২৪২. আমি এইরূপ শ্রবণ করিয়াছি। এক সময়ে ভগবান রাজগৃহে বেনুবনে কলন্দক নিবাপে অবস্থান করিতেছিলেন। ওই সময় সিংগালক নামক গৃহপতি-পুত্র প্রত্যুষে উত্থান করিয়া রাজগৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া আর্দ্রবস্ত্রে, আর্দ্রকেশে অঞ্জলিবদ্ধ হইয়া পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর, নিম্ন, ঊর্ধ্ব, সর্বদিককে নমস্কার করিতেছিল।

২৪৩. তখন ভগবান পূর্বাহ্নের পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া পাত্র ও চীবর হস্তে রাজগৃহে পিণ্ডার্থ প্রবেশ করিলেন। ওই সময় পূজানিরত সিংগালককে দেখিয়া বলিলেন, “গৃহপতি-পুত্র, তুমি কি নিমিত্ত প্রত্যুষে উঠিয়া রাজগৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া আর্দ্রবস্ত্র ও আর্দ্রকেশে অঞ্জলিবদ্ধ হইয়া পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর, নিম্ন, ঊর্ধ্ব, সর্বদিককে নমস্কার করিতেছ?”

“ভন্তে, পিতা মৃত্যুকালে আমাকে বলিয়াছিলেন, “পুত্র, দিকসমূহকে নমস্কার করিতে হইবে।” সেই নিমিত্ত আমি পিতৃবাক্যের সৎকার, গুরুত্ব স্বীকার, সম্মান ও পূজাস্বরূপ প্রত্যুষে উঠিয়া রাজগৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া আর্দ্রবস্ত্র ও আর্দ্রকেশে অঞ্জলিবদ্ধ হইয়া পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর, নিম্ন, ঊর্ধ্ব, সর্বদিককে নমস্কার করিতেছি।”

২৪৪. “গৃহপতি-পুত্র, এইরূপে ছয়দিককে নমস্কার করিতে হয় না।”

“ভন্তে, তবে কিরূপে করিতে হয়? আর্য বিনয়ানুসারে যেরূপে ছয়দিককে নমস্কার করিতে হয় তাহা ভগবান অনুগ্রহপূর্বক আমায় শিক্ষা দিন।”

“তাহা হইলে শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনঃসংযোগ করো, আমি বলিতেছি।”

“উত্তম, ভন্তে,” বলিয়া গৃহপতি-পুত্র সিংগালক ভগবানের নিকট সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। ভগবান এইরূপ বলিলেন :

২৪৫. “গৃহপতি-পুত্র, যখন আর্যশ্রাবকের চতুর্বিধ কর্মক্লেশ নষ্ট হয়, তিনি চতুর্বিধ স্থানে পাপকর্মে বিরত হন, ভোগহানিকর ষড়বিধ কারণে অনুযুক্ত হন না, তখন তিনি উক্ত চতুর্দশবিধ পাপ হইতে মুক্ত হইয়া ছয়দিক আচ্ছাদিত করেন, উভয় লোক জয় করিবার মার্গে প্রতিষ্ঠিত হন, ইহলোক ও পরলোক উভয় লোকেরই প্রীতিকর হন। তিনি মরণান্তে দেহের বিনাশে স্বর্গে উৎপন্ন হন।

“তাঁহার কোন কোন চারি কর্মক্লেশ নষ্ট হইয়া যায়? গৃহপতি-পুত্র, প্রাণাতিপাত, অদত্তের গ্রহণ, ব্যভিচার, মৃষাবাদ-তাঁহার এই চারি কর্মক্লেশ বিনষ্ট হয়।” ভগবান এইরূপ বলিলেন।

এইরূপ বলিয়া সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“প্রাণাতিপাত, অদত্তের গ্রহণ, মৃষাবাদ এবং
ব্যভিচার, এই সকল পণ্ডিতগণ কর্তৃক
প্রশংসিত হয় না।”

২৪৬. “কোন কোন চারিস্থানে পাপকর্ম করেন না? ছন্দের বশবর্তী হইয়া, দ্বেষ-মোহ-ভয়ের বশবর্তী হইয়া মানুষ পাপকর্ম করে। যেহেতু, গৃহপতি পুত্র, আর্যশ্রাবক ছন্দের বশবর্তী হন না, দ্বেষ-মোহ-ভয়ের বশবর্তী হন না, সেইহেতু এই চারি স্থানে তিনি পাপকর্ম করেন না।” ভগবান এইরূপ বলিলেন।

এইরূপ বলিয়া সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“ছন্দ, দ্বেষ, ভয় ও মোহের বশবর্তী হইয়া যে
ধর্মকে লঙ্ঘন করে, কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রের ন্যায় তাহার
যশ ক্ষীণ হইয়া যায়। ওই সকলের বশবর্তী হইয়া
যে ধর্মকে লঙ্ঘন করে না, শুক্লপক্ষের চন্দ্রের
ন্যায় তাহার যশ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।”

২৪৭. “কোন কোন ষড়বিধ ভোগহানিকর কর্মে লিপ্ত হন না? গৃহপতি পুত্র, সুরা, মেরয়াদি মদ্যপান ভোগহানিকর। অসময়ে পথে পথে ভ্রমণানুরক্তি ভোগহানিকর। নৃত্য-গীতাদির অভিনয় দর্শনে আসক্তি ভোগহানিকর। দ্যূতাসক্তি ভোগহানিকর। পাপমিত্রের সংসর্গে অনুযুক্ত হওয়া ভোগহানিকর। আলস্যপরায়ণতা ভোগহানিকর।

২৪৮. “গৃহপতি পুত্র, সুরা মেরয়াদি মদ্যে আসক্তি হইতে ছয় প্রকার অনিষ্টের উৎপত্তি হয়, প্রত্যক্ষ ধননাশ, কলহ বৃদ্ধি, বিবিধ রোগের উৎপত্তি, অযশের প্রচার, উলঙ্গ অবস্থা, বুদ্ধিনাশ।

২৪৯. “গৃহপতি-পুত্র, অসময়ে পথে পথে ভ্রমণের আনুরক্তি হইতে ছয় প্রকার অনিষ্টকর ফল উৎপন্ন হয়, আপনার অসংবৃত এবং অরক্ষিত অবস্থা, স্ত্রী-পুত্রগণেরও অসংবৃত ও অরক্ষিত অবস্থা; ধন সম্পত্তির অসংবৃত এবং অরক্ষিত অবস্থা; অবাঞ্ছনীয় স্থানে আপনাকে সন্দেহের পাত্রে পরিণত করণ; মিথ্যা অপবাদের বিষয়ীভূত হওয়া; বহুবিধ দুঃখের আসব হওয়া।

২৫০. “নৃত্য-গীতাদির অভিনয় দর্শনে আসক্তি হইতে ছয় প্রকার অনিষ্টের উৎপত্তি হয়, “কোথায় নৃত্য, কোথায় গীত, কোথায় বাদ্য, কোথায় আখ্যান, কোথায় পাণিস্বর, কোথায় দামামা বাদ্য?”

২৫১. “দ্যূতাসক্তির ছয় প্রকার অনিষ্টকর ফল, জয়লাভে শত্রুতার উৎপত্তি, পরাজিত হইলে অনুতাপ, সাক্ষাতে ধননাশ, দ্যূতাসক্তের বাক্য সভাস্থলে গৃহীত হয় না, মিত্র ও রাজকর্মচারীগণ কর্তৃক সে অবজ্ঞাত হয়, আবাহ-বিবাহে সে কাহারও প্রার্থিত নয়, কারণ জনসাধারণ মনে করে দ্যূতাসক্ত স্ত্রীর ভরণ পোষণে অক্ষম।

২৫২. “পাপ-মিত্রের সংসর্গের ছয় প্রকার অনিষ্টকর ফল, যাহারা ধূর্ত, সুরাসক্ত, অভাবগ্রস্ত, বঞ্চক, শঠ, দুর্বৃত্ত, তাহারাই মিত্র হয়। গৃহপতি-পুত্র, পাপমিত্র সংসর্গের এই ছয় প্রকার অনিষ্টকর ফল।

২৫৩. “আলস্যপরায়ণতার ছয় প্রকার অনিষ্টকর ফল, “অত্যন্ত শীত” এই ছলে কাজকর্ম করে না, “অত্যন্ত উষ্ণ” এই ছলে কাজকর্ম করে না, “এখন অতি বিলম্ব হইয়া গিয়াছে” এই ছলে কাজকর্ম করে না, “এখন অতিশয় সকাল” এই ছলে কাজকর্ম করে না, “অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়াছি” এই ছলে কাজকর্ম করে না, “অত্যন্ত অধিক আহার হইয়া গিয়াছে” এই ছলে কাজকর্ম করে না, এই সকল ছলে কাজকর্ম করে না। এইরূপ সর্ববিষয়ে কর্তব্য পরাঙ্মুখতার ফলে অনুৎপন্ন ভোগের উৎপত্তি হয় না, উৎপন্ন ভোগ ক্ষীণ হইয়া যায়। গৃহপতি-পুত্র, আলস্যপরায়ণতার এই ছয় অনিষ্টকর ফল।” শাস্তা এইরূপ বলিলেন।

অতঃপর সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“কেহ পানকালে সখা হয়, কেহ “মিত্র, মিত্র”
রূপে সম্বোধন করে, কিন্তু যে প্রয়োজনের সময়ে
মিত্র হয় সেই সখা।
সূর্যোদয়ের পরেও নিদ্রাসক্তি, পরদার গমন,
বৈর-প্রসঙ্গ, অনিষ্ট-রতি, পাপ-মিত্র এবং হীন
স্বার্থপরতা, এই ষড়বিধ কারণে মানুষের ধ্বংস
সাধন হয়।
যে মনুষ্য দুষ্টকে মিত্ররূপে গ্রহণ করে, দুষ্টের সংসর্গ
করে, পাপাচরণে রত হয়, সে ইহলোক ও
পরলোক উভয়লোক হইতেই দুঃখময় অবস্থায়
নিক্ষিপ্ত হয়।
দ্যূত-ক্রীড়া ও নারী, মদ্য ও নৃত্য-গীত, দিবানিদ্রা
অকাল ভ্রমণ, পাপমিত্র ও হীন স্বার্থপরতা-এই
ছয় কারণে পুরুষ বিনষ্ট হয়।
সে অক্ষ-ক্রীড়ায় রত হয়, সুরা পান করে, অপরের
প্রাণসম স্ত্রীতে গত হয়, জ্ঞানীর অনুসরণে বিরত
হইয়া হীনের অনুসরণ করে এবং কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রের
ন্যায় ক্ষীণ হইয়া যায়।
সুরাপান করিয়া, সুরাসক্ত, নির্ধন ও বিত্তহীন
হইয়া, পাপাচরণ করিয়া সে অবিলম্বে ঋণরূপ
অকুল সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়।
দিবাভাগে নিদ্রাশীল ও রাত্রিকালে জাগরণশীল
হইয়া, মত্ত ও সুরাসক্ত গৃহবাসের উপযুক্ত
হয় না।
“অতি শীত, অতি উষ্ণ, আর সময় নাই”
এইরূপ করিয়া কর্তব্যচ্যুত হইয়া মানুষ ইষ্টলাভে
বঞ্চিত হয়। কিন্তু যে শীতোষ্ণকে তৃণাধিক
জ্ঞান করে না, পুরুষের কর্তব্য পালন করে, সে
সুখলাভে বঞ্চিত হয় না।”

২৫৪. “গৃহপতি-পুত্র, এই চারিজনকে মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রু বলিয়া জানিবে, পরস্বাপহরণকারী, বাক্‌সর্বস্ব, তোষামোদকারী, হানিকর কর্মে সহায়ক।

২৫৫. “চারি লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ পরস্বাপহরণকারীকে জানিতে পারা যায়, সে পরধনহরণকারী, অল্পের পরিবর্তে অত্যধিক লাভ করিতে ইচ্ছা করে, ভয়োৎপাদক কর্মের কারক, সে স্বার্থসেবী। গৃহপতি পুত্র, এই চারি লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ পরস্বাপহরণকারীকে জানিতে পারা যায়।

২৫৬. চারি লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ বাক্‌-সর্বস্বকে জানিতে পারা যায়, সে অতীতের উল্লেখপূর্বক বন্ধুত্বের ছল করে ; ভবিষ্যতের উল্লেখপূর্বক বন্ধুত্বের ছল করে; নিরর্থক বাক্য বলিয়া অনুগ্রহ লাভের প্রয়াসী; সাহায্যের প্রয়োজন উপস্থিত হইলে সে আপনার অসামর্থ্য জ্ঞাপন করে। গৃহপতি-পুত্র, এই চারি লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ বাক্‌-সর্বস্বকে জানিতে পারা যায় :

২৫৭. “চতুর্বিধ লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ তোষামোদকারীকে জানিতে পারা যায়, সে পাপকর্মেরও অনুমোদন করে, কল্যাণকর কর্মের প্রতিকূল আচরণেরও অনুমোদন করে; সে সম্মুখে প্রশংসা করিবে কিন্তু পরোক্ষে নিন্দা করিবে। গৃহপতি-পুত্র, এই চতুর্বিধ লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ তোষামোদকারীকে জানিতে পারা যায়।”

২৫৮. “চতুর্বিধ লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ হানিকর কর্মের সহায়ককে জানিতে পারা যায়, সে মদ্যাদি পানকালে সহায় হয়; সন্ধ্যার অন্ধকারে পথে পথে ভ্রমণের সহায়ক হয়; নাটকাদি প্রদর্শনীতে গমনে সহায় হয়, দ্যূতক্রীড়াদি প্রমোদস্থানে সহায় হয়। গৃহপতি-পুত্র, এই চতুর্বিধ লক্ষণ দ্বারা মিত্রের ছদ্মবেশে শত্রুরূপ সহায়ককে জানিতে পারা যায়।”

২৫৯. ভগবান এইরূপ বলিলেন। এইরূপ বলিয়া সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

যে মিত্র পরস্বাপহরণকারী, যে মিত্র বাক্‌-সর্বস্ব,
যে মিত্র তোষামোদকারী, যে মিত্র হানিকর
কর্মের সহায়ক, পণ্ডিত ব্যক্তি এই চারিজনকে
শত্রু জ্ঞান করিয়া ভয়সঙ্কুল মার্গের ন্যায় দূর
হইতে তাহাদিগকে বর্জন করিবেন।

২৬০. “গৃহপতি-পুত্র, এই চারি প্রকার মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে; যিনি উপকারী তিনি সুহৃদ, যিনি সুখ দুঃখের সমভাগী, যিনি হিত প্রদর্শনকারী, যিনি দয়ার্দ্র; এই সকলকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে।”

২৬১. “চতুর্বিধ ক্ষেত্রে উপকারী মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে; প্রমত্ত হইলে তিনি রক্ষা করেন, প্রমত্তের ধন সম্পত্তি রক্ষা করেন, ভয়ার্তের শরণ হন, কর্তব্যের সম্পাদনে প্রয়োজনীয় অর্থের দ্বিগুণ তিনি দান করেন। গৃহপতি-পুত্র, এই চতুর্বিধ ক্ষেত্রে উপকারী মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে।”

২৬২. “চতুর্বিধ স্থানে সুখ দুঃখের সমভাগী মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে; তিনি আপনার যাহা গোপনীয় তাহা প্রকাশ করেন, মিত্রের যাহা গুপ্ত বিষয় তাহা তিনি উত্তমরূপে গুপ্ত রাখেন, বিপদে পরিত্যাগ করেন না, মিত্রের জন্য তিনি আত্মপ্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করেন। গৃহপতি-পুত্র, এই চতুর্বিধ স্থানে সুখ দুঃখের সমভাগী মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে।”

২৬৩. “চতুর্বিধ স্থানে হিত-প্রদর্শনকারী মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে :

তিনি পাপ হইতে সংযত করেন, কল্যাণে নিয়োজিত হইতে প্রবুব্ধ করেন, যাহা অশ্রুত তাহা ব্যক্ত করেন, স্বর্গের মার্গ প্রদর্শন করেন। গৃহপতি-পুত্র, এই চতুর্বিধ স্থানে হিত-প্রদর্শনকারীকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে।”

২৬৪. “চতুর্বিধ স্থানে দয়ার্দ্র মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে, মিত্রের অমঙ্গলে তিনি আনন্দিত হন না, মিত্রের মঙ্গলে আনন্দ লাভ করেন, কেহ মিত্রের নিন্দা করিলে তিনি নিবারণ করেন, প্রশংসা করিলে তিনি প্রশংসা করেন। গৃহপতি-পুত্র, এই চতুর্বিধ স্থানে দয়ার্দ্র মিত্রকে সুহৃদ বলিয়া জানিবে।”

২৬৫. ভগবান এইরূপ বলিলেন। এইরূপ বলিয়া সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

যে মিত্র উপকারী,
যিনি সুখে ও দুঃখে মিত্র,
যে মিত্র হিত প্রদর্শনকারী,
যে মিত্র দয়ার্দ্র,
পণ্ডিত ব্যক্তি এই চারিজনকে
মিত্র রূপে জ্ঞান করিয়া,
ঔরস পুত্রের সেবারত মাতার
ন্যায় তাঁহাদের সেবা করিবেন।
শীলসম্পন্ন পণ্ডিত নর
জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় দীপ্তিমান হন।
মধু সংগ্রহ-রত ভ্রাম্যমান
ভ্রমরের ন্যায় ধনাহরণরতের
ভোগ সঞ্চিত হইয়া বল্মিক্ল-
স্তূপের ন্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
এইরূপে ভোগাহরণ করিয়া
তিনি স্বকুলের মঙ্গল স্বরূপ হন।
তিনি স্বকীয় বিত্ত চারিভাগে
বিভক্ত করিবেন, এবং এইরূপে
জীবনের সর্ববিধ কাম্য
তাঁহার লাভ হইবে।
এক অংশ স্বয়ং ভোগ করিবেন,
দুই অংশ কর্মে প্রয়োগ করিবেন,
চতুর্থ অংশ দুঃসময়ের নিমিত্ত
সঞ্চয় করিবেন।

২৬৬. গৃহপতি-পুত্র, আর্যশ্রাবক কী প্রকারে ছয় দিক আচ্ছাদনকারী হন? এই ছয় বস্তুকে ছয়দিকরূপে জানিতে হইবে, মাতাপিতাকে পূর্বদিকরূপে জানিতে হইবে; আচার্যগণকে দক্ষিণদিকরূপে জানিতে হইবেঃ স্ত্রী-পুত্রগণকে পশ্চিমদিকরূপে, মিত্রাদিকে উত্তরদিকরূপে, দাস কর্মকারগণকে অধোদিকরূপে এবং শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণকে ঊর্ধ্বদিকরূপে জানিতে হইবে।

২৬৭. “পুত্র পঞ্চ প্রকারে পূর্বদিকরূপ মাতাপিতার সেবা করিবেন, “তাঁহারা ভরণ পোষণ করিয়াছেন, অতএব তাঁহাদের ভরণ পোষণ করিতে হইবে, তাঁহাদের কৃত্য করিতে হইবে; কুলবংশ রক্ষা করিতে হইবে, আমি উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হইয়াছি, আমাকেও উহা প্রতিপাদন করিতে হইবে; যাঁহারা মৃত তাঁহাদের দক্ষিণা (শ্রদ্ধাদি) দান করিতে হইবে।” এইরূপ পাঁচ প্রকারে সেবিত হইয়া মাতাপিতা পাঁচ প্রকারে পুত্রকে অনুকম্পা করেন, পাপ হইতে রক্ষা করেন, কল্যাণে নিয়োজিত করেন, শিল্পশিক্ষা দেন, যোগ্য স্ত্রীর সহিত বিবাহ দেন, যথাসময়ে উত্তরাধিকার দেন। গৃহপতি-পুত্র, এই পাঁচ প্রকারে পূর্ব দিকরূপ মাতাপিতা পুত্র কর্তৃক সেবিত হইয়া পাঁচ প্রকারে পুত্রকে অনুকম্পা করেন। এইরূপে পূর্বদিক রক্ষিত হয়, শান্তিপূর্ণ হয়, ভয়হীন হয়।”

২৬৮. “গৃহপতি পুত্র, শিষ্য পাঁচ প্রকারে দক্ষিণ দিকরূপ আচার্যগণের সেবা করিবেন, তৎপরতা, সেবা, শুশ্রূষা, পরিচর্যা দ্বারা এবং সসম্মানে শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করিয়া। এই পাঁচ প্রকারে সেবিত হইয়া আচার্যগণ পাঁচ প্রকারে শিষ্যকে অনুকম্পা করেন, তাঁহারা শিষ্যকে সুবিনীত করেন, উত্তমরূপে শিক্ষা দেন, সর্ববিদ্যা শিক্ষা দেন, মিত্র সহায়কবর্গের নির্বাচন করিয়া দেন, সর্বদিক রক্ষা করেন। গৃহপতি-পুত্র, এই পাঁচ প্রকারে দক্ষিণ দিকরূপ আচার্যগণ শিষ্য কর্তৃক সেবিত হইয়া পাঁচ প্রকারে শিষ্যকে অনুকম্পা করেন। এইরূপে দক্ষিণদিক সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ এবং ভয়হীন হয়।”

২৬৯. “গৃহপতি-পুত্র, এই পাঁচ প্রকারে স্বামী পশ্চিম দিকরূপ ভার্যার সেবা করিবেন, সম্মানের দ্বারা, অবজ্ঞা বর্জন দ্বারা, অবিচলিত আনুরক্তির দ্বারা, ঐশ্বর্য প্রদানের দ্বারা, অলংকার প্রদানের দ্বারা। এইরূপে সেবিত হইয়া পাঁচ প্রকারে পত্নী স্বামীর প্রতি অনুকম্পা করেন-গৃহকর্ম তৎকর্তৃক সুসম্পাদিত হয়, পরিজনবর্গ উত্তমরূপে প্রতিপালিত হয়, তিনি ব্যভিচারিণী হন না, ধন সম্পত্তি রক্ষা করেন, তিনি দক্ষ এবং সর্বকার্যে আলস্যহীন হন। এই পাঁচ প্রকারে স্বামী কর্তৃক পশ্চিমদিকরূপ ভার্যা সেবিত হইয়া পাঁচ প্রকারে স্বামীকে অনুকম্পা করেন। এইরূপে পশ্চিমদিক সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ এবং ভয়হীন হয়।”

২৭০. “গৃহপতি-পুত্র, পাঁচ প্রকারে কুলপুত্র উত্তর দিকরূপ মিত্র সহায়কবর্গের সেবা করিবেন, দান, প্রিয়বাক্য, অর্থচর্যা, সমামাত্মতা এবং অবিসংবাদিতা দ্বারা। এইরূপে সেবিত হইয়া তাঁহারা পাঁচ প্রকারে কুলপুত্রের প্রতি অনুকম্পা করেন, প্রমত্ত হইলে রক্ষা করেন, তাঁহার ধন সম্পত্তি রক্ষা করেন, ভীত হইলে তাঁহার আশ্রয়স্থল হন, বিপদে পরিত্যাগ করেন না, তাঁহার পরিবারবর্গের অপর সকলেরও সম্মান রক্ষা করেন। এই পাঁচ প্রকারে কুলপুত্র কর্তৃক উত্তর দিকরূপ মিত্র সহায়কবর্গ সেবিত হইয়া পাঁচ প্রকারে তাঁহার প্রতি অনুকম্পা করেন। এইরূপে উত্তরদিক সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ ও ভয়হীন হয়।”

২৭১. “গৃহপতি-পুত্র, সম্ভ্রান্ত কুলপুত্র পাঁচ প্রকারে অধোদিকরূপ দাস কর্মকারগণের সেবা করিবেন, বলানুরূপ কর্মের বিধান করিয়া, আহার ও বেতন প্রদানের দ্বারা, অসুস্থতায় সেবা করিয়া, উৎকৃষ্ট ভোজনের অংশ প্রদান করিয়া, যথাসময়ে কর্ম হইতে অবকাশ প্রদান দ্বারা। এইরূপে সেবিত হইয়া দাস কর্মকারগণ পাঁচ প্রকারে প্রভুর প্রতি অনুকম্পা করে, তাহারা প্রত্যুষে প্রভুর পূর্বে শয্যাত্যাগ করে, সর্বপশ্চাতে শয়ন করে, বদান্য হয়, উত্তমরূপে কর্ম সম্পাদন করে, প্রভুর কীর্তি ও প্রশংসা ঘোষণা করে। এই পাঁচ প্রকারে সম্ভ্রান্ত কুলপুত্র কর্তৃক দাস কর্মকারগণ সেবিত হইয়া পাঁচ প্রকারে তাঁহার সেবা করে। এইরূপে অধোদিক সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ ও ভয়হীন হয়।

২৭২. “পাঁচ প্রকারে কুলপুত্র ঊর্ধ্বদিকরূপ শ্রমণ-ব্রাহ্মণের সেবা করিবেন, মৈত্রীভাবযুক্ত কায়কর্মের দ্বারা, মৈত্রীভাবযুক্ত বাচনিক কর্মের দ্বারা, মৈত্রীভাবযুক্ত মানসিক কর্মের দ্বারা, অবারিত দ্বার হইয়া খাদ্য ভোজ্যাদি প্রদানের দ্বারা। এইরূপে সেবিত হইয়া তাঁহারা ছয় প্রকারে কুলপুত্রের প্রতি অনুকম্পা করেন, পাপ হইতে রক্ষা করেন, কল্যাণে নিয়োজিত করেন, কল্যাণকামী হইয়া অনুকম্পা করেন, অলব্ধ বিদ্যা দান করেন, লব্ধ বিদ্যা পরিমার্জিত করেন, স্বর্গের মার্গ প্রদর্শন করেন। এই পাঁচ প্রকারে সম্ভ্রান্ত কুলপুত্র কর্তৃক ঊর্ধ্বদিকরূপ শ্রমণ ব্রাহ্মণগণ সেবিত হইয়া ছয় প্রকারে কুলপুত্রের অনুকম্পা করেন। এইরূপ ঊর্ধ্বদিক সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ ও ভয়হীন হয়।”

২৭৩. ভগবান এইরূপ বলিলেন। এইরূপ বলিয়া সুগত শাস্তা পুনরায় বলিলেন :

“মাতাপিতা পূর্বদিক, আচার্যগণ দক্ষিণ দিক,
স্ত্রী-পুত্র পশ্চিম দিক, জ্ঞাতি ও মিত্রগণ উত্তরদিক,
দাস কর্মকারগণ অধোদিক, শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ ঊর্ধ্বদিক,
গৃহী কুলের মঙ্গলার্থে এই সকল দিককে নমস্কার
করিবেন। পণ্ডিত, শীলসম্পন্ন, বিনয়ী, এইরূপ
পূজানিরত, নিরহংকারী, নম্র যশ লাভ করেন।
উৎসাহসম্পন্ন, অনলস, বিপদে ধৈর্যসম্পন্ন, নির্দোষ
এবং মেধাবী পুরুষ যশ লাভ করেন। যিনি জনপ্রিয়,
মিত্র-সংগ্রাহক, বদান্য, বীত-মাৎসর্য, নেতা, বিনেতা,
শান্তি-প্রতিষ্ঠাতা, তিনি যশ লাভ করেন। দান,
প্রিয়বাক্য, অর্থচর্যা, সর্বত্র, সর্বভূতে যথার্থ
সমানাত্মতা, এই সকলের কারণেই, কীলক যেইরূপ
রথচক্রের আবর্তন সম্পাদন করে, সেইরূপ জগৎও
চলিতেছে। যদি এই সকল না থাকিত, তাহা
হইলে মাতা পুত্রের নিকট সম্মান ও পূজা পাইতেন
না, পিতাও পুত্রের নিকট তাহা পাইতেন না।
এই সকলের মূল্য পণ্ডিতগণ যথার্থরূপে দর্শন করিয়া
মহত্ত্বপ্রাপ্ত এবং প্রশংসনীয় হন।”

২৭৪. এইরূপ উক্ত হইলে গৃহপতি-পুত্র সিংগালক ভগবানকে এইরূপ বলিলেন, “অতি উত্তম, ভন্তে, অতি উত্তম। যেইরূপ উৎপাতিতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, লুক্কায়িত প্রকাশিত হয়, মূঢ় পথপ্রদর্শিত হয়, চক্ষুষ্মানের দেখিবার নিমিত্ত অন্ধকারে তৈলদীপ ধৃত হয়, সেইরূপ ভগবান অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশিত করিয়াছেন। আমি ভগবানের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। ভগবান আজ হইতে জীবনের অন্তকাল পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে গ্রহণ করুন।”

সিংগালোবাদ সূত্রান্ত সমাপ্ত।

The Long Discourses

|_III. The Chapter with Pāṭikaputta

DN31. সিংগালোবাদ সূত্রান্ত

Translations [29]

English

繁體字

日本語

Deutsch

Italiano

Español

Português

Русский

Nederlands

Norsk

Magyar

Svenska

Srpski

Čeština

Polski

Română

Slovenščina

Lietuvių Kalba

עִבְרִית

हिंदी

ಕನ್ನಡ

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference