আমি এইরূপ শুনিয়াছি।

১. একসময় ভগবান শ্রাবস্তী-সমীপে অবস্থান করিতেছিলেন, জেতবনে, অনাথপিণ্ডিকের আরামে। সেই সময় পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট নামে জনৈক ভিক্ষুর এইরূপ পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছিল : ‘আমি ভগবৎ-দেশিত ধর্ম এমনভাবে জানি যাহাতে ভগবান যে-সকল পাপধর্ম অন্তরায়কর মনে করেন সে-সকল ধর্ম অনুশীলন করিলে উহারা অন্তরায় ঘটাইবে না।’ বহুসংখ্যক ভিক্ষু শুনিতে পাইলেন যে, পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুর মধ্যে এইরূপ পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে। অতঃপর তাঁহারা পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুর নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘সত্যই কি, অরিষ্ট, তোমার মধ্যে এইরূপ মিথ্যাদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে : তুমি ভগবদ্দেশিত ধর্ম এমনভাবে জান যাহাতে তিনি যে-সকল ধর্ম অন্তরায়কর বলেন সে-সকল ধর্ম অনুশীলন করিলে উহারা তোমার পক্ষে অন্তরায়কর হইবে না?’ ‘হাঁ, তাহাই বটে।’ ওই ভিক্ষুগণ পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুকে এই পাপদৃষ্টি হইতে মুক্ত করিবার মানসে সমনুযুক্ত, সমনুগ্রাহী (সমনুগ্রাহী?) এবং সমনুভাষী হইয়া কহিলেন, ‘অরিষ্ট, তুমি এমন কথা বলিও না, ভগবানের অপবাদ করিও না, ভগবানের অপবাদ করা ভালো নহে, ভগবান কিছুতেই এইরূপ কথা কখনও বলিবেন না। অরিষ্ট, ভগবান বহুপর্যায়ে (বহুপ্রকারে) অন্তরায়কর ধর্মকে অন্তরায়কর বলিয়াছেন, যে-সকল ধর্ম আচরণ করিলে অন্তরায় ঘটাইবে। অরিষ্ট, ভগবান বহুপর্যায়ে বলিয়াছেন : অল্পাস্বাদ কাম বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, ইহাতে আদীনবই অত্যধিক। কাম অস্থিকঙ্কালসদৃশ, মাংসপেশিসদৃশ৫, তৃণোল্কাসদৃশ, অঙ্গারিসদৃশ, স্বপ্নসদৃশ, যাচিতকসদৃশ বিষবৃক্ষের ফলসদৃশ, অসিধারাসদৃশ, শক্তিশূলসদৃশ, সর্পশিরসদৃশ, বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, ইহাতে আদীনবই অত্যধিক।’ ভিক্ষুগণ দ্বারা পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষু এইরূপে সমনুযুক্ত, সমনুগ্রাহিত এবং সমনুভাষিত হইয়াও ওই পাপদৃষ্টি আঁকড়াইয়া ধরিয়া উহাতে অভিনিবিষ্ট হইয়া রহিলেন : ‘আমি ভগবদ্দেশিত ধর্ম এমনভাবে জানি যাহাতে তিনি যে-সকল পাপধর্ম অন্তরায়কর বলিয়াছেন সে-সকল ধর্ম আচরণ করিলে অন্তরায় ঘটায় না।’

২. ওই ভিক্ষুগণ পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুকে পাপদৃষ্টি হইতে বিচ্যুত করিতে না পারিয়া ভগবৎ-সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন; উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহারা ভগবানের নিকট সকল বিষয় যথাযথ বিবৃত করিয়া কহিলেন, ‘প্রভো, পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুকে এই পাপদৃষ্টি হইতে বিচ্যুত করিতে না পারিয়া এ বিষয় আপনাকে জানাইতেছি।’

৩. অনন্তর ভগবান জনৈক ভিক্ষুকে আহ্বান করিলেন, ভিক্ষু, এদিকে আইস, তুমি আমার আদেশে পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুকে গিয়া বলো : ‘শাস্তা তোমাকে ডাকিয়াছেন।’ ‘যথা আজ্ঞা, প্রভো’ বলিয়া ওই ভিক্ষু পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুর নিকট উপস্থিত হইলেন; উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘অরিষ্ট, শাস্তা তোমায় ডাকিয়াছেন।’ ‘তথাস্তু বলিয়া অরিষ্ট ভিক্ষু ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন; উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুকে ভগবান কহিলেন, সত্যই কি, অরিষ্ট, তোমার এইরূপ পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে : তুমি ভগবদ্দেশিত ধর্ম এমনভাবে জান যাহাতে তিনি যে-সকল ধর্ম অন্তরায়কর বলিয়াছেন সে-সকল ধর্ম আচরণ করিলে অন্তরায় ঘটাইবে না। ‘প্রভো, তাহাই বটে।’ তুমি মোঘপুরুষ (মূর্খ)। আমি এইরূপ ধর্মদেশনা করিয়াছি তুমি কাহার নিকট জানিলে? আমি কি বহুপর্যায়ে অন্তরায়কর ধর্মকে অন্তরায়কর বলি নাই, যে-সকল ধর্ম আচরণ করিলে অন্তরায় ঘটাইবেই? আমি কি এ কথা বলি নাই যে, অল্পাস্বাদ কাম বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, ইহাতে আদীনবই অত্যধিক? আমি কি আরও বলি নাই যে, কাম অস্থিকঙ্কালসদৃশ, মাংসপেশিসদৃশ, তৃণোল্কাসদৃশ, অঙ্গারিসদৃশ, স্বপ্নসদৃশ, যাচিতকসদৃশ, বিষবৃক্ষের ফলসদৃশ, অসিধারাসদৃশ, শক্তিশূলসদৃশ, সর্পশিরসদৃশ, বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, ইহাতে আদীনবই অত্যধিক? অথচ তুমি নিজে আমার উক্তি কদর্থে গ্রহণ করিয়া আমাকেও নিন্দিত করিতেছ, নিজের জন্যও গর্ত খনন করিতেছ এবং বহু অপুণ্য প্রসব করিতেছ। ইহা তোমার পক্ষে দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের কারণ হইবে। অতঃপর ভগবান অন্যান্য ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন, তোমরা কি মনে করো যে, পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষু এই ধর্মবিনয়ে জ্ঞানদীপ্ত হইয়াছে? ‘প্রভো, ইহা কি সম্ভব? তাহার এমন কী আছে যে, সে এইরূপ হইবে? না, তাহার পক্ষে তাহা সম্ভব নহে।’ এ কথা বলিলে পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষু তূষ্ণীম্ভূত, মঙ্কুভূত (নিস্তেজ), অধোশির, অধোবদন, নিষ্পন্দ ও নীরব হইয়া রহিলেন।

৪. অনন্তর ভগবান পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষুকে তূষ্ণীম্ভূত, মঙ্কুভূত (নির্বাক; ভগ্নোৎসাহ), অধোশির, অধোবদন, নিষ্পন্দ ও নীরব দেখিয়া কহিলেন, মোঘপুরুষ, তুমি তোমার নিজ পাপদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হইবে, আমি এখন অপরাপর ভিক্ষুদিগকে এই বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব। অনন্তর তিনি ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি জান যে, আমি এইরূপে কোনো ধর্মোপদেশ প্রদান করিয়াছি যাহা কদর্থে গ্রহণ করিয়া এই পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষু আমাকে নিন্দিত করিতেছে, নিজের জন্যও গর্ত খনন করিতেছে এবং বহু অপুণ্য প্রসব করিতেছে? ‘না প্রভো, আমরা এইরূপ জানি না। প্রভো, আমরা এইরূপ জানি যে, ভগবান বহুপর্যায়ে অন্তরায়কর ধর্মকে অন্তরায়কর বলিয়াছেন, যে-সকল অন্তরায়কর ধর্ম আচরণ করিলে অন্তরায় ঘটাইবেই। আমরা ইহাও জানি যে, ভগবান বলিয়াছেন, অল্পাস্বাদ কাম বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, কামে আদীনবই অত্যধিক। আমরা জানি যে, ভগবান বলিয়াছেন, কাম অস্থিকঙ্কালসদৃশ, মাংসপেশিসদৃশ, তৃণোল্কাসদৃশ, অঙ্গারিসদৃশ, স্বপ্নসদৃশ, যাচিতকসদৃশ, বিষবৃক্ষের ফলসদৃশ, অসিধারাসদৃশ, শক্তিশূলসদৃশ, সর্পশিরসদৃশ, বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, ইহাতেই আদীনবই অত্যধিক।’ হে ভিক্ষুগণ, তাহা হইলে আমি বহুপর্যায়ে অন্তরায়কর ধর্মকে অন্তরায়কর বলিয়াছি, যে-সকল অন্তরায়কর ধর্ম আচরণ করিলে অন্তরায় ঘটাইবেই। তাহা হইলে আমি বলিয়াছি, অল্পাস্বাদ কাম বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, কামে আদীনবই অত্যধিক, কাম অস্থিকঙ্কালসদৃশ, মাংসপেশিসদৃশ, তৃণোল্কাসদৃশ, অঙ্গারিসদৃশ, স্বপ্নসদৃশ, যাচিতকসদৃশ, বিষবৃক্ষের ফলসদৃশ, অসিধারাসদৃশ, শক্তিশূলসদৃশ, সর্পশিরসদৃশ, বহু দুঃখজনক, বহু নিরাশার কারণ, ইহাতে আদীনবই অত্যধিক। হে ভিক্ষুগণ, তাহা হইলে আমি বহুপর্যায়ে বহুপ্রকারে অন্তরায়কর ধর্মকে অন্তরায়কর বলিয়াছি, অথচ এই পূর্বগৃধ্রবধক অরিষ্ট ভিক্ষু কদর্থে আমার উক্তি গ্রহণ করিয়া আমাকে নিন্দিত করিতেছে, নিজেরও গর্ত খনন করিতেছে এবং বহু অপুণ্য প্রসব করিতেছে। তাহা হইলে ইহা সত্যসত্যই তাহার ন্যায় মোঘপুরুষের পক্ষে দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের কারণ হইবে। হে ভিক্ষুগণ, সে যে কাম বিনা, কামসংজ্ঞা বিনা, কামবিতর্ক বিনা কাম প্রতিসেবন করিবে, এহেন সম্ভাবনা নাই।

৫. হে ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো মোঘপুরুষ (মৎকথিত) ধর্ম অধ্যয়ন করে; যথা : সূত্র, গেয়, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইত্যুক্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্য। তাহারা এই ধর্ম অধ্যয়ন করিয়া প্রজ্ঞা দ্বারা ইহার অর্থ উপপরীক্ষা করে না, প্রজ্ঞা দ্বারা তাহারা ধর্মের অর্থ উপপরীক্ষা করে না বলিয়া নিধ্যান তাহাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাহারা পরমত নিরস্ত এবং স্বমত সমর্থন করিবার আকাঙ্ক্ষা লইয়া ধর্ম অধ্যয়ন করে, তাহা করিতে গিয়া যে-জন্য তাহারা ধর্ম অধ্যয়ন করে তাহা তাহাদের অনুভূতিতে আসে না। সেই ধর্ম ভিন্নার্থে গ্রহণ করায় তাহা তাহাদের পক্ষে দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের কারণ হয়। ইহার কারণ কী? যেহেতু উপদিষ্ট ধর্ম তাহারা ভিন্নার্থে গ্রহণ করিয়াছে। হে ভিক্ষুগণ, মনে করো অলগর্দ-অর্থী, অলগর্দ-গবেষক জনৈক ব্যক্তি অলগর্দ-অন্বেষণে বিচরণ করিতে করিতে এক বৃহৎ অলগর্দ (আশীবিষ) দেখিতে পাইল এবং উহার দেহমধ্যে কিংবা নঙ্গুষ্ঠে (লেজে) ধরিল, অলগর্দ উলটিয়া তাহার হস্তে বা বাহুতে বা অপর কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে দংশন করিল। মনে করো, সে তৎকারণে মৃত্যুকবলে গমন করিল কিংবা মৃত্যুসম দুঃখ পাইল। ইহার কারণ কী? যেহেতু সে অলগর্দের দেহের যথাস্থানে ধরিতে পারে নাই। তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো মোঘপুরুষ মৎকথিত ধর্ম অধ্যয়ন করে; যথা : সূত্র, গেয়, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইত্যুক্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্য। তাহারা এই ধর্ম অধ্যয়ন করিয়া প্রজ্ঞা দ্বারা ইহার অর্থ উপপরীক্ষা করে না, প্রজ্ঞা দ্বারা তাহারা ধর্মের অর্থ উপপরীক্ষা করে না বলিয়া নিধ্যান তাহাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাহারা পরমত খণ্ডন ও স্বমত সমর্থন করিবার আকাঙ্ক্ষা লইয়া ধর্ম অধ্যয়ন করে। তাহা করিতে গিয়া যে কারণে তাহারা ধর্ম অধ্যয়ন করে তাহা তাহাদের অনুভূতিতে আসে না। সেই ধর্ম ভিন্নার্থে গ্রহণ করায় তাহা তাহাদের পক্ষে দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের কারণ হয়। ইহার কারণ কী? যেহেতু উপদিষ্ট ধর্ম তাহারা ভিন্নার্থে গ্রহণ করিয়াছে।

৬. হে ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো কুলপুত্র আমার উপদিষ্ট ধর্ম অধ্যয়ন করেন; যথা : সূত্র, গেয়, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইত্যুক্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্য। তাঁহারা তাহা অধ্যয়ন করিয়া প্রজ্ঞা দ্বারা তাহা উপপরীক্ষা করেন। প্রজ্ঞা দ্বারা ধর্ম উপপরীক্ষা করিবার ফলে তাঁহাদের পক্ষে নিধ্যান সম্ভব হয়। তাঁহারা পরমত খণ্ডন ও স্বমত সমর্থন আকাঙ্ক্ষায় ধর্ম অধ্যয়ন করেন না, যে উদ্দেশ্যে তাঁহারা ধর্ম অধ্যয়ন করেন তাহা তাঁহাদের নিকট অনুভূত হয়। তাঁহাদের পক্ষে সুগৃহীত ধর্ম হিত ও সুখের কারণ হয়। ইহার কারণ কী? যেহেতু তাঁহারা সুভাবেই ধর্মার্থ গ্রহণ করিয়াছেন। হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, অলগর্দ-অর্থী, অলগর্দ-গবেষক জনৈক ব্যক্তি অলগর্দ-অন্বেষণে বিচরণ করিতে করিতে এক বৃহৎ অলগর্দ দেখিতে পাইল। মনে করো, সে অজপাদ-দণ্ডের (চিমটির) দ্বারা অলগর্দকে নিশ্চল করিয়া হস্ত দ্বারা উহার গ্রীবা শক্ত করিয়া ধরিল। তখন সেই অলগর্দ স্বীয় দেহকুণ্ডল দ্বারা ওই ব্যক্তির হস্ত বা বাহু বা অপর কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেষ্টন করুক না কেন, তৎকারণে সে মৃত্যুকবলে গমন করিবে না অথবা মৃত্যুসম দুঃখ পাইবে না। ইহার কারণ কী? যেহেতু সে অলগর্দের দেহ যথাস্থানে ধরিয়াছে। তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো কুলপুত্র মৎকথিত ধর্ম অধ্যয়ন করেন; যথা : সূত্র, গেয়, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইত্যুক্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্য। তাঁহারা তাহা অধ্যয়ন করিয়া প্রজ্ঞা দ্বারা তাহা উপপরীক্ষা করেন, প্রজ্ঞা দ্বারা ধর্ম উপপরীক্ষা করিবার ফলে তাঁহাদের পক্ষে নিধ্যান সম্ভব হয়। তাঁহারা পরমত খণ্ডন ও স্বমত সমর্থন করিবার আকাঙ্ক্ষায় ধর্ম অধ্যয়ন করেন না, যে উদ্দেশ্যে তাঁহারা ধর্ম অধ্যয়ন করেন তাহা তাঁহাদের নিকট অনুভূত হয়। তাঁহাদের পক্ষে সুগৃহীত ধর্ম হিত ও সুখের কারণ হয়। ইহার কারণ কী? যেহেতু তাঁহারা সুভাবেই ধর্মার্থ গ্রহণ করিয়াছেন। অতএব, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মৎকথিত যে ধর্মের অর্থ যেভাবে আমা হইতে জান, তাহা সেইভাবে অবধারণ করো, মৎকথিত যে ধর্মের অর্থ তোমরা ঠিক জান না তদ্‌বিষয়ে তোমরা আমাকে কিংবা কোনো দক্ষ ভিক্ষুকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবে। হে ভিক্ষুগণ, আমি তোমাদের নিকট কুল্লোপম (ভেলোপম) ধর্মোপদেশ প্রদান করিব, নিস্তারের জন্য, অস্মিতাদি মিথ্যাদৃষ্টি গ্রহণের জন্য নহে। তোমরা তাহা শ্রবণ করো, উত্তমরূপে মনোনিবেশ করো, আমি তাহা বিবৃত করিতেছি। ‘যথা আজ্ঞা, প্রভো’ বলিয়া ভিক্ষুগণ প্রত্যুত্তরে সম্মতিজ্ঞাপন করিলেন। ভগবান কহিলেন :

৭. হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, দীর্ঘপথযাত্রী জনৈক ব্যক্তি দেখিতে পাইল, তাহার সম্মুখে এক মহার্ণব, মহোদধি রহিয়াছে, যাহার এই তীর ভয়সংকুল এবং অপর তীর ক্ষেম ও অভয়পূর্ণ। তাহার নিকট না আছে ‘তরণের নৌকা’, না আছে ‘পরপারে গমনের সেতু।’ তখন তাহার মনে হইল, ‘এই তো আমার সম্মুখে এক মহার্ণব মহোদধি, যাহার এই তীর ভয়সংকুল এবং অপর তীর ক্ষেম ও অভয়পূর্ণ, এদিকে আমার না আছে তরণের নৌকা, না আছে পরপারে গমনের সেতু। তাহা হইলে কি আমি তৃণকাষ্ঠ, শাখাপলাশ সংগ্রহ করিয়া কুল্ল বাঁধিয়া তাহা অবলম্বনে হস্তপদে বাহিয়া নিরাপদে সাগরপারে উত্তীর্ণ হইব?’ এই ভাবিয়া ওই ব্যক্তি তৃণকাষ্ঠ ও শাখাপলাশ সংগ্রহ করিয়া কুল্ল বাঁধিয়া তাহা অবলম্বনে হস্তপদে বাহিয়া নিরাপদে সাগরপারে উত্তীর্ণ হইল। পরপারে উত্তীর্ণ (পারগত) হইয়া তাহার মনে হইল : ‘এই কুল্ল (ভেলা) আমার পক্ষে বহু উপকারী, যেহেতু আমি ইহাই অবলম্বনস্বরূপ করিয়া হস্তপদে বাহিয়া নিরাপদে পরপারে উত্তীর্ণ হইয়াছি, অতএব আমি ইহাকে একবার শিরে, একবার স্কন্ধে স্থাপন করিয়া যথেচ্ছা (ইচ্ছামতো) গমন করিব।’ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি মনে করো যে, তাহা করিতে গিয়া ওই ব্যক্তি ওই কুল্ল সম্পর্কে যুক্তকারী হইল? ‘না প্রভো, যুক্তকারী হইল না।’ তবে, হে ভিক্ষুগণ, কী করিলে ওই ব্যক্তি ওই কুল্ল সম্পর্কে যুক্তকারী হইবে? হে ভিক্ষুগণ, পরপারে উত্তীর্ণ হইয়া ওই ব্যক্তি মনে করিল, ‘এই কুল্ল আমার পক্ষে বহু উপকারী, যেহেতু ইহাকে অবলম্বনস্বরূপ করিয়া হস্তপদে বাহিয়া আমি নিরাপদে পরপারে উত্তীর্ণ হইয়াছি। এখন আমি ওই ভেলা স্থলে উঠাইয়া অথবা জলে ডুবাইয়া যথেচ্ছা গমন করিব।’ হে ভিক্ষুগণ, এইরূপ আচরণ করিলেই ওই ব্যক্তি ওই কুল্ল বিষয়ে যুক্তকারী হইবে। তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, আমি তোমাদের নিকট কুল্লোপম ধর্মোপদেশ প্রদান করিলাম, তাহা তোমাদের নিস্তারের জন্য, তদ্বারা কোনো মিথ্যাদৃষ্টি গ্রহণের জন্য নহে। এই যে আমি তোমাদের নিকট কুল্লোপম (ভেলোপম) ধর্মোপদেশ প্রদান করিলাম, যাহারা ইহার যথার্থ অর্থ জানিবে তাহারা (কথিত) ধর্মও পরিত্যাগ করিবে, অধর্ম তো পূর্বেই পরিত্যাগ করিবে।

৮. হে ভিক্ষুগণ, এই ছয় দৃষ্টিস্থান (মিথ্যাদৃষ্টির কারণ)। ছয় কী কী? হে ভিক্ষুগণ, অশ্রুতবান পৃথগ্‌জন, অনভিজ্ঞ সাধারণ জন, যিনি আর্যগণের দর্শন লাভ করেন নাই, যিনি আর্যধর্মে অকোবিদ, আর্যধর্মে অবিনীত, যিনি সৎপুরুষগণের দর্শন লাভ করেন নাই, সৎপুরুষধর্মে অকোবিদ, সৎপুরুষধর্মে অবিনীত, স্বজ্ঞানে দর্শন করেন : ‘এই রূপ আমার, আমিই রূপ, ইহা আমার আত্মা (নিজস্ব বস্তু)। এই বেদনা আমার, আমি বেদনা, ইহাই আমার আত্মা। এই সংজ্ঞা আমার, আমি সংজ্ঞা, ইহাই আমার আত্মা। এই সংস্কার আমার, আমি সংস্কার, ইহাই আমার আত্মা। যাহা কিছু দৃষ্ট, শ্রুত, মত (অনুমিত), বিজ্ঞাত, প্রাপ্ত, অন্বেষিত, মনের দ্বারা অনুবিচারিত তাহাও আমার, আমি তাহা, তাহাই আমার আত্মা। এই যে দৃষ্টিস্থান-সে-ই লোক (জগৎ) সে-ই আত্মা (নিজস্ব বস্তু), সে-ই আমি পরে হইব, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী আমি চিরকাল একইরূপে থাকিব, তাহাও আমার, আমি তাহা, তাহাই আমার আত্মা।’

[পক্ষান্তরে] হে ভিক্ষুগণ, শ্রুতবান আর্যশ্রাবক, যিনি আর্যগণের দর্শন লাভ করিয়াছেন, আর্যধর্মে কোবিদ, আর্যধর্মে সুবিনীত, যিনি সৎপুরুষগণের দর্শন লাভ করিয়াছেন, সৎপুরুষধর্মে কোবিদ, সৎপুরুষধর্মে সুবিনীত, স্বজ্ঞানে দর্শন করেন : ‘এই রূপ আমার নহে, আমি রূপ নহি, রূপ আমার আত্মা নহে। এই বেদনা আমার নহে, আমি বেদনা নহি, বেদনা আমার আত্মা নহে। এই সংজ্ঞা আমার নহে, আমি সংজ্ঞা নহি, সংজ্ঞা আমার আত্মা নহে। এই সংস্কার আমার নহে, আমি সংস্কার নহি, সংস্কার আমার আত্মা নহে। যাহা কিছু দৃষ্ট, শ্রুত, মত, বিজ্ঞাত, প্রাপ্ত, মনের দ্বারা অনুবিচারিত তাহাও আমার নহে, আমি তাহা নহি, তাহা আমার আত্মা নহে। এই যে দৃষ্টিস্থান-সে-ই লোক, সে-ই আত্মা, সে-ই আমি পরে হইব, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী আমি চিরকাল একইরূপে থাকিব, তাহাও আমার নহে, আমি তাহা নহি, তাহা আমার আত্মা নহে।’ এইরূপে সর্ব জ্ঞেয় বিষয় স্বজ্ঞানে দর্শন করিলে আমার বলিয়া কিছু না থাকায় তাঁহার পরিক্লেশ হয় না।

৯. ইহা বিবৃত হইলে জনৈক ভিক্ষু ভগবানকে কহিলেন, ‘প্রভো, বাহিরে আত্মবস্তুর অভাবে পরিক্লেশ হইতে পারে কী?’ ভগবান কহিলেন, ভিক্ষু, হইতে পারে। কাহারও কাহারও মনে হয় : ‘আমার যাহা ছিল তাহা এখন আমার নাই, যাহা আমার থাকা উচিত তাহা আমি পাই না’ এই ভাবিয়া সে অনুশোচনা করে, ক্লিষ্ট হয়, আর্তনাদ করে, ঊরু চাপড়াইয়া ক্রন্দন করে, সম্মোহপ্রাপ্ত হয়। ভিক্ষু, এইরূপে বাহিরে আত্মবস্তুর অভাবে তাঁহার পরিক্লেশ হয়।

‘প্রভো, বাহিরে আত্মবস্তুর অভাবে পরিক্লেশ না হইতে পারে কি?’ ভগবান কহিলেন, ভিক্ষু, না হইতেও পারে। কাহারও কাহারও মনে হয় : ‘আমার যাহা ছিল তাহা আমার নাই, যাহা আমার থাকা উচিত তাহা আমি পাই না।’ অথচ তিনি তজ্জন্য অনুশোচনা করেন না, ক্লিষ্ট হন না, আর্তনাদ করেন না, ঊরু চাপড়াইয়া ক্রন্দন করেন না, সম্মোহপ্রাপ্ত হন না। ভিক্ষু, এইরূপে বাহিরে আত্মবস্তুর অভাবে তাঁহার পরিক্লেশ হয় না।

‘প্রভো, অধ্যাত্মে আত্মবস্তুর অভাবে পরিক্লেশ হইতে পারে কি?’ ভগবান কহিলেন, ভিক্ষু, হইতে পারে। কাহারও কাহারও এইরূপ দৃষ্টি (বিশ্বাস) জন্মে : ‘সে-ই লোক সে-ই আত্মা, সে-ই আমি পরে হইব, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী আমি চিরকাল একইরূপে থাকিব।’ সে শুনিতে পায় তথাগত কিংবা কোনো তথাগত-শ্রাবক সর্বদৃষ্টি, দৃষ্টিস্থান, দৃষ্টি-অধিষ্ঠান (ভিত্তি), দৃষ্টি-পর্যুত্থান (বহিঃপ্রকাশ), দৃষ্টি-অভিনিবেশরূপী অনুশয়গুলি সমুৎপাটিত করিবার জন্য, সর্বসংস্কার উপশমিত করিবার জন্য, সর্বোপাধি পরিবর্জন করিবার জন্য, তৃষ্ণাক্ষয়-বিরাগ-নিরোধ (নামধেয়) নির্বাণ লাভের জন্য ধর্মোপদেশ প্রদান করিতেছেন। ইহাতে তাহার মনে হয় : ‘আমি সত্যই উচ্ছিন্ন হইব, সত্যই বিনষ্ট হইব, সত্যই আমি (পরে) হইব না।’ তজ্জন্য সে অনুশোচনা করে, ক্লিষ্ট হয়, আর্তনাদ করে, ঊরু চাপড়াইয়া ক্রন্দন করে, সম্মোহপ্রাপ্ত হয়। ভিক্ষু, এইরূপে অধ্যাত্মে আত্মবস্তুর অভাবে তাহার পরিক্লেশ হয়।

‘প্রভো, অধ্যাত্মে আত্মবস্তুর অভাবে পরিক্লেশ না হইতে পারে কি?’ ভগবান কহিলেন, ভিক্ষু, না হইতেও পারে। হে ভিক্ষুগণ, কাহারও কাহারও মনে হয় না : ‘সে-ই লোক সে-ই আত্মা, সে-ই আমি পরে হইব, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী আমি চিরকাল একইরূপে থাকিব।’ সে শুনিতে পায় তথাগত কিংবা কোনো তথাগত-শ্রাবক সর্বদৃষ্টি, দৃষ্টিস্থান, দৃষ্টি-অধিষ্ঠান, দৃষ্টি-পর্যুত্থান, দৃষ্টি-অভিনিবেশরূপী অনুশয়গুলি সমুৎপাটিত করিবার জন্য, সকল সংস্কার উপশমিত করিবার জন্য, সর্বোপাধি পরিবর্জনের জন্য, তৃষ্ণাক্ষয়-বিরাগ-নিরোধ-(নামধেয়) নির্বাণ লাভের জন্য ধর্মোপদেশ প্রদান করিতেছেন। ইহাতে তাঁহার মনে হয় না : ‘আমি সত্যই উচ্ছিন্ন হইব, সত্যই বিনষ্ট হইব, সত্যই পরে হইব না।’ তজ্জন্য তিনি অনুশোচনা করেন না, ক্লিষ্ট হন না, আর্তনাদ করেন না, ঊরু চাপড়াইয়া ক্রন্দন করেন না, সম্মোহপ্রাপ্ত হন না। ভিক্ষু, এইরূপেই অধ্যাত্মে আত্মবস্তুর অভাবে তাঁহার পরিক্লেশ হয় না।

১০. হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, তোমরা তেমন এক পরিগ্রহ (বহিরবস্তু) পরিগ্রহণ করিতে চাও যাহা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী এবং যাহা চিরদিন একইরূপে থাকিবে। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি তেমন কোনো পরিগ্রহ দেখিতে পাও যাহা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত ও অবিপরিণামী এবং যাহা চিরদিন একইরূপে থাকিবে? ‘না, প্রভো।’ সাধু, হে ভিক্ষুগণ, আমিও তেমন কোনো পরিগ্রহ দেখি না যাহা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী এবং যাহা চিরদিন একইরূপে থাকিবে। হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, তোমরা তেমন এক আত্মবাদ-উপাদান গ্রহণ করিতে চাও যাহা গ্রহণ করিলে শোক, পরিদেব, দুঃখ, দৌর্মনস্য এবং নিরাশা উৎপন্ন হইবে না। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি তেমন কোনো আত্মবাদ-উপাদান দেখিতে পাও যাহা গ্রহণ করিলে শোক, পরিদেব, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নিরাশা উৎপন্ন হইবে না? ‘না, প্রভো।’ সাধু, হে ভিক্ষুগণ, আমিও তেমন কোনো আত্মবাদ-উপাদান দেখি না যাহা গ্রহণ করিলে শোক, পরিদেব, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নিরাশা উৎপন্ন হইবে না। হে ভিক্ষুগণ, মনে করো, তোমরা তেমন এক দৃষ্টি-আশ্রয় আশ্রয় করিতে চাও যাহা আশ্রয় করিলে শোক, পরিদেব, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নিরাশা উৎপন্ন হইবে না। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি তেমন কোনো দৃষ্টি-আশ্রয় দেখিতে পাও যাহা আশ্রয় করিলে শোক, পরিদেব, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নিরাশা উৎপন্ন হইবে না? ‘না, প্রভো!’ সাধু, হে ভিক্ষুগণ, আমিও তেমন কোনো দৃষ্টি-আশ্রয় দেখি না যাহা আশ্রয় করিলে শোক, পরিদেব, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নিরাশা উৎপন্ন হইবে না।

১১. হে ভিক্ষুগণ, যদি আত্মা থাকে, তাহা হইলে ‘আত্মীয় (স্বকীয় বস্তু) আমার আছে’, এই ধারণা হইতে পারে তো? ‘হাঁ প্রভো, আত্মা থাকিলে ‘আত্মীয় আমার’ এই ধারণা হইতে পারে।’ হে ভিক্ষুগণ, আত্মাতে এবং আত্মীয়ে সত্যত ও যথার্থত লক্ষ করিলে এই যে দৃষ্টিস্থান : ‘সে-ই লোক সে-ই আত্মা, সে-ই আমি পরে হইব, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী আমি চিরকাল একইরূপে থাকিব’ তাহা কেবল পরিপূর্ণ বালধর্ম নয় কি? ‘প্রভো, তাহা কেবল পরিপূর্ণ বালধর্ম ব্যতীত আর কী হইতে পারে!’ হে ভিক্ষুগণ, ‘তোমরা কি মনে করো, রূপ নিত্য না অনিত্য, বেদনা নিত্য না অনিত্য, সংজ্ঞা নিত্য না অনিত্য, সংস্কার নিত্য না অনিত্য, বিজ্ঞান নিত্য না অনিত্য?’ ‘প্রভো, তাহা অনিত্য।’ যাহা অনিত্য তাহা দুঃখ না তাহা সুখ? ‘প্রভো, তাহা দুঃখ।’ যাহা অনিত্য, দুঃখ ও বিপরিণামী তাহা কি জ্ঞানত এইরূপে দেখা যুক্তিযুক্ত-ইহা আমার, আমি ইহা, ইহা আমার আত্মা? ‘না প্রভো, তাহা যুক্তিযুক্ত নহে।’ অতএব, হে ভিক্ষুগণ, যাহা কিছু রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার অথবা বিজ্ঞান অতীত, অনাগত অথবা প্রত্যুৎপন্ন (বর্তমান), অধ্যাত্মে অথবা বাহিরে, স্থূল বা সূক্ষ্ম, হীন অথবা উৎকৃষ্ট, দূরে অথবা নিকটে, সর্ব রূপ, সর্ব বেদনা, সর্ব সংজ্ঞা, সর্ব সংস্কার, সর্ব বিজ্ঞান আমার নহে, আমি তাহা নহি, তাহা আমার আত্মা নহে। এইরূপে বিষয়টি যথাযথ সম্যক জ্ঞান দ্বারা দেখিবে।

১২. হে ভিক্ষুগণ, বিষয়টি এইরূপে দেখিয়া শ্রুতবান আর্যশ্রাবক রূপে নির্বেদপ্রাপ্ত হন, বেদনায় নির্বেদপ্রাপ্ত হন, সংজ্ঞায় নির্বেদপ্রাপ্ত হন, সংস্কারে নির্বেদপ্রাপ্ত হন, বিজ্ঞানে নির্বেদপ্রাপ্ত হন, নির্বেদহেতু বৈরাগ্য লাভ করেন, চরম বৈরাগ্যহেতু বিমুক্ত হন, বিমুক্ত হইলে ‘বিমুক্ত হইয়াছি’ জ্ঞান হয় এবং প্রকৃষ্টরূপে জানেন : ‘জন্মবীজ ক্ষীণ হইয়াছে, ব্রহ্মচর্য-ব্রত উদ্‌যাপিত হইয়াছে, করণীয় কার্য কৃত হইয়াছে, ইহার পর অত্র আর আসিতে হইবে না।’ হে ভিক্ষুগণ, এইরূপ হইলেই বলা যায় : ভিক্ষু উৎক্ষিপ্ত-পলিঘ, সংকীর্ণ-পরিখ অব্যূঢ়-এষিক, নিরর্গল, এবং পতিত-ধ্বজ, পতিত-ভার ও বিসংযুক্ত, আর্য হইয়াছেন।

হে ভিক্ষুগণ, কিরূপে ভিক্ষু উৎক্ষিপ্ত-পলিঘ হন? ভিক্ষুর অবিদ্যা প্রহীন, মূলোচ্ছিন্ন, ছিন্নশীর্ষ সমূল-উৎপাটিত তালবৃক্ষে পরিণত, অনস্তিত্বভাব-প্রাপ্ত ও অনাগতে পুনরুৎপত্তি-রহিত হয়। এইরূপেই, হে ভিক্ষুগণ, ভিক্ষু উৎক্ষিপ্ত-পলিঘ হন।

হে ভিক্ষুগণ, কিরূপে ভিক্ষু সংকীর্ণ-পরিখ হন? ভিক্ষুর পুনর্ভব, জন্মপরিগ্রহরূপ সংসার প্রহীন, মূলোচ্ছিন্ন, ছিন্নশীর্ষ সমূল-উৎপাটিত তালবৃক্ষে পরিণত, অনস্তিত্বভাব-প্রাপ্ত ও অনাগতে পুনরুৎপত্তি-রহিত হয়। এইরূপেই, হে ভিক্ষুগণ, তিনি সংকীর্ণ-পরিখ হন।

হে ভিক্ষুগণ, কিরূপে ভিক্ষু অব্যূঢ়-এষিক হন? ভিক্ষুর তৃষ্ণা প্রহীন, মূলোচ্ছিন্ন, ছিন্নশীর্ষ সমূল-উৎপাটিত তালবৃক্ষে পরিণত, অনস্তিত্বভাব-প্রাপ্ত ও অনাগতে পুনরুৎপত্তি-রহিত হয়। এইরূপেই, হে ভিক্ষুগণ, তিনি অব্যূঢ়-এষিক হন।

হে ভিক্ষুগণ, কিরূপে ভিক্ষু নিরর্গল হন? ভিক্ষুর অবরভাগী পঞ্চসংযোজন প্রহীন, মূলোচ্ছিন্ন, ছিন্নশীর্ষ সমূল-উৎপাটিত তালবৃক্ষে পরিণত, অনস্তিত্বভাব-প্রাপ্ত ও অনাগতে পুনরুৎপত্তি-রহিত হয়। এইরূপেই, হে ভিক্ষুগণ, তিনি নিরর্গল হন।

হে ভিক্ষুগণ, কিরূপে ভিক্ষু পতিত-ধ্বজ, পতিত-ভার ও বিসংযুক্ত আর্য হন? ভিক্ষুর ‘আমি আছি’ এই অভিমান প্রহীন, মূলোচ্ছিন্ন, ছিন্নশীর্ষ সমূল-উৎপাটিত তালবৃক্ষে পরিণত, অনস্তিত্বভাব-প্রাপ্ত ও অনাগতে পুনরুৎপত্তি-রহিত হয়। এইরূপেই, হে ভিক্ষুগণ, তিনি পতিত-ধ্বজ, পতিত-ভার ও বিসংযুক্ত আর্য হন।

১৩. হে ভিক্ষুগণ, ইন্দ্র-প্রমুখ, ব্রহ্মাপ্রমুখ ও প্রজাপতি-প্রমুখ দেব-ব্রহ্মগণ অন্বেষণ করিয়া এইরূপে বিমুক্ত-চিত্তের সন্ধান পায় না। ইহাই তথাগতের নিঃসৃত (নির্গত, বিনির্মুক্ত) বিজ্ঞান। ইহার কারণ কী? যেহেতু, হে ভিক্ষুগণ, আমি এই দৃষ্টধর্মেই তথাগতকে অননুবেদ্য বলি।

হে ভিক্ষুগণ, আমি এই মতবাদী, এই আখ্যায়ী, তথাপি কতিপয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অসত্যের দ্বারা, শূন্যের উপর, মিছামিছি, অযথা আমাকে (এই বলিয়া) অভিযুক্ত করেন : ‘বৈনয়িক শ্রমণ গৌতম সত্ত্ব (আত্মা) থাকা সত্ত্বেও উহার উচ্ছেদ, বিনাশ ও বিভব (ধ্বংস) জ্ঞাপন করেন।’ যাহা আমি নহি, যাহা আমি বলি না এইরূপ অসত্যের দ্বারা, শূন্যের উপর, মিছামিছি, অযথা মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ আমাকে অভিযুক্ত করেন : ‘বৈনয়িক শ্রমণ গৌতম সত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও উহার উচ্ছেদ, বিনাশ ও বিভব জ্ঞাপন করেন।’

হে ভিক্ষুগণ, পূর্বে যেমন এখনো তেমন আমি দুঃখ এবং দুঃখের নিরোধই নির্দেশ করি। যদি, হে ভিক্ষুগণ, ইহাতে অপরে তথাগতের প্রতি আক্রোশ করে, তাঁহাকে পরিহাস করে, তাঁহার প্রতি রোষ প্রকাশ করে, বিহিংসা পোষণ করে অথবা তাঁহাকে আঘাত প্রদান করে, তাহাতে তথাগতের মনে আঘাত লাগে না, ব্যথার কারণ উৎপন্ন হয় না, অনভিরতি (অসন্তুষ্টি) আসে না। হে ভিক্ষুগণ, যদি তদ্‌বিষয়ে অপরে তাঁহাকে সম্মান-সৎকার করে, গুরুস্থানীয় মনে করে, মানে ও পূজা করে, তাহাতেও তাঁহার মনে আনন্দ, সৌমনস্য ও উৎফুল্লভাব হয় না। যদি, হে ভিক্ষুগণ, অপরে তাঁহাকে সম্মান-সৎকার করে, গুরুস্থানীয় মনে করে, মানে ও পূজা করে, তাহাতে শুধু তাঁহার এই মনে হয় : আমি পূর্ব হইতেই জানি যে, এ বিষয়ে লোকে এইরূপেই সম্মান করিয়া থাকে।

১৪. অতএব, হে ভিক্ষুগণ, যদি অপরে তোমাদের প্রতিও আক্রোশ করে, তোমাদিগকে পরিহাস করে, তোমাদের প্রতি রোষ প্রকাশ করে, বিহিংসা পোষণ করে, অথবা তোমাদিগকে আঘাত প্রদান করে, তাহাতে তোমাদের চিত্তেও আঘাত আসিতে এবং ব্যথার কারণ ও অনভিরতি উৎপন্ন হইতে দেওয়া উচিত নহে। যদি অপরে তোমাদিগকে সম্মান-সৎকার করে, গুরুস্থানীয় মনে করে, মানে ও পূজা করে, তাহাতেও তোমাদের মনে আনন্দ, সৌমনস্য ও উৎফুল্লভাব উৎপন্ন হইতে দেওয়া উচিত নহে। যদি অপরে তোমাদিগকে সম্মান-সৎকার করে, গুরুস্থানীয় মনে করে, মানে ও পূজা করে, তাহাতে তোমরা শুধু মনে করিবে : ‘আমরা তো পূর্ব হইতেই জানি, এ বিষয়ে লোকে এইরূপেই সম্মান করিয়া থাকে।’ অতএব, হে ভিক্ষুগণ, যাহা তোমাদের নহে তাহা পরিত্যাগ করো। প্রহীন হইলে তাহা তোমাদের পক্ষে দীর্ঘকাল সুখ ও হিতের কারণ হইবে।

হে ভিক্ষুগণ, তোমাদের নিজস্ব নহে কী? রূপ তোমাদের নিজস্ব নহে, বেদনা তোমাদের নিজস্ব নহে, সংজ্ঞা তোমাদের নিজস্ব নহে, সংস্কার তোমাদের নিজস্ব নহে, বিজ্ঞান তোমাদের নিজস্ব নহে, যাহা তোমাদের নিজস্ব নহে তাহা পরিত্যাগ করো। প্রহীন হইলে তাহা তোমাদের পক্ষে দীর্ঘকাল সুখ ও হিতের কারণ হইবে। হে ভিক্ষুগণ, এই জেতবনে যে-সকল তৃণ, কাষ্ঠ ও শাখাপলাশ আছে, যদি কোনো লোক তাহা অপহরণ করে, দগ্ধ করে, কিংবা যাহা ইচ্ছা করে, তাহা হইলে তোমরা কি মনে করিবে যে, ওই ব্যক্তি তোমাদিগকেই অপহরণ, দগ্ধ অথবা যাহা ইচ্ছা করিতেছে? ‘না প্রভো, আমরা তাহা মনে করি না।’ ইহার কারণ কী? ‘যেহেতু, প্রভো, এ স্থলে আমি বা আমার বলিতে কিছুই নাই।’ তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, যাহা তোমাদের নহে তাহা পরিত্যাগ করো। প্রহীন হইলে তাহা তোমাদের পক্ষে দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হইবে।

হে ভিক্ষুগণ, এইরূপে আমার দ্বারা ধর্ম সুব্যাখ্যাত, উত্তান (উন্মুক্ত), বিবৃত (অনাবৃত), প্রকাশিত ও পরিস্ফুট হইয়াছে। এইরূপে ধর্ম সুব্যাখ্যাত, উত্তান, বিবৃত, প্রকাশিত ও পরিস্ফুট হইবার ফলে যাঁহারা ক্ষীণাসব অর্হৎ, যাঁহারা ব্রহ্মচর্যব্রত উদ্‌যাপন করিয়াছেন, করণীয় কার্য সম্পাদন করিয়াছেন, যাঁহারা ভারমুক্ত হইয়াছেন, সদর্থ লাভ করিয়াছেন, যাঁহাদের ভব-সংযোজন পরিক্ষীণ হইয়াছে, যাঁহারা সম্যক জ্ঞান দ্বারা বিমুক্ত হইয়াছেন তাঁহাদের বিবর্তন নির্দেশ করিবার নাই, তাঁহাদের আর পুনর্জন্ম নাই। যে-সকল ভিক্ষুর অবরভাগী পঞ্চসংযোজন প্রহীন হইয়াছে তাঁহারা সকলে অনাগামী-রূপে ঊর্ধ্ব দেবলোকে জাত হইয়া তথায় পরিনির্বৃত হন, ওই দেবলোক হইতে মর্ত্যে তাঁহাদের পুনরাবর্তন হয় না; যে-সকল ভিক্ষুর ত্রিবিধ সংযোজন প্রহীন এবং রাগ, দ্বেষ ও মোহ তনুতা প্রাপ্ত হয় তাঁহারা সকলে সকৃদাগামী-রূপে মাত্র একবার ইহলোকে আগমন করিয়া দুঃখের অন্তসাধন করেন; যে-সকল ভিক্ষুর ত্রিবিধ সংযোজন প্রহীন হয় তাঁহারা সকলে স্রোতাপন্নরূপে সম্বোধিপরায়ণ হন, তাঁহাদের আর পতনের সম্ভাবনা থাকে না, (সপ্ত জন্মের) মধ্যে নির্বাণ লাভ করা তাঁহাদের পক্ষে নিশ্চিত; যে-সকল ভিক্ষু ধর্মানুসারী ও শ্রদ্ধানুসারী তাঁহারা সকলে সম্বোধিপরায়ণ, আমাতে যাঁহাদের শ্রদ্ধামাত্র, প্রেমমাত্র আছে, তাঁহারা সকলেও স্বর্গপরায়ণ।

ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন। ভিক্ষুগণ তাহা প্রসন্নমনে শ্রবণ করিয়া আনন্দ প্রকাশ করিলেন।

অলগর্দোপম-সূত্র সমাপ্ত।

The Middle Discourses

|_A. The First Fifty

|__III. The Chapter of Similes

MN22. অলগর্দোপম-সূত্র

Translations [31]

English

繁體字

日本語

Français

Deutsch

Italiano

Español

Català

Português

Русский

Norsk

Magyar

Srpski

Čeština

Polski

Slovenščina

हिंदी

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference