আমি এইরূপ শুনিয়াছি।

১. একসময় ভগবান বৈশালী-সমীপে অবস্থান করিতেছিলেন, বহির্নগরে, পশ্চিম দিকে অবস্থিত বনখণ্ডে। সেই সময়ে সুনক্ষত্র নামক লিচ্ছবিপুত্র অল্পদিন হইল এই ধর্মবিনয় (বুদ্ধশাসন) হইতে চলিয়া গিয়াছেন। তিনি বৈশালী-পরিষদে এ কথা বলিতেছিলেন : ‘শ্রমণ গৌতমের নিকট অলৌকিক ঋদ্ধিশক্তি নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন (দিব্যদৃষ্টি, অতীন্দ্রিয় জ্ঞান) তো দূরের কথা। তিনি শুধু তর্ক-প্রণোদিত ও মীমাংসানুচরিত ধর্মই উপদেশ প্রদান করেন, অথচ স্বয়ং বক্তা হইয়া স্বপ্রতিভায় তিনি যাহার হিতার্থ ধর্মোপদেশ প্রদান করেন, সে তদনুযায়ী কার্য করিলে তাহা সম্যকভাবে তাহাকে দুঃখক্ষয়ের অভিমুখে চালিত করে।’

২. অনন্তর আয়ুষ্মান সারিপুত্র পূর্বাহ্ণে বহির্গমন-বাস পরিধান করিয়া, পাত্রচীবর লইয়া, বৈশালী নগরে ভিক্ষান্নসংগ্রহের জন্য প্রবেশ করিলেন। তিনি শুনিতে পাইলেন যে, লিচ্ছবিপুত্র সুনক্ষত্র বৈশালী-পরিষদে এ কথা বলিতেছেন : ‘শ্রমণ গৌতমের নিকট অলৌকিক ঋদ্ধিশক্তি নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা। তিনি শুধু তর্ক-প্রণোদিত ও মীমাংসানুচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন, অথচ স্বয়ং বক্তা হইয়া স্বপ্রতিভায় তিনি যাহার হিতার্থ ধর্মোপদেশ প্রদান করেন, সে তদনুযায়ী কার্য করিলে তাহা সম্যকভাবে তাহাকে দুঃখক্ষয়ের অভিমুখে চালিত করে।’ ভিক্ষান্নসংগ্রহে বিচরণ করিয়া, ভোজনান্তে ভিক্ষান্নসংগ্রহ-কার্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া ভগবৎ-সমীপে উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট হইয়া সারিপুত্র ভগবানকে কহিলেন, ‘প্রভো, লিচ্ছবিপুত্র সুনক্ষত্র অল্পদিন হইল এই ধর্মবিনয় হইতে চলিয়া গিয়াছেন, তিনি বৈশালী-পরিষদে এ কথা বলিতেছেন : শ্রমণ গৌতমের নিকট অলৌকিক ঋদ্ধিবল নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা। তিনি তর্ক-উদ্বুদ্ধ ও মীমাংসানুচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন ইত্যাদি।’

৩. সারিপুত্র, কোপনস্বভাব সুনক্ষত্র মোঘপুরুষ (মূর্খ), ক্রোধবশতই সে এমন কথা বলিয়াছে। অখ্যাতি বিবৃত করিবে উদ্দেশ্যে মত প্রকাশ করিতে গিয়া সে তথাগতের খ্যাতিই বর্ণনা করিয়াছে। সারিপুত্র, যে এমন কথা বলিবে : ‘তিনি যাহার হিতার্থ ধর্মোপদেশ প্রদান করেন, সে তদনুযায়ী কার্য করিলে তাহা সম্যকভাবে তাহাকে দুঃখক্ষয়ের অভিমুখে চালিত করে’, তথাগতের পক্ষে তাহা খ্যাতির বিষয়ই বটে।

৪. সারিপুত্র, আমার প্রতি মোঘপুরুষ সুনক্ষত্রের এইরূপ ধর্মভাব হইবে না : ‘এই সেই ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ, অনুত্তর দম্যপুরুষসারথি, দেবমনুষ্যগণের শাস্তা, বুদ্ধ ভগবান।’

৫. সারিপুত্র, আমার প্রতি তাহার এইরূপ ধর্মভাব হইবে না : ‘সেই ভগবান বহুপ্রকারে বহুবিধ ঋদ্ধি স্বয়ং অনুভব করেন, এক হইয়া বহু হন, বহু হইয়া এক হন, ইচ্ছাক্রমে তাঁহার আবির্ভাব-তিরোভাব ঘটে, ভূমিতে পদস্থাপন না করিয়া তিনি প্রাচীর, প্রাকার ও পর্বত অতিক্রম করেন শূন্যে গমনের ভাবে, স্থলে উন্মজ্জন-নিমজ্জন করেন জলে ডুবা-উঠার ভাবে, জলে নিমগ্ন না হইয়া চলেন স্থলে গমনের ভাবে, আকাশে পর্যঙ্কবন্ধ হইয়া গমন করেন পক্ষী-শকুনের (বিহঙ্গের) ভাবে, মহাশক্তিসম্পন্ন মহাকায় চন্দ্রসূর্যকে স্বহস্তে স্পর্শ ও মর্দন করেন, আব্রহ্মভুবন স্ববশে আনয়ন করেন।’

৬. সারিপুত্র, আমার প্রতি তাহার এই ধর্মভাব হইবে না : ‘সেই ভগবান অতি বিশুদ্ধ, লোকাতীত শ্রোত্রধাতু দ্বারা উভয় শব্দ শুনিতে পান, যাহা দিব্য ও যাহা মানুষ, যাহা দূরে ও যাহা নিকটে।’

সারিপুত্র, তোমার [আমার] প্রতি তাহার এই ধর্মভাব হইবে না : ‘সেই ভগবান স্বচিত্তে অপর জীবগণের চিত্তের অবস্থা প্রকৃষ্টরূপে জানেন, তাহাদের চিত্ত সরাগ হইলে সরাগ বলিয়াই জানেন, বীতরাগ হইলে বীতরাগ, সংক্ষিপ্ত হইলে সংক্ষিপ্ত, বিক্ষিপ্ত হইলে বিক্ষিপ্ত, মহদ্গত হইলে মহদ্গত, অমহদ্গত হইলে অমহদ্গত, স-উত্তর হইলে স-উত্তর, অনুত্তর হইলে অনুত্তর, সমাহিত হইলে সমাহিত, অসমাহিত হইলে অসমাহিত, বিমুক্ত হইলে বিমুক্ত, অবিমুক্ত হইলে অবিমুক্ত বলিয়াই প্রকৃষ্টরূপে জানেন।’

৭. সারিপুত্র, তথাগতের দশ তথাগত-বল যাহাতে সমন্বিত হইয়া তথাগত নির্ভীকতা উপলব্ধি করেন, সর্বপরিষদে সিংহনাদ করেন, ব্রহ্মচক্র প্রবর্তন করেন। দশবল কী কী? (১) তিনি স্থানকে (কারণকে) স্থানের ভাবে, অস্থানকে (অকারণকে) অস্থানের ভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (২) তিনি অতীত, অনাগত ও প্রত্যুৎপন্নে (বর্তমানে) কর্মপরিগ্রহণের বিপাক (পরিণাম) হেতুত ও কারণত যথার্থভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (৩) তিনি সর্বত্রগামী প্রতিপদ (সর্বার্থসাধক পথ) যথার্থভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (৪) তিনি বহুধাতের, নানাধাতের লোককে যথার্থভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (৫) তিনি জীবগণের নানা অধিমুক্তি (মুক্তিপ্রবণতা) যথার্থভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (৬) তিনি অপর জীবগণের শ্রদ্ধাদি ইন্দ্রিয়ের পরা-অপরাভাব যথার্থভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (৭) তিনি ধ্যানবিমোক্ষ-সমাধিসমাপন্ন ব্যক্তির সংক্লেশ (মালিন্য), ব্যবদান (পবিত্রতা) এবং উত্থান (অব্যাহতি) যথার্থভাবে প্রকৃষ্টরূপে জানেন; (৮) তিনি বহুপ্রকারে বহু পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করেন, এক জন্ম, দুই জন্ম, তিন জন্ম, চারি জন্ম, পাঁচ জন্ম, দশ জন্ম, বিশ জন্ম, ত্রিশ জন্ম, পঞ্চাশ জন্ম, শত জন্ম, সহস্র জন্ম, বহু সংবর্তকল্পে, বহু বিবর্র্তকল্পে আমি ওই স্থানে ছিলাম, এই ছিল আমার নাম, গোত্র, বর্ণ, আহার, সুখ-দুঃখ-অনুভব, আয়ু-পরিমাণ, তথা হইতে চ্যুত হইয়া আমি অমুক স্থানে উৎপন্ন হই, তখন এই ছিল আমার নাম, গোত্র, বর্ণ, আহার, সুখ-দুঃখ-অনুভব, আয়ুপরিমাণ, তথা হইতে চ্যুত হইয়া আমি অত্র উৎপন্ন হইয়াছি, এইরূপে আকার ও উদ্দেশ্যসহ বহুপ্রকারে বহু পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করেন; (৯) তিনি বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পান : জীবগণ চ্যুত হইতেছে, উৎপন্ন হইতেছে, প্রকৃষ্টরূপে জানেন-কীরূপে জীবগণ স্ব স্ব কর্মানুসারে হীনোৎকৃষ্ট যোনি, সুবর্ণ-দুর্বর্ণ, সুগতি-দুর্গতি প্রাপ্ত হইতেছে; (১০) তিনি আসবক্ষয়ে অনাসব চিত্তবিমুক্তি এবং প্রজ্ঞাবিমুক্তি দৃষ্টধর্মে (প্রত্যক্ষজীবনে) স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করেন।

সারিপুত্র, তথাগতের এই দশ তথাগত-বল যাহাতে সমন্বিত হইয়া তিনি নির্ভীকতা অনুভব করেন, সর্বপরিষদে সিংহনাদ করেন, ব্রহ্মচক্র প্রবর্তন করেন।

৮. সারিপুত্র, যে আমাকে এইরূপে জানিয়া এবং দেখিয়াও এ কথা বলে : ‘শ্রমণ গৌতমের অলৌকিক ঋদ্ধিবল নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা, তিনি স্বপ্রতিভায় স্বয়ংবক্তারূপেই তর্ক-প্রণোদিত এবং মীমাংসানুচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন’, সেই উক্তি, সেই চিত্ত এবং সেই দৃষ্টি (মিথ্যা ধারণা) পরিত্যাগ ও বিসর্জন না করিবার ফলে সে যথানীত নিরয়ে (নরকে) নিক্ষিপ্ত হয়। যাহাতে শীলসম্পন্ন, সমাধিসম্পন্ন এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন ভিক্ষু দৃষ্টধর্মে আজ্ঞা (অধিকার) লাভ করিতে পারে আমি তেমন সম্পদের কথাই বলি। সেই উক্তি পরিত্যাগ, সেই চিত্ত পরিত্যাগ এবং সেই দৃষ্টি (মিথ্যা ধারণা) বিসর্জন না করিবার ফলে সে যথানীত নিরয়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

৯. সারিপুত্র, তথাগতের এই চারি বৈশারদ্য যাহাতে সমন্বিত হইয়া তথাগত নির্ভীকতা অনুভব করেন, সর্বপরিষদে সিংহনাদ করেন, ব্রহ্মচক্র প্রবর্তন করেন। চারি বৈশারদ্য কী কী ? প্রথম, সর্বধর্ম অধিগত করিয়া আমি সম্যকসম্বুদ্ধ হইয়াছি, সকল ধর্ম পরিজ্ঞাত হইয়াছি, তাহা জানিয়াও আমার দ্বারা এই সকল ধর্ম অধিগত হয় নাই বলিয়া তদ্‌বিষয়ে কোনো শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, দেব, মার কিংবা ব্রহ্মা, জগতে এমন কেহ ধর্মত, ন্যায়ত আমাকে অভিযুক্ত করিবে, এহেন নিমিত্ত (সম্ভাবনা, কারণ) আমি দেখিতে পাই না; তাহা দেখিতে পাই না বলিয়াই আমি ক্ষেমপ্রাপ্ত, অভয়প্রাপ্ত এবং বৈশারদ্যপ্রাপ্ত হইয়া বিচরণ করি। দ্বিতীয়, আমি সর্বাসবক্ষয়ে ক্ষীণাসব হইয়াছি জানিয়াও আমার দ্বারা এই সকল আসব পরিক্ষীণ হয় নাই বলিয়া তদ্‌বিষয়ে কোনো শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, দেব, মার কিংবা ব্রহ্মা, জগতে এমন কেহ আমাকে ধর্মত, ন্যায়ত অভিযুক্ত করিবে, এহেন নিমিত্ত আমি দেখিতে পাই না; তাহা দেখিতে পাই না বলিয়াই আমি ক্ষেমপ্রাপ্ত, অভয়প্রাপ্ত ও বৈশারদ্যপ্রাপ্ত হইয়া বিচরণ করি। তৃতীয়ত, যে-সকল পাপধর্ম মুক্তির অন্তরায়কর বলিয়া কথিত তৎসমস্ত অন্তরায়কর নহে ভাবিয়া আমি প্রতিসেবন (পরিপোষণ) করি মনে করিয়া কোনো শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, দেব, মার কিংবা ব্রহ্মা, জগতে এমন কেহ ধর্মত, ন্যায়ত আমাকে অভিযুক্ত করিবে এহেন নিমিত্ত আমি দেখিতে পাই না; তাহা দেখিতে পাই না বলিয়াই আমি ক্ষেমপ্রাপ্ত, অভয়প্রাপ্ত ও বৈশারদ্যপ্রাপ্ত হইয়া বিচরণ করি। চতুর্থত, আমি যাহার হিতার্থ ধর্মোপদেশ প্রদান করি সে তদনুযায়ী কার্য করিলে তাহা তাহাকে দুঃখক্ষয়ের অভিমুখে চালিত করে না মনে করিয়া কোনো শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, দেব, মার কিংবা ব্রহ্মা, জগতে এমন কেহ আমাকে তদ্‌বিষয়ে অভিযুক্ত করিবে এহেন নিমিত্ত দেখিতে পাই না বলিয়াই আমি ক্ষেমপ্রাপ্ত, অভয়প্রাপ্ত ও বৈশারদ্যপ্রাপ্ত হইয়া বিচরণ করি। সারিপুত্র, তথাগতের এই চারি বৈশারদ্য যাহাতে সমন্বিত হইয়া তথাগত নির্ভীকতা অনুভব করেন, সর্বপরিষদে সিংহনাদ করেন, ব্রহ্মচক্র প্রবর্তন করেন।

সারিপুত্র, যে আমাকে এইরূপে জানিয়া এবং দেখিয়াও এ কথা বলে : ‘শ্রমণ গৌতমের অলৌকিক ঋদ্ধিবল নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা, তিনি স্বপ্রতিভায় স্বয়ংবক্তারূপেই তর্ক-প্রণোদিত এবং মীমাংসানুচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন’ ইত্যাদি পূর্ববৎ।

১০. সারিপুত্র, অষ্ট পরিষদ। অষ্ট কী কী? ক্ষত্রিয়পরিষদ, ব্রাহ্মণপরিষদ, গৃহপতিপরিষদ, শ্রমণপরিষদ, চতুর্মহারাজপরিষদ, ত্রয়স্ত্রিংশপরিষদ, মারপরিষদ ও ব্রহ্মপরিষদ। সারিপুত্র, এই অষ্ট পরিষদ। উক্ত চারি বৈশারদ্যে সমন্বিত হইয়া তথাগত এই অষ্ট পরিষদের নিকট গমন করেন, অষ্ট পরিষদে প্রবেশ করেন। আমি বিশেষভাবে জানি যে, আমি বহুশত ক্ষত্রিয়পরিষদের নিকট গমন করিয়াছি, পূর্বে তাঁহাদের সঙ্গে উপবেশন করিয়াছি, তাঁহাদের সহিত আলাপ-সালাপ করিয়াছি এবং ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। উহাতে ভয় বা সংকোচ আমার মধ্যে সংক্রমিত হইতে পারে এহেন নিমিত্ত (সম্ভাবনা, কারণ) আমি দেখিতে পাই না; তাহা দেখিতে পাই না বলিয়াই আমি ক্ষেমপ্রাপ্ত, অভয়প্রাপ্ত এবং বৈশারদ্যপ্রাপ্ত হইয়া বিচরণ করি। বহুশত ব্রাহ্মণপরিষদ, গৃহপতিপরিষদ প্রভৃতি সম্বন্ধেও এইরূপ।

সারিপুত্র, যে আমাকে এইরূপে জানিয়া এবং দেখিয়াও এ কথা বলে, ‘শ্রমণ গৌতমের অলৌকিক ঋদ্ধিবল নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা, তিনি স্বপ্রতিভায় স্বয়ংবক্তারূপেই তর্ক-প্রণোদিত এবং মীমাংসানুচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন,’ ইত্যাদি পূর্ববৎ।

১১. সারিপুত্র, চারি জীবযোনি। চারি কী কী? অণ্ডজ যোনি, জরায়ুজ যোনি, সংস্বেদজ যোনি, ঔপপাতিক যোনি। অণ্ডজ কাহারা? যে-সকল জীব অণ্ডকোষ ভেদ করিয়া জন্মে তাহারা অণ্ডজ। জরায়ুজ কাহারা? যে-সকল জীব বস্তিকোষ ভেদ করিয়া জন্মে তাহারা জরায়ুজ। সংস্বেদজ কাহারা? যে-সকল জীব পূতিমৎস্যে, পূতিকুণপে, পূতিশস্যাদিতে, চন্দনিকায় অথবা অবটগর্তে জন্মে তাহারা সংস্বেদজ। ঔপপাতিক কাহারা? দেবগণ, নরকে জাত সত্ত্বগণ, কোনো কোনো মনুষ্য এবং কোনো কোনো নিম্নগামী জীব, ইহারাই ঔপপাতিক। সারিপুত্র, এই চারি জীবযোনি।

সারিপুত্র, যে আমাকে এইরূপে জানিয়া এবং দেখিয়াও এ কথা বলে : ‘শ্রমণ গৌতমের অলৌকিক ঋদ্ধিবল নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা, তিনি স্বপ্রতিভায় স্বয়ংবক্তারূপেই তর্ক-প্রণোদিত এবং মীমাংসানুচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন,’ ইত্যাদি পূর্ববৎ।

১২. সারিপুত্র, জীবের পঞ্চগতি। পঞ্চ কী কী? নিরয় (নরক), তির্যকযোনি (পশুযোনি), পিতৃবিষয় (প্রেতলোক), মনুষ্য (মর্ত্য) ও দেবলোক। সারিপুত্র, নিরয় কী তাহা আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি, নিরয়গামী মার্গ যাহা অনুসরণ করিলে দেহান্তে মৃত্যুর পর জীব অপায়দুর্গতি, বিনিপাত নরকে উৎপন্ন হয় তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি। তির্যকযোনি কী তাহা আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি, তির্যকযোনিগামী মার্গ যাহা অনুসরণ করিলে জীব দেহান্তে মৃত্যুর পর তির্যকযোনিতে উৎপন্ন হয় তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি। পিতৃবিষয় (প্রেতলোক) কী তাহা আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি, পিতৃবিষয়গামী মার্গ যাহা অনুসরণ করিলে জীব দেহান্তে মৃত্যুর পর পিতৃবিষয়ে উৎপন্ন হয় তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি। মনুষ্যলোক কী তাহা আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি, মনুষ্যলোকগামী মার্গ যাহা অনুসরণ করিলে জীব দেহান্তে মৃত্যুর পর মনুষ্যলোকে (মর্ত্যে) উৎপন্ন হয় তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি। দেবলোক কী তাহা আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি, দেবলোকগামী মার্গ যাহা অনুসরণ করিলে জীব দেহান্তে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হয় তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি। সারিপুত্র, নির্বাণ কী তাহা আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি, নির্বাণগামী মার্গ যাহা অনুসরণ করিলে জীব আসবক্ষয়ে অনাসব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি দৃষ্টধর্মে, এই প্রত্যক্ষজীবনে, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থিত হইয়া বিচরণ করে, তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি।

১৩. সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে আমি ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অনুসরণ করিয়া এইভাবে গমন করিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে দেহান্তে মৃত্যুর পর অপায়দুর্গতি, বিনিপাত নরকে উৎপন্ন হইবে। পরে একসময়ে আমি বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, সেই ব্যক্তি দেহান্তে মৃত্যুর পর অপায়দুর্গতি, বিনিপাত নরকে উৎপন্ন হইয়া তীব্র, কটু ও একান্ত দুঃখ, তীব্র-কঠোর বেদনা অনুভব করিতেছে। যেমন মানবদেহপরিমিত ধূমহীন, দীপ্ত, জ্বলন্ত অঙ্গারপূর্ণ অনলকু-কে লক্ষ করিয়া এবং তাহাতে পৌঁছিবার একমাত্র পথ ধরিয়া ঘর্মাভিষিক্ত ঘর্মাক্তকলেবর, ক্লান্ত, তৃষিত ও পিপাসিত ব্যক্তিকে আসিতে দেখিলে চক্ষুষ্মান পুরুষ এ কথা বলিতে পারেন : এই লোকটি এই পথ অবলম্বন করিয়া এইভাবে চলিবে, এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে এই অনলকুণ্ডেই আসিয়া পড়িবে এবং পরে একসময় দেখিতে পান সেই লোকটি অনলকুণ্ডে পতিত হইয়া একান্ত দুঃখ, তীব্র-কঠোর বেদনা অনুভব করিতেছে, তেমনভাবেই সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এইভাবে এই পথ অবলম্বন করিয়া এইভাবে চলিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে, যাহাতে সে দেহান্তে মৃত্যুর পর অপায়দুর্গতি, বিনিপাত নরকে উৎপন্ন হইবে।

১৪. সারিপুত্র, স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে আমি ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবেই চলিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে দেহান্তে মৃত্যুর পর তির্যকযোনিতে উৎপন্ন হইবে এবং পরে একসময়ে বিশুদ্ধ, লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, সত্যসত্যই সে দেহান্তে মৃত্যুর পর তির্যকযোনিতে উৎপন্ন হইয়া তীব্র দুঃখ, কঠোর বেদনা অনুভব করিতেছে। সারিপুত্র, যদি পুরুষদেহপরিমিত গূথকূপ গূথপূর্ণ হয় এবং ঘর্মাক্তকলেবর, ক্লান্ত, তৃষিত ও পিপাসিত কোনো ব্যক্তি সেই গূথকূপকে লক্ষ করিয়া তাহাতে পৌঁছিবার একমাত্র পথ ধরিয়া আসিতে থাকে, যেমন তাহাকে ওই গূথকূপের দিকে আসিতে দেখিয়া চক্ষুষ্মান পুরুষ এ কথা বলিবেন : এই লোকটি এই পথ অনুসরণ করিয়া এইভাবে চলিবে, সে এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে ওই গূথকূপেই আসিয়া পড়িবে এবং পরে একসময়ে দেখিতে পাইবে যে, সেই লোকটি সত্যসত্যই গূথকূপে পতিত হইয়া তীব্র দুঃখ, কঠোর বেদনা অনুভব করিতেছে, তেমনভাবেই সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অনুসরণ করিয়া এইভাবে চলিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে যে দেহান্তে মৃত্যুর পর তির্যকযোনিতে উৎপন্ন হইবে এবং পরে একসময়ে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, সে সত্যসত্যই তির্যক-যোনিতে উৎপন্ন হইয়া তীব্র দুঃখ, কঠোর বেদনা অনুভব করিতেছে।

১৫. সারিপুত্র আমি স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বন করিয়া এইভাবেই চলিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে দেহান্তে মৃত্যুর পর পিতৃবিষয়ে (প্রেতলোকে) উৎপন্ন হইবে এবং পরে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, সত্যসত্যই সে দেহান্তে মৃত্যুর পর পিতৃবিষয়ে উৎপন্ন হইয়া তীব্র দুঃখ অনুভব করিতেছে। যদি বিষম ভূমিভাগে বৃক্ষ বিরলপত্র ও বিরলচ্ছায় হয়, এবং ঘর্মাক্তকলেবর, ক্লান্ত, তৃষিত ও পিপাসিত কোনো ব্যক্তি ওই বৃক্ষকে লক্ষ করিয়া তাহাতে পৌঁছিবার একমাত্র পথে আসিতে থাকে, যেমন তাহাকে ওই বৃক্ষের দিকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া চক্ষুষ্মান পুরুষ এ কথা বলিবেন : এই লোকটি এই পথ অবলম্বনে এইভাবেই চলিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে ওই বৃক্ষতলে আসিয়া পড়িবে এবং পরে একসময় দেখিতে পাইবেন যে, সত্যসত্যই সে ওই বৃক্ষচ্ছায়ায় আসীন বা শায়িত হইয়া দুঃখবহুল বেদনা অনুভব করিতেছে; তেমনভাবেই সারিপুত্র, স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবেই চলিবে, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবে যাহাতে সে দেহান্তে মৃত্যুর পর পিতৃবিষয়ে (প্রেতলোকে) উৎপন্ন হইবে এবং পরে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, সত্যসত্যই সে পিতৃবিষয়ে উৎপন্ন হইয়া তীব্র দুঃখ, কঠোর বেদনা অনুভব করিতেছে।

১৬. সারিপুত্র, স্বচিত্তে পরচিত্ত জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এই ভাবে চলিবেন, এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি দেহান্তে মৃত্যুর পর মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হইবেন এবং পরে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, তিনি সত্যসত্যই দেহান্তে মৃত্যুর পর মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হইয়া সুখবহুল বেদনা অনুভব করিতেছেন। যদি সমভূমিতে জাত বৃক্ষ পত্রবহুল ও ঘনচ্ছায় হয়, এবং ঘর্মাক্তকলেবর, ক্লান্ত, তৃষিত ও পিপাসিত কোনো ব্যক্তি ওই বৃক্ষকে লক্ষ করিয়া তাহাতে পৌঁছিবার একমাত্র পথে আসিতে থাকেন, যেমন তাঁহাকে ওই বৃক্ষের দিকে আসিতে দেখিয়া চক্ষুষ্মান পুরুষ এ কথা বলিবেন : এই মহানুভব ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন, এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি ওই বৃক্ষে আসিয়া পড়িবেন এবং পরে একসময়ে দেখিতে পান : সত্যসত্যই তিনি ওই বৃক্ষচ্ছায়ায় আসীন বা শায়িত হইয়া সুখবহুল বেদনা অনুভব করিতেছেন, তেমনভাবেই সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তভাব জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি দেহান্তে মৃত্যুর পর মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হইয়া সুখবহুল বেদনা অনুভব করিবেন এবং পরে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, তিনি সত্যসত্যই দেহান্তে মৃত্যুর পর মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হইয়া সুখবহুল বেদনা অনুভব করিতেছেন।

১৭. সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে আমি ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এই পথে চলিবেন এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি দেহান্তে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবেন এবং পরে একসময়ে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, তিনি সত্যসত্যই দেহান্তে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়া একান্ত সুখবেদনা অনুভব করিতেছেন। যদি অভ্যন্তরে উৎক্ষিপ্ত, বহির্ভাগে অবলিপ্ত, নির্বাত, পুষ্পিত অর্গলযুক্ত, সুবিহিত-বাতায়ন-শোভিত, কূটাগারজাতীয় দীর্ঘ প্রাসাদ থাকে এবং তন্মধ্যে ‘গোণক’ নামীয় কৃষ্ণলোমাস্তরণে আবৃত, ‘পটিক’ নামীয় ঊর্ণাময় শ্বেতাস্তরণে আবৃত, ‘পটলিক’ নামীয় ঘনসূচিকর্মযুক্ত ঊর্ণাময় আস্তরণে আবৃত, কদলিমৃগচর্মে নির্মিত অতি উৎকৃষ্ট প্রত্যাস্তরণে আবৃত, চাদর-আচ্ছাদিত ও লোহিত উপাদানযুক্ত পর্যঙ্ক থাকে, এবং ঘর্মাক্তকলেবর, ক্লান্ত, তৃষিত ও পিপাসিত কোনো ব্যক্তি ওই প্রাসাদকে লক্ষ করিয়া তাহাতে পৌঁছিবার একমাত্র পথে আসিতে থাকেন, যেমন তাঁহাকে ওই প্রাসাদের দিকে আসিতে দেখিয়া চক্ষুষ্মান পুরুষ এ কথা বলিবেন : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এই পথে চলিবেন, এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি ওই প্রাসাদে আসিয়া পড়িবেন এবং পরে একসময়ে দেখিতে পান : তিনি সত্যসত্যই ওই প্রাসাদ-কূটাগারে, ওই পর্যঙ্কে আসীন বা শায়িত হইয়া একান্ত সুখবেদনা অনুভব করিতেছেন। তেমনভাবেই, সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তভাব জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি দেহান্তে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবেন এবং পরে একসময়ে বিশুদ্ধ লোকাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, তিনি সত্যসত্যই দেহান্তে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়া একান্ত সুখবেদনা অনুভব করিতেছেন।

১৮. সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তগতি জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি আসবক্ষয়ে অনাসব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি দৃষ্টধর্মে, এই প্রত্যক্ষজীবনে, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থিত হইয়া বিচরণ করিবেন এবং পরে একসময়ে দেখিতে পাই যে, তিনি সত্যসত্যই আসবক্ষয়ে অনাসব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি দৃষ্টধর্মে, এই প্রত্যক্ষজীবনে, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থিত হইয়া বিচরণ করিতেছেন। যদি স্বচ্ছোদক, প্রসন্নসলিল, শীতলবারি, সুরম্য বাঁধা মর্মরসোপানযুক্ত পুষ্করিণী এবং উহার অদূরে অতি মনোহর বনভূমি থাকে এবং ঘর্মাক্তকলেবর, ক্লান্ত, তৃষিত ও পিপাসিত কোনো ব্যক্তি ওই পুষ্করিণীকে লক্ষ করিয়া তাহাতে পৌঁছিবার একমাত্র পথ ধরিয়া আসিতে থাকেন, যেমন তাঁহাকে ওই পুষ্করিণীর দিকে আসিতে দেখিয়া চক্ষুষ্মান পুরুষ এ কথা বলিবেন : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন, এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি ওই পুষ্করিণীতে আসিয়া পড়িবেন এবং পরে একসময়ে দেখিতে পান : তিনি সত্যসত্যই ওই পুষ্করিণীতে আসিয়া তাহাতে অবগাহন করিয়া, স্নান করিয়া, উহার জল পান করিয়া সর্ব পথশ্রান্তি, পথক্লান্তি ও তৃষ্ণাক্লেশ প্রশমিত করিয়া তীরে উঠিয়া ওই বনভূমিতে আসীন বা শায়িত হইয়া একান্ত সুখ অনুভব করিতেছেন, তেমনভাবেই সারিপুত্র, আমি স্বচিত্তে পরচিত্তভাব জানিবার ভাবে ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন, এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি স্বচ্ছোদক, প্রসন্নসলিল, শীতলবারি সুরম্য বাঁধা মর্মরসোপানযুক্ত পুষ্করিণীতে উপস্থিত হইয়া তাহাতে অবগাহন করিয়া, স্নান করিয়া, উহার জল পান করিয়া সর্ব পথশ্রান্তি, পথক্লান্তি ও তৃষ্ণাক্লেশ প্রশমিত করিয়া, তীরে উঠিয়া ওই বনভূমিতে আসীন বা শায়িত হইয়া একান্ত সুখ অনুভব করিবেন এবং পরে একসময় দেখিতে পান : তিনি সত্যসত্যই স্বচ্ছোদক, প্রসন্নসলিল, শীতলবারি, সুরম্য বাঁধা মর্মরসোপানযু্‌ক্ত পুষ্করিণীতে উপস্থিত হইয়া, তাহাতে অবগাহন করিয়া, স্নান করিয়া, উহার জল পান করিয়া, সর্ব পথশ্রান্তি, পথক্লান্তি ও তৃষ্ণাক্লেশ প্রশমিত করিয়া, তীরে উঠিয়া ওই বনভূমিতে আসীন বা শায়িত হইয়া একান্ত সুখ অনুভব করিতেছেন, তেমনভাবেই সারিপুত্র, স্বচিত্তে পরচিত্ত জানিবার ভাবে আমি ব্যক্তিবিশেষকে প্রকৃষ্টরূপে জানি : এই ব্যক্তি এই পথ অবলম্বনে এইভাবে চলিবেন, এবং এমন এক মার্গসমারূঢ় হইবেন যাহাতে তিনি আসবক্ষয়ে অনাসব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি দৃষ্টধর্মে, এই প্রত্যক্ষজীবনে, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থিত হইয়া বিচরণ করিবেন, এবং পরে একসময়ে দেখিতে পাই যে, তিনি সত্যসত্যই ওই পথে চলিয়া ওই মার্গসমারূঢ় হইয়া দৃষ্টধর্মে আসবক্ষয়ে অনাসব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থিত হইয়া বিচরণ করিতেছেন।

১৯. সারিপুত্র, জীবের এই পঞ্চগতি। যে আমাকে এইরূপে জানিয়া এবং দেখিয়াও এ কথা বলিবে : ‘শ্রমণ গৌতমের অলৌকিক ঋদ্ধিবল নাই, আর্যজ্ঞানদর্শন তো দূরের কথা, তিনি স্বপ্রতিভায় স্বয়ংবক্তারূপেই তর্ক-প্রণোদিত এবং মীমাংসাচরিত ধর্মোপদেশ প্রদান করেন,’ ইত্যাদি পূর্ববৎ।

২০. সারিপুত্র, আমি বিশেষভাবে জানি যে, আমি চতুরঙ্গসমন্বিত ব্রহ্মচর্য আচরণ করিয়াছি; আমি তপস্বী হইয়াছি, পরম তপস্বী; আমি রুক্ষ হইয়াছি, পরম রুক্ষ (কঠোর সাধক); জুগুপ্সী হইয়াছি, পরম জুগুপ্সী; প্রবিবিক্ত হইয়াছি, পরম প্রবিবিক্ত (পরমকেবলী)।

প্রথম, আমার তপস্বিতার স্বরূপ এই : আমি অচেলক (নগ্ন-প্রব্রজিত), মুক্তাচারী, হস্তাবলেহী হইয়াছি। ‘ভদন্ত, আসুন, ভিক্ষা গ্রহণ করুন’ বলিলে ভিক্ষান্ন গ্রহণ করি নাই। পূর্ব হইতে কেহ অপেক্ষা করিয়া থাকিলে সে ভিক্ষান্ন গ্রহণ করি নাই। আমার জন্য ভিক্ষান্ন প্রস্তুত হইয়াছে বলিয়া জানাইলে তাহা গ্রহণ করি নাই। কোনো নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি নাই। কুম্ভীমুখ (পাত্রাভ্যন্তর) হইতে প্রদত্ত ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই। ‘কালোপিমুখ (কটোরাভ্যন্তর) হইতে প্রদত্ত ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই পাছে তাহা চামচের আঘাতে ব্যথা পায়। উনানমধ্যে রাখিয়া কেহ ভিক্ষা দিলে তাহা গ্রহণ করি নাই পাছে সে উনানে পড়িয়া যায়। মুষলমধ্যে রাখিয়া কেহ ভিক্ষা দিলে তাহা গ্রহণ করি নাই। যেখানে দুইজন ভোজন করিতেছে, তন্মধ্যে একজনকে ভোজনত্যাগ করিয়া উঠিয়া ভিক্ষা দিতে হইলে ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই পাছে তাহার আহার নষ্ট হয়। গর্ভবতী স্ত্রীলোক ভিক্ষা দিলে তাহা গ্রহণ করি নাই পাছে গর্ভস্থ সন্তান কষ্ট পায়। শিশুকে স্তন্যপান করাইবার সময় পাছে শিশুর কষ্ট হয় সে জন্য ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই। স্বামীসহবাসকালে স্ত্রীলোকের নিকট হইতে ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই পাছে তাহার রতিসুখে বিঘ্ন ঘটে। সৎকাজের সময় ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই। যেখানে আহার পাইবে আশায় কুক্কুর দাঁড়াইয়া থাকে, যেখানে আহার-উদ্দেশ্যে মক্ষিকা একত্র সঞ্চরণ করে, সেখানে ভিক্ষা গ্রহণ করি নাই। মৎস্য-মাংস আহার করি নাই, সুরা, মৈরেয় ও মদ্যপান করি নাই। মাত্র এক গৃহ হইতে সংগৃহীত ভিক্ষান্ন হইতে এক গ্রাস ভোজন করিয়াছি, দুই গৃহ হইতে সংগৃহীত ভিক্ষান্ন হইতে মাত্র দুই গ্রাস ভোজন করিয়াছি,… সপ্তগৃহ হইতে সংগৃহীত ভিক্ষান্ন হইতে মাত্র সাত গ্রাস ভোজন করিয়াছি। মাত্র এক দত্তিতে (একবার প্রদত্ত পরিমিত দানে) দিনযাপন করিয়াছি, মাত্র দুই দত্তিতে দিনযাপন করিয়াছি,… মাত্র সাত দত্তিতে দিনযাপন করিয়াছি, একদিন অন্তর, দু-দিন অন্তর, তিন দিন অন্তর,… সপ্তাহ অন্তর আহার করিয়াছি। এইরূপে এমনকি অর্ধমাস অন্তর অন্তর ভিক্ষান্ন ভোজনে নিরত হইয়া অবস্থান করিয়াছি। শাকভোজী, শ্যামাকভোজী, নীবারভোজী, দর্দুরভোজী (পরিত্যক্ত চর্মভোজী), শৈবালভোজী, কণভোজী, আচামভোজী, পিণ্যাকভোজী তৃণভোজী, গোময়ভোজী, ফলমূলাহার কিংবা ভূপতিত ফলভোজী হইয়া দিনযাপন করিয়াছি। আমি শাণবাক্‌চেল [শণবাক্‌চেল] ধারণ করিয়াছি, মশানলব্ধ বস্ত্র ধারণ করিয়াছি, শবাচ্ছাদন ধারণ করিয়াছি, পাংশুকূল (পরিত্যক্ত নক্তক) ধারণ করিয়াছি, তিরীট (বল্কল) ধারণ করিয়াছি, অজিন (মৃগচর্ম) ধারণ করিয়াছি, কুশচীর, বাকচীর (বল্কল), ফলকচীর (দার্বচীবর) ধারণ করিয়াছি, কেশকম্বল ধারণ করিয়াছি, ব্যালকম্বল ধারণ করিয়াছি, উলূকপক্ষ (পালকনির্মিত) বস্ত্র ধারণ করিয়াছি, কেশ-শ্মশ্রুমুণ্ডন কার্যে নিরত হইয়াছি, উৎকুটিক হইয়া উৎভ্রষ্টিক হইয়া আসন পরিত্যাগপূর্বক উৎকুটিক সাধনে নিরত হইয়াছি। কণ্টকশায়ী হইয়া কণ্টকশয্যায় শয়ন করিয়াছি। দিবসে তিনবেলা উদক-অবরোহণ (জলে অবতরণ) কার্যে নিরত হইয়াছি। এইরূপে বহুপ্রকার বহুবিধ কায়তাপন পরিতাপন অভ্যাসে নিযুক্ত হইয়া বিচরণ করিয়াছি। সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে পূর্বতপস্বিতা।

২১. সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে রুক্ষতা (কঠোর সাধন)। বহুবৎসর ধরিয়া আমার দেহে ধুলাবালি সঞ্চিত হইয়া পাট বাঁধিয়াছে। সারিপুত্র, যেমন বহুবর্ষ ধরিয়া তিন্দুকস্থাণু রাশীকৃত ও পাট-পাট হয় তেমনভাবেই বহুবর্ষ ধরিয়া আমার অঙ্গে রজোমল সঞ্চিত হইয়া পাট বাঁধিয়াছে। আমার এমনও মনে হয় নাই যে, আমি এই রজোমল হস্ত দ্বারা পরিমার্জিত করিব, অপর কেহ আমার অঙ্গের এই রজোমল হস্ত দ্বারা পরিমার্জিত করিবে তাহাও আমার মনে উদিত হয় নাই। সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে পূর্বরুক্ষতা বা কঠোর সাধন।

২২. সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে জুগুপ্সুতা। আমি স্মৃতিমান হইয়া সাবধানে চলাফেরা করিয়াছি, যাহাতে বিপাকে পড়িয়া আমার দ্বারা ক্ষুদ্রপ্রাণীও আঘাত না পায়। সামান্য জলবিন্দুতেও আমার দয়া উপস্থাপিত ছিল। সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে পূর্বজুগুপ্সুতা (পাপে ঘৃণা)।

২৩. সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে প্রবিবিক্ততা (বিবেক-বৈরাগ্যসাধন)। আমি কোনো এক অরণ্যায়তনে প্রবিষ্ট হইয়া বিচরণ করিয়াছি। যখনই কোনো গোপবালককে, পশুপালককে, তৃণাহরণকারীকে, কাষ্ঠাহরণকারীকে, অথবা বনে ফলমূলসন্ধানকারীকে (বনকর্মীকে) দেখিয়াছি, আমি বন হইতে বনে, গহন হইতে গহনে, নিম্ন হইতে নিম্নস্থলে, উচ্চ হইতে উচ্চস্থলে গিয়া পড়িয়াছি, যাহাতে তাহারা আমাকে দেখিতে না পায়, আমিও তাহাদিগকে দেখিতে না পাই। সারিপুত্র, যেমন অরণ্যচারী মৃগ মানুষকে দেখিয়া বন হইতে বনে, গহন হইতে গহনে, নিম্ন হইতে নিম্নস্থলে, উচ্চ হইতে উচ্চস্থলে ছুটিয়া যায়, তেমনভাবেই, সারিপুত্র, যখনই আমি কোনো গোপবালককে, পশুপালককে, তৃণাহরণকারীকে, কাষ্ঠাহরণকারীকে, বনকর্মীকে দেখিয়াছি, তখনোই আমি বন হইতে বনে, গহন হইতে গহনে, নিম্ন হইতে নিম্নস্থলে, উচ্চ হইতে উচ্চস্থলে গিয়া পড়িয়াছি, যাহাতে তাহারা আমাকে দেখিতে না পায়, আমিও তাহাদিগকে দেখিতে না পাই।

২৪. সারিপুত্র, যখন গোষ্ঠ হইতে গাভিসকল চলিয়া গিয়াছে, গোপবালকগণও চলিয়া গিয়াছে, তখন হামাগুড়ি দিয়া তথায় যাইয়া স্তন্যপায়ী তরুণ বাছুরের গোময় আমি আহার করিয়াছি। সারিপুত্র, ভূপতিত হইবার পূর্বেই স্বমলমূত্র গ্রহণ করিয়া আহার করিয়াছি। ইহাই আমার পক্ষে পূর্বমহাবিকটভোজন।

সারিপুত্র, কখনো-বা অপর কোনো এক ভীষণ বনখণ্ডে প্রবেশ করিয়া বিচরণ করিয়াছি। সেই ভীষণ বনের ভীষণতা এই যে, যে-কেহ অবীতরাগ হইয়া তাহাতে প্রবেশ করে, বহুল পরিমাণে তাহার রোমাঞ্চ উপস্থিত হয়।

সারিপুত্র, শীত ও হেমন্ত ঋতুতে, হিমপাত সময়ে, অন্তর-অষ্টকায় যে-সকল বিভীষিকাপূর্ণ রাত্রি সে-সকল রাত্রিতে সারারাত্রি উন্মুক্ত আকাশতলে এবং সারাদিন বনখণ্ডে বিচরণ করিয়াছি। গ্রীষ্ম ঋতুর শেষ মাসে দিনে উন্মুক্ত আকাশতলে এবং রাত্রিতে বনখণ্ডে বিচরণ করিয়াছি। সারিপুত্র, সেই সময়ে আমার অন্তরে এই অশ্রুতপূর্ব আশ্চর্য ভাবোদ্দীপক গাথা স্ফূর্ত হইয়াছিল :

তপ্ত, সিক্ত, একা আমি ভীষণ সে বনে।
নগ্ন অচেলক মুনি আসীন আসনে
অগ্নি বিনা, মৌন ধ্যায়ী লক্ষ্যের সাধনে ॥

২৫. সারিপুত্র, আমি শ্মশানে শবাস্থিকে উপাধান করিয়া শয়ন করিয়াছি। এমনও ঘটিয়াছে যে, গোপবালকগণ আমার নিকট আসিয়া অঙ্গে নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিয়াছে, কর্ণকুহরে শলাকা প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে, অথচ আমি বিশেষভাবে জানি কখনও তাহাদের প্রতি আমি পাপচিত্ত উৎপাদন করি নাই। সারিপুত্র, ইহাই আমার পক্ষে পূর্ব উপেক্ষা-বিহার।

২৬. সারিপুত্র, কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : আহার সংযমে আত্মশুদ্ধি হয়, কুল (বদরী)-মাত্র আহারে জীবনযাপন করিব, এ কথা বলিয়া তাঁহারা কুলভক্ষণ করেন, কুলোদক পান করেন, বহুপ্রকারে বহুকুলে প্রস্তুত খাদ্য ভক্ষণ করেন। সারিপুত্র, আমি বিশেষরূপে জানি যে, আমি দিনে মাত্র একটি কুলে আহার শেষ করিয়াছি। সারিপুত্র, তোমার মনে হইতে পারে, তখন ভুক্ত কুলটি বুঝি অতি বৃহৎ ছিল। বিষয়টি এইভাবে দেখিও না। এখন যেমন, তখনও কুলটি ঠিক এই আকারেই ছিল। সারিপুত্র, দিনে মাত্র একটি কুলে আহার শেষ করিতে গিয়া আমার দেহ অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষীণ হইয়াছিল, যেমন অশীতলতা অথবা কাললতা সন্ধিস্থানে মিলাইয়া মধ্যভাগে উন্নত-অবনত হয় তেমনভাবেই সেই অল্পাহার নিমিত্ত আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দুরবস্থা হইয়াছিল, উষ্ট্রপদের সংযোগস্থলের ন্যায় আমার গুহ্যদ্বার অবিশদ গর্তসদৃশ হইয়াছিল। সেই অল্পাহারহেতু আমার পৃষ্ঠকণ্টক যষ্ঠিতে বেষ্টিত সূত্রাবলির ন্যায় দেখিতে উন্নত-অবনত হইয়াছিল। যেমন জীর্ণগৃহের বরগাগুলি উৎলগ্নবিলগ্ন (এলোমেলো) হয় তেমন অল্পাহারহেতু আমার বক্ষপঞ্জরগুলি উৎলগ্ন-বিলগ্ন হইয়াছিল। যেমন গভীর উদপানে (কূপে) উদকতারকা (উদকচন্দ্র, প্রতিবিম্ব) গভীর জলে প্রবিষ্ট হয়, তেমন সেই অল্পাহারহেতু অক্ষিকূপে অক্ষিতারকা গভীরে প্রবিষ্ট হইয়াছিল। যেমন তিক্ত অলাবু (করলা) কচি অবস্থায় ছিন্ন হইলে বাতাতপস্পর্শে সহসা সংম্লান হয় তেমন অল্পাহারহেতু আমার শিরশ্চর্ম বাতাতপস্পর্শে ম্লান হইয়াছিল। সারিপুত্র, সেই অল্পাহারহেতু আমার উদরচর্ম এমনভাবে পৃষ্ঠকণ্টকে লীন হইয়াছিল যে, উদরচর্মে হস্তস্পর্শ করিলে পৃষ্ঠকণ্টক ধরিয়াছি বলিয়া মনে হইয়াছে, পৃষ্ঠকণ্টক স্পর্শ করিলে উদরচর্ম স্পর্শ করিয়াছি বলিয়া মনে হইয়াছে। সারিপুত্র, মলমূত্র ত্যাগ করিতে গিয়া সে-স্থানেই কুব্জ হইয়া ভূপতিত হইয়া পড়িয়াছি। সারিপুত্র, সেই অল্পাহারহেতু দেহ আশ্বস্ত করিতে গিয়া হস্ত দ্বারা গাত্রে হাত বুলাইয়াছি, গাত্রে হাত বুলাইতে গিয়া পচিতমূল লোমসমূহ অঙ্গ হইতে স্খলিত হইয়া পড়িয়াছে।

২৭. সারিপুত্র, কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : সংসারগতিতে (জন্মজন্মান্তর গ্রহণে) আত্মশুদ্ধি হয়। দীর্ঘকালের মধ্যে আমি যত সংসারে পূর্বে পরিভ্রমণ করিয়াছি তন্মধ্যে শুদ্ধাবাস দেবলোক ব্যতীত অপর কোনো লোকে জন্ম সুলভরূপ (সুখের আবাস) নহে। সারিপুত্র, শুদ্ধাবাস দেবলোকে জন্মলাভ করিলে পুনরায় এই মর্ত্যলোকে আগমন করিতে হয় না। কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : পুনরুৎপত্তিতেই আত্মশুদ্ধি হয়। কিন্তু আমি দীর্ঘকালের মধ্যে যত লোকে উৎপন্ন হইয়াছি, তন্মধ্যে শুদ্ধাবাস দেবলোক ব্যতীত অপর কোনো লোকে উৎপত্তি সুলভরূপ (সুখের জন্ম) নহে। সারিপুত্র, শুদ্ধাবাসে উৎপন্ন হইলে পুনরায় এই মর্ত্যলোকে আগমন করিতে হয় না। কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : বিভিন্ন ভবাবাসে জন্মগ্রহণ দ্বারা আত্মশুদ্ধি হয়। কিন্তু আমি দীর্ঘকালের মধ্যে যতগুলি ভবাবাসে পূর্বে গমন করিয়াছি, তন্মধ্যে শুদ্ধাবাস দেবলোক ব্যতীত অপর কোনো ভবাবাস সুলভরূপ নহে। সারিপুত্র, শুদ্ধাবাসে বাস করিতে পারিলে পুনরায় এই মর্ত্যে আগমন করিতে হয় না।

কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : বহুযজ্ঞ সম্পাদনে আত্মশুদ্ধি হয়। কিন্তু আমি দীর্ঘকালের মধ্যে রাজ্যাভিষিক্ত মুকুটপরিহিত ক্ষত্রিয়রূপে অথবা মহাশাল ব্রাহ্মণরূপে পূর্বে যত যজ্ঞ করিয়াছি তন্মধ্যে কোনোটিই সুলভরূপ (সুখদায়ক) নহে।

কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : অগ্নিপরিচর্যা (অগ্নিহোত্র) দ্বারা আত্মশুদ্ধি হয়। কিন্তু সারিপুত্র, আমি দীর্ঘকালের মধ্যে মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয়রূপে অথবা মহাশাল ব্রাহ্মণরূপে পূর্বে যতবার অগ্নি পরিচর্যা করিয়াছি, তন্মধ্যে তাহা কোনো বার সুলভরূপ (সুখদায়ক) হয় নাই।

সারিপুত্র, কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন : যদবধি কোনো ব্যক্তি তরুণ, যুবা, শিশু, কৃষ্ণকেশ, প্রথম বয়সে পূর্ণযৌবনসম্পন্ন থাকে, তদবধি তিনি পরম তীব্রপ্রজ্ঞাসম্পন্ন থাকেন। আর যখনই তিনি জরাজীর্ণ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধজাতীয়, অর্ধগত, উপনীত-বয়ঃ, অশীতিবর্ষবয়স্ক, নবতিবর্ষবয়স্ক, অথবা শতবর্ষবয়স্ক হন, তখন তিনি সেই প্রজ্ঞার তীব্রতা হারাইয়া বসেন। সারিপুত্র, বিষয়টি এইরূপে দেখিবে না। আমিও তো এখন জীর্ণ, বৃদ্ধ, বয়স্ক, অর্ধগত, উপনীত-বয়ঃ হইয়াছি, এবং আমার বয়স হইতেছে অশীতি বৎসর, আমার চারিজন শ্রাবক (উন্নত শিষ্য) আছেন, যাঁহাদের শতবর্ষ আয়ু, শতবর্ষ জীবন, অথচ তাঁহারা পরম গতি, স্মৃতি ও ধৃতিসম্পন্ন এবং পরম ও তীব্র-প্রজ্ঞাসম্পন্ন। যেমন, সারিপুত্র, দৃঢ়পণ, শিক্ষিত, সিদ্ধহস্ত এবং পারদর্শী ধনুগ্রাহী (ধনুর্ধারী) অল্পায়াসে লঘুকাণ্ডের দ্বারা তির্যকভাবে তালচ্ছায়া বিদ্ধ করেন, তেমনভাবেই অধিকমাত্রায় স্মৃতিমান, গতিমান, মতিমান, ধৃতিমান এবং পরম তীব্রপ্রজ্ঞাসম্পন্ন আমার এই শিষ্যগণ অশন, পান, খাদন ও আস্বাদন, মলমূত্রত্যাগ, নিদ্রা ও বিশ্রাম ব্যতীত অপর সব সময় আমাকে চারি স্মৃতি-উপস্থানের এক একটি বিষয় লইয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন এবং আমিও জিজ্ঞাসিত হইয়া উত্তর প্রদানে প্রশ্ন ব্যাখ্যা করি। তাঁহারা ব্যাখ্যাতকে ব্যাখ্যাতরূপে অবধারণ করিয়া তদ্‌বিষয়ে তদুপরি দ্বিতীয়বার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না। সারিপুত্র, তথাগতের ধর্মদেশনা অপরিক্ষীণ, ধর্মপদব্যঞ্জন অপরিক্ষীণ, প্রশ্নের উত্তরদান-ক্ষমতা অপরিক্ষীণ, শতবর্ষজীবী, শতবর্ষবয়স্ক আমার সেই চারি শিষ্য শতবর্ষ পরে কালপ্রাপ্ত হইবেন। কিন্তু সারিপুত্র, তোমরা আমাকে মঞ্চোপরি বহন করিয়া গমন করিবে এহেন অবস্থা আমার হইবে না, তথাগতের প্রজ্ঞার তীব্রতার ব্যতিক্রম হইবে না। সারিপুত্র, যদি কেহ এ কথা বলেন, বহু লোকের হিতের জন্য, সুখের জন্য, বিশ্বে অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেবনর সকলের অর্থ, হিত ও সুখের জন্য জগতে এক মোহাতীত মহাপুরুষ, উৎপন্ন (আবির্ভূত) হইয়াছেন তাহা হইলে তিনি তাহা যথার্থই বলিবেন। যদি কেহ আমাকে লক্ষ করিয়াই এ কথা বলেন, তাহাতে তিনি যথার্থই বলিবেন, বহু লোকের হিতের জন্য, সুখের জন্য, বিশ্বে অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেবনর সকলের অর্থ, হিত ও সুখের জন্য জগতে এক মোহাতীত মহাপুরুষ উৎপন্ন হইয়াছেন।

সেই সময়ে আয়ুষ্মান নাগসমাল ভগবানের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া ভগবানকে ব্যজন করিতেছিলেন। আয়ুষ্মান নাগসমাল ভগবানকে কহিলেন, প্রভো, ইহা বড়ই আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর। প্রভো, এই ধর্মপর্যায়, ধর্মতত্ত্ব শ্রবণ করিয়া আমার রোমাঞ্চ হইতেছে। প্রভো, এই ধর্মপর্যায়ের নাম কী হইবে? নাগসমাল, যখন তুমি বলিতেছ, ইহা শ্রবণ করিয়া তোমার রোমাঞ্চ হইতেছে, তখন তোমরা রোমহর্ষ ধর্ম-পর্যায়রূপে অবধারণ করো। ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন। তাহাতে আয়ুষ্মান নাগসমাল আনন্দিত হইলেন।

মহাসিংহনাদ-সূত্র সমাপ্ত।

The Middle Discourses

|_A. The First Fifty

|__II. The Chapter on the Lion’s Roar

MN12. মহাসিংহনাদ-সূত্র

Translations [28]

English

繁體字

日本語

Français

Deutsch

Italiano

Español

Português

Norsk

Srpski

Čeština

Slovenščina

हिंदी

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference