থানেই গতিহীন হইয়া রহিল, আসন হইতেও উত্থান করিতে সমর্থ হইল না। তখন সেই লিচ্ছবি মহামাত্র অচেল পাথিক-পুত্তকে বলিলেন, সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনার কী হইয়াছে? আপনার দেহলোম কী আসনে বদ্ধ হইয়াছে, অথবা আসন দেহলোমে লগ্ন হইয়াছে? “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া ওইস্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছেন, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছেন না।”

ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলেও পাথিক-পুত্ত “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিল, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইল না।”

২৫. ভগ্গব, যখন সেই লিচ্ছবি মহামাত্র বুঝিতে পারিলেন যে অচেল পাথিক-পুত্ত পরাজিত, “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া একই স্থানে গতিহীন হইয়া রহিয়াছে, আসন হইতেও উঠিতে পারিতেছে না; তখন তিনি আসিয়া পরিষদে ঘোষণা করিলেন, “অচেল পাথিক-পুত্ত পরাজিত, “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছে, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছে না।”

এইরূপ কথিত হইলে, ভগ্গব, আমি সেই পরিষদকে বলিলাম, “অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে। আয়ুষ্মান লিচ্ছবিগণ যদি মনে করেন, “আমরা অচেল পাথিক-পুত্তকে বরত্র দ্বারা বন্ধন করিয়া গো-যুগের সাহায্যে টানিয়া আনিব,” তাহা হইলে বরত্র অথবা পাথিক-পুত্ত ছিন্ন হইবে। অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।”

২৬. ভগ্গব, তখন দারুপত্তিকের শিষ্য জালিয় আসন হইতে উঠিয়া পরিষদকে বলিল, “আপনারা ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি যাইতেছি, ইহা সম্ভব যে আমি অচেল পাথিক-পুত্তকে এই পরিষদে আনিতে সমর্থ হইব।”

তখন জালিয় তিণ্ডুক্খানু পরিব্রাজকারামে অচেল পাথিক-পুত্তের নিকট গমনপূর্বক তাহাকে বলিল, “সৌম্য পাথিক-পুত্ত অগ্রসর হউন, উহাই আপনার শ্রেয়ঃ, খ্যাতনামা লিচ্ছবিগণ, ব্রাহ্মণ-মহাশাল ও গৃহপতিগণ এবং নানাতীর্থিয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ সমাগত, শ্রমণ গৌতমও দিবাবিহারার্থ আপনার আরামে উপবিষ্ট। বৈশালির পরিষদে আপনি ঘোষণা করিয়াছেন, “শ্রমণ গৌতমও জ্ঞানবাদী, আমিও জ্ঞানবাদী। জ্ঞানবাদীর উচিত জ্ঞানবাদীর সহিত ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করা। শ্রমণ গৌতম অর্ধপথ আগমন করুন, আমিও অর্ধপথ গমন করিব। আমরা উভয়েই ওইস্থানে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিব। শ্রমণ গৌতম একটি অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলে আমি দুইটি করিব। তিনি দুইটি প্রদর্শন করিলে আমি চারিটি করিব। তিনি চারিটি প্রদর্শন করিলে আমি আটটি করিব। এইরূপে শ্রমণ গৌতম যতই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিবেন, আমি তাহার দ্বিগুণ দ্বিগুণ করিব।” সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনি অর্ধপথ আগমন করুন, সর্বপ্রথমেই শ্রমণ গৌতম আপনার আরামে আসিয়া দিবাবিহারার্থ উপবিষ্ট আছেন। শ্রমণ গৌতম পরিষদে ঘোষণা করিয়াছেন, “অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।” আয়ুষ্মান লিচ্ছবিগণ যদি মনে করেন “আমরা অচেল পাথিক-পুত্তকে বরত্র দ্বারা বন্ধন করিয়া গো-যুগের সাহায্যে টানিয়া আনিব,” তাহা হইলে বরত্র অথবা পাথিক-পুত্ত ছিন্ন হইবে। অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।” পাথিক-পুত্ত, আপনি অগ্রসর হউন, এইরূপ করিলে আপনার জয় এবং শ্রমণ গৌতমের পরাজয়ের বিধান করিব।”

এইরূপ উক্ত হইলে অচেল পাথিক-পুত্ত “আমি আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিল, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইল না। তখন দারুপত্তিকের শিষ্য জালিয় অচেল পাথিক-পুত্তকে বলিল, “সৌম্য পাথিক-পুত্ত, আপনার কী হইয়াছে? আপনার দেহলোম কী আসনে আবদ্ধ হইয়াছে, অথবা আসন দেহলোমে লগ্ন হইয়াছে? “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া ওই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছেন, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছেন না।”

ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলেও অচেল পাথিক-পুত্ত “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিল, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইল না।

২৭. ভগ্গব, যখন দারুপত্তিকের শিষ্য জালিয় বুঝিলেন অচেল পাথিক-পুত্ত পরাজিত, “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া একই স্থানে গতিহীন অবস্থায় রহিয়াছেন, আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছেন না, তখন তিনি পাথিক-পুত্তকে বলিলেন, “সৌম্য পাথিক-পুত্ত, পূর্বকালে এক সময় মৃগরাজ সিংহের মনে হইয়াছিল, “আমি কোনো বনসণ্ডে বাসস্থান করিব, সায়াহ্ন সময়ে বাসস্থান হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বিজৃম্ভণপূর্বক চতুর্দিক অবলোকনান্তে বারত্রয় সিংহনাদ করিয়া গোচরার্থে অগ্রসর হইব; উত্তম উত্তম মৃগবধ করিয়া মৃদু মাংস ভক্ষণপূর্বক বাসস্থানে প্রবেশ করিব।”

“তদনন্তর সেই মৃগরাজ অন্যতর বনসণ্ডে বাসস্থান করিয়া সায়াহ্ন সময়ে তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বিজৃম্ভণপূর্বক চতুর্দিক অবলোকনান্তে বারত্রয় সিংহনাদ করিয়া গোচরার্থে অগ্রসর হইল। সে উত্তম উত্তম মৃগ বধ করিয়া মৃদু মাংস ভক্ষণপূর্বক বাসস্থানে প্রবেশ করিল।

২৮. “সৌম্য পাথিক-পুত্ত, সেই মৃগরাজ সিংহের ভুক্তাবশিষ্টে বর্ধিত এক বৃদ্ধ শৃগাল গর্বিত ও বলশালী হইয়াছিল। সেই শৃগাল চিন্তা করিল, “আমিই বা কে, মৃগরাজ সিংহই বা কে? আমিও কোনো বনসণ্ডে বাসস্থান করিয়া সায়াহ্ন সময়ে তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বিজৃম্ভণপূর্বক চতুর্দিক অবলোকনান্তে বারত্রয় সিংহনাদ করিয়া গোচরার্থে অগ্রসর হইব; উত্তম উত্তম মৃগ বধ করিয়া মৃদু মাংস ভক্ষণপূর্বক বাসস্থানে প্রবেশ করিব।”

অতঃপর সেই বৃদ্ধ শৃগাল অন্যতর বনসণ্ডে বাসস্থান করিয়া সায়াহ্ন সময়ে তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বিজৃম্ভণপূর্বক চতুর্দিক অবলোকনান্তে “বারত্রয় সিংহনাদ করিব” এইরূপ মনস্থ করিয়া শৃগালের ধ্বনি করিল। কোথায় শৃগালের রব, আর কোথায় সিংহনাদ!

“সৌম্য পাথিক-পুত্ত, সেইরূপই তুমি সুগতের দানে জীবনধারণ করিয়া সুগতের ভুক্তাবশিষ্ট ভোজন করিয়া তথাগত অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধকে আসাদ্য মনে করিয়াছ-কোথায় হীন পাথিক-পুত্ত, আর কোথায়ই বা তথাগত অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধের আসাদন?”

২৯. ভগ্গব, যখন দারুপত্তিকের শিষ্য জালিয় এই উপমা দ্বারাও অচেল পাথিক-পুত্তকে সেই আসন হইতে চ্যুত করিতে পারিল না, তখন সে তাহাকে বলিল :

“আপনাকে সিংহ জ্ঞান করিয়া শৃগাল মনে
করিল “আমি মৃগরাজ,”
কিন্তু সে শৃগালের রব করিল, “কোথায়,
হীন শৃগাল, আর কোথায় সিংহনাদ?”

“সৌম্য পাথিক-পুত্ত, সেইরূপই তুমি সুগতের দানে জীবনধারণ করিয়া সুগতের ভুক্তাবশিষ্ট ভোজন করিয়া তথাগত অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধকে আসাদ্য মনে করিয়াছ-কোথায় নগণ্য পাথিক-পুত্ত, আর কোথায়ই বা তথাগত সম্যকসম্বুদ্ধের আসাদন?”

৩০. ভগ্গব, যখন জালিয় এই উপমা দ্বারাও পাথিক-পুত্তকে সেই আসন হইতে চ্যুত করিতে পারিল না, তখন সে তাহাকে বলিল :

“উচ্ছিষ্ট ভোজনে আপনাকে অন্য জীব মনে করিয়া,
স্বরূপ না দেখিয়া, শৃগাল আপনাকে “ব্যাঘ্র” মনে করিয়াছিল,
তথাপি সে শৃগালের রব করিল, “কোথায়
নগণ্য শৃগাল, কোথায়ই বা সিংহনাদ?”

“সৌম্য পাথিক-পুত্ত, সেইরূপই তুমি সুগতের ভুক্তাবশিষ্ট ভোজন করিয়া তথাগত অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধকে আসাদ্য মনে করিয়াছ-কোথায় নগণ্য পাথিক-পুত্ত, আর কোথায়ই বা তথাগত সম্যকসম্বুদ্ধের আসাদন?”

৩১. ভগ্গব, যখন জালিয় এই উপমা দ্বারাও পাথিক-পুত্তকে সেই আসন হইতে চ্যুত করিতে পারিল না, তখন সে তাহাকে বলিল :

“ভেক, ক্ষেত্র-মূষিক এবং শ্মশানে নিক্ষিপ্ত
মৃতদেহাদি ভক্ষণ করিয়া,
শূন্য অথবা মহাবনে বর্ধিত শৃগাল মনে করিল
“আমি মৃগরাজ,”
তথাপি সে শৃগালেরই রব করিল, “কোথায়
নগণ্য শৃগাল, কোথায় বা সিংহনাদ?”

“সৌম্য পাথিক-পুত্ত, সেইরূপই তুমি সুগতের ভুক্তাবশিষ্ট ভোজন করিয়া তথাগত অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধকে আসাদ্য মনে করিয়াছ-কোথায় নগণ্য পাথিক-পুত্ত, আর কোথায়ই বা তথাগত সম্যকসম্বুদ্ধের আসাদন?”

৩২. ভগ্গব, যখন জালিয় এই উপমা দ্বারাও পাথিক পুত্তকে সেই আসন হইতে চ্যুত করিতে পারিল না, তখন সে আসিয়া পরিষদে ঘোষণা করিল, “অচেল পাথিক-পুত্ত পরাজিত, “আসিতেছি, আসিতেছি” বলিয়া সেই স্থানেই গতিহীন হইয়া রহিয়াছে আসন হইতেও উঠিতে সক্ষম হইতেছে না।”

৩৩. ভগ্গব, এইরূপ উক্ত হইলে আমি পরিষদকে বলিলাম, “অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে। আয়ুষ্মান লিচ্ছবিগণ যদি মনে করেন “আমরা অচেল পাথিক-পুত্তকে বরত্র দ্বারা বন্ধন করিয়া গো-যুগের সাহায্যে টানিয়া আনিব,” তাহা হইলে বরত্র অথবা পাথিক-পুত্ত ছিন্ন হইবে। অচেল পাথিক-পুত্ত যে ওইরূপ বাক্য, ওইরূপ চিত্ত ও ওইরূপ দৃষ্টি পরিহার না করিয়া আমার সম্মুখীন হইবে, তাহা সম্ভব নয়। যদি সে মনে করে আমি ওইরূপ বাক্য, চিত্ত ও দৃষ্টি পরিহার না করিয়া শ্রমণ গৌতমের সম্মুখীন হইব, তাহা হইলে তাহার মস্তক বিদীর্ণ হইবে।”

৩৪. অতঃপর, ভগ্গব, আমি সেই পরিষদকে ধর্মকথা দ্বারা উপদিষ্ট, জ্ঞানদীপ্ত, উত্তেজিত, অনুপ্রাণিত করিলাম, এবং এইরূপে উহাকে মহাবন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া, চতুরশীতি সহস্র প্রাণীকে অতি দুর্গম স্থান হইতে উদ্ধার করিয়া ধ্যানযোগে তোজোময় হইয়া আকাশে সপ্ততাল উচ্চে উঠিয়া; সপ্ততাল পরিমিত অর্চিচ নির্মাণ ও প্রজ্জ্বলিত করিয়া, সুবাস বিকীর্ণ করিয়া মহাবনে কূটাগারশালায় পুনরাবির্ভূত হইলাম।

৩৫. অনন্তর, ভগ্গব, সুনক্ষত্ত আমার নিকট আসিয়া আমাকে অভিবাদনান্তে একপ্রান্তে উপবেশন করিলে আমি তাহাকে বলিলাম, “সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, পাথিক-পুত্ত সম্বন্ধে আমি তোমাকে যাহা বলিয়াছিলাম, সেইরূপই হইয়াছে অথবা তাহার অন্যথা হইয়াছে?”

“ভগবান যাহা বলিয়াছিলেন তাহাই হইয়াছে, তাহার অন্যথা হয় নাই।”

“সুনক্ষত্ত, তুমি কী মনে করো, এইরূপ হইলে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইয়াছে, অথবা না?”

“ভন্তে, এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শিত হইয়াছে, হয় নাই তাহা নহে।”

“মূঢ়, আমি তোমাকে এইরূপ ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করিলেও তুমি বলিয়াছ, “ভগবান আমাকে অলৌকিক ঋদ্ধিবল প্রদর্শন করেন না।” মূঢ়, এইস্থানে তোমার ভ্রম দেখো।”

ভগ্গব, আমি এইরূপ কহিলে সুনক্ষত্ত এই ধর্মবিনয় পরিত্যাগপূর্বক অপায়-নিরয়োন্মুখ হইয়া প্রস্থান করিল।

৩৬. ভগ্গব, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ আমি অবগত আছি, শুধু তাহাই নয়, তাহা অপেক্ষাও অধিক আমার বিদিত, কিন্তু ওই জ্ঞান আমাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া আমি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করি, যে অনুভূতির নিমিত্ত তথাগত দুঃখে নিপতিত হন না।

৩৭. ভগ্গব, কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাহারা তাহাদের শিক্ষানুসারে ঘোষণা করেন যে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ ঈশ্বর অথবা ব্রহ্মার লীলা। আমি তাহাদের নিকট গমন করিয়া কহি, “সত্যই কি আপনারা ঘোষণা করেন যে আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ ঈশ্বর, অথবা ব্রহ্মার লীলা?” এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া তাহারা বলেন, “ইহা সত্য।” আমি তাহাদিগকে কহি, “আপনারা কিরূপে নির্ধারণ করেন যে, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ ঈশ্বর অথবা ব্রহ্মার লীলা?” আমি এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা উত্তর দিতে সমর্থ না হইয়া আমাকে প্রতিপ্রশ্ন করেন। তখন আমি উত্তর করি :

৩৮. “বন্ধুগণ, এমন সময় আসে যখন, আজই হউক কিংবা কালই হউক, দীর্ঘকাল অতীত হইবার পর এই জগৎ লয় প্রাপ্ত হয়। ওইরূপ সময়ে জীবগণ বহুল পরিমাণে আভাস্বর জগতে পুনর্জন্ম লাভ করে। তাহারা তথায় মনোময় হইয়া থাকে, প্রীতি তাহাদের ভক্ষ্যস্বরূপ হয়, তাহারা স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর এবং শুভস্থায়ী হইয়া সুদীর্ঘকাল অবস্থান করে। এমন সময় আসে যখন, আজই হউক কিংবা কালই হউক, দীর্ঘকাল অতীত হইবার পর এই জগতের বিবর্তন হয়। ওই সময় শূন্য ব্রহ্মবিমান প্রাদুর্ভূত হয়। কোনো সত্ত্ব আয়ুক্ষয় কিংবা পুণ্যক্ষয়ের নিমিত্ত আভাস্বর জগৎ হইতে চ্যুত হইয়া শূন্য ব্রহ্মবিমানে পুনরায় উৎপন্ন হয়। সে তথায় মনোময় হইয়া থাকে, প্রীতি তাহার ভক্ষ্য হয়, সে স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর এবং শুভস্থায়ী হইয়া দীর্ঘকাল অবস্থান করে। দীর্ঘকাল তথায় একাকী বাস করিয়া তাহার মনে অসন্তুষ্টি ও ভয়ের উৎপত্তি হয়; “হায়, যদি অপর জীবগণও এইস্থানে আগমন করিত!” ওই সময়েই অন্য জীবগণও আয়ুক্ষয় কিংবা পুণ্যক্ষয়বশত, আভাস্বর লোক হইতে চ্যুত হইয়া তাহার সঙ্গীরূপে ব্রহ্মবিমানে উৎপন্ন হয়। তাহারাও তথায় মনোময় হইয়া থাকে, প্রীতি তাহাদের ভক্ষ্য হয়, তাহারা স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর এবং শুভস্থায়ী হইয়া সুদীর্ঘকাল অবস্থান করে।

৩৯. “বন্ধুগণ, তদনন্তর প্রথমোৎপন্ন সত্ত্ব এইরূপ চিন্তা করিলেন, “আমি ব্রহ্মা, মহাব্রহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, ভূত ও ভক্ষ্যের শক্তিমান পিতা। এই জীবগণ আমা কর্তৃক সৃষ্ট। কী হেতু? পূর্বে আমি এইরূপ চিন্তা করিয়াছিলাম, “অহো; অন্য জীবগণও এইস্থানে আগমন করুক। আমার এই প্রার্থনায় এই সকল সত্ত্ব এখানে আগমন করিয়াছে।” পশ্চাদুৎপন্ন সত্ত্বগণও এইরূপ চিন্তা করে, “ইনি ব্রহ্মা, মহাব্রহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, ভূত ও ভক্ষ্যের শক্তিমান পিতা। আমরা এই ব্রহ্ম কর্তৃক সৃষ্ট। কী হেতু? আমরা ইহাকেই প্রথমোৎপন্ন জীবরূপে দেখিয়াছি, আমরা ইহার পশ্চাতে উৎপন্ন।”

৪০. “বন্ধুগণ, অতঃপর যিনি প্রথমে উৎপন্ন হইয়াছিলেন তিনি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ু, সৌন্দর্য ও পরাক্রমশালী। যাহারা পশ্চাতে উৎপন্ন হইয়াছিলেন, তাহারা অপেক্ষাকৃত অল্পায়ু, অল্প সৌন্দর্য ও পরাক্রমশালী। তৎপরে, বন্ধুগণ, ইহা সম্ভব যে, কোনো এক সত্ত্ব ওইস্থান হইতে চ্যুত হইয়া এই লোকে আগমন করেন। এই লোকে আগমন করিয়া তিনি গৃহবাস পরিত্যাগ করিয়া অনাগারিত্ব অবলম্বন করেন। তৎপরে তিনি উৎসাহ, উদ্যোগ, অনুযোগ, অপ্রমাদ, সম্যক চিন্তার দ্বারা এইরূপ চিত্তসমাধি প্রাপ্ত হন যে, ওইরূপ সমাধির অবস্থায় তিনি উক্ত পূর্বনিবাস স্মরণ করেন, কিন্তু তৎপূর্ববর্তী জন্ম স্মরণ করিতে অক্ষম হন। তিনি এইরূপ বলেন, “সেই মহিমাময় ব্রহ্মা, মহাব্রহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, ভূত ও ভক্ষ্যের শক্তিমান পিতা, যাহা কর্তৃক আমরা সৃষ্ট হইয়াছি, তিনি নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণাম-ধর্ম, তিনি অনন্তকাল ওইরূপে অবস্থান করিবেন। কিন্তু সেই ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট আমরা অনিত্য, অধ্রুব, অল্পায়ুক, পরিবর্তনশীল হইয়া এই লোকে আগমন করিয়াছি।” বন্ধুগণ, ইহাই আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভরূপে কথিত ঈশ্বর অথবা ব্রহ্মার লীলা।

তদুত্তরে তাহারা বলেন, “সৌম্য গৌতম, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমরাও তাহাই শুনিয়াছি।” ভগ্গব, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ আমি অবগত আছি, শুধু তাহাই নয়, তাহা অপেক্ষাও অধিক আমার বিদিত, কিন্তু ওই জ্ঞান আমাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া আমি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করি, যে অনুভূতির নিমিত্ত তথাগত দুঃখে নিপতিত হন না।

৪১. ভগ্গব, কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাহারা তাহাদের শিক্ষানুসারে ঘোষণা করেন যে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ হাস্য-ক্রীড়া-রতি। আমি তাহাদের নিকট গমন করিয়া কহি, “সত্যই কি আপনারা ঘোষণা করেন যে, আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ হাস্য-ক্রীড়া-রতি?” এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহারা বলেন, “ইহা সত্য।” আমি তাহাদিগকে কহি, “আপনারা কিরূপে নির্ধারণ করেন যে, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ হাস্য-ক্রীড়া-রতি?” আমি এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা উত্তর দিতে সমর্থ না হইয়া আমাকে প্রতি-প্রশ্ন করেন। তখন আমি উত্তর করি :

৪২. “বন্ধুগণ, কতকগুলি দেবতা আছেন যাঁহাদের নাম ক্রীড়া প্রদোষিক। তাঁহারা দীর্ঘকাল ধরিয়া হাস্য-ক্রীড়া-রতি-ধর্মসম্পন্ন হইয়া বিহার করেন। ওই কারণে তাঁহাদের স্মৃতি বিমুগ্ধ হয়, এবং ওই মোহের কারণে তাঁহারা সেই জন্ম হইতে চ্যুত হন। বন্ধুগণ, ইহা সম্ভব যে কোনো সত্ত্ব ওই জন্ম হইতে চ্যুত হইয়া এই লোকে আগমন করেন। ইহলোকে আগমন করিয়া তিনি গৃহবাস পরিত্যাগপূর্বক অনাগারীত্ব অবলম্বন করেন। তৎপরে তিনি উৎসাহসম্পন্ন হইয়া উদ্যোগ, অনুযোগ, অপ্রমাদ, সম্যক চিন্তার দ্বারা এইরূপ চিত্ত-সমাধি প্রাপ্ত হন যে, ওইরূপ সমাধির অবস্থায় তিনি পূর্বোক্ত জন্ম অনুস্মরণ করেন কিন্তু তৎপূর্ব জন্ম স্মরণ করিতে অক্ষম হন। তিনি এইরূপ বলেন, “যে-সকল দেবতা ক্রীড়া-প্রদোষিক নহেন, তাঁহারা দীর্ঘকাল হাস্য-ক্রীড়া-রতি-ধর্মসম্পন্ন হইয়া বিহার করেন না। উহার ফলে তাঁহাদের স্মৃতি বিমুগ্ধ হয় না, এবং ওই অমোহের ফলে তাঁহারা সেই জন্ম হইতে চ্যুত হন না; তাঁহারা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণাম-ধর্ম, তাঁহারা অনন্তকাল ওইস্থানেই অবস্থান করিবেন। কিন্তু আমরা ক্রীড়া-প্রদোষিক হইয়া দীর্ঘকাল হাস্য-ক্রীড়া-রতি-ধর্মসম্পন্ন হইয়া বিচরণ করিয়াছিলাম, তাহার ফলে আমাদের স্মৃতি বিমুগ্ধ হইয়াছিল, ওই মোহের ফলে আমরা সেই জন্ম হইতে চ্যুত হইয়া অনিত্য, অধ্রুব, অল্পায়ু, পরিবর্তনশীলরূপে ইহলোকে আগমন করিয়াছি।” বন্ধুগণ, ইহাই আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভরূপে ঘোষিত হাস্য-ক্রীড়া-রতি।”

তদুত্তরে তাঁহারা বলেন, “সৌম্য গৌতম, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমরাও তাহাই শুনিয়াছি।” ভগ্গব, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ আমি অবগত আছি, শুধু তাহাই নয়, তাহা অপেক্ষাও অধিক আমার বিদিত, কিন্তু ওই জ্ঞান আমাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া আমি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করি, যে অনুভূতির নিমিত্ত তথাগত দুঃখে নিপতিত হন না।

৪৩. ভগ্গব, কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা তাঁহাদের শিক্ষানুসারে ঘোষণা করেন যে, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ মনোপ্রদোষ। আমি তাহাদের নিকট গমন করিয়া কহি, “সত্যই কি আপনারা ঘোষণা করেন যে, আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ মনোপ্রদোষ?” এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহারা বলেন, “ইহা সত্য।” আমি তাঁহাদিগকে কহি, “আপনারা কিরূপে নির্ধারণ করেন যে, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ মনোপ্রদোষ?” আমি এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা উত্তর দিতে সমর্থ না হইয়া আমাকে প্রতিপ্রশ্ন করেন। তখন আমি উত্তর করি :

৪৪. “বন্ধুগণ, কতকগুলি দেবতা আছেন, তাঁহাদের নাম মনোপ্রদোষিক। দীর্ঘকাল পরস্পর পরস্পরের প্রতি অসূয়াপরবশ হইয়া তাঁহাদের চিত্ত পরস্পরের প্রতি প্রদুষ্ট হয়। এইরূপ প্রদুষ্টচিত্ত হইয়া তাঁহাদের দেহ ও মন ক্লান্ত হয়। ওই দেবগণ ওই দেহ হইতে চ্যুত হন। বন্ধুগণ, ইহা সম্ভব যেকোনো এক সত্ত্ব ওই জন্ম হইতে চ্যুত হইয়া এই লোকে আগমন করেন। ইহলোকে আগমন করিয়া তিনি গৃহবাস পরিত্যাগপূর্বক অনাগারিত্ব অবলম্বন করেন। তৎপরে তিনি উৎসাহসম্পন্ন হইয়া উদ্যোগ, অনুযোগ, অপ্রমাদ, সম্যক চিন্তার দ্বারা এইরূপ চিত্ত-সমাধি প্রাপ্ত হন যে, ওইরূপ সমাধির অবস্থায় তিনি পূর্বোক্ত জন্ম অনুস্মরণ করেন, কিন্তু তৎপূর্বজন্ম স্মরণ করিতে অক্ষম হন। তিনি এইরূপ বলেন, “যে-সকল দেবতা মনোপ্রদোষিক নহেন, তাঁহারা দীর্ঘকাল পরস্পর পরস্পরের প্রতি অসূয়াপরবশ হন না। ফলে তাহাদের চিত্ত পরস্পরের প্রতি প্রদুষ্ট হয় না, তাঁহাদের দেহ ও মন ক্লান্ত হয় না। তাঁহারা ওই দেহ হইতে চ্যুত হন না। তাঁহারা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণাম-ধর্ম হইয়া অনন্তকাল ওইস্থানে অবস্থান করেন। কিন্তু আমরা মনোপ্রদোষিক হইয়া পরস্পর পরস্পরের প্রতি অসূয়াপরবশ হইয়াছিলাম, আমাদের চিত্ত পরস্পরের প্রতি প্রদুষ্ট হইয়াছিল, আমাদের দেহ ও মন ক্লান্ত হইয়াছিল। আমরা ওইস্থান হইতে চ্যুত হইয়া অনিত্য, অধ্রুব, অল্পায়ু ও মৃত্যুপরায়ণ হইয়া ইহলোকে আগমন করিয়াছি।” বন্ধুগণ, ইহাই আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভরূপে ঘোষিত মনোপ্রদোষ।।”

তদুত্তরে তাঁহারা বলেন, “সৌম্য গৌতম, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমরাও তাহাই শুনিয়াছি।” ভগ্গব, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ আমি অবগত আছি, শুধু তাহাই নয়, তাহা অপেক্ষাও অধিক আমার বিদিত, কিন্তু ওই জ্ঞান আমাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া আমি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করি, যে অনুভূতির নিমিত্ত তথাগত দুঃখে নিপতিত হন না।

৪৫. ভগ্গব, কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা তাঁহাদের শিক্ষানুসারে ঘোষণা করেন যে, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ অধীত্য-সমুৎপন্ন । আমি তাঁহাদের নিকট গমন করিয়া কহি, “সত্যই কি আপনারা ঘোষণা করেন যে আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ-অধীত্য-সমুৎপন্ন? এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহারা বলেন, “ইহা সত্য।” আমি তাঁহাদিগকে কহি, “আপনারা কিরূপে নির্ধারণ করেন যে, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ অধীত্য-সমুৎপন্ন?” আমি এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা উত্তর দিতে সমর্থ না হইয়া আমাকে প্রতিপ্রশ্ন করেন। তখন আমি উত্তর করি :

৪৬. “বন্ধুগণ, অসংজ্ঞ-সত্ত্ব নামক কোনো কোনো দেবতা আছেন, সংজ্ঞা উৎপন্ন হইলেই ওই দেবগণ ওই দেহ হইতে চ্যুত হন। বন্ধুগণ, ইহা সম্ভব যে কোনো সত্ত্ব ওই দেহ হইতে চ্যুত হইয়া এই জগতে আগমন করেন; তৎপরে তিনি গৃহবাস ত্যাগ করিয়া অনাগারীত্ব অবলম্বন করেন। পরে তিনি উৎসাহসম্পন্ন হইয়া উদ্যোগ, অনুযোগ, অপ্রমাদ, সম্যক চিন্তার দ্বারা এইরূপ চিত্ত-সমাধিতে উপনীত হন যে ওইরূপ সমাধির অবস্থায় তিনি সংজ্ঞার উৎপত্তি অনুস্মরণ করেন, কিন্তু তৎপূর্বাবস্থা স্মরণে অক্ষম হন। তিনি বলেন, “আত্মা ও জগৎ অকারণসম্ভূত। কী কারণে? আমি পূর্বে ছিলাম না, কিন্তু পূর্বে না থাকিয়াও এক্ষণে সত্ত্বত্বে পরিণত হইয়াছি।” বন্ধুগণ, ইহাই আপনারা আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের অধীত্য-সমুৎপন্ন প্রারম্ভরূপে ঘোষণা করেন।”

তদুত্তরে তাঁহারা বলেন, “সৌম্য গৌতম, আপনি যাহা বলিতেছেন আমরাও তাহাই শুনিয়াছি।” ভগ্গব, বস্তুসমূহের প্রারম্ভ আমি অবগত আছি, শুধু তাহাই নয়, তাহা অপেক্ষাও অধিক আমার বিদিত, কিন্তু ওই জ্ঞান আমাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া আমি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করি, যে অনুভূতির নিমিত্ত তথাগত দুঃখে নিপতিত হন না।

৪৭. ভগ্গব, আমি এইরূপ মত প্রকাশ করিলে, কোনো কোনো শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ-যাঁহারা অসৎ ও তুচ্ছ-আমার সম্বন্ধে অন্যায়রূপে মিথ্যা অভিযোগ করেন, “শ্রমণ গৌতম ও ভিক্ষুগণ ভ্রান্ত। শ্রমণ গৌতম বলেন, যে সময়ে শুভ বিমোক্ষের প্রাপ্তি হয়, তখন সর্ববস্তু অশুভরূপে প্রতীয়মান হয়।” কিন্তু ভগ্গব, আমি এইরূপ কহি না। আমি এইরূপ কহি, “যে সময়ে শুভ বিমোক্ষের প্রাপ্তি হয়, তখন “শুভ!” এই জ্ঞানই হয়।”

“ভন্তে, যাহারা ভগবান এবং ভিক্ষুগণকে ভ্রান্ত মনে করে, তাহারাই ভ্রান্ত, আমি ভগবানের প্রতি এতই প্রসন্ন হইয়াছি যে আমার বিশ্বাস ভগবান আমাকে এইরূপ ধর্মোপদেশ দিতে পারেন যাহা দ্বারা আমি শুভ বিমোক্ষে উপনীত হইয়া বিহার করিতে পারি।”

৪৮. ভগ্গব, তুমি ভিন্নদৃষ্টিসম্পন্ন, ভিন্ন মতাবলম্বী, ভিন্ন রুচিসম্পন্ন, ভিন্ন আযোগানুসারী, ভিন্ন আচার্যের শিক্ষা গ্রহণকারী; এইজন্য শুভ বিমোক্ষে উপনীত হইয়া বিহার করা তোমার পক্ষে সুকঠিন। তবে, ভগ্গব, আমার প্রতি তোমার যে প্রসাদ উহাই তুমি উত্তমরূপে রক্ষা করো।”

“ভন্তে, আমি ভিন্নদৃষ্টিসম্পন্ন, ভিন্ন মতাবলম্বী, ভিন্নরুচিসম্পন্ন, ভিন্ন-আযোগানুসারী, ভিন্ন আচার্যের শিক্ষাগ্রহণকারী, এইজন্য যদি শুভ বিমোক্ষে উপনীত হইয়া বিহার করা আমার পক্ষে দুষ্কর হয়, তাহা হইলে ভগবানের প্রতি আমার যে প্রসাদ, উহাই আমি উত্তমরূপে রক্ষা করিব।”

ভগবান এইরূপ বলিলেন। ভগ্গব-গোত্ত পরিব্রাজক হৃষ্টচিত্তে ভগবানের বাক্যের অভিনন্দন করিলেন।

পাথিক সূত্রান্ত সমাপ্ত।

The Long Discourses

|_III. The Chapter with Pāṭikaputta

DN24. পাথিক সূত্রান্ত

Translations [19]

English

繁體字

日本語

Deutsch

Italiano

Português

Norsk

Srpski

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference

Translations [19]

English

繁體字

日本語

Deutsch

Italiano

Português

Norsk

Srpski

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference

Commentaries [0]