আমি এইরূপ শুনিয়াছি।

১. একসময় ভগবান শ্রাবস্তী-সমীপে অবস্থান করিতেছিলেন, জেতবনে, অনাথপিণ্ডিকের আরামে। সেই সময় আয়ুষ্মান মৌলীফাল্গুন অতিরিক্ত মাত্রায় ভিক্ষুণীদিগের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করিতেছিলেন। নিম্নোক্তভাবে তিনি ভিক্ষুণীদিগের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করিতেছিলেন : যদি কোনো ভিক্ষু তাঁহার সম্মুখে ভিক্ষুণীদিগের অখ্যাতিসূচক কোনো কথা বলিতেন, তাহাতে তিনি কুপিত ও অপ্রসন্ন হইতেন, এমনকি ভিক্ষুর কৃত অপরাধের বিচার প্রার্থনা করিতেন। যদি কোনো ভিক্ষু ভিক্ষুণীদিগের সম্মুখে মৌলীফাল্গুনের অখ্যাতিসূচক কোনো কথা বলিতেন, তাহা হইলে তাঁহারা কুপিত ও অপ্রসন্ন হইতেন, এমনকি ভিক্ষুর কৃত অপরাধের বিচার প্রার্থনা করিতেন। এইভাবেই ভিক্ষুণীদিগের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া মৌলীফাল্গুন অবস্থান করিতেছিলেন।

অতঃপর জনৈক ভিক্ষু ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট হইয়া তিনি উপরি-উক্ত বিষয় ভগবানের নিকট যথাযথ বিবৃত করিলেন।

২. ভগবান অপর এক ভিক্ষুকে ডাকিয়া কহিলেন, ভিক্ষু, তুমি এদিকে আইস [আসো], আমার আদেশে মৌলীফাল্গুনকে গিয়া জানাও, ‘শাস্তা তোমাকে ডাকিয়াছেন’। ‘যথা আজ্ঞা, প্রভো’ বলিয়া এই ভিক্ষু আয়ুষ্মান মৌলীফাল্গুনের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে জানাইলেন যে, শাস্তা তাঁহাকে ডাকিয়াছেন। ‘তথাস্তু বলিয়া আয়ুষ্মান মৌলীফাল্গুন ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান মৌলীফাল্গুনকে ভগবান জিজ্ঞাসা করিলেন, সত্যই কি তুমি, ফাল্গুন, ভিক্ষুণীদিগের সহিত অতিরিক্ত মাত্রায় সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করিতেছ? এইভাবেই তুমি ভিক্ষুণীদিগের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করিতেছ : যদি কোনো ভিক্ষু তোমার সম্মুখে ভিক্ষুণীদিগের অখ্যাতিসূচক কোনো কথা বলে, তাহাতে তুমি কুপিত ও অপ্রসন্ন হও, এমনকি ভিক্ষুর কৃত অপরাধের জন্য বিচার প্রার্থনা কর; আর যদি কেহ ভিক্ষুণীদিগের নিকট তোমার অখ্যাতিসূচক কোনো কথা বলে, তাহাতে তাহারা কুপিত ও অপ্রসন্ন হয়, এমনকি ভিক্ষুর কৃত অপরাধের বিচার প্রার্থনা করে। এইভাবেই কি তুমি ভিক্ষুণীদিগের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করো?

‘হাঁ প্রভো, তাহাই বটে।’ ফাল্গুন, তুমি কি জান না যে তুমি কুলপুত্র, পরে শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইয়াছ? ‘হাঁ প্রভো, তাহাই বটে।’ ফাল্গুন, শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত কুলপুত্রের পক্ষে ইহা সমীচীন নহে যে, তুমি ভিক্ষুণীদিগের সহিত অতিমাত্রায় সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করিবে। অতএব যদি কেহ তোমার সম্মুখে ভিক্ষুণীদিগের অখ্যাতিসূচক কোনো কথাও বলে, তথাপি তুমি যাহা গৃহীজনোচিত ছন্দ, যাহা গৃহীজনোচিত বিতর্ক তাহা পরিত্যাগ করিবে এবং এইরূপে শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে আমার চিত্ত বিপরিণত (বিকারপ্রাপ্ত) হইবে না, কোনো পাপবাক্য উচ্চারণ করিব না, সর্বভূতের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে দ্বেষ-ব্যবধানে অবস্থান করিব।’ এইরূপে ফাল্গুন, তুমি বিষয়টি শিক্ষা করিবে : যদি কেহ তোমার সম্মুখে পাণি দ্বারা, লোষ্ট্র দ্বারা, দণ্ড দ্বারা অথবা শস্ত্র দ্বারা ভিক্ষুণীদিগকে প্রহারও করে, তথাপি তুমি যাহা গৃহীজনোচিত ছন্দ, যাহা গৃহীজনোচিত বিতর্ক তাহা পরিত্যাগ করিবে এবং এইভাবে শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে আমার চিত্ত বিপরিণত হইবে না, কোনো পাপবাক্য উচ্চারণ করিব না, সর্বভূতের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে দ্বেষ-ব্যবধানে অবস্থান করিব।’

যদি কেহ তোমার সম্মুখে তোমারই অখ্যাতিসূচক কোনো কথা বলে, তথাপি যাহা গৃহীজনোচিত ছন্দ, যাহা গৃহীজনোচিত বিতর্ক তাহা পরিত্যাগ করিবে এবং এইরূপে শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে আমার চিত্ত বিপরিণত হইবে না, কোনো পাপবাক্য উচ্চারণ করিব না, সর্বভূতের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে দ্বেষ-ব্যবধানে অবস্থান করিব।’

ফাল্গুন, যদি কেহ তোমাকে পাণি দ্বারা, লোষ্ট্র দ্বারা, দণ্ড দ্বারা অথবা শস্ত্র দ্বারা প্রহারও করে, তথাপি যাহা গৃহীজনোচিত ছন্দ, যাহা গৃহীজনোচিত বিতর্ক তাহা পরিত্যাগ করিবে এবং এইরূপে শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে আমার চিত্ত বিপরিণত হইবে না, কোনো পাপবাক্য উচ্চারণ করিব না, সর্বভূতের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে দ্বেষ-ব্যবধানে অবস্থান করিব।’

৩. অনন্তর ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে ভিক্ষুগণ, একসময় আমার ভিক্ষুশিষ্যগণ চিত্তসংযম সাধনা করিতেছিলেন, আমি তাহাদের ডাকিয়া কহিলাম, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমি একাসন-ভোজনমাত্র ভোজন করি, একাসন-ভোজন ভোজন করিয়া আমি অল্পাবাধ, অল্পাতঙ্ক, লঘুভাব, বল ও সুখবিহার কী, তাহা জানি। আইস, তোমরাও একাসন-ভোজন ভোজন করো, একাসন-ভোজন ভোজন করিয়া অল্পাবাধ, অল্পাতঙ্ক, লঘুভাব, বল ও সুখবিহার কী, তাহা জান।’ হে ভিক্ষুগণ, ওই সকল ভিক্ষুর মধ্যে আমাকে কোনো অনুশাসন প্রদান করিতে হয় নাই। শুধু স্মরণ করাইবার ভাবেই আমাকে ওই ভিক্ষুদিগকে যাহা কিছু বলিতে হইয়াছে। যদি, হে ভিক্ষুগণ, সুভূমিতে চৌরাস্তায় সুবিনীত-সুদান্ত-অশ্বযুক্ত রথ সুবিন্যস্ত কশাসহ স্থিত হয়, তাহা হইলে দক্ষ রথাচার্য দম্য-অশ্ব-সারথি তাহাতে আরোহন করিয়া বামহস্তে রশ্মি ও দক্ষিণহস্তে কশা গ্রহণপূর্বক রথখানিকে যেদিকে যেভাবে ইচ্ছা, কি সম্মুখে, কি পশ্চাতে চালনা করিতে পারেন, তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, ওই সকল ভিক্ষুর মধ্যে আমাকে কোনো অনুশাসন প্রদান করিতে হয় নাই, শুধু স্মরণ করাইবার ভাবেই আমাকে যাহা কিছু বলিতে হইয়াছে। অতএব, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা অকুশল ধর্ম পরিত্যাগ করো, কুশল ধর্মে আত্মনিয়োগ করো, তাহা করিলেই তোমরা এই ধর্মবিনয়ে ঋদ্ধি, সমৃদ্ধি ও বিপুলতা লাভ করিতে পারিবে। যদি কোনো গ্রাম বা নিগমের অদূরে স্থিত কোনো এক বৃহৎ শালবন (শালদূষক) এরণ্ড বৃক্ষ দ্বারা আবৃত হয় এবং যদি এমন কোনো অর্থকামী, হিতকামী ও যোগক্ষেমকামী ব্যক্তির আবির্ভাব হয়, যিনি যে-সমস্ত শালযষ্টি, শালকাণ্ড কুটিল ও ওজ-অপহারক সেই সমস্ত শালযষ্টি, শালকাণ্ড কুঠার দ্বারা কর্তন করিয়া বাহিরে নিক্ষেপ করেন এবং বনাভ্যন্তর সুবিশুদ্ধ করিবার ভাবে বিশোধন করেন, এবং যে-সকল শালযষ্টি ঋজু ও সুজাত সে-সকল শালযষ্টিকে সম্যকভাবে প্রতিপালন করেন, এবং তাহা করিবার ফলে ওই শালবন পরে বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি ও বিপুলতা লাভ করে। তেমনভাবেই হে ভিক্ষুগণ, তোমরা অকুশল ধর্ম পরিত্যাগ করো, কুশল ধর্মে আত্মনিয়োগ করো, তাহা হইলে তোমরাও এই ধর্মবিনয়ে ঋদ্ধি, সমৃদ্ধি ও বিপুলতা লাভ করিবে।

৪. পূর্বকালে এই শ্রাবস্তীতে বৈদেহিকা নাম্নী এক বিশিষ্টা গৃহিনী ছিলেন। তাহার এইরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ, সুযশ-সুনাম অভ্যুদ্গত হইয়াছিল যে, তিনি সুব্রতা, ভদ্রস্বভাবা এবং শান্তশীলা। কালী নামে তাঁহার জনৈকা দক্ষা, অনলসা এবং কুশলকর্মা দাসী ছিল। অনন্তর কালীদাসীর মনে এই চিন্তা উদিত হইল : ‘আমার আর্যপত্মীর এইরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ অভ্যুদ্গত হইয়াছে, সুযশ-সুনাম প্রচারিত হইয়াছে যে, তিনি সুব্রতা, ভদ্রস্বভাবা এবং শান্তশীলা। তিনি কি স্বভাবত শান্ত বলিয়াই কোপ প্রকাশ করেন না অথবা আমার কাজকর্ম সুসম্পাদিত দেখিয়াই স্বভাবে অশান্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি শান্তভাব অবলম্বন করেন এবং কোনো কোপ প্রকাশ করেন না? যাহা হউক, আমি তাঁহাকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করিয়া দেখিব।’ অতঃপর দাসী সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই নিদ্রা হইতে উঠিল। তাহা দেখিয়া গৃহিনী দাসীকে কহিলেন, ‘কী লো, কালী!’ ‘কী, মা!’ ‘তুই যে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই উঠিলি?’ ‘এ তো তেমন কিছু নয়, মা!’ ‘পাপিষ্ঠা, তুই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উঠিলি, অথচ বলিতেছিস, এ কিছুই নয়, মা!’ এইভাবে তিনি কুপিতা ও অপ্রসন্না হইয়া ভ্রূকুটি করিলেন। তখন কালীদাসীর মনে চিন্তা হইল : ‘এই বিষয়ে আমি তাঁহাকে আরও অধিক পরীক্ষা করিয়া দেখিব’, এই ভাবিয়া সে একদিন আরও দেরি করিয়া নিদ্রা হইতে উঠিল। সেদিনও গৃহিনী তাহাকে লক্ষ করিয়া কহিলেন, ‘কী লো, কালী!’ ‘কী, মা!’ ‘আজ যে তুই আরও দেরি করিয়া উঠিলি!’ ‘এ তো তেমন কিছু নয়, মা!’ “পাপিষ্ঠা, তুই আরও দেরি করিয়া উঠিলি, অথচ বলিতেছিস, ‘এ তো তেমন কিছু নয়, মা!’” এইভাবে তিনি কুপিতা ও অপ্রসন্না হইয়া অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করিলেন। অতঃপর কালীর মনে এই চিন্তা উদিত হইল : ‘আমি তাঁহাকে আরও অধিক পরীক্ষা করিয়া দেখিব।’ তারপর একদিন সে আরও দেরি করিয়া নিদ্রা হইতে উঠিল। সেদিনও তিনি তাহাকে লক্ষ করিয়া কহিলেন, ‘কী লো, কালী!’ ‘কী, মা!’ ‘তুই যে আরও দেরি করিয়া উঠিলি?’ ‘এ তো কিছুই নয়, মা!’ “পাপিষ্ঠা, তুই আরও দেরি করিয়া উঠিলি, অথচ বলিতেছিস, ‘এ তো কিছুই নয়, মা!’” এইভাবে গৃহিনী আরও কুপিতা ও অপ্রসন্না হইয়া অর্গলসূচি (দ্বারদ-) লইয়া দাসীর শিরে আঘাত করিলেন এবং মাথা ফাটাইয়া দিলেন। দাসী রক্তগলগলমান ফাটা-মাথা লইয়াই প্রতিবেশীদিগকে ডাকিয়া বলিল, ‘ওহে, দেখ দেখ, আমার সুব্রতা গৃহস্বামিনীর কার্য, ভদ্রস্বভাবার কার্য, শান্তশীলার কার্য, কীরূপে তিনি মাত্র এক দাসীর দেরিতে উঠার অপরাধে কুপিতা ও অপ্রসন্না হইয়া অর্গলসূচি হাতে লইয়া শিরে আঘাত করেন এবং মাথা ফাটাইয়া দেন!’ তাহা করিবার ফলে পরে বৈদেহিকা গৃহিনীর এইরূপ অকীর্তি-শব্দ অভ্যুদ্গত হইল, কুযশ-কুনাম প্রচারিত হইল যে, বৈদেহিকা গৃহিনী চণ্ডস্বভাবা, অধীরা, অশান্তশীলা। তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো ভিক্ষু অতি সুব্রত, সুশান্ত এবং শান্তশীল হয়, যে পর্যন্ত না কোনো অমনোজ্ঞ ও অপ্রিয় বাক্য তাহাকে স্পর্শ করে। যে মুহূর্তে তাহাকে কোনো অমনোজ্ঞ ও অপ্রিয় বাক্য স্পর্শ করে তখনোই জানিতে হয়, সে সুব্রত, সুশান্ত ও শান্তশীল কি না। হে ভিক্ষুগণ, আমি সেই ভিক্ষুকে সুবচ বলি না, যদি সে চীবর, পিণ্ডপাত, শয্যাসন, রোগীপথ্য ও ভৈষজ্যোপকরণ লাভহেতু সুবচ হয়, এবং সুবচভাব গ্রহণ করে। ইহার কারণ কী? যেহেতু চীবর, পিণ্ডপাত, শয্যাসন, রোগীপথ্য ও ভৈষজ্যোপকরণ লাভ করিতে না পারিলে সে আর সুবচ হইবে না, সুবচভাবও অবলম্বন করিবে না।

যে ভিক্ষু ধর্মকেই সৎকার-সম্মান করিয়া, ধর্মকেই গুরুস্বরূপ করিয়া, ধর্মকেই মানিয়া, পূজিয়া, সংবর্ধনা করিয়া সুবচ হন, সুবচভাব অবলম্বন করেন, তাঁহাকে আমি যথার্থ সুবচ বলি। অতএব, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এইরূপে শিক্ষা করিবে : ‘আমরা ধর্মকেই সম্মান-সৎকার করিয়া, ধর্মকেই গুরুস্বরূপ করিয়া, মানিয়া, পূজিয়া, সংবর্ধনা করিয়া সুবচ হইব, সুবচভাব অবলম্বন করিব।’ তোমরা ইহাই শিক্ষা করিবে।

৫. হে ভিক্ষুগণ, এই পঞ্চবচনপথে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহা বলিবার বলিতে পারে : কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে। কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহাই বলুক না কেন, তোমরা কিন্তু তদ্‌বিষয়ে এইরূপ শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে যেন আমাদের চিত্ত বিপরিণত (বিকারপ্রাপ্ত) না হয়, আমরা কোনো পাপবাক্য উচ্চারণ না করি, দ্বেষবশবর্তী না হইয়া সকলের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করি। ওই সকল ব্যক্তিকে মৈত্রীসহগত-চিত্তে স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করি। তদবলম্বনে সর্বলোক বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয়, অবৈর এবং অব্যাপন্ন-চিত্তে স্ফুরিত করিয়া মৈত্রীসহগত-চিত্তে অবস্থান করি।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এইরূপেই বিষয়টি শিক্ষা করিবে। কোনো এক ব্যক্তি কোদাল ও পেটক লইয়া বলিল, ‘আমি এই মহাপৃথিবীকে নিষ্পৃথিবী (অপৃথিবী) করিব।’ ‘পৃথিবী নিষ্পৃথিবী হও, পৃথিবী নিষ্পৃথিবী হও’ বলিতে বলিতে সে এখানে-সেখানে মৃত্তিকা খনন করিয়া ইতস্তত তাহা বিদীর্ণ করিল। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি মনে করো যে, ওই ব্যক্তি তাহার এই কার্যের দ্বারা এই মহাপৃথিবীকে নিষ্পৃথিবী করিতে পারিবে? ‘না প্রভো, ইহা সম্ভব নহে।’ ইহার কারণ কী? ‘প্রভো, ইহার কারণ এই যে, এই মহাপৃথিবী সুগভীর, অপ্রমেয়, উহাকে নিষ্পৃথিবী করা সহজ নহে, পৃথিবীকে নিষ্পৃথিবী করিতে গেলে এই ব্যক্তি শুধু শ্রমক্লান্ত এবং দুঃখভাগীই হইবে।’ তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, এই পঞ্চবচনপথে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহা বলিতে হয় বলিবে, কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে। কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহাই বলুক না কেন, তোমরা কিন্তু তদ্‌বিষয়ে এইরূপ শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে যেন আমাদের চিত্ত বিপরিণত না হয়, আমরা পাপবাক্য উচ্চারণ না করি, দ্বেষবশবর্তী না হইয়া আমরা যেন সকলের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করি, ওই ব্যক্তিকে মৈত্রীসহগত চিত্তে স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করি, তদবলম্বনে সর্বলোক বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয়, অবৈর এবং অব্যাপন্ন চিত্তে স্ফুরিত করিয়া মৈত্রীসহগত চিত্তে অবস্থান করি।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এইরূপেই বিষয়টি শিক্ষা করিবে।

৬. হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, কোনো এক ব্যক্তি লাক্ষা বা হরিদ্রা, নীল অথবা মঞ্জিষ্ঠা বর্ণ লইয়া বলিল, ‘আমি এই আকাশে চিত্র অঙ্কন করিব, প্রতিবিম্ব প্রকটিত করিব।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি মনে করো যে, এই ব্যক্তি সত্যসত্যই আকাশে চিত্র অঙ্কিত করিয়া প্রতিবিম্ব প্রকটিত করিতে পারিবে? ‘না প্রভো, ইহা সম্ভব নহে।’ ‘ইহার কারণ কী?’ ‘প্রভো, ইহার কারণ এই যে, আকাশ অরূপী, অনিদর্শন (অদৃশ্য), তাহাতে চিত্রাঙ্কন করিয়া প্রতিবিম্ব প্রকটিত করা সম্ভব নহে, তাহা করিবার চেষ্টা করিলে ওই ব্যক্তি শুধু শ্রমক্লান্ত ও দুঃখভাগী হইবে।’ তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, এই পঞ্চবচনপথে অপরে যাহা বলিবার বলিবে, কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে। কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহাই বলুক না কেন, তোমরা কিন্তু তদ্‌বিষয়ে এইরূপ শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে যেন আমাদের চিত্ত বিপরিণত না হয়, আমরা পাপবাক্য উচ্চারণ না করি, দ্বেষবশবর্তী না হইয়া সকলের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করি, ওই ব্যক্তিকে মৈত্রীসহগত চিত্তে স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করি, তদবলম্বনে সর্বলোক বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয়, অবৈর এবং অব্যাপন্ন চিত্তে স্ফুরিত করিয়া মৈত্রীসহগত চিত্তে অবস্থান করি।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা বিষয়টি এইরূপে শিক্ষা করিবে।

৭. হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, কোনো এক ব্যক্তি দীপ্ত মশালহস্তে আসিয়া বলিল, ‘আমি এই দীপ্ত মশাল দ্বারা গঙ্গানদী সন্তপ্ত করিব, সম্পরিতপ্ত করিব।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি মনে করো যে, ওই ব্যক্তি সত্যসত্যই ওই দীপ্ত মশাল দ্বারা গঙ্গানদী সন্তপ্ত ও সম্পরিতপ্ত করিতে পারিবে? ‘না প্রভো, ইহা সম্ভব নহে।’ ইহার কারণ কী? ‘প্রভো, ইহার কারণ এই যে, গঙ্গানদী সুগভীরা, অপ্রমেয়া, সামান্যদীপ্ত মশাল দ্বারা তাহা সন্তপ্ত ও সম্পরিতপ্ত করা সহজ নহে, তাহা করিবার চেষ্টা করিলে ওই ব্যক্তি নিজেই সন্তপ্ত ও দুঃখভাগী হইবে।’ তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, এই পঞ্চবচনপথে অপরে যাহা বলিবার বলিবে, কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে। কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহাই বলুক না কেন, তোমরা কিন্তু তদ্‌বিষয়ে এইরূপ শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে যেন আমাদের চিত্ত বিপরিণত না হয়, আমরা পাপবাক্য উচ্চারণ না করি, দ্বেষবশবর্তী না হইয়া, সকলের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করি, ওই ব্যক্তিকে মৈত্রীসহগত চিত্তে স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করি, তদবলম্বনে সর্বলোক বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয়, অবৈর এবং অব্যাপন্ন চিত্তে স্ফুরিত করিয়া মৈত্রীসহগত চিত্তে অবস্থান করি।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা বিষয়টি এইরূপে শিক্ষা করিবে।

৮. হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, এখানে একটি মর্দিত, সুমর্দিত, সুপরিমর্দিত, সুকোমল, শিমুল তুলার ন্যায় নরম, সরসর ভরভর শব্দবিহীন বিড়ালচর্মনির্মিত থলি আছে। মনে করো, কোনো এক ব্যক্তি কাঠ বা কাঠিহস্তে আসিয়া বলিল, ‘আমি এই কাঠির দ্বারা এই মর্দিত, সুমর্দিত, সুপরিমর্দিত, সুকোমল, শিমুল তুলার ন্যায় নরম, সরসর ভরভর শব্দবিহীন বিড়ালচর্মনির্মিত থলিতে সরসর ভরভর শব্দ উৎপাদন করিব।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি মনে করো যে, এই ব্যক্তি কাঠি দ্বারা ওই বিড়ালচর্মনির্মিত থলিতে সরসর ভরভর শব্দ উৎপাদন করিতে পারিবে? ‘না প্রভো, ইহা সম্ভব নহে।’ ইহার কারণ কী? ‘প্রভো, ইহার কারণ এই যে, ওই বিড়ালচর্মনির্মিত থলি মর্দিত, সুমর্দিত, সুপরিমর্দিত, সুকোমল শিমুল তুলার ন্যায় নরম, সরসর ভরভর শব্দবিহীন; কাঠ বা কাঠির দ্বারা তাহাতে সরসর ভরভর শব্দ উৎপাদন করা সহজ নহে, তাহা করিবার চেষ্টা করিলে ওই ব্যক্তিই নিজে শ্রমক্লান্ত ও দুঃখভাগী হইবে।’ তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, এই পঞ্চবচনপথে অপরে যাহা বলিবার বলিবে : কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে। কালে বা অকালে, যথা বা অযথা, মধুর বা কর্কশভাবে, অর্থত বা অনর্থত, মৈত্রীচিত্তে বা দ্বেষবশে অপরে তোমাদের সম্বন্ধে যাহাই বলুক না কেন, তোমরা কিন্তু তদ্‌বিষয়ে এইরূপ শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে যেন আমাদের চিত্ত বিপরিণত না হয়, আমরা পাপবাক্য উচ্চারণ না করি, দ্বেষবশবর্তী না হইয়া সকলের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করি, ওই ব্যক্তিকে মৈত্রীসহগত চিত্তে স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করি; তদবলম্বনে সর্বলোক বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয়, অবৈর এবং অব্যাপন্ন চিত্তে স্ফুরিত করিয়া মৈত্রীসহগত চিত্তে অবস্থান করি।’ হে ভিক্ষুগণ, বিষয়টি এইরূপে শিক্ষা করিবে।

৯. হে ভিক্ষুগণ, যদি চোর অথবা কোনো নীচকর্মা তস্কর উভয়দিকে বাঁটযুক্ত ককচ দ্বারা তোমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কর্তনও করে, তাহাতে তোমাদের মধ্যে যে মনকে প্রদূষিত করিবে, সে আমার শাসনকর, আজ্ঞাবহ শিষ্য নহে। হে ভিক্ষুগণ, সেক্ষেত্রেও তোমরা বিষয়টি এইরূপে শিক্ষা করিবে : ‘ইহাতে আমাদের চিত্ত বিপরিণত হইবে না, কর্কশ বাক্য উচ্চারণ করিব না, দ্বেষবশবর্তী না হইয়া সকলের হিতানুকম্পী হইয়া মৈত্রীচিত্তে অবস্থান করিব, মৈত্রীসহগত চিত্তে ওই ব্যক্তিকে স্ফুরিত করিয়া তদবলম্বনে সর্বলোক মৈত্রীসহগত, বিপুল, মহদ্গত অপ্রমেয়, অবৈর ও অব্যাপন্ন চিত্তে স্ফুরিত করিয়া অবস্থান করিব।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এইরূপে বিষয়টি শিক্ষা করিবে।

হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এই ককচোপম উপদেশ অনুক্ষণ মনে রাখিবে, সাবধানে দেখিবে, যেন তোমাদের সম্বন্ধে অপরের এইরূপ অণু বা স্থূল কোনো উক্তি তোমরা পোষণ না করো। ‘প্রভো, আমরা তাহা পোষণ করিব না।’ অতএব, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এই ককচোপম উপদেশ অনুক্ষণ মনে রাখিবে, যেহেতু তাহা তোমাদের পক্ষে দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হইবে। ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন।

ভিক্ষুগণ তাহা প্রসন্নমনে শ্রবণ করিয়া আনন্দ প্রকাশ করিলেন।

ককচোপম-সূত্র সমাপ্ত।

The Middle Discourses

|_A. The First Fifty

|__III. The Chapter of Similes

MN21. ককচোপম-সূত্র

Translations [32]

English

繁體字

日本語

한국어

Français

Deutsch

Italiano

Español

Português

Русский

Nederlands

Norsk

Magyar

Srpski

Čeština

Slovenščina

Lietuvių Kalba

हिंदी

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference