আমি এইরূপ শুনিয়াছি।

১. একসময় ভগবান শ্রাবস্তী-সমীপে অবস্থান করিতেছিলেন, জেতবনে, অনাথপিণ্ডিকের আরামে। অনন্তর জানুশ্রোণি (জানশ্রুতি?) নামক ব্রাহ্মণ যেখানে ভগবান উপবিষ্ট ছিলেন সেখানে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানের সহিত প্রীত্যালাপচ্ছলে কুশলসংবাদ জানিলেন, প্রীতিকর কুশলবাদ বিনিময়ের পর সসম্ভ্রমে একান্তে উপবেশন করিলেন। একান্তে উপবিষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণ জানুশ্রোণি ভগবানকে কহিলেন, ‘হে গৌতম, যে-সকল কুলপুত্র মহানুভব গৌতমকে উদ্দেশ করিয়া শ্রদ্ধায় (শ্রদ্ধাবশত) গৃহবাস ত্যাগ করিয়া অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইয়াছেন, মহানুভব গৌতম তাঁহাদের পুরোগামী (অগ্রনায়ক), মহানুভব গৌতম তাঁহাদের বহুপকারী, সমাদপেতা (সমুৎসাহদাতা), সেই জনগণ মহানুভব গৌতমেরই মতানুবর্তী।’

ব্রাহ্মণ, ‘এইরূপই বটে, যথার্থই এইরূপ, যে-সকল কুলপুত্র আমাকে উদ্দেশ করিয়া শ্রদ্ধায় গৃহবাস ত্যাগ করিয়া অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইয়াছেন আমি তাঁহাদের পুরোগামী, বহুপকারী, সমাদপেতা, সেই জনগণ আমারই মতানুবর্তী।’

২. ‘হে গৌতম, অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন (অবস্থান) দুরভিসম্ভব (দুঃসাধ্য), বিবেক-বৈরাগ্যসাধন দুষ্কর-দুরভিরাম মনে হয় একাকী অবস্থানে-যে ভিক্ষু সমাধির অবস্থা লাভ করিতে পারেন নাই, নিবিড় বন তাঁহার মন অপহরণ করে।’

ব্রাহ্মণ, এইরূপই বটে, যথার্থই এইরূপ, অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন দুরভিসম্ভব, বিবেক-বৈরাগ্যসাধন দুষ্কর-দুরভিরাম, একাকী অবস্থানে মনে হয়, যে ভিক্ষু সমাধির অবস্থা লাভ করিতে পারেন নাই, নিবিড় বন তাঁহার মন অপহরণ করে।

৩. ব্রাহ্মণ, সম্যক সম্বোধি লাভ করিবার পূর্বে, বোধিসত্ত্ব অবস্থায়, আমারও এই ধারণা হইয়াছিল : সত্যই অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন দুরভিসম্ভব, বিবেক-বৈরাগ্যসাধন দুষ্কর-দুরভিরাম, একাকী অবস্থানে মনে হয়, যে ভিক্ষু সমাধির অবস্থা লাভ করিতে পারেন নাই, নিবিড় বন তাঁহার মন অপহরণ করে।

৪. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, সর্বদৈহিক কর্ম পরিশুদ্ধ না করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অনুশীলন করিতে চাহেন, তাঁহাদের সর্বদৈহিক কর্ম অপরিশুদ্ধ থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি সর্বদৈহিক কর্ম পরিশুদ্ধ না করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমার সর্বদৈহিক কর্ম পরিশুদ্ধ হইয়াছে। যে-সকল আর্য সর্বদৈহিক কর্ম পরিশুদ্ধ করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজেকে সর্বদৈহিক কর্মে পরিশুদ্ধ দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

৫. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, বাক্‌কর্ম… মনঃকর্ম… আজীব (জীবিকার নিয়ম) পরিশুদ্ধ না করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের বাক্‌কর্ম… মনঃকর্ম… আজীব অপরিশুদ্ধ থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি সর্ব বাক্‌কর্ম… মনঃকর্ম… আজীব পরিশুদ্ধ না করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমার সর্ব বাক্‌কর্ম… মনঃকর্ম… আজীব পরিশুদ্ধ হইয়াছে। যে-সকল আর্য সর্ব বাক্‌কর্ম… মনঃকর্ম… আজীব পরিশুদ্ধ করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজেকে সর্ব বাক্‌কর্মে… মনঃকর্মে… আজীব-বিষয়ে পরিশুদ্ধ দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

৬. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, অভিধ্যালু (লোভপ্রবণ), কাম্যবস্তুতে তীব্ররাগাসক্ত হইয়াও অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের অভিধ্যালু, কাম্যবস্তুতে তীব্ররাগাসক্ত হইয়া থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি অভিধ্যালু, কাম্যবস্তুতে তীব্ররাগাসক্ত হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি কিছুতেই অভিধ্যালু নহি। যে-সকল আর্য অভিধ্যালু না হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজেকে অনভিধ্যালু দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

৭. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, ব্যাপন্নচিত্ত হইয়া, প্রদুষ্ট-সংকল্পযুক্ত মন লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের চিত্ত হিংসাপ্রবণ, প্রদুষ্ট-সংকল্পযুক্ত হইবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি ব্যাপন্নচিত্ত হইয়া, প্রদুষ্ট-সংকল্পযুক্ত মন লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমার চিত্ত মৈত্রীপূর্ণ হইয়াছে। যে-সকল আর্য মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে মৈত্রীপূর্ণ চিত্ত দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

৮. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, পর্যুত্থিত স্ত্যানমিদ্ধ লইয়া, তন্দ্রালস্য-বিহ্বল হইয়া, অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের স্ত্যানমিদ্ধ-পর্যুত্থিত হইবার, তন্দ্রালস্য-বিহ্বল হইবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি পর্যুত্থিত স্ত্যানমিদ্ধ লইয়া, তন্দ্রালস্য-বিহ্বল হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি স্ত্যানমিদ্ধবিহীন, তন্দ্রালস্যশূন্য। যে-সকল আর্য স্ত্যানমিদ্ধবিহীন, তন্দ্রালস্যশূন্য হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে স্ত্যানমিদ্ধবিহীনতা, তন্দ্রালস্যশূন্যতা দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

৯. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, উদ্ধত প্রকৃতি, অশান্তচিত্ত লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের প্রকৃতি উদ্ধত, চিত্ত অশান্ত থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি উদ্ধত প্রকৃতি, অশান্তচিত্ত লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমার চিত্ত উপশান্ত হইয়াছে। যে-সকল আর্য শান্তচিত্তে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে চিত্তের শান্তভাব দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১০. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, শঙ্কা, বিচিকিৎসা, সংশয়, দ্বিধাভাব লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের মনে শঙ্কা, বিচিকিৎসা, সংশয়, দ্বিধাভাব থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি শঙ্কা, বিচিকিৎসা, সংশয়, দ্বিধাভাব থাকিতে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি বিচিকিৎসা উত্তীর্ণ হইয়াছি, সংশয় অতিক্রম করিয়াছি। যে-সকল আর্য বিচিকিৎসা উত্তীর্ণ হইয়া, সংশয় অতিক্রম করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে, বিচিকিৎসা উত্তীর্ণ হইয়াছেন, সংশয় অতিক্রম করিয়াছেন, এহেন ব্যক্তির অবস্থা দেখিয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১১. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, আত্মশ্লাঘা ও পরগ্লানি লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের স্বভাবে আত্মশ্লাঘা-পরগ্লানি থাকিবার দোষে, সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি আত্মশ্লাঘা-পরগ্লানি থাকিতে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি আত্মশ্লাঘা-পরগ্লানিকারী নহি। যে-সকল আর্য আত্মশ্লাঘা-পরগ্লানিকারী না হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে আত্মশ্লাঘা-পরগ্লানিবিহীনতা দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১২. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, ভীত ভাব, ভীরু স্বভাব লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের ভীরু স্বভাব থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি ভীত ভাব, ভীরু স্বভাব লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি বিগতরোমহর্ষ, বীতরোমাঞ্চ হইয়াছি। যে-সকল আর্য বিগতরোমহর্ষ, বীতরোমাঞ্চ হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে বিগতরোমহর্ষতা, বীতরোমাঞ্চতা দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১৩. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, লাভ-সৎকার, কীর্তি-শ্লোক, লাভ, সম্মান ও স্তুতিবাদ কামনা করিয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের মনে লাভ-সৎকার ও কীর্তি-শ্লোক কামনা থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি লাভ-সৎকার-শ্লোক-কামনা থাকিতে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি অল্পেচ্ছু। যে-সকল আর্য অল্পেচ্ছু হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে অল্পেচ্ছুতা দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১৪. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, অলস ও হীনবীর্য হইয়া বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের অলস ও হীনবীর্য হইবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি অলস ও হীনবীর্য হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি আরব্ধবীর্য, কর্মতৎপর। যে-সকল আর্য আরব্ধবীর্য হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে আরব্ধবীর্যতা, কর্মতৎপরতা দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১৫. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ, কিংবা ব্রাহ্মণ, মূঢ়স্মৃতি, অসম্প্রজ্ঞান (যথাযথ জ্ঞানের অভাব) লইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের মূঢ়স্মৃতি, অসম্প্রজ্ঞান বা যথাযথ জ্ঞানের অভাব থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি মূঢ়স্মৃতি, অসম্প্রজ্ঞান বা যথাযথ জ্ঞানের অভাব থাকিতে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমার স্মৃতি উপস্থাপিত হইয়াছে, আমি স্মৃতিমান। যে-সকল আর্য উপস্থাপিত স্মৃতি লইয়া, স্মৃতিশীল হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে উপস্থিত-স্মৃতিতা, স্মৃতিশীলতা দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১৬. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, অসমাহিত, বিভ্রান্তচিত্ত হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের চিত্ত অসমাহিত ও বিভ্রান্ত থাকিবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমার চিত্ত অসমাহিত ও বিভ্রান্ত থাকিতে অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি সমাধিসম্পন্ন। যে-সকল আর্য সমাধিসম্পন্ন হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে সমাধি-সম্পদ দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১৭. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : যে-কেহ, শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ, দুষ্প্রাজ্ঞ, এণমৃগবৎ, মুগ্ধস্বভাব হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিতে চাহেন, তাঁহাদের দুষ্প্রাজ্ঞ, এণমৃগবৎ মুগ্ধস্বভাব হইবার দোষে সত্যসত্যই ওই সকল মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অকুশল ভয়ভৈরব (অমঙ্গল ভয়ভীতি) আহ্বান করেন মাত্র। অতএব আমি দুষ্প্রাজ্ঞ, এণমৃগবৎ মুগ্ধস্বভাব হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করিব না। আমি প্রজ্ঞাসম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান। যে-সকল আর্য প্রজ্ঞাসম্পন্ন হইয়া অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন, আমি তাঁহাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণ, এই অবস্থায় আমি নিজের মধ্যে প্রজ্ঞাসম্পদ দেখিতে পাইয়া অরণ্যবাসে অধিকতর আগ্রহান্বিত হই।

১৮. ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার এই ধারণা হইয়াছিল : কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী (অমাবস্যা), কৃষ্ণাষ্টমী, শুক্লপক্ষের পঞ্চদশী (পূর্ণিমা) এবং শুক্লাষ্টমী প্রভৃতি যে-সকল রাত্রি অভিজ্ঞাত অভিলক্ষিত, উপযুক্ত তিথি বলিয়া লোকপ্রসিদ্ধ, যে-সকল রাত্রিতে যে-সকল আরামচৈত্য, বনচৈত্য অথবা বৃক্ষচৈত্য ভীষণ ভয়জনক ও রোমাঞ্চকর, যদি আমি সে-সকল স্থানেও বিচরণ (বা অবস্থান) করি, তাহা হইলে অতি অল্প, অতি সামান্যমাত্র ভয়ভৈরব দেখিতে পাইব। ব্রাহ্মণ, এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি অপর একসময়ে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী, কৃষ্ণাষ্টমী, শুক্লপক্ষের পঞ্চদশী এবং শুক্লাষ্টমী প্রভৃতি যে-সকল রাত্রি অভিজ্ঞাত অভিলক্ষিত, উপযুক্ত তিথি বলিয়া লোকপ্রসিদ্ধ, সে-সকল রাত্রিতে যে-সকল স্থান ভয়জনক ও রোমাঞ্চকর সে-সকল স্থানে বিচরণ (বা অবস্থান) করি। ব্রাহ্মণ, সে-সকল স্থানে বিচরণ (বা অবস্থান) করিতে গিয়া দেখি হয়ত-বা কোনো মৃগ (রাত্রিচর পশু, শ্বাপদ) আসিতেছে, হয়ত-বা ময়ূরাদি কোনো পাখি কাঠ ফেলিতেছে, হয়ত-বা মরুত পত্ররাশি কম্পিত করিতেছে। ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার মনে হইয়াছিল, এই বুঝি ভয়ভৈরব আসিতেছে। ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমার মনে এই চিন্তা উদিত হইয়াছিল : আমি কি শুধু ভয়-প্রতীক্ষায় থাকিব কিংবা যেকোনো অবস্থায় ভয়ভৈরব আমার নিকট আসিতে থাকে ঠিক সেই অবস্থায় থাকিয়াই আমি তাহা নিরস্ত করিব! ব্রাহ্মণ, যখন চঙ্ক্রমণ অবস্থায় আমার নিকট ভয়ভৈরব আসিল, তখন আমি সংকল্প করিলাম, যে-পর্যন্ত চঙ্ক্রমণ অবস্থাতেই সেই ভয়ভৈরব নিরস্ত করিতে না পারিতেছি সে-পর্যন্ত আমি দাঁড়াইব না, উপবেশন করিব না, শয়নও করিব না। ব্রাহ্মণ, যখন দণ্ডায়মান অবস্থায় আমার নিকট ভয়ভৈরব আসিল তখন আমি সংকল্প করিলাম, যে-পর্যন্ত দণ্ডায়মান অবস্থাতেই সেই ভয়ভৈরব নিরস্ত করিতে না পারিতেছি সে-পর্যন্ত আমি পাদচারণ করিব না, উপবেশন করিব না, শয়নও করিব না। ব্রাহ্মণ, যখন উপবেশনকালে আমার নিকট ভয়ভৈরব আসিল তখন আমি সংকল্প করিলাম, যে-পর্যন্ত উপবিষ্ট অবস্থাতেই সেই ভয়ভৈরব নিরস্ত করিতে না পারিতেছি সে-পর্যন্ত আমি শয়ন করিব না, দাঁড়াইব না, পাদচারণও করিব না। ব্রাহ্মণ, যখন শয়নকালে ভয়ভৈরব আমার নিকট আসিল তখন আমি সংকল্প করিলাম, যে-পর্যন্ত শায়িত অবস্থাতেই সেই ভয়ভৈরব নিরস্ত করিতে না পারিতেছি সে-পর্যন্ত আমি উপবেশন করিব না, দাঁড়াইব না, পাদচারণও করিব না।

১৯. ব্রাহ্মণ, এমন এক শ্রেণির শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা রাত্রিকে দিবা এবং দিবাকে রাত্রি বলিয়াই জানেন। আমি বলি, তাহা তাঁহাদের সম্মোহ-বিহারের বা স্মৃতিবিভ্রমের পরিচায়ক। ব্রাহ্মণ, আমি কিন্তু রাত্রিকে রাত্রি, দিবাকে দিবা বলিয়াই জানি। ব্রাহ্মণ, যদি কেহ এ কথা বলেন-বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, বিশ্বে অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেব-নর সকলের অর্থ, হিত ও সুখের জন্য জগতে এক মোহাতীত পুরুষ উৎপন্ন (আবির্ভূত) হইয়াছেন, তাহা হইলে তিনি যাহা বলিবার তাহা যথার্থই বলিবেন। যদি কেহ আমাকে লক্ষ করিয়াই সে কথা বলেন, তাহাতে তিনি যাহা বলিবার তাহাই যথার্থ বলিবেন-বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, বিশ্বে অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেব-নর সকলের অর্থ, হিত ও সুখের জন্য জগতে এক মোহাতীত পুরুষ উৎপন্ন (আবির্ভূত) হইয়াছেন।

২০. ব্রাহ্মণ, আমার বীর্য (কর্মতৎপরতা) আরব্ধ হইয়াছে, তাহা শিথিল হইবার নহে; স্মৃতি উপস্থাপিত হইয়াছে, তাহা সংমূঢ় হইবার নহে; দেহ-মন প্রশান্ত হইয়াছে, তাহা নিপীড়িত হইবার নহে; সমাহিত চিত্ত একাগ্র হইয়াছে, (তাহা বিক্ষিপ্ত হইবার নহে)। ব্রাহ্মণ, সেই অবস্থায় আমি কামসম্পর্ক হইতে বিবিক্ত হইয়া, সর্ব অকুশল পরিহার করিয়া, সবিতর্ক, সবিচার এবং বিবেকজ প্রীতিসুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া তাহাতে বিচরণ করি। বিতর্ক-বিচার-উপশমে অধ্যাত্ম-সম্প্রসাদী, চিত্তের একীভাব-আনয়নকারী, বিতর্কাতীত, বিচারাতীত সমাধিজ প্রীতিসুখমণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া তাহাতে বিচরণ করি। প্রীতিতেও বিরাগী হইয়া উপেক্ষার ভাবে অবস্থান করি, স্মৃতিমান ও সম্প্রজ্ঞাত হইয়া স্বচিত্তে (প্রীতিনিরপেক্ষ) সুখ অনুভব করি, আর্যগণ যে-ধ্যানস্তরে আরোহণ করিলে ‘ধ্যায়ী উপেক্ষাসম্পন্ন ও স্মৃতিমান হইয়া (প্রীতিনিরপেক্ষ) সুখে বিচরণ করেন’ বলিয়া বর্ণনা করেন, সেই তৃতীয় ধ্যানস্তরে উন্নীত হইয়া তাহাতে বিচরণ করি। সর্বদৈহিক সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করিয়া, পূর্বেই সৌমনস্য-দৌর্মনস্য (মনের হর্ষ-বিষাদ) অস্তমিত করিয়া, না-দুঃখ-না-সুখ, উপেক্ষা ও স্মৃতি দ্বারা পরিশুদ্ধ চিত্তে চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া তাহাতে বিচরণ করি।

২১. এইরূপে সমাহিত চিত্তের সেই পরিশুদ্ধ, পর্যবদাত (পরিষ্কৃত), অনঞ্জন (নিরঞ্জন), উপক্লেশ-বিগত, মৃদুভূত, কমনীয়, স্থিত (স্থির) ও আনেঞ্জ-প্রাপ্ত (অনেজ, নিষ্কম্প) অবস্থায় জাতিস্মর-জ্ঞানাভিমুখে চিত্ত নমিত করি। সেই অবস্থায় আমি নানাপ্রকারে বহু পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করি : এক জন্ম, দুই জন্ম, তিন জন্ম, চারি জন্ম, পাঁচ জন্ম, দশ জন্ম, বিশ জন্ম, ত্রিশ জন্ম, চল্লিশ জন্ম, পঞ্চাশ জন্ম, শত জন্ম, সহস্র জন্ম, এমনকি শতসহস্র জন্ম; বহু সংবর্ত-কল্পে, বহু বিবর্ত-কল্পে, এমনকি বহু সংবর্ত-বিবর্ত-কল্পে ওই স্থানে আমি ছিলাম, এই ছিল আমার নাম, এই আমার গোত্র, এই আমার জাতিবর্ণ, এই আমার আহার, এইরূপ আমার সুখ-দুঃখ অনুভব, এই আমার পরমায়ু, তথা হইতে চ্যুত হইয়া তত্র (ওই যোনিতে) আমি উৎপন্ন হই; তথায় ছিল আমার এই নাম, এই গোত্র, এই জাতিবর্ণ, তথা হইতে চ্যুত হইয়া আমি অত্র (এই যোনিতে) উৎপন্ন হইয়াছি। এইভাবে আকার ও উদ্দেশ, স্বরূপ ও গতিসহ নানাপ্রকারে বহু পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করি। ব্রাহ্মণ, অপ্রমত্ত, আতাপী (বীর্যবান) ও সাধনা-তৎপর হইলে যেমন যেমন হয়, রাত্রির প্রথম যামে তেমনভাবেই আমার এই প্রথম বিদ্যা (জাতিস্মর-জ্ঞান) অধিগত (আয়ত্ত) হয়, অবিদ্যা বিহত (বিনষ্ট), বিদ্যা উৎপন্ন, তম (অন্ধকার) বিহত, আলোক উৎপন্ন হয়।

২২. এইরূপে সমাহিত চিত্তের সেই পরিশুদ্ধ, পর্যবদাত, অনঞ্জন, উপক্লেশ-বিগত, মৃদুভূত, কমনীয়, স্থিত ও অনেজ অবস্থায় সত্ত্বগণের (অপরাপর জীবের) চ্যুতি-উৎপত্তি (গতিপরম্পরা) জ্ঞানাভিমুখে চিত্ত নমিত করি। সেই অবস্থায় দিব্যচক্ষে, বিশুদ্ধ, লোকাতীত অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিতে দেখিতে পাই : জীবগণ এক যোনি হইতে চ্যুত হইয়া অপর যোনিতে উৎপন্ন হইতেছে, প্রকৃষ্টরূপে জানিতে পারি-হীনোৎকৃষ্ট-জাতীয় উত্তম-অধম বর্ণের জীবগণ স্ব স্ব কর্মানুসারে সুগতি-দুর্গতি প্রাপ্ত হইতেছে-এ-সকল মহানুভব জীব কায়দুশ্চরিত্র-সমন্বিত, বাক্‌-দুশ্চরিত্র-সমন্বিত, মনোদুশ্চরিত্র-সমন্বিত, আর্যগণের নিন্দুক, মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন এবং মিথ্যাদৃষ্টি-প্রণোদিত কর্ম-পরিগ্রাহী হইবার ফলে দেহাবসানে মৃত্যুর পর অপায়-দুর্গতিতে, বিনিপাত-নিরয়ে (নরকে) উৎপন্ন হইতেছে; অথবা এ-সকল মহানুভব জীব কায়সুচরিত্র-সমন্বিত, বাক্‌সুচরিত্র-সমন্বিত, মনঃসুচরিত্র-সমন্বিত, আর্যগণের অনিন্দুক, ‘সম্যক দৃষ্টিসম্পন্ন এবং সম্যক দৃষ্টি-প্রণোদিত কর্ম-পরিগ্রাহী হইবার ফলে দেহাবসানে মৃত্যুর পর সুগতি-স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইতেছে। এইভাবে দিব্যনেত্রে, বিশুদ্ধ লোকাতীত দৃষ্টিতে দেখিতে পাই : সত্ত্বগণ (অপরাপর জীবগণ) এক যোনি হইতে চ্যুত হইয়া অন্য যোনিতে উৎপন্ন হইতেছে, প্রকৃষ্টরূপে জানিতে পারি-হীনোৎকৃষ্ট জাতীয়, উত্তম-অধমবর্ণের জীবগণ আপনাপন কর্মানুসারে সুগতি-দুর্গতি প্রাপ্ত হইতেছে। ব্রাহ্মণ, অপ্রমত্ত, আতাপী ও সাধনা-তৎপর হইলে যেমন যেমন হয়, তেমনভাবেই রাত্রির মধ্যম যামে আমার দ্বিতীয় বিদ্যা (জীবের গতিপরম্পরা-জ্ঞান, কর্মফল-জ্ঞান) অধিগত হয়, অবিদ্যা বিহত, বিদ্যা উৎপন্ন, তম বিহত, আলোক উৎপন্ন হয়।

২৩. এইরূপে সমাহিত চিত্তের সেই পরিশুদ্ধ, পর্যবদাত, অনঞ্জন, উপক্লেশ-বিগত, মৃদুভূত, কমনীয়, স্থিত ও অনেজ অবস্থায় আসবক্ষয়-জ্ঞানাভিমুখে আমার চিত্ত নমিত করি। তদবস্থায় উন্নত জ্ঞানে যথার্থ জানিতে পারি-ইহা ‘দুঃখ’ আর্যসত্য, ইহা ‘দুঃখসমুদয়’ (দুঃখের উৎপত্তি) আর্যসত্য, ইহা ‘দুঃখনিরোধ’ আর্যসত্য, ইহা ‘দুঃখনিরোধগামী প্রতিপদ’ আর্যসত্য; এ-সকল আসব, ইহা আসব-সমুদয়, ইহা আসব-নিরোধ, ইহা আসব-নিরোধগামী প্রতিপদ। তদবস্থায় এইরূপে আর্যসত্য জানিবার এবং দেখিবার ফলে কামাসব হইতে আমার চিত্ত বিমুক্ত হয়, ভবাসব হইতে আমার চিত্ত বিমুক্ত হয়, অবিদ্যাসব হইতেও আমার চিত্ত বিমুক্ত হয়, বিমুক্ত চিত্তে ‘বিমুক্ত হইয়াছি’ এই জ্ঞান উদিত হয়, উন্নত জ্ঞানে জানিতে পারি-চিরতরে জন্মবীজ ক্ষীণ হইয়াছে, ব্রহ্মচর্যব্রত উদ্‌যাপিত হইয়াছে, যাহা কিছু করিবার ছিল করা হইয়াছে, অতঃপর অত্র আর আসিতে হইবে না। ব্রাহ্মণ,… রাত্রির অন্তিম যামে আমার এই তৃতীয় বিদ্যা (আসবক্ষয়-জ্ঞান) অধিগত হয়, অবিদ্যা বিহত, বিদ্যা উৎপন্ন, তম বিহত, আলোক উৎপন্ন হয়।

২৪. ব্রাহ্মণ, এইরূপও আপনার মনে হইতে পারে, যেহেতু আজ পর্যন্ত শ্রমণ গৌতম বীতরাগ, বীতদ্বেষ এবং বীতমোহ হইতে পারেন নাই সেই কারণে তিনি অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করেন। ব্রাহ্মণ, বিষয়টি এইরূপে দেখিতে নাই। ব্রাহ্মণ, দুই কারণে, দ্বিবিধ উপকারিতা দেখিয়া, আমি অরণ্যে বনপ্রস্থজীবন, বিজনপ্রান্তে শয়নাসন অভ্যাস করি : প্রথম, প্রত্যক্ষভাবে নিজের সুখ-বিহার (স্বচ্ছন্দে অবস্থান); দ্বিতীয়, পরোক্ষভাবে পরবর্তী জনগণের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন।

২৫. মহানুভব গৌতম কর্তৃক সত্যসত্যই পরবর্তী জনগণ অনুগৃহীত হইতেছে, যেন তাহা অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধের দ্বারা হইতেছে। অতি সুন্দর, হে গৌতম, অতি মনোহর, হে গৌতম, যেমন কেহ উল্টানকে সোজা, আবৃতকে অনাবৃত, বিমূঢ়কে পথনির্দেশ, অথবা অন্ধকারে তৈলপ্রদীপ ধারণ করে যাহাতে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি রূপ (দৃশ্যবস্তু) দেখিতে পায়, এইরূপে মহানুভব গৌতম কর্তৃক বহু পর্যায়ে, বিবিধ যুক্তিতে, ধর্ম (জ্ঞেয় বিষয়) প্রকাশিত হইয়াছে। আমি মহানুভব গৌতমের, তৎপ্রবর্তিত ধর্মের এবং তৎপ্রতিষ্ঠিত ভিক্ষুসংঘের শরণাগত হইতেছি, আজ হইতে আমরণ শরণাগত আমাকে মহানুভব গৌতম উপাসকরূপে অবধারণ করুন।

ভয়ভৈরব-সূত্র সমাপ্ত।

The Middle Discourses

|_A. The First Fifty

|__I. The Chapter on the Root of All Things

MN4. ভয়ভৈরব-সূত্র

Translations [32]

English

繁體字

日本語

한국어

Français

Deutsch

Italiano

Español

Português

Русский

Norsk

Magyar

Srpski

Čeština

Polski

Slovenščina

हिंदी

ગુજરાતી

বাংলা

Việt Ngữ

Bahasa Indonesia

සිංහල

ပြန်သွားရန်

ภาษาไทย

पाळिभासा (Pāli)

Reference