আমি এইরূপ শুনিয়াছি।

১. একসময় ভগবান শ্রাবস্তী-সমীপে অবস্থান করিতেছিলেন, জেতবনে, অনাথপিণ্ডিকের আরামে। ভগবান পূর্বাহ্ণে বহির্গমন-বাস পরিধান করিয়া, পাত্রচীবর লইয়া শ্রাবস্তীতে ভিক্ষান্নের জন্য প্রবেশ করিলেন। অনন্তর বহুসংখ্যক ভিক্ষু আয়ুষ্মান আনন্দের নিকট উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া তাঁহারা কহিলেন, ‘আনন্দ, তুমি তো চিরকালই ভগবৎ-প্রমুখাৎ ধর্মকথা শুনিয়া আসিতেছ। আমরা কি একবার ভগবৎ-প্রমুখাৎ ধর্মকথা শুনিবার সুযোগ লাভ করিতে পারিব?’ ‘যদি আয়ুষ্মানগণ সেই সুযোগ লাভ করিতে চাহেন, যেখানে রম্যক ব্রাহ্মণের আশ্রম সেখানে গমন করুন, অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা সেই সুযোগ লাভ করিবেন।’ ‘তথাস্তু বলিয়া ভিক্ষুগণ তাঁহাদের সম্মতি জানাইলেন।

এদিকে ভগবান ভিক্ষান্নসংগ্রহে বিচরণ করিয়া ভোজনশেষে ভিক্ষান্নসংগ্রহ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, আনন্দ, যেখানে পূর্বারাম, মৃগার-মাতৃ-প্রাসাদ তথায় দিবাবিহারের জন্য গমন করিব। ‘যথা আজ্ঞা, প্রভো’ বলিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ তাঁহার সম্মতিজ্ঞাপন করিলেন। অনন্তর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দের সহিত দিবাবিহারের জন্য পূর্বারামে, মৃগার-মাতৃ-প্রাসাদে গমন করিলেন। সায়াহ্নে ভগবান সমাধি হইতে উঠিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, গাত্রপরিষেকের (স্নানের) জন্য পূর্বপ্রকোষ্ঠে (পূর্বদ্বারের পার্শ্ববর্তী কক্ষে) গমন করিব। ‘যথা আজ্ঞা, প্রভো’ বলিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ তাঁহার সম্মতি জানাইলেন। অনন্তর প্রকোষ্ঠে (গাত্রপরিষেকের) আয়োজন হইলে গাত্রপরিষেকের জন্য ভগবান আনন্দের সহিত পূর্বপ্রকোষ্ঠে গমন করিলেন। পূর্বপ্রকোষ্ঠে গাত্রপরিষেক করিয়া তথা হইতে বাহির হইয়া ভগবান গাত্র শুকাইবার জন্য একচীবরে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। অতঃপর আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে কহিলেন, ‘প্রভো, অদূরে রম্যক ব্রাহ্মণের আশ্রম। প্রভো, এই আশ্রম অতি রমণীয় ও মনোহর। প্রভো, অনুকম্পাপূর্বক আপনি এই রম্যক ব্রাহ্মণের আশ্রমে গমন করুন।’ ভগবান মৌনভাবে সম্মতি জানাইলেন। অনন্তর ভগবান যেখানে রম্যক ব্রাহ্মণের আশ্রম তথায় গমন করিলেন। সেই সময় বহুসংখ্যক ভিক্ষু ওই আশ্রমে ধর্মালাপে সমাসীন ছিলেন। ভগবান তাঁহাদের কথা (বক্ষ্যমাণ বিষয়) সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বহির্দ্বার-প্রকোষ্ঠে অপেক্ষা করিলেন।

২. ভগবান তাঁহাদের কথা সমাপ্ত হইয়াছে জানিয়া একটু কাশিয়া বহির্দেশ হইতে অর্গল টানিলেন। ভিতর হইতে ভিক্ষুগণ ভগবানকে দ্বার খুলিয়া দিলেন। ভগবান রম্যক ব্রাহ্মণের আশ্রমে প্রবেশ করিয়া নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হইলেন। উপবিষ্ট হইয়া ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখন কী কথা লইয়া সমাসীন আছ? তোমাদের মধ্যে কী কথাই বা বিপ্রকৃত হইল (থামিয়া গেল)? ‘প্রভো, ভগবান সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে ধর্মকথাও থামিল আর ভগবানও এ স্থলে উপনীত হইলেন।’ ‘উত্তম কথা, শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত তোমাদের ন্যায় কুলপুত্রগণ ধর্মালাপে সমাসীন হইবেন। হে ভিক্ষুগণ, একত্রিত হইলে তোমাদের এই দ্বিবিধ কর্তব্য : ধর্মকথার আলোচনা অথবা আর্যোচিত তূষ্ণীম্ভাব ধারণ।’

৩. হে ভিক্ষুগণ, দ্বিবিধ পর্যেষণ (সন্ধান)-অনার্যোচিত ও আর্যোচিত। হে ভিক্ষুগণ, অনার্যোচিত পর্যেষণ কী? এ জগতে কেহ কেহ নিজে জন্মাধীন হইয়া জন্মানুগ ধর্মের, জরাধীন হইয়া জরানুগ ধর্মের, ব্যাধির অধীন হইয়া ব্যাধি-অনুগ ধর্মের, মরণাধীন হইয়া মরণানুগ ধর্মের, শোকাধীন হইয়া শোকানুগ ধর্মের, সংক্লেশাধীন হইয়া সংক্লেশানুগ ধর্মেরই পর্যেষণ করেন। জন্মানুগ ধর্ম বলিতে তোমরা কী বলিবে? হে ভিক্ষুগণ, পত্মী-পুত্র, দাস-দাসী, অজ-মেষ, কুক্কুট-শূকর, হস্তী-গো-অশ্ব, অশ্বতর, জাতরূপ এবং রজতই জন্মানুগ ধর্ম। এ-সকল জন্মানুগ ধর্মই উপাধি যাহাতে গ্রথিত, মূর্ছিত ও সমাপন্ন হইলে মনে করিতে হইবে মানব নিজে জন্মাধীন হইয়া জন্মানুগ ধর্মেরই পর্যেষণ করিতেছে। জরানুগ ধর্ম, ব্যাধি-অনুগ ধর্ম, মরণানুগ ধর্ম, শোকানুগ ধর্ম, সংক্লেশানুগ ধর্ম সম্বন্ধেও এইরূপ। ইহাই, হে ভিক্ষুগণ, অনার্যোচিত পর্যেষণ।

৪. হে ভিক্ষুগণ, আর্যোচিত পর্যেষণ কী? এ জগতে কেহ কেহ নিজে জন্মাধীন হইয়া জন্মানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অজাত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করেন। নিজে জরাধীন হইয়া জরানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অজর, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করেন। নিজে ব্যাধির অধীন হইয়া ব্যাধি-অনুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া নির্ব্যাধি, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করেন। নিজে মরণাধীন হইয়া মরণানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অমৃত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করেন। নিজে শোকাধীন হইয়া শোকানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অশোক, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করেন। নিজে সংক্লেশাধীন হইয়া সংক্লেশানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অসংক্লিষ্ট, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করেন। ইহাই, হে ভিক্ষুগণ, আর্যোচিত পর্যেষণ।

৫. আমিও, হে ভিক্ষুগণ, সম্যক সম্বোধি লাভের পূর্বে, বোধিসত্ত্ব অবস্থায় নিজে জন্মাধীন হইয়া জন্মানুগ ধর্মের, জরাধীন হইয়া জরানুগ ধর্মের, ব্যাধির অধীন হইয়া ব্যাধি-অনুগ ধর্মের, মরণাধীন হইয়া মরণানুগ ধর্মের, শোকাধীন হইয়া শোকানুগ ধর্মের, সংক্লেশাধীন হইয়া সংক্লেশানুগ ধর্মের পর্যেষণ করি। তখন আমার মনে এই চিন্তা উদিত হয় : ‘আমি নিজে জন্মাধীন হইয়া জন্মানুগ ধর্মের, জরাধীন হইয়া জরানুগ ধর্মের, ব্যাধির অধীন হইয়া ব্যাধি-অনুগ ধর্মের, মরণাধীন হইয়া মরণানুগ ধর্মের, শোকাধীন হইয়া শোকানুগ ধর্মের, সংক্লেশাধীন হইয়া সংক্লেশানুগ ধর্মের পর্যেষণ করিতেছি। অতএব, এখন জন্মাধীন আমি জন্মানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অজাত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিব। জরাধীন আমি জরানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অজর, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিব। ব্যাধির অধীন আমি ব্যাধি-অনুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া নির্ব্যাধি, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিব। মরণাধীন আমি মরণানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অমৃত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিব। শোকাধীন আমি শোকানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অশোক, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিব। সংক্লেশাধীন আমি সংক্লেশানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অসংক্লিষ্ট, অনুত্তর যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিব।’

৬. হে ভিক্ষুগণ, সেই আমি পরে যখন তরুণ, নবীন, কৃষ্ণকেশ এবং ভদ্রযৌবনসম্পন্ন তখন স্নেহশীল ও অনিচ্ছুক মাতাপিতাকে কাঁদাইয়া, কেশ-শ্মশ্রু ছেদন করিয়া, কাষায় বস্ত্রে দেহ আচ্ছাদিত করিয়া আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হই। প্রব্রজিত হইয়া কুশল কী সন্ধানে এবং অনুত্তর শান্তিবরপদ নির্বাণ অন্বেষণে অরাড় কালামের নিকট উপস্থিত হই। উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, কালাম, আমি তোমার ধর্মবিনয়ে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি। অরাড় কালাম আমাকে কহিলেন, ‘আপনি এখানে থাকুন; তাদৃশ এই ধর্মতত্ত্ব যাহাতে বিজ্ঞ ব্যক্তি অচিরে নিজেই নিজের গুরু হইয়া, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা তাহা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করিতে পারেন।’ হে ভিক্ষুগণ, আমি অচিরে, অত্যল্পকালের মধ্যেই সেই ধর্ম আয়ত্ত করি। ওষ্ঠ-প্রহত এবং উচ্চারিত হইতে না হইতেই আমি সেই জ্ঞানবাদ বলিতে পারি, সেই স্থবিরবাদ জানিতে পারি, দেখিতে পাই, ইহার বৈশিষ্ট্যও জানিতে পারি, শুধু আমি নহি অপরাপর ব্যক্তিও তাহা অনায়াসে জানিতে পারে। তখন আমার মনে এই চিন্তা উদিত হয় : অরাড় কালাম শুধু বিশ্বাসের উপর নহে এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়াই অবস্থান করেন বলিয়া তিনি তাহা প্রকাশ করেন। নিশ্চয় তিনি এই ধর্ম স্বয়ং জানিয়া-দেখিয়া উহাতে অবস্থান করেন। অনন্তর আমি তাঁহার নিকট উপস্থিত হই, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, কালাম, ধ্যানের কোন স্তর পর্যন্ত এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তুমি উহাতে অবস্থান করো? হে ভিক্ষুগণ, এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইলে অরাড় কালাম কহিলেন, ‘আকিঞ্চনায়তন নামক অরূপধ্যানস্তর পর্যন্ত।’ তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : শুধু যে অরাড় কালামের শ্রদ্ধা আছে নহে, আমাদেরও আছে শ্রদ্ধা, শুধু যে তাঁহার বীর্য আছে নহে, আমাদেরও আছে বীর্য, শুধু যে তাঁহার স্মৃতি আছে নহে, আমাদেরও আছে স্মৃতি, শুধু যে তাঁহার সমাধি আছে নহে, আমাদেরও আছে সমাধি, শুধু যে তাঁহার প্রজ্ঞা আছে নহে, আমাদেরও আছে প্রজ্ঞা। অতএব তিনি যে-ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করেন বলিয়া প্রকাশ করেন, আমিও সেই ধর্ম সাক্ষাৎকার করিবার জন্য প্রয়াসী হইব।

হে ভিক্ষুগণ, আমি অচিরে, অত্যল্পকালের মধ্যে সেই ধর্ম অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি। অনন্তর আমি অরাড় কালামের নিকট উপস্থিত হই, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, এই ধ্যানস্তর পর্যন্তই তো তুমি এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করো বলিয়া প্রকাশ করো। ‘হাঁ, এই পর্যন্তই বটে!’ কালাম, আমিও তো এই ধ্যানস্তর পর্যন্ত স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করিতে পারি। [তিনি কহিলেন] ‘ইহা আমাদের মহালাভ, সুলব্ধ সৌভাগ্য যে আমরা আপনার সদৃশ সতীর্থ দেখিতে পাইতেছি। আমি যে-ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি বলিয়া প্রকাশ করি তুমিও সেই ধর্ম অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করিতে পার। তুমি যে-ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করো, ঠিক সেই ধর্মই আমি স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করি বলিয়া প্রকাশ করি। এইরূপে যে-ধর্ম আমি জানি তাহা তুমি জান, যে-ধর্ম তুমি জান তাহা আমি জানি; আমি যাদৃশ তুমি তাদৃশ, তুমি যাদৃশ আমি তাদৃশ। অতএব, বন্ধু, আইস, এখন হইতে আমরা উভয়ে একসঙ্গে বাস করিয়া এই শিষ্যগণকে পরিচালিত করি।’

হে ভিক্ষুগণ, অরাড় কালাম আমার আচার্য (শিক্ষাগুরু) হইয়াও অন্তেবাসী আমাকে তাঁহার সমস্থানে স্থাপন করিলেন, উদারভাবে আমাকে সম্মান করিলেন। তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : এই ধর্ম নির্বেদের অভিমুখে, বিরাগের অভিমুখে, নিরোধের অভিমুখে, উপশমের অভিমুখে, অভিজ্ঞার অভিমুখে, সম্বোধির অভিমুখে, নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত হয় না। ইহার গতি তো আকিঞ্চনায়তন পর্যন্ত। হে ভিক্ষুগণ, আমি এই ভাবিয়া সেই ধর্ম পর্যাপ্ত মনে না করিয়া তাহা হইতে অনাসক্তভাবে প্রস্থান করি।

৭. হে ভিক্ষুগণ, কুশল কী সন্ধানে, অনুত্তর শান্তিবরপদ অন্বেষণে আমি রুদ্র রামপুত্রের নিকট উপস্থিত হই। উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, রাম, আমি তোমার ধর্মবিনয়ে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি। রামপুত্র আমাকে কহিলেন, ‘আপনি এখানে থাকুন। তাদৃশ এই ধর্মতত্ত্ব যাহাতে বিজ্ঞ ব্যক্তি অচিরে নিজেই নিজের গুরু হইয়া, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা তাহা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করিতে পারেন।’ হে ভিক্ষুগণ, আমি অচিরে, অত্যল্পকালের মধ্যে সেই ধর্ম আয়ত্ত করি। ওষ্ঠপ্রহত এবং উচ্চারিত হইতে না হইতেই আমি সেই জ্ঞানবাদ বলিতে পারি, সেই স্থবিরবাদ জানিতে পারি, দেখিতে পাই, ইহার বৈশিষ্ট্যও জানিতে পারি, শুধু আমি নহি, অপরাপর ব্যক্তিও তাহা জানিতে পারে। তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : রামপুত্র শুধু শ্রদ্ধার ভিত্তির উপর নহে, এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়াই তাহাতে অবস্থান করেন বলিয়া তিনি তাহা প্রকাশ করেন। নিশ্চয় তিনি এই ধর্ম স্বয়ং জানিয়া-দেখিয়া উহাতে অবস্থান করেন। অনন্তর আমি তাঁহার নিকট উপস্থিত হই। উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, রাম, ধ্যানের কোন স্তর পর্যন্ত এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তুমি উহাতে অবস্থান করো? হে ভিক্ষুগণ, ইহা জিজ্ঞাসিত হইলে রামপুত্র কহিলেন, ‘নৈব-সংজ্ঞা-না-সংজ্ঞা-আয়তন নামক অরূপধ্যানস্তর পর্যন্ত।’ তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : শুধু যে রামপুত্রের শ্রদ্ধা আছে নহে, আমাদেরও আছে শ্রদ্ধা, শুধু যে তাঁহার বীর্য আছে নহে, আমাদেরও আছে বীর্য, শুধু যে তাঁহার স্মৃতি আছে নহে, আমাদেরও আছে স্মৃতি, শুধু যে তাঁহার সমাধি আছে নহে, আমাদেরও আছে সমাধি, শুধু যে তাঁহার প্রজ্ঞা আছে নহে, আমাদেরও আছে প্রজ্ঞা। অতএব, তিনি যে-ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করেন বলিয়া প্রকাশ করেন আমিও সেই ধর্ম সাক্ষাৎকার করিবার জন্য প্রয়াসী হইব।

হে ভিক্ষুগণ, আমি অচিরে, অত্যল্পকালের মধ্যে সেই ধর্ম অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি। অনন্তর আমি রামপুত্রের নিকট উপস্থিত হই, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, রাম, এই ধ্যানস্তর পর্যন্তই তো তুমি এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করো বলিয়া প্রকাশ করো? ‘হাঁ, এই পর্যন্তই বটে!’ রাম, আমিও এই ধ্যানস্তর পর্যন্ত এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করিতে পারি। তিনি কহিলেন, ‘ইহাতে আমাদের মহালাভ, সুলব্ধ সৌভাগ্য যে আমরা আপনার সদৃশ সতীর্থ দেখিতে পাইতেছি। আমি যেই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করি বলিয়া প্রকাশ করি তুমিও সেই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করিতে পার। তুমি যে-ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করো, ঠিক সেই ধর্ম আমি স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি বলিয়া প্রকাশ করি। এইরূপে যে-ধর্ম আমি জানি তাহা তুমি জান, যে-ধর্ম তুমি জান তাহা আমি জানি; আমি যাদৃশ তুমি তাদৃশ, তুমি যাদৃশ আমি তাদৃশ। অতএব, বন্ধু, আইস, এখন হইতে আমরা উভয়ে একসঙ্গে বাস করিয়া এই শিষ্যগণকে পরিচালিত করি।’

হে ভিক্ষুগণ, রুদ্র রামপুত্র আমার আচার্য (শিক্ষাগুরু) হইয়াও অন্তেবাসী আমাকে তাঁহার সমস্থানে স্থাপন করিলেন। তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : এই ধর্ম নির্বেদের অভিমুখে, বিরাগের অভিমুখে, নিরোধের অভিমুখে, উপশমের অভিমুখে, অভিজ্ঞার অভিমুখে, নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত হয় না। ইহার গতি নৈবসংজ্ঞা-না-অসংজ্ঞায়তন নামক অরূপধ্যান পর্যন্ত। হে ভিক্ষুগণ, আমি এই ভাবিয়া সেই ধর্ম পর্যাপ্ত মনে না করিয়া তাহা হইতে অনাসক্তভাবে প্রস্থান করি।

৮. হে ভিক্ষুগণ, কুশল কী সন্ধানে, অনুত্তর শান্তিবরপদ অন্বেষণে আমি মগধরাজ্যে ক্রমাগত বিচরণ করিতে করিতে যেখানে উরুবেলা মহাবেলা, যেখানে সেনা-নিগম তদভিমুখে অগ্রসর হই। তথায় উপনীত হইয়া দেখিতে পাই এক অতি রমণীয় ভূমিভাগ, এক মনোহর বনখণ্ড, অদূরে স্বচ্ছসলিলা সতীর্থযুক্তা নদী প্রবাহমানা, এবং চতুর্দিকে রমণীয় গোচর-গ্রাম। তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : এই তো সেই রমণীয় ভূমিভাগ এবং মনোহর বনখণ্ড, অদূরে স্বচ্ছসলিলা সুতীর্থযুক্ত প্রবাহমানা নদী এবং চতুর্দিকে রমণীয় গোচর-গ্রাম। সাধনাপ্রয়াসী কুলপুত্রের পক্ষে এই তো সেই সাধনার স্থান। ইহা ভাবিয়া, হে ভিক্ষুগণ, সাধনার পক্ষে এই স্থান পর্যাপ্ত মনে করিয়া ওই স্থানেই আমি ধ্যানাসনে উপবিষ্ট হই।

৯. হে ভিক্ষুগণ, জন্মাধীন আমি জন্মানুগ ধর্মে আদীনব বিদিত হইয়া অজাত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অজাত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ আয়ত্ত করি। জরাধীন আমি জরানুগ ধর্মে আদীনব বিদিত হইয়া অজর, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অজর, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ আয়ত্ত করি। ব্যাধির অধীন আমি ব্যাধি-অনুগ ধর্মে আদীনব বিদিত হইয়া নির্ব্যাধি, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে নির্ব্যাধি, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ আয়ত্ত করি। মরণাধীন আমি মরণানুগ ধর্মে আদীনব বিদিত হইয়া অমৃত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অমৃত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ আয়ত্ত করি। শোকাধীন আমি শোকানুগ ধর্মে আদীনব বিদিত হইয়া অশোক, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অশোক, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ আয়ত্ত করি। সংক্লেশাধীন আমি সংক্লেশানুগ ধর্মে আদীনব বিদিত হইয়া অসংক্লিষ্ট, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অসংক্লিষ্ট, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ আয়ত্ত করি। আমার জ্ঞান ও দর্শন উৎপন্ন হইল, আমার চিত্তবিমুক্তি অচল, এই আমার শেষ জন্ম, এখন আমার আর পুনর্ভবের সম্ভাবনা নাই।

১০. তখন, হে ভিক্ষুগণ, আমার এই চিন্তা হইল : যে-ধর্ম গভীর, দুর্দর্শ, দুরনুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ ও পণ্ডিত-বেদনীয় তাহা আলয়ারামী, আলয়-রত ও আলয়-সম্মোদিত জনগণের এই তত্ত্ব, এই হেতুপ্রত্যয়তা প্রতীত্যসমুৎপাদ দর্শন করা দুষ্কর। তাহাদের পক্ষে এই যে সর্ব-সংস্কার-শমথ, সর্ব-উপাধি-বর্জিত, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ ও নিরোধ (নামধেয়) নির্বাণ দর্শন করা দুষ্কর। যদি আমি এই ধর্মোপদেশ প্রদান করি এবং অপরে ইহা জানার মতো জানিতে না পারে, তাহা হইলে তাহা আমার পক্ষে ক্লেশ ও কষ্টের কারণ হইবে। হে ভিক্ষুগণ, তখন আমার মুখ হইতে এই অশ্রুতপূর্ব, অত্যাশ্চর্য গাথা প্রতিভাত হয় :

কষ্টে যাহা অধিগত প্রকাশে কী কাজ,
রাগ-দ্বেষপরায়ণ মানবসমাজ।
রাগ-দ্বেষ-অভিভূত, অজ্ঞান, অবোধ,
এই ধর্ম তাহাদের নহে সুখবোধ।
স্রোত-প্রতিকূলগামী, নিপুণ, গভীর,
দুরদশ, অতিসূক্ষ্ম, ধর্ম সুগভীর।
কেমনে দেখিবে তাহা রাগাসক্ত জন,
তমস্কন্ধে, অন্ধকারে আবৃত নয়ন!

হে ভিক্ষুগণ, ইহা আলোচনা করিলে অনৌৎসুক্যের দিকেই আমার চিত্ত নমিত হয়, ধর্মদেশনার প্রতি নহে।

১১. হে ভিক্ষুগণ, তখন আমার স্বচিত্তের তর্ক-বিতর্ক জানিতে পারিয়া সোহম্পতি ব্রহ্মার মনে এই চিন্তা উদিত হয় : ‘ওহে, জগৎ যে নষ্ট হইল, জগৎ যে বিনষ্ট হইল, যেহেতু তথাগত সম্যকসম্বুদ্ধের চিত্ত অনৌৎসুক্যের প্রতি নমিত হইল, ধর্মদেশনার প্রতি নহে।’ অনন্তর যেমন কোনো এক বলবান পুরুষ সংকুচিত বাহু প্রসারিত করে অথবা প্রসারিত বাহু সংকুচিত করে তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, সোহম্পতি ব্রহ্মা ব্রহ্মলোক হইতে অন্তর্হিত হইয়া আমার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। তিনি একাংসে উত্তরাসঙ্গ (উত্তরীয়) স্থাপন করিয়া আমার প্রতি কৃতাঞ্জলি হইয়া আমাকে কহিলেন, ‘প্রভো, ভগবান, আপনি ধর্মোপদেশ প্রদান করুন। সুগত, আপনি ধর্মোপদেশ প্রদান করুন। স্বল্পরজ-জাতীয় সত্ত্বও আছে যাহারা ধর্ম শ্রবণ করিতে না পারিলে অধঃপতিত হইবে। ধর্মের রসগ্রাহী শ্রোতা অবশ্যই মিলিবে।’ সোহম্পতি ব্রহ্মা এ কথা বলিলেন, ইহা বলিয়া অতঃপর তিনি গাথায় প্রকাশ করিলেন :

“উদিত মগধে পূর্বে ধরম সমল,
নহে সুচিন্তিত তাহা শুদ্ধ নিরমল।
উদ্‌ঘাটিত এবে জান অমৃতের দ্বার
জন্ম-জরা-মৃত্যু হ’তে করিতে উদ্ধার।
সমুদিত ধর্ম হেথা শুদ্ধ সুবিমল,
সুচিন্তিত, শুন তাহা, শুভ্র নিরমল।
শৈলে স্থিত যথা কেহ দেখে জনতারে-
পর্বত-শিখর হতে নিম্নে চারি ধারে-
সেইরূপ, হে সুমেধ, করি আরোহণ
ধর্মময় প্রাসাদেতে করো বিলোকন
সর্বদর্শী, বীতশোক, শোকাকুল জনে
হের তুমি, চারি ধারে রয়েছে কেমনে।
জন্ম-জরা-অভিভূত করিছে ক্রন্দন,
অজাতে অজরে তুমি পেয়েছ দর্শন।
ওঠো বীর! জয়ী তুমি, বিজিত সংগ্রাম,
ঋণহীন সার্থবাহ তুমি গুণধাম।
বিচরণ করো লোকে তুমি ভগবান,
উপদেশ করো ধর্ম তব সুমহান,
অবশ্য মিলিবে শ্রোতা বহু জ্ঞানবান,
বুঝিতে পারিবে ধর্ম, হবে আগুয়ান।”

১২. হে ভিক্ষুগণ, আমি ব্রহ্মার অভিপ্রায় বিদিত হইয়া, সর্বসত্ত্বের প্রতি কারুণ্যবশত বুদ্ধচক্ষু দ্বারা জগৎ বিলোকন করি। বুদ্ধদৃষ্টিতে বিশ্ব-বিলোকন করিয়া আমি দেখিতে পাই কোনো কোনো জীব স্বল্পরজ, কোনো কোনো জীব মহারজ, কেহ তীক্ষ্ণ-ইন্দ্রিয়, কেহ বা মৃদু-ইন্দ্রিয়, কেহ বা সু-আকারবিশিষ্ট, কেহ বা কদাকার, কেহ বা সুবোধ, কেহ বা অবোধ, কেহ কেহ বা পারত্রিক পাপভয়দর্শী হইয়া অবস্থান করিতেছে, কেহ কেহ বা পারত্রিক পাপভয়দর্শী হইয়া অবস্থান করিতেছে না। যেমন উৎপল, পদ্ম, অথবা পুণ্ডরীকের মধ্যে কোনো কোনোটি জলে উৎপন্ন হইয়া, জলে সংবর্ধিত হইয়া জলাভ্যন্তরেই পোষিত হয়; কোনো কোনোটি জলে উৎপন্ন ও সংবর্ধিত হইয়া জলসীমায় স্থিত থাকে; আবার কোনো কোনোটি জলে উৎপন্ন ও সংবর্ধিত হইয়া, জল হইতে অভ্যুত্থিত হইয়া, জল দ্বারা অনুপলিপ্ত থাকে, তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, আমি বুদ্ধদৃষ্টিতে জগৎ বিলোকন করিয়া দেখিতে পাই কোনো কোনো সত্ত্ব অল্পরজ, কোনো কোনো সত্ত্ব মহারজ, কেহ বা তীক্ষ্ণ-ইন্দ্রিয়, কেহ বা মৃদু-ইন্দ্রিয়, কেহ বা সু-আকারবিশিষ্ট, কেহ বা কদাকার, কেহ বা সুবোধ, কেহ বা অবোধ, কেহ কেহ বা পারত্রিক পাপভয়দর্শী হইয়া অবস্থান করিতেছে, কেহ কেহ বা পারত্রিক পাপভয়দর্শী হইয়া অবস্থান করিতেছে না। অনন্তর আমি নিম্নগাথায় সোহম্পতি ব্রহ্মাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করি :

উদ্‌ঘাটিত জান তবে অমৃতের দ্বার
জন্ম-জরা-মৃত্যু হতে করিতে উদ্ধার।
শ্রোতা যারা, শুনিবারে ব্যাকুল যাহারা,
শ্রদ্ধা প্রকাশিয়া ধর্ম শুনুক তাহারা।
কষ্ট জানি করি নাই, ব্রহ্মা, অস্বীকার
প্রচারিতে ধর্ম যাহা অভ্যস্ত আমার,
বিশ্বের মনুজ-মাঝে করিতে প্রচার
ধর্ম সুপ্রণীত যাহা অমৃতের দ্বার।

অনন্তর সোহম্পতি ব্রহ্মা আমি ধর্মোপদেশ করিতে স্বীকৃত হইয়াছি জানিয়া, আমাকে অভিবাদন করিয়া এবং পুরোভাগে দক্ষিণ পার্শ্বে রাখিয়া তথা হইতে অন্তর্হিত হইলেন।

১৩. হে ভিক্ষুগণ, অতঃপর আমার মনে এই চিন্তা উদিত হইল : আমি কাহার নিকট প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদান করিব যিনি এই ধর্মের শীঘ্র অর্থবোধ করিতে পারিবেন? তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : অরাড় কালামই সুপণ্ডিত, দক্ষ, মেধাবী এবং দীর্ঘকাল অল্পরজ-জাতীয় পুরুষ। অতএব, আমি তাঁহারই নিকট প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদান করিব, তিনিই এই ধর্মের অর্থ শীঘ্র জানিতে পারিবেন। তখন জনৈক দেবতা আমার নিকট উপস্থিত হইয়া জানাইল, ‘প্রভো, সপ্তাহকাল হইল অরাড় কালাম দেহত্যাগ করিয়াছেন।’ আমার মধ্যেও জ্ঞানদর্শন উৎপন্ন হইল যে সপ্তাহকাল পূর্বে সত্যই অরাড় কালাম দেহত্যাগ করিয়াছেন। তখন আমার মনে এই চিন্তা উদিত হইল : অরাড় কালাম মহাজ্ঞানী ছিলেন বটে যিনি এই ধর্ম শ্রবণমাত্র ইহার অর্থবোধ করিতে পারিতেন। তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : তবে আমি কাহার নিকট প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদান করিব যিনি এই ধর্ম শ্রবণ করিয়া শীঘ্র ইহার অর্থবোধ করিতে পারিবেন? তখন আমার মনে হইল : রুদ্র রামপুত্র তো সুপণ্ডিত, দক্ষ, মেধাবী এবং দীর্ঘকাল অল্পরজ-জাতীয় পুরুষ। অতএব, আমি তাঁহারই নিকট প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদান করিব। তিনি এই ধর্ম শ্রবণমাত্র শীঘ্রই ইহার অর্থবোধ করিতে পারিবেন। তখন জনৈক দেবতা আমার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, ‘প্রভো, সপ্তাহকাল হইল রুদ্র রামপুত্র দেহত্যাগ করিয়াছেন।’ আমার মধ্যেও জ্ঞানদর্শন উৎপন্ন হইল যে সত্যই সপ্তাহকাল পূর্বে রুদ্র রামপুত্র দেহত্যাগ করিয়াছেন। তখন আমার মনে এই চিন্তা উদিত হইল : রুদ্র রামপুত্র মহাজ্ঞানী ছিলেন বটে যিনি এই ধর্ম শ্রবণমাত্র ইহার অর্থবোধ করিতে পারিতেন। হে ভিক্ষুগণ, অতঃপর আমার মনে হইল : কেন? পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ তো আমার বহুপকারী, যাহারা আমার সাধনা-তৎপরতার সময় আমার নিকট উপস্থিত থাকিয়া সেবা করিয়াছিল। অতএব, আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণের নিকট প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদান করিব। তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল : পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ এখন কোথায় অবস্থান করিতেছে? আমি দিব্যচক্ষে, বিশুদ্ধ লোকাতীত দৃষ্টিতে দেখিতে পাইলাম পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ বারাণসী-সমীপে ঋষিপত্তন মৃগদাবে অবস্থান করিতেছে। অনন্তর, হে ভিক্ষুগণ, আমি উরুবেলায় যথারুচি বিচরণ করিয়া অবশেষে বারাণসী-অভিমুখে যাত্রা করি।

১৪. হে ভিক্ষুগণ, উপক নামক আজীবক দেখিতে পাইল যে, আমি দীর্ঘ পথযাত্রী হইয়া গয়া ও বোধিদ্র্বমের মধ্যবর্তী স্থানে উপনীত হইয়াছি। আমাকে দেখিয়া উপক কহিল, ‘এই যে দেখিতেছি তোমার ইন্দ্রিয়গ্রাম সুবিমল হইয়াছে। তোমার দেহকান্তি যে পরিশুদ্ধ ও সুপরিষ্কৃত হইয়াছে। বন্ধু, তুমি কাহার উদ্দেশে প্রব্রজিত হইয়াছ? কে বা তোমার শাস্তা? কোন ধর্মেই বা তোমার রুচি?’ তদুত্তরে আমি উপক আজীবককে গাথাযোগে কহিলাম :

সকলের বিভু আমি, সর্ববিদ হয়েছি এখন,
কোনো ধর্মে নহি লিপ্ত, ছিন্ন মম সকল বন্ধন।
সর্বঞ্জহ, সর্বত্যাগী, তৃষ্ণাক্ষয়ে বিমুক্ত মানস,
নিজ অভিজ্ঞায় যদি সিদ্ধ আমি পূরিত-মানস,
বলো তবে, আজীবক, কারে আমি করিব উদ্দেশ,
স্বয়ম্ভু হইয়া নিজে গুরুরূপে করিব নির্দেশ?
আচার্য নাহিক মোর, নাহি গুরু, নাহি উপাধ্যায়,
সদৃশ যে কেহ নাই, প্রতিদ্বন্দ্বী মম এ ধরায়।
আব্রহ্ম-ভুবন-মাঝে কোথা আছে হেন কোনো জন,
প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দ্বী, যুঝিবারে লোকাতীত রণ!
অর্হৎ আমি যে বিশ্বে, আমি হই শাস্তা অনুত্তর,
সম্যকসম্বুদ্ধ আমি, শীতিভূত, নির্বৃত অন্তর।
ধর্মচক্র প্রবর্তিতে চলিয়াছি কাশীর নগর,
অন্ধবিশ্বে বাজাইয়া অমৃত-দুন্দুভি নিরন্তর।

উপক কহিল, ‘বন্ধু, তুমি যেভাবে আত্মপরিচয় জানাইতেছ, তাহাতে তুমি কি অনন্তজিন হইবার যোগ্য?’ তদুত্তরে আমি কহিলাম :

‘জিন যাঁরা জয়ী তাঁরা জিত-অরি যাঁরা রিপুঞ্জয়,
মাদৃশ যে জিন তাঁরা, সিদ্ধ, করি আসবের ক্ষয়।
আছে যত পাপধর্ম সব আমি করিয়াছি জয়,
তাই তো উপক, তোমা দিই আমি জিন-পরিচয়!’

ইহা বিবৃত হইলে ‘বন্ধু, তাহা হইবে’ বলিয়া উপক আজীবক (সামান্য অবহেলার ভাবে) মাথা নাড়িয়া উন্মার্গ অবলম্বনে স্বপথে প্রস্থান করিল।

১৫. হে ভিক্ষুগণ, আমি ক্রমাগত পর্যটন করিতে করিতে বারাণসী-সমীপে ঋষিপত্তন-মৃগদাবে যেখানে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু ছিল তথায় উপনীত হই। পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ দূর হইতে আমাকে আসিতে দেখিল। আমাকে আসিতে দেখিয়া তাহারা পরস্পর পরস্পরকে সতর্ক করিয়া রাখিল : ‘এই যে দ্রব্যবহুল, সাধনাভ্রষ্ট, বাহুল্যে-প্রবৃত্ত শ্রমণ গৌতম আসিতেছেন। তাঁহাকে অভিবাদনও করা হইবে না, তাঁহার সম্মানার্থ গাত্রোত্থানও করা হইবে না এবং তাঁহার হস্ত হইতে পাত্রচীবরও গ্রহণ করা হইবে না; তবে আসনমাত্র প্রস্তুত করিয়া রাখা হইবে, যদি তিনি ইচ্ছা করেন তবে উপবেশন করিতে পারিবেন।’ হে ভিক্ষুগণ, ক্রমে যতই আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণের নিকটবর্তী হইলাম, ততই তাহারা স্ব স্ব প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়া, আমার দিকে অগ্রসর হইয়া একজন আমার পাত্রচীবর গ্রহণ করিল, একজন আসন নির্দিষ্ট করিল, একজন পাদোদক উপস্থিত করিল। তাহারা আমাকে স্বনামে সম্বোধন করিয়া আমার সহিত বন্ধুবৎ আচরণ করিতে আরম্ভ করিল। এইভাবে কথা বলিতে দেখিয়া আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণকে কহিলাম, হে ভিক্ষুগণ, তথাগতকে স্বনামে সম্বোধন করিয়া তাঁহার সহিত বন্ধুবৎ আচরণ করিতে নাই। তথাগত যে অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ, হে ভিক্ষুগণ, অবহিত হও, অমৃত অধিগত হইয়াছে, আমি অনুশাসন প্রদান করিতেছি, ধর্মোপদেশ প্রদান করিতেছি। তোমরা যেভাবে উপদিষ্ট হইবে সেভাবে প্রতিপন্ন হইলে অচিরে যে-জন্য কুলপুত্রগণ সম্যকভাবে আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হয়, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্য-পরিসমাপ্তি দৃষ্টধর্মে (প্রত্যক্ষজীবনে) স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করিতে পারিবে। ইহা বিবৃত হইলে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ আমাকে কহিল, ‘সে কী, গৌতম, তুমি সেই কঠোর বিহার, সেই কঠোর পন্থা, সেই দুষ্করচর্যা দ্বারা অতীন্দ্রিয় ধর্ম লাভ করিতে পারিলে না, আর্যজ্ঞানদর্শনবিশেষ তো দূরের কথা, আর এখন দ্রব্যবহুল, সাধনাভ্রষ্ট এবং বাহুল্যে প্রবৃত্ত হইয়া তুমি কি বলিতে চাও যে তুমি অতীন্দ্রিয় ধর্ম আর্যজ্ঞানদর্শনসহ আয়ত্ত করিতে পারিলে?’ আমি কহিলাম, হে ভিক্ষুগণ, তথাগত তো দ্রব্যবহুল, সাধনাভ্রষ্ট ও বাহুল্যে প্রবৃত্ত নহেন, তিনি যে অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ। তোমরা অবহিত হও, অমৃত অধিগত হইয়াছে, আমি অনুশাসন প্রদান করিতেছি, ধর্মদেশনা করিতেছি। যেভাবে উপদিষ্ট হইবে সেভাবে প্রতিপন্ন হইলে অচিরে যে-জন্য কুলপুত্রগণ সম্যকভাবে আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হয় তোমরা সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্য-পরিসমাপ্তি দৃষ্টধর্মে (প্রত্যক্ষজীবনে) স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করিতে পারিবে। দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও এইরূপ কথোপকথন হইল। তৃতীয়বার একই উক্তি করিয়া আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণকে বিষয়টি জানাইতে সক্ষম হইলাম। তাহাদের দুইজনকে উপদেশ দিতে থাকিলে অপর তিনজন ভিক্ষান্নসংগ্রহে বিচরণ করে। তিনজন বিচরণ করিয়া যে ভিক্ষান্নসংগ্রহ করে তাহাতে আমরা ছয়জন দিনযাপন করি। যখন তাহাদের তিনজনকে উপদেশ প্রদান করিতে থাকি তখন দুইজন ভিক্ষান্নসংগ্রহে বিচরণ করে; দুইজন বিচরণ করিয়া যে ভিক্ষান্নসংগ্রহ করে তাহাতে ছয়জন দিনযাপন করি। অনন্তর পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ এইরূপে আমার দ্বারা উপদিষ্ট ও অনুশাসিত হইলে পর তাহারা জন্মাধীন হইয়া জন্মানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অজাত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অজাত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ লাভ করে; জরাধীন হইয়া জরানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অজর, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অজর, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ লাভ করে; নিজে ব্যাধির অধীন ব্যাধি-অনুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া নির্ব্যাধি, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে নির্ব্যাধি, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ লাভ করে; নিজে মরণাধীন হইয়া মরণানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অমৃত, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অমৃত, অনুত্তর যোগক্ষেম নির্বাণ লাভ করে; নিজে শোকাধীন হইয়া শোকানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অশোক, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অশোক, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ লাভ করে; নিজে সংক্লেশাধীন হইয়া সংক্লেশানুগ ধর্মে আদীনব আছে জানিয়া অসংক্লিষ্ট, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ পর্যেষণ করিতে করিতে অসংক্লিষ্ট, অনুত্তর, যোগক্ষেম নির্বাণ লাভ করে। তাহাদের জ্ঞান ও দর্শন উৎপন্ন হয়, তাহাদের চিত্তবিমুক্তি অচল, এই তাহাদের শেষ জন্ম, এখন আর তাহাদের পুনর্ভবের সম্ভাবনা নাই।*

১৬. হে ভিক্ষুগণ, এই পঞ্চকামগুণ। কী কী? চক্ষু-বিজ্ঞেয় রূপ যাহা ইষ্ট, কান্ত ও মনোজ্ঞ প্রিয়রূপ কামোপসংহিত ও মনোরঞ্জক, শ্রোত্র-বিজ্ঞেয় শব্দ, ঘ্রাণ-বিজ্ঞেয় গন্ধ, জিহ্বা-বিজ্ঞেয় রস ও কায়-বিজ্ঞেয় স্পর্শ, যাহা ইষ্ট, কান্ত ও মনোজ্ঞ প্রিয়রূপ কামোপসংহিত ও মনোরঞ্জক; ইহারাই পঞ্চকামগুণ। যে-সকল শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ এই পঞ্চকামগুণে গ্রথিত, মূর্ছিত ও সমাপন্ন হইয়া, পঞ্চকামগুণে আদীনবদর্শী না হইয়া এবং তাহা হইতে নিষ্কৃতির জ্ঞান উৎপাদন না করিয়া পঞ্চকামগুণ পরিভোগ করিতে থাকে, জানিবে, ইহাতে তাহারা অনয়-আপন্ন, ব্যসন-আপন্ন এবং পাপাত্মা মারের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন হয়। যেমন কোনো আরণ্যক মৃগ জালপাশে আবদ্ধ হইয়া শায়িত থাকিলে এ কথা জানিতে হয়, এই মৃগ অনয়-আপন্ন, ব্যসন-আপন্ন এবং মৃগলুব্ধকের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন, এবং লুব্ধক আসিলে সে যথেচ্ছ প্রস্থান করতে পারিবে না, তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, যে-সকল শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ এই পঞ্চকামগুণে গ্রথিত, মূর্ছিত ও সমাপন্ন হইয়া, উহাতে আদীনবদর্শী না হইয়া এবং নিষ্কৃতির জ্ঞান উৎপাদন না করিয়া উহা পরিভোগ করিতে থাকে, জানিবে, তাহারা অনয়-আপন্ন, ব্যসন-আপন্ন ও পাপাত্মা মারের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। হে ভিক্ষুগণ, যে-সকল শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ এই পঞ্চকামগুণে গ্রথিত, মূর্ছিত ও সমাপন্ন না হইয়া, উহাতে আদীনবদর্শী হইয়া এবং উহা হইতে নিষ্কৃতির জ্ঞান উৎপাদন করিয়া উহা পরিভোগ করিতে থাকেন, জানিবে, তাঁহারা অনয়-আপন্ন, ব্যসন-আপন্ন ও পাপাত্মা মারের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন হন না। যেমন কোনো আরণ্যক মৃগ জালপাশে আবদ্ধ না হইয়া শায়িত থাকিলে, জানিতে পারা যায়, সে অনয়-আপন্ন, ব্যসন-আপন্ন এবং মৃগলুব্ধকের ইচ্ছাধীন নহে, মৃগলুব্ধক আসিলে সে যথেচ্ছ প্রস্থান করিতে পারিবে, তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, যে-সকল শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ এই পঞ্চকামগুণে গ্রথিত, মূর্ছিত ও সমাপন্ন না হইয়া, উহাতে আদীনবদর্শী হইয়া ও উহা হইতে নিষ্কৃতির জ্ঞান উৎপাদন করিয়া উহা পরিভোগ করে, জানিবে, তাঁহারা অনয়-আপন্ন, ব্যসন-আপন্ন ও পাপাত্মা মারের ইচ্ছাধীন হন না। যেমন কোনো আরণ্যক মৃগ অরণ্যে বা উপবনে বিচরণকালে বিসংযুক্ত হইয়া গমন করে, বিসংযুক্ত হইয়া অবস্থান করে, বিসংযুক্ত হইয়া উপবেশন করে, বিসংযুক্ত হইয়া শয়ন করে, যেহেতু ইহা লুব্ধকের গোচরগত নহে, তেমনভাবেই, হে ভিক্ষুগণ, ভিক্ষু কামসম্পর্ক হইতে বিবিক্ত হইয়া, সর্ব অকুশল পরিহার করিয়া, সবিতর্ক, সবিচার, বিবেকজ প্রীতিসুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া তাহাতে বিচরণ করিতে থাকিলে বলা হয় :

মারেরে করেছে অন্ধ সত্যই সে জন
বধি চক্ষু, যাহে পথ না পায় দর্শন।
পাপাত্মা সে মার, যার এই ত্রিভুবন,
মারচক্ষু অদর্শনে গত যোগীজন।

দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান ও চারি অরূপধ্যান সম্বন্ধেও এইরূপ। অবশেষে সর্বাংশে নৈবসংজ্ঞা-না-অসংজ্ঞায়তন অতিক্রম করিয়া, সংজ্ঞা-বেদয়িত-নিরোধ নামক লোকোত্তর সমাধি লাভ করিয়া তাহাতে অবস্থান করিলে জ্ঞানদর্শনের ফলে আসব পরিক্ষীণ হয়। তখন বলা হয় :

মারেরে করেছে অন্ধ সত্যই সে জন
বধি চক্ষু, যাহে পথ না পায় দর্শন।
পাপাত্মা সে মার যার এই ত্রিভুবন,
মারচক্ষু অদর্শনে গত যোগীজন।
লোকোত্তীর্ণ লোকাতীত বুদ্ধ শুদ্ধ জন
বিষাত্মিকা তৃষ্ণা যত করিয়া ছেদন।

তিনি বিসংযুক্ত হইয়া গমন করেন, বিসংযুক্ত হইয়া অবস্থান করেন, বিসংযুক্ত হইয়া উপবেশন করেন, বিসংযুক্ত হইয়া শয়ন করেন, যেহেতু, হে ভিক্ষুগণ, তিনি পাপাত্মা মারের গোচরগত নহেন। ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন। ভিক্ষুগণ তাহা প্রসন্নমনে শ্রবণ করিয়া আনন্দ প্রকাশ করিলেন।

আর্যপর্যেষণ-সূত্র সমাপ্ত।

The Middle Discourses

|_A. The First Fifty

|__III. The Chapter of Similes

MN26. আর্যপর্যেষণ-সূত্র

Translations [33]

English

繁體字

日本語

한국어

Français

Deutsch

Italiano

Español

Català

Português

Русский

Norsk

Srpski

Čeština

Slovenščina

Hrvatski

Türkçe

עִבְרִית

हिंदी

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference